>

কল্যাণ মুখোপাধ্যায়

SongSoptok | 11/15/2016 |



সকাল সকাল খবরটা আসতেই Sub Inspector সজল চৌধুরী চটপট থানায় চলে এলো।  খারাপ খবর।  এক একটা দিন এমন করে শুরু হয়!  থানায় পৌঁছে দেখলো বড়োবাবুও হাজির! বড়োবাবু দিব্যসুন্দর ঘোষ খুব দিলদার হাসিখুশি মানুষ।  কিন্তু সেই মানুষের মুখও ভার। কার আর সকাল সকাল মৃত্যুর খবর শুনতে ভালো লাগে ! তাও আবার এলাকার জনপ্রিয় তরুণ সুদর্শন ডাক্তারের।  

"চলো সজল, যাওয়া যাক!" বলতে বলতে বড়োবাবু গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা গাড়িতে উঠতে উঠতেই পিছনে লাফিয়ে উঠলো ঐশী আর ঐশীর হ্যান্ডলার । সঙ্গে "forencic" লেখা এপ্রন পরে মিতা আর  অতীন ।  থানাগুলো আজকাল সেলফ সাফিসিয়েন্ট হয়ে গেছে। পুলিশ কুকুর আর ফরেন্সিক ইউনিট সব আছে। 


সজল মিতাকে একবার মনে করিয়ে দিলো, "ফিঙ্গার প্রিন্ট নেবার কিটটা নিয়েছো তো? "
" হ্যাঁ, স্যার! " মিতার হয়ে উত্তর দিলো অতীন।
এই ছেলেটাকে ভীষণ সপ্রতিভ লাগে সজলের। কাজেরও আছে।  অসাধারণ রবীন্দ্রসংগীত গায় ভরা গলায়. এখনো গুনগুন করে গাইছে, " মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান......"


দেখতে দেখতে গাড়িটা এসে দাঁড়ালো একতলা বাড়িটার সামনে। 
বাড়ির গেটে নেমপ্লেটে জ্বল জ্বল করছে - ডক্টর অভিরূপ সেন। 
গেট খুলে ঢুকতে গেলো সজল। মিতা প্রায় দৌড়ে এসে ওকে বাধা দিল -  " প্লিজ স্যার, please let me first check if there are any visible marks left in the compound!"
সজল থমকে গিয়ে বললো, " বেশ তো।  করে নাও।"
আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো বেশ সপ্রতিভ। মিতা প্রবাসী বাঙ্গালী - তাই কথায় কথায় ইংরেজি বা হিন্দি ব্যাবহার করে বেশি। অতীন বহু সময়ই স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে ওর কথার অনুবাদ করে দেয় - বা মিতার হয়ে উত্তর দিয়ে দেয়। সজল আর দিব্যসুন্দর চোখ চাওয়াচাওয়ি করেন মাঝে মাঝে - ওরা খেয়াল করে না বা পাত্তা দেয় না।

ইতিমধ্যে বড়োবাবু ও সজল হাতে গ্লাভস পরে ফেলেছেন।
বড়োবাবু একজন কনস্টেবলকে বলে দিলেন, " কেউ যেন ভেতরে না ঢোকে, especially প্রেসের লোক। "
গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে করতে সজল বড়োবাবুকে প্রশ্ন করলো, " কে প্রথম দেখেছিলো স্যার?"
"সরমা, কাজের মাসী। ভোরবেলা এসে দেখে ডাক্তারবাবু বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় মরে পড়ে আছেন। ওই থানায় খবর দেয়।"
ও ভেতরে ঢুকল কি করে? ডাক্তারের বাড়িতে কি আর কেউ থাকে?”
না। ডাক্তার সেন তো অবিবাহিত ছিলেন। সরমার কাছে ডাক্তারের বাড়ীর চাবি থাকত। ডাক্তার অনেক রাত অবধি জেগে কাজ কর্ম করতেন - তাই