জয়ী
(পঞ্চম পর্ব)
আগে
যা ঘটেছে::: হঠাৎ করেই অষ্টমী মারা যাওয়াতে মঙ্গলা মজুমদার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা
চালাচ্ছে। মজুমদারদের ছেলে শুভ উপস্থিত একদিন।
চোখে
চোখ দুজনের, কেমন গভীর দৃষ্টি শুভর, পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল মঙ্গলা। শুভও এসে বসলো মঙ্গলার ঘরে, মেয়েটা কত রুচি সম্মত ভাবে সাজিয়েছে ঘরটা, নাকি সর্বানি সাজিয়েছে?
"বাবা, যা বুঝছি, তোমার বড়ই দুর্দিন; আগেতো একা মমের শাসন
ছিলো" মঙ্গলার বই খাতা নাড়াচাড়া করতে করতে বলে শুভ। কি সুন্দর হাতের লেখা
মেয়েটার, মুগ্ধ হয়ে দেখে সে।
"তবেই বোঝ,
তোর
মায়ের সাথে তো ঝগড়াঝাঁটি চলে, একে তো কিছু ____" বলতে বলতে হাজির মঙ্গলা;
এসেই
চায়ের ট্রে রেখে খপখপ করে নিজের বইখাতা শুভর হাত থেকে সরিয়ে নিলো।
"অ্যাই, দ্যাখ, তোর সামনে পরীক্ষা, তুই পাতি কলকাতাইয়া তস্য
পাতি মাস্টারের কাছে পড়বি? তার চেয়ে দেখ কেমন বিদেশী
মাস্টার এসে গেলো" বলে হো হো করে হাসছে অলকেন্দু।
"আমি পাতি কলকাতাইয়া, তস্য পাতি একটা স্কুলে পড়ি,
সুতরাং
পাতি মাস্টারই আমার জন্য এনাফ; তোমার যদি অসুবিধে থাকে
বোলো, নিজে নিজে যেমন পারি পড়ব" গম্ভীর হয়ে
অন্যদিকে মুখ ফিরে বলল মঙ্গলা। সর্বানি এসে পড়ায় ব্যাহত হোলো ওদের আড্ডা।
একটা
দুটোদিন, শুভ কখনো আরাম করে, গড়াগড়ি খায়, কখনো কি কাজে ব্যস্ত থাকে
সারাদিন ঘরেই থাকেনা। মঙ্গলা তার নিজের মতই থাকে,
বিশেষ
কোনো হেলদোল নেই শুভ আসায়। মি. আর মিসেস মজুমদার বাজার করে, স্পেশ্যাল সব রান্না করে,
করায়; সাথে সর্বানির তো আছেই ফোনে সংবাদ প্রচার, প্রায় সারাদিনই দফায় দফায় চলে। মঙ্গলা একটা নোটস আনতে ওর
বন্ধু সুচেতার বাড়ি যাবে, সকালে সবার সামনেই অনুমতি
নিলো। কোথায় যাবে কখন যাবে শুভ সহ সবাই ই জানলো। মঙ্গলা তৈরী হচ্ছে, সেই সময়েই শুভর নাকি হঠাৎ কি একটা জরুরি কাজ মনে পড়ে গেছে, ধুরুম ধারুম রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো; কেউ বোঝেনি আসল উদ্দেশ্য। নীচে নেমে মঙ্গলা দেখে গাড়ি
নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ, মঙ্গলাকে লিফ্ট দিতে চায়।
তারও নাকি কাজ আছে, তাই ভাবলো। যথেষ্ট বিরক্ত হলেও আসেপাশে
পরিচিত মুখ আছে দেখে কোনো সিন ক্রিয়েট না করে গাড়িতে উঠলো মঙ্গলা।
"দেখুন, আমার না এই সব বড়লোকি চাল
পোশায় না"
"গাড়িতে কাউকে লিফ্ট দেওয়াটা বড়লোকি চাল?" শুভর আওয়াজে কৌতুকের ছোঁয়া
"আপনার কাছে হয়ত নয়, কিন্তু আমার মতো ছেলেমেয়েদের জন্য তাই ই" অন্যদিকে
তাকিয়ে বলে মঙ্গলা; ওদের বিল্ডিংগুলোর থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন
বাইপাস আসতে বেশ একটা লম্বা টানা রাস্তা, যদিও বাইপাসের ওপর
দাঁড়ালে মনেহয় ঢিল ছোঁড়া দূরত্ব; রাস্তাটা এমনিতে জনবহুল
কিন্তু দুপুরের এই সময়টায় তেমন লোকজন রিক্সা থাকেনা, আজও নেই। শুভ হঠাৎ গাড়িটা সাইড করে দাঁড় করায়, মঙ্গলা অবাক হয়ে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে তাকায় শুভর দিকে, কেন দাঁড়ালো বুঝতে চায়। আস্তে করে মঙ্গলার কাছে এসে, ওর গায়ে ছোঁয়া না লাগে খুব সচেতন ভাবে পাশ থেকে সিট
বেল্টটা নিয়ে লাগিয়ে দিয়ে আবার চলতে লাগলো শুভ। ঘটনাটা হয়ত সামান্যই, কিন্তু তার অত কাছে যাওয়ায় অথচ এত সচেতন ভাবে কোথাও
ছোঁয়া না লাগায় আর সে যে বেল্ট লাগায়নি সেইটা লক্ষ্য করে এমন কেয়ার দেখানো সব
মিলিয়ে মঙ্গলা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। শুভ শুনেছিল বটে কিন্তু বোঝেনি মঙ্গলা ঠিক
কোথায় যাবে, বাইপাসে উঠে জিজ্ঞেস করলো
"এবার কোনদিকে?"
