দক্ষিণ ক্যারোলাইনার
এক ছোট্ট শহরে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে
এসেছে অনির্বাণ বছর দুয়েক হল। না,এখন আর সে একা
নয়। মাস কয়েক আগে চলে এসেছে তার নব পরিণীতা স্ত্রী সতী। এখন অক্টোবর মাস, এবার বেশ খানিকটা ঠাণ্ডা পড়ে গেছে, গাছের পাতার রঙ কখনও এমন উজ্জ্বল লাল, বা কমলা হতে পারে,জানতো না সতী। ছেলেমানুষের মত পাতা কুড়িয়ে বইয়ের পাতায়
জমা করে। অনির্বাণ,সতীর কাণ্ড দেখে হাসে,বাধা দেয় না,বলে ”কি করবে,নুতন ধরনের শিল্প কলা? ”কি করব,অতশত ভেবে কাজ করে না সতী।
সে প্রায়ই এ রকম নানা জিনিষ সংগ্রহ করে,বই পড়ে,নয়ত দেশে ফোন করে সময় কাটায়। পরের
বছর এখানে একটা মাস্টার্স ডিগ্রি করে নেবে এরকম পরিকল্পনা আছে। আপাতত তার দিন কাটতে চায় না,হাতে অঢেল সময়। শপিং এর নেশা তার কোনদিন ই ছিল না। এখানে এখন ও
মনের মিল হয় এমন কোন সঙ্গী পায় নি। রেসিপি
দেখে নুতন নুতন রান্না করে,অনির্বাণ কে খাওয়ায়।
অনির্বাণ কম কথার মানুষ। নিজস্ব পড়াশোনার বাইরে,অন্য বিষয়ে তার আগ্রহ কম। প্র তিদিনই দুপুরে অধীর আগ্রহে মেল বক্স চেক
করে সতী। বাবা মার এক আধটা চিঠি আসে,বেশির ভাগই বিজ্ঞাপন জাতীয় জাঙ্ক
মেল।
অক্টোবর মাসের
মাঝামাঝি মেল বক্সে একটা সরু কালো বর্ডার
দেওয়া বাহারি খাম দেখে সতী অবাক হল। এই
শহরে ভারতীয় বেশ কয়েকজন আছেন,তাঁরা চিঠি দিয়ে
নিমন্ত্রণ করবেন এমন মনে হয় নি সতীর। কার্ডে স্পষ্ট লেখা,”অনুগ্রহ করে আগামী ৩১ এ অক্টোবর
সন্ধ্যা আটটায় আমাদের বাড়িতে আসবেন। ককটেল
অ্যান্ড ডিনার।“নিমন্ত্রণ করেছেন কোন এক মিসেস জে
স্মিথ। অনির্বাণ কার্ডটি নিয়ে
ট্র্যাস বাসকেটে ফেলতে যাচ্ছিল,কিন্তু সতী বাধ সাধলো। বাড়িটির ঠিকানা শহর থেকে সামান্য দূরে একটা বড় লেকের
কাছে। লেকটিতে অনেকেই বেড়াতে যায়।
সতী বলে, গিয়ে দেখা যাক,ক্ষতি কি হবে? স্থানীয় আমেরিকানদের সঙ্গে মেলামেশার একটা সুযোগ হবে।
পরিচিত ভারতীয়দের বাড়িতে প্রায় সপ্তাহ শেষে খাওয়া দাওয়া গল্প গুজব হয়। বেশির ভাগ
সময় পারটিতে আসেন নি এমন কারও বিষয়ে নিন্দা,হাসি ঠাট্টা চলে। সতীর
সম্বন্ধে কোন রসালো খবর জোগাড় করতে না
পেরে,স্থানীয় ভারতীয় মহিলারা অন্য আলোচনায়
মাতেন। বুদ্ধি করে এই কালো বর্ডার দেওয়া
চিঠির কথা চেপে যায় ওরা দুজনেই।
অনির্বাণ তখন ও মন স্থির করতে পারে নি
যাবে কি না। সে একটু মুখ চোরা মানুষ। চেনা
মানুষদের মধ্যেও তাকে প্রায় দেখা যায়, সেলফ থেকে কোন জটিল বিষয়ের বই নিয়ে পড়তে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে ডিনার এর দিন এসে
পড়ল। অনির্বাণ তখনও অনিচ্ছুক। ফোন করে
দেখেছে,ওই ফোন নম্বরে কেউ সাড়া দেয় নি।
