মাদার
মেরী
ফোটোগ্রাফি,নাকি
ইঞ্জিনিয়ারিং নাকি ইংলিশ অনর্স এই নিয়ে যখন আমি চক্রব্যুহে ফেঁসে আছি, ঘরে বসে, আমজাদীয়ায় বসে মাথার চুল
ছিঁড়ছি,ঠিক সেই সময় এক দামাল ঝড় এসে আমাকে একটা
গাছের ডালে লটকে দিল। সরদার্জী একটা ফ্রড। টাকা পয়সা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। মাঝখানে
আমাকেও একটা ফ্রড বানিয়ে রাস্তায় ফেলে গেছে। ক’দিন থেকেই আমার কাছে জমা
টাকাটা সরদার্জীকে দেয়া হয় নি। ভর্তি নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। একদিন অফিসেও
গিয়েছিলাম,পাই নি। একদিন হাওড়ার অশোকা হোটেলেও। সেখানে
ক্যাফেটারিয়ার ম্যানেজার বলল,সরদার্জী তো বোর্ডার নয়,এখানে
খেতে আসত। বেশির ভাগ ব্রেকফাস্ট। এখন কিছুদিন ধরে আসছে না।মনে পড়ল,আমি
এলে ওই সময়েই আসতাম। ব্রেকফাস্টের সময়। একবারও মনে হয়নি সে বোর্ডার নয়। বেয়ারাদের
সবাইকে তো চিনত! সন্দেহের একটা তুলো আমার চারপাশে ঘুরতে লাগল। সোজা জুনের অফিসে
চলে যাই, সব শুনে মাটিতে বসে পড়ি যেন। 'ইউ
আর স্টিল ওয়ার্কিং উইথ হিম? হি ইজ আ ফ্রড,শান্তিপুর।
আই অ্যাম সরি। আই ব্রট ইউ টু হিম। আই অ্যাম রিয়েলি সরি, ডিয়ার।'ম্যাগাজিন অফিস থেকে লোক
এসেছিল খোঁজ করতে। ঐ অফিসটার শুধু ঠিকানাই ব্যবহার করত সর্দার,ওর
নিজের টেবিলও ছিল না....আর শুনে কী করব?মনে পড়ছিল সরদার্জীর
বেপরোয়া চলাফেরা। ট্যাক্সি চড়ত। ব্রড্ওয়ের ব্যালেন্টাইন বারে একসঙ্গে বীয়ার-ও
খেয়েছি, সঙ্গে লোভনীয় সন্যাক্স। ওর চলাফেরায় আমি
স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলাম। আমার গাড়ি, বারে বন্ধুদের নিয়ে
হুল্লোড়... একজিকিউটিভ উত্তমকুমারের জীবন।
ফরিদ
আমার মনটাকে বুঝে ফেলতে পারে আমার দিকে তাকালেই,‘চায়েঁ লায়েঁ,হারুণজী? 'চা? কার পয়সায়? পকেটে পড়ে আছে বউবাজার টু চাঁদনির কোন না কোন সাধারণ শ্রমিক
কর্মচারির পয়সা। বিশেষ করে মনে পড়ছিল,চাঁদনির প্লামবিং শপের সেই
ঘর্মক্লান্ত কর্মচারিটির মুখটা। আজো, এই পঞ্চাশ বছরের দুরত্বেও
মনে পড়ে মুখটা আর এক অসহায়ত্বের রক্ত ছনছনিয়ে ওঠে সারা শরীরে। ছয়মাসের জন্য সে বুক
করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সোভিয়েত নারী। তার টাকা আমার পকেটে। কার টাকায় খেয়েছি
বিরিয়ানি,চাঁপ,ফিরনি?ফরিদ
সম্ভবত আমার ফ্যালফ্যাল করে চাওয়া মুখের দিকে চেয়ে জেনে গিয়েছিল, আমার কাছে টাকা নেই। চা আর আনে নি সে।
আমি
ক্রমশ ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছি। আমি প্রতিদিন ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছি। অথচ আমি জানি,আমাকেই
এ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমাকেই নির্দেশ দিতে হবে আমাকে,কী
করতে হবে। আমাকেই বলতে হবে আমাকে,এটা করো,এটা
কোর না। এ যে কী বিষম বিভ্রান্তি!
এক
সকালে আঙ্কল প্যাটার্সন এলেন। এই সময়টা আমজাদীয়ায় আসেন ব্রেকফাস্ট করতে,কাজে
যাবার আগে। বেঁটে খাটো মানুষ। সাড়ে চার ফুট? গোলগাল। পাট ভাঙা চেক
শার্ট, গুঁজে পরেন। সারা শরীরটাই ফুটবলের মত। হাত
দুটো ছোট ছোট,পা-ও। হাতের আঙুল মোটা মোটা। কিন্তু বামনবীর
না। ল্যুকদের নিচে আমারটার মতই এক ঘরের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকেন। সাত কুলে কেউ
আছেন কিনা আমরা কেউ জানি না। খিদিরপুর ডকে কাজ করেন,আয়রন
ওর জাতীয় নানা মিন্যারালসের লোডিং আনলোডিং তদারকীর কাজ। সোজা আমার টেবিলে এসে
বসলেন। 'অফিস যাচ্ছ,আঙ্কল? 'না আজ দেরী করে যাবেন। লাঞ্চের পরে। নাও যেতে পারেন,একটা
জাহাজ চরায় আটকে গেছে,তাই ঠিক নেই।
'বাট হোয়াই ইউ লুক স্যাড,ডিয়ার?'খুব স্নেহশীল মানুষ। আমাকে অযথাই ভালোবাসেন। জানেন, আমিও তার মতই একা মানুষ। চাকরি খুঁজছি। পড়াশুনাও করতে চাই। 'কাম
অন,ইউ আর অলওয়েজ আ চেয়ার্ফুল চ্যাপ!'যেন
আমি আমার ভেতরের সব কিছু ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে উজার করে দিয়ে বসেছি। তবে কি আমার
মুখে অসহয়তা ফুটে উঠেছে?হয়ত। আমি বললাম সব কথা,আমি
কী ভাবে আমার জীবনের এক মহা সনদ্ধিক্ষণে এসে ভ্যাবাচাকা খেয়ে বসে আছি। আমার আগের
সব হিসাব কী ভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এখন কোনোটাই এক নম্বর না, কোনটাই তিন নম্বর না। ফোটগ্রাফির প্রতি আমার আগ্রহ ইতিমধ্যে
না-এর পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে পাড়ে আছাড় খেতে শুরু করেছে,কিন্তু
অত টাকা পাব কোথায়? দাদা বলছেন,ইঞ্জিনিয়ারিং,দাদা
মিছিমিছি আমার ওপরে ভরসা করছেন তাও না। কিন্তু আমি তো সাংবাদিক হতে চাই।
পাকিস্তানে বসে কি আর ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম না?
আর
ইংলিশ অনর্স। অনর্স পড়লেই যে ইংরেজি লেখায় হাত পেকে যাবে গ্যারান্টি কোথায়?
আঙ্কল
মন দিয়ে চোখ পিট পিট করে সব শুনলেন। আমি উত্তরের অপেক্ষায়,হঠাৎ
বললেন, 'লেটস গো টু মাদার মেরী। শী উইল শো আস দ্য
ওয়ে।' মাদার মেরী?
আমি
অবাক। বললেন, 'ইয়েস মাদার মেরী। দ্য সেম সিচুয়েশন কেম টু
মাই লাইফ টূ, শান্তিপুর! মাই পসিশন ওয়াস মাচ ওয়ার্সট দ্যান
ইয়র্স,আই ওয়েন্ট টু মাদার। শী টোলড মী হোয়াট টু ডু, হুইচ ওয়ে টু ডু। আই ফলোড হার। লুক, হোয়াট আই আম টূডে।'সত্যি,আঙ্কলসদাহাস্য
সুখী মানুষ। আমরা বলাবলি করি। সকালে বিকালে চান করেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন প্যান্ট
শার্ট। নিভাঁজ আঁচড়ানো চুল। মদ্যপান হয়ত করেন। আমরা কেউ টের পাই না। পাড়ার সবাই
আঙ্কলের প্রশংসা করেন। নিন্দে শুনিনি একটাও, কারো কাছেই।
'তুমি অপেক্ষা করো, আমি জামা কাপড় পাল্টে আসি।
রাতের বেশেই আমজাদীয়ায় এসে বসেছি তো? 'খপ করে হাতটা ধরে টেনে
বসিয়ে দেন আমাকে,'হোয়াট? ইউ আর গোয়িং টু গড'স
প্লেস,শান্তিপুর। গড উইল সী ইউ,নট
ইয়োর ড্রেস,ডিয়ার! নো ওয়ান ইজ ডার্টি টু মাদার মেরী।
এভরিওয়ান ইজ হার চাইল্ড...’বলতে বলতে চলতে শুরু করেন।
আমি তাঁকে দম দেওয়া পুতুলের মতো অনুসরণ করতে থাকি। কাছেই বৈঠকখানা চার্চ। শুনেছি,জব
চার্ণকের চার্চ। কোনদিন ভেতরে যাই নি। আমি কোনদিনই কোন মন্দির মশজিদ বা চার্চের
ভেতরে যাইনি। আজ গেলাম। শুধু গেলামই না, আঙ্কল প্যাটার্সনের
নির্দেশ মেনে একটি মোমবাতি নিয়ে চার্চের ভেতরে একেবারে মেরীর পায়ের কাছে। আঙ্কল
যেমনটা করেন। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে মাদারের পায়ের কাছে রেখে, ফিরে এসে দুমুঠো একত্র করে,হাঁটু গেড়ে,টেবিলে
কনুই চেপে বসে যাই। আঙ্কল আমার পিছমের সারিতে। শুধু ফিসফিসিয়ে বললেন, 'প্রে'.