হাতের
ইশারায় বাঁ দিকে দেখালো মঙ্গলা। কাছেই যাবে বেশি দূর নয়; ইশারাতেই দেখাতে লাগলো কোনদিকে, একটা গলির মুখে দাঁড়াতে বলল। নামার আগে সিটবেল্টটা খুলতে
গিয়ে আবার যেন সিটবেল্ট লাগানোর দৃশ্যটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
"থ্যাঙ্কস"
"ফর হোয়াট?"
"ফর দ্য লিফ্ট" বলে নেমে যাচ্ছিলো
"ইউ আর ওয়েল কাম, তোমার কি অনেক দেরী হবে ফিরতে?"
"না, তেমন নয়, ঘন্টা তিনেক লাগবে হয়ত;
কেন?"
"এমনি, চল বাই"
"বাই" বলে নেমে ঘুরব না ঘুরব না করেও
কয়েকপা গিয়ে ঠিক পিছন ঘুরে দেখেই ফেলল, হ্যাঁ,তখনও
দাঁড়িয়ে গাড়ি; সুচেতাদের বাড়ির গেট খোলা অবধি দেখতে পেল
গাড়িটাকে। প্রায় সন্ধ্যে নাগাদ ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে বেরোলো মঙ্গলা, গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় আসতেই
"মঙ্গলা" ডাক শুনে চমকে তাকিয়ে হাঁ, গাড়ি নিয়ে শুভ দাঁড়ানো
"একি আপনি?"
"চটপট ওঠো" গাড়িতে উঠেই আবার মঙ্গলার
মনে পড়ল সিটবেল্ট লাগানোর দৃশ্যটা; ওঃ! সুচেতাদের বাড়িতেও
বারে বারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল ওই একটা দৃশ্য মনে পড়ায়। হাত স্লো হয়ে যাচ্ছিল
লিখতে লিখতে।
"আপনি ___"
"শোন না খুব ক্ষিধে পাচ্ছে, কোনো একটা ভালো ইটারি বলতে পারো?"
"ইটারি? আমি? নাঃ জানিনা" বলেই কেমন দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো মঙ্গলার
মাথায়
"ওহ, না জানিতো"
"কোথায় আই মিন কোনদিকে?"
"বাইপাসে উঠে ডানদিকে, মিসেস মজুমদারের ঘরে" বলে খিল খিল করে হাসছে, শুভ আসার পর এই প্রথম বোধহয় হাসতে দেখল ওকে; মুগ্ধ চোখে তাকায়
"তুমি এত্ত সুন্দর হাসতে পারো?" ঝপ করে হাসি বন্ধ হয়ে যায় মঙ্গলার।
"ঠিক আছে চলো ঘরেই যাই, ভাবছিলাম তোমারও হয়ত একটু ক্ষিধে ক্ষিধে পেতে পারে, একসাথে বসে কিছু খেতাম। আচ্ছা তুমি কি বুঝতে পারছনা আমি ___" শুভকে শেষ না করতে দিয়ে মঙ্গলাই বলে
"আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চান এই তো?"
"সব বুঝেও?"
"হ্যাঁ, বুঝেও; কারণ আপনারা আমরা আলাদা ক্লাস। এটা আপনি না বুঝলেও আমি বুঝি
আর খুব বেশি রকম বুঝি। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, আমি যদি খুব কুৎসিত দেখতে একটা মেয়ে হতাম, তাহলেও কি আপনি ঠিক এই একই ভাবে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে
চাইতেন?" বন্ধুত্ব শব্দটা বলার সময়ে হাত নেড়ে কোটেশন
মার্কের মতো করে বলে। আহত মুখে তাকালো শুভ, কিছু সময় চুপ করে থেকে
বলল
"মে বি ইউ আর রাইট, হয়ত এতটা ইন্টারেস্ট থাকত না"
"কিন্তু তাতেও কি আমার লড়াইটা কিছু অন্য হয়ে
যেতো? আমার মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে আজ আমায়
এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন, উনি নেই তবু আমি ওনার
অবদান বা নিজের পরিচয় দিতে এতোটুকুনও দ্বিধা বোধ করিনা। তখন তাই ই হত, নয় কি?"