কিন্তু ৩১ অক্টোবরের বিকেল থেকেই বাচ্চারা নানা বেশ ভুষা করে থলি
নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ক্যান্ডী চেয়ে, নিজেদের থলিতে ভরছে। অনির্বাণ ব্যাপারটা জানত, তাই আগেই কিনে রেখেছিল নানা ধরনের
চকলেট। ভেবেছিল,এইসব নানা হুজুগে সতী বুঝি ভুলে যাবে রাতের ওই ডিনার পারটির কথা। কিন্ত ভবি ভুলবার নয়। অনির্বাণকে কে নিতান্ত অনিচ্ছা
স্বত্তেও গাড়ি বার করতে হল। আটটার পাঁচ
মিনিট আগেই ওরা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে
যায়। আর কোন গাড়ি নেই দেখে দুজনেরই
খটকা লাগে। তবে অনির্বাণ বোঝায় এদেশে সবাই নির্ধারিত সময়ে পৌঁছবে । ভারতীয় সমাবেশ হলে আলাদা কথা, তখন সময়কে নিজের মত গুছিয়ে নেন অতিথিরা।
গাড়ীটা পার্ক করে
ওরা বাড়ির সদর দরজার দিকে হাঁটতে
শুরু করে। এমনিতেই বাড়িটা রাস্তা থেকে
দেখা যায় না,বড় বড় পাইন গাছে ঢাকা
লম্বা ড্রাইভওয়ে । দরজার সামনে মাকড়সার
জাল,পরিচর্যা বিহীন ঝোপঝাড় দেখে অবাক হয় সতী।
অনির্বাণ বোঝায় এটা সাজানো, ৩১
অক্টোবর অল হ্যালোস ইভ। লোকের মুখে মুখে সেটা দাড়িয়েছে হ্যলোইন। এইদিন বাড়ির সামনে এরকম মেকি মাকড়সার
জাল,খড়ের কাক তাড়ুয়া,সাদা কাপড়ে মোড়া ভুত প্রেত,ইঁদুর সাজানো হয়। একটি চেয়ারে
একজন বসে আছেন। প্রায়ন্ধকার পরটিকোতে তাঁর
বয়স আন্দাজ করা মুশকিল,তবে মুখ টুপিতে ঢাকা। পাইপের আগুন
জ্বলছে,নিভছে । এটাও সাজসজ্জার অঙ্গ,অনির্বাণ জানায় অনেকেই এমন চেয়ারে
বসে থাকেন,বাচ্চারা এলে আদর করে চকলেট দেন। সতী বেশ অবাক হলেও চুপ করে থাকে। এখনও পর্যন্ত
তাদের নিজস্ব এলাকায় সে দু একটি কুমড়ো ও খড়ের পুতুল দেখেছে। এই বাড়ির সমস্ত ড্রাইভ
জুড়ে অজস্র শুকনো পাতা উড়ছে।
সতী ভাঙবে তবু মচকাবে না। সে ডোরবেল খুঁজতে লাগলো, রঙচটা দরজার পাশে। এবারে দরজা
খুলে বেরিয়ে এলেন এক সুসজ্জিতা যুবতী ।
তাঁর পরনে লম্বা
ড্রেস, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক,ঘাড় পর্যন্ত সোনালী চুলটা সামনের
দিকে ঢেউ
খেলানো । এমন পুরনো স্টাইলের সাজসজ্জা
হয়ত বা এই বিশেষ দিনের জন্য। সতী
মনে করতে পারল না কোনো
থিমের কথা লেখা ছিল কি না কার্ডে । তারা তো বিশেষ কোন সাজসজ্জা করে
আসে নি। এবার সতীর একটু আপশোষ হল সে
জন্য। লম্বা গাউন ততক্ষনে তাদের
ভিতরে আসতে বলেছেন। তিনি মিষ্টি
স্বরে,
স্থানীয় টানে বললেন,”এসো এসো,মেক ইয়োরসেলফ অ্যাট হোম। কি ড্রিঙ্ক নেবে বল। ডিয়ার তুমি একটা লাইম
উইথ জিন নাও।” এবার মহা ফাঁপরে পড়লো
সতী। ভারতীয় পার্টিতে ওয়াইন
খেয়ে দেখেছে আগে,তেমন ভাল লাগে নি। তার গা গুলোতে থাকে,মাথা ধরে। অনির্বাণ এসবে অভ্যস্থ। সে স্মারটলি ঘরের অন্য প্রান্তে সাজানো বারের দিকে এগিয়ে
গেল। অগত্যা সতী”ইয়েস প্লিজ”বলে হাসি হাসি মুখে দাড়িয়ে রইল। বাইরে লোকটি তেমনই বসে আছেন । মনে হচ্ছে পাশের
কোন ঘরে
যেন পিয়ানো বাজছে। বাকি অতিথিরা
এখনও আসেন নি,দেখে সতীর অসোয়াস্তি শুরু হয়েছে। তাহলে কি তারা ভুল সময়ে এসে পড়ল? দেওয়ালে তাকিয়ে দেখলো বিশাল সব অয়েল পেন্টিং,মনে হল এদের পূর্ব পুরুষের প্রতিকৃতি।
সমস্ত ঘর নানা আসবাবে ঠাসা। এরকম সুন্দর ডিজাইন,দামী কাঠের আসবাব যেন
অ্যান্টিক দোকানের মত সাজানো। জিন
খেয়ে মন্দ লাগলো না,তবে মাথা একটু ঝিমঝিম করতে লাগলো। খোলা দরজা
দিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশাল ডাইনিং টেবিল পরিপাটী করে সাজানো। নানা কায়দার ছুরি কাটা, চামচ রয়েছে।
সতীর ধারনা সে আর
অনির্বাণ পাশাপাশি বসবে। মিসেস স্মিথ বললেন,” মারিয়া তুমি তো জিমের পাশেই বসতে
চাও। সেরকম সিট প্লেসমেন্ট কার্ড
সাজিয়েছি।“ মারিয়া নাম
শুনে, যতটা নয় তার চাইতেও বেশি চমকাল সে
মিসেস স্মিথের গলার স্বরে। কোথায়
সেই আগেকার মার্জিত কথার সুর? এ কণ্ঠ স্বর সাপের মত হিস হিসে।
সে মিন্ মিন করে আপত্তি জানাল।” আপনাদের ভুল হচ্ছে,আমি মারিয়া নই।“এবার মিসেস স্মিথ সতীর হাত ধরে তাকে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। সতী অবাক
হয়ে দেখে,সত্যি নেম কার্ডে লেখা মারিয়া লোপেজ।
তারা ভুল জায়গায় এসে পড়েছে,এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ হল। অথচ
আশ্চর্য কে যেন তাকে চেয়ারে আটকে রেখেছে,উঠতে দিচ্ছে না কিছুতেই।
অনির্বাণকে কাছেপিঠে দেখা যাচ্ছে না। সে কি এখনও প্রথম
হল ঘরে দেখা বার এ রয়ে গেল? সে এপাশে ফিরে দেখল,মিসেস স্মিথ পিয়ানোর কাছে। আবার সেই হিস হিসে
কন্ঠ,”কি হল,মারিয়া আজ পিয়ানো বাজাবে না ? সবাই বসে আছে”। এবার
সতী ঘোর লাগা মানুষের মত সেই দিকে এগিয়ে
গিয়ে,পিয়ানো বাজাতে বসলো। তার হাত আপনা
আপনি চলে গেল সামনে রাখা মিউজিক শীটে। পিয়ানোর বাজনা সতীর একেবারে অপরিচিত নয়। তবে
ফিফথ সিম্ফোনির এমন নিখুঁত,মিষ্টি সুর তো তার হাতে বাজে না! মুখ
তুলে চেয়ে দেখল,মিসেস স্মিথ হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।
বলছেন,”ভেবেছিলে আমি টের পাব না, বোট হাউসে তোমরা আমাকে এড়িয়ে প্রায় চলে যাও। আমি কি এতই
বোকা?
আমার জিম কে
তুমি পিয়ানোর সুরে,তোমার কালো চোখের জাদুতে,জড়িয়েছ। বাইরে
বোট হাউসে ও তোমার জন্য লুকিয়ে অপেক্ষা করছে,আমি জানি না ভেবেছ সিনরিটা মারিয়া?”সতী যেন সম্মোহিত হয়ে আছে। তার বোধ শক্তি কাজ করছে না। সে
যেন সত্যি পিয়ানো টিচার মারিয়া, সতী নয়!
আর কিছুক্ষনের
মধ্যেই মিসেস স্মিথের ঠান্ডা শক্ত হাত সতীকে বাইরে খোলা হাওয়ায় এনে ফেলল । চারিদিকে ঘুটঘুটে
অন্ধকার। সতীর কন্ঠ রুদ্ধ,নিঃশ্বাস দ্রুত,ঘাসে তার
হাল্কা চটি ভিজে যাচ্ছে ।
অন্ধকারে মিসেস স্মিথ কে দেখা যায় না।
শুধু তার সিল্কের গাউন টা যেন ভেসে ভেসে চলেছে। লেকের জলীয় বাতাস সতীর গায়ে ঝাপ্টা মারে। নাকে আঁশটে
গন্ধ লাগে। সতী ভাল করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই
বোট হাউসে এর নিচে এসে মিসেস স্মিথ তাকে
ধাক্কা দিয়ে বোটে তুলে দেন। বোট
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করে।”কে চালায়”? দমকা বাতাসে লেকের জলে উথাল পাথাল ঢেউ। বোটের
সামনের দিকে তাকিয়ে সতী দেখে,”আরে এ তো সেই বারান্দায় ওয়েসটারন
হ্যাট পরা মানুষটি! সতী
যেন অস্পস্ট শুনতে পায়,সেই মানুষ টি বলছে,”মারিয়া মাই লাভ, কাম
উইথ মি”। জলের পাড়ে
ঢেউএর আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসে মিসেস স্মিথের পৈশাচিক অট্টহাসি। সেই
হাড় হিম করা হাসিতে সতীর গলা শুকিয়ে আসে।
আর্তস্বরে মিস্টার স্মিথ বা জিমকে বোট ফেরানোর জন্য অনুনয় করতে গিয়ে দেখে এ
তো রক্তমাংসের জীবিত মানুষ নয়,একটি কঙ্কাল! বোট টা তীর থেকে আরও দূরে এগিয়ে যাচ্ছে,দাউ দাউ করে আগুন ধরেছে।
এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সতী,আর কিছু তার মনে থাকে না।
পুলিশের গাড়ির নীল আলোয়,সতী কিছুক্ষনের জন্য চোখ মেলে।
দিন দুয়েক পরে সুস্থ হয়ে সে জানতে পারে, সে রাতে অনির্বাণ অনেকক্ষন তাকে
খুঁজেছে । কেন যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল,সে বিষয়ে অনির্বাণ স্পষ্ট কিছু বলতে পারে নি।
এলোমেলো ঘুরেছে বাড়ির আশেপাশে, সামনের রাস্তায় ও
লেকের ধারে। গাড়ির হেড লাইট জ্বেলে রাখার ফলে পুলিশের নজরে পড়ে। সেল ফোন
কোথায় হারিয়ে ফেলেছে নেশার ঘোরে! অনেক
রাতে,ঘোর কেটে যেতে সে বুঝতে পারে এখানে
কোন মানুষের বসত বাড়ি থাকতে পারে না । ঝোপ ঝাড় আগাছার মধ্যে আধ ভাঙ্গা একটি
ভুতুড়ে বাড়ির পেছনে আগাছায় ভর্তি বোট হাউস টা সে দেখতেই পায় নি। পুলিস প্রথমে
তাকেই সন্দেহ করে, মুখ্য
সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে। তাদের তৎপরতায়
সতীকে ঊদ্ধার করা হয় ভাঙ্গা পরিত্যক্ত
বোট হাউসে। ১৯৪৫ সালের রানাবাউট
ইনবোরড এর ইঞ্জিনটা জ্বলে গেছে বহু আগেই।
অবশিষ্ট অংশটি মরচে ধরা,শ্যাওলা
ঢাকা। সতীর একটি পা লেকের জলে,ঠান্ডায় অবশ সারা শরীর,পালস খুব কম। হাইপোথারমিয়া, প্রথম স্টেজ ডাক্তার বললেন।
প্রচণ্ড ভয় পাওয়ার ফলে সতীর মানসিক ভারসাম্য ছিল না প্রায় পনেরো দিন। সে গুম হয়ে বসে থাকতো, কেউ এলে বেরুতে চাইত না ।
ভাল হওয়ার পর দুজনে
লোকাল লাইব্রেরির আর্কাইভ থেকে জানতে
পারে,১৯৪৫ এর ৩১ শে অক্টোবর এই লেকে একটি বোটে আগুন ধরে যায় । মৃতের সংখ্যা দুই। জেমস এডয়াড়ড স্মিথ
ও মিস
মারিয়া অ্যানা লপেজ। বোটের গ্যাস
ভাল্ভ আগে থাকতে গোলমাল করে রাখার দায়ে অভিযুক্ত হন মিসেস স্মিথ। স্থানীয় গোরস্থা্নে খোঁজ নিয়ে জানা যায়,মিসেস স্মিথের দেহবসান হয়েছে
কয়েক দিন আগেই। তিনি দীর্ঘকাল
জীবিত ছিলেন, একটি সিনিয়র কেয়ার হোমে । আরও জানা গেল,প্রতি বছর তিনি এরকম কালো বরডার দেওয়া চিঠি পাঠাতেন, ফোন বুক থেকে যে কোন পছন্দ মতো ঠিকানা বেছে নিয়ে।
রিমি পতি