প্রে? আমি তো প্রার্থনা করতে আসিনি! আমি কেন এসেছি? আমিই জানি না। চোখ বুজি। কিন্তু কোথা থেকে ঢল দিয়ে আমার দু'চোখ
ভিজে গেল। মাদার মেরীর দিকে তাকাতেই দু'চোখ বেয়ে. আমার গাল বেয়ে অশ্রুর ঢল নামল। হাতের পিঠ
দিয়ে তা মুছতে যাব,হঠাৎ মনে হলো,
'আরে,হচ্ছেটা
কী?! হচ্ছেটা কী অরুণ চক্রবর্তী? নিজের ওপর নিজের সব আস্থা খতম? নিজের সব শক্তি লোপাট এই একটি বিভ্রান্তিতে? সেই ভগবান ভরসাই জীবন? উঠে দাঁড়াই। ঘুরে সোজা চলে
যাই চার্চের বাইরে। আঙ্কলের জন্য অপেক্ষা করি না। আঙ্কল খানিক পরে বাইরে এলেন, 'হোয়াট হ্যাপ্পেন্ড,শান্তিপুর? শী ইজ নট গড অফ মাইন,আ ক্রিশ্চিয়ান। শী ইজ ফর
অল। অল হিন্দুস, মুসলিমস...'আমি হাঁটতে হাঁটতে বলতে
থাকি,'দ্যাটস নট দ্য পয়েন্ট,আঙ্কল।
আই ওয়ান্ট টু বি আ মী। আই অ্যাম অরুণ,অরুণ চক্রবর্তী। আই উইল
হ্যাভ টু উইন অল অডস, এন্ড অল বাই মাইসেল্ফ,আঙ্কল....'
কয়েকদিন
পরেই ফোটগ্রাফির ভর্তির ইন্টারভ্যু। টেবিলের ওপারে কলেজের প্রিনসিপ্যাল মনে হল। দু'পাশে
দু'জন। 'তুমি তো টেস্টে ফার্সট
হয়েছ। তোমাকে ভর্তি করলে কন্টিন্যু করবে তো, নাকি ছেড়ে অন্য লাইন পেলে
চলে যাবে?'আমি আর চালাকি করব না। মনে মনে ঠিক করি। বলি, 'যদি, ইংরেজি অনর্স পেয়ে যাই, স্যার, তাহলে ফোটোগ্রাফি পড়ব না।'প্রিনসিপ্যাল
প্রশংসা করলেন আমার স্বচ্ছ চিন্তার। বললেন,'তোমার ফোটগ্রাফি হবে। তবু
ভর্তির আগে ভেবে দেখো।' ফাইন্যাল সিলেকশন লিস্ট যখন টাঙানো হল। আমার
নাম কোথাও নেই। মন খারাপ হল বটে, তবে হতাশ হইনি আর।
এরপর
এলো বিই কলেজের ভর্তির টেস্ট পরীক্ষা। ইংরেজী অনর্সে ভর্তি মোটামুটি স্থির। সিএনআর
আমার নতুন ফর্মটা ভরিয়ে রেখেছেন,বলেছেন,হয়ে
যাবে। বেলাবেলি কলম টলম ঠিকঠাক করে শিবপুর রওনা হলাম। কিন্তু মন চাইছে না। দাদার
মুখটা মনে পড়ছে। দাদা আমার ছোটবেলা থেকেই বলতেন,আমার নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং
স্কিল জন্মগত। আমি ভবিষ্যতে ভালো ইঞ্জিনিয়ার হব। ইঞ্জিনিয়ারিং বলতে আমার ধারণা
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। পরে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কথা শুনেছিলাম। আগ্রহ হয়েছিল।
কিন্তু... শিয়ালদা থেকে হাওড়া,হাওড়া থেকে বাসবদল করে
শিবপুর। আমি ডান দিকের জানালায়। হাওড়ার ভীড় ঠেলে ঠেলে যাচ্ছিল বাসটা। আমার মনে
ভীড়-- পরীক্ষা দেব কি দেব না। হঠাৎ দেখি 'অজন্তা' সিনেমা হল। বিশাল হোর্ডিং। 'নির্জন সৈকতে'.অনিল-শর্মিলা। নেমে পড়ি। আমি তো টেস্ট দিয়েও সিলেক্ট না হতে
পারি! পরীক্ষা না-দিয়ে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরেছি,এই কথাটা দাদা না-জানলেই
তো হল...
অরুণ চক্রবর্তী