"হ্যাঁ, তবে কি মঙ্গলা, তখনও কিন্তু আমি তোমার পার্সোনালিটিকে বা তোমার এই
মেন্টালিটিকে সম্মান দিতাম; চাইতাম তুমি যেটা অ্যাচিভ
করতে চাও সেটাতে আমি এতোটুকু হলেও যদি হেল্প করতে পারি। আর এটাতো মানবে মানুষ
সুন্দরের পূজারী, ওপরওয়ালা তাহলে সুন্দর সৃষ্টিই করতেন না।
তাই ____ "
"হয়ত তাই,
তবে
আমার রিকয়েস্ট আপনি অন্য কোনো সুন্দরের দিকে তাকান প্লিজ; আই ডোন্ট বিলংটু ইয়োর ক্লাস"
"মঙ্গলা!!!" স্বাভাবিক ভাবেই, ঘরে পৌঁছল দুজনে এক সাথে;
সর্বানির
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, চোখ চকচকিয়ে উঠলো অলকেন্দুর
"ফেরার সময়ে দেখা হওয়াতে লিফ্ট দিলাম"
সাফাই দেবার চেষ্টা করে শুভ
"বেশ করেছিস,
আরে
আমি তো চিন্তাই করছিলাম যে মেয়েটা ফিরছে না, সন্ধ্যে হয়ে গেলো, পরশু বাদে তরশু বলে পরীক্ষা। টেনশন হয়না?" চুপচাপ ঘরে গেলো দুজনেই।
💛💙💜💚❤️
"বাবা, আমি না কিছুতেই বুঝতে
পারছিনা; মঙ্গলার পরীক্ষা চলছে তাই ডিস্টার্বও করবো
না। বাট আই থিঙ্ক শি লাভ্স মি অ্যাস আই ডু, কোনো কারণে ও কিছুতেই
স্বীকার করতে চায়না"
"দেখ, স্বীকার না করার কারনটা
কিন্তু জাষ্টিফায়েড; তুই বুঝতে পারছিস না, তোর মম ছেলের বউ হিসাবে হয়ত কোনো দিনও ওকে মানতে পারবে না।
অন্ততঃ এই স্টেজে পারবে না, আনলেস মঙ্গলী দারুণ একটা
কিছু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র হয়। আর আমাকে তো জানিস,
যতই
মাঝে মধ্যে হম্বিতম্বি করি আল্টিমেটলি আমি তোর মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারি না।
মেয়েটাকে ভালোবাসি কাইন্ড অফ লুকিয়ে, আর তোর মায়ের তো ওর প্রতি
ভালবাসা পুরোটাই শো। মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতি রে"
"বুঝলাম; কিন্তু বাবা, সব কিছুর পরেও আমি কি করি
বলোতো? ও সামনে এলে আমার যে সব... গোলমাল হয়ে
যাচ্ছে। আচ্ছা ওর রেজাল্ট ভালো হলে কি ওকে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাবার অফার
দেবো? না, মানে বলো না একটু কিছু, কি করা যায়। এভাবে তো পাগল হয়ে যাবো"
"দাঁড়া ভাবতে হবে, এদিকে তোর ফেরার সময়ও হয়ে আসছে, ওদিকে তোর মায়ের তো তুই আসা উপলক্ষ্যে পার্টি থ্রো করাই
হয়নি, মঙ্গলীর পরীক্ষা বলে; একটা দেখার ব্যাপার আছে না?
আবার
কাজের লোকের অভাবও হয়ে যাবে; পরীক্ষার মধ্যে তো ওকে
স্পেয়ার করতেই হয়। এই উইকেন্ডে সেই পার্টি; তারপর দেখি মেয়েটাতো
জয়েন্ট দেবে বলে রেডি হয়েছিল, আমি পড়ালাম তো আমি জানি ও
ঠিক পারবে। দেখি ভেবে চিন্তে যদি কিছু বের করতে পারি"
শুভ
হতাশ হয়ে ঝপ করে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল; শুয়ে সিগারেট ধরাতে গিয়ে
মঙ্গলার কথা মনে পড়ায় সব গুটিয়ে রাখলো। নিজের মনেই হাসে এখনি সে মঙ্গলার ওই
জ্বলন্ত তাকানোকে ভয় পেতে শুরু করেছে; মনে মনে বলল "তু তো
গয়া বাচ্চু"।
(চলবে)
[মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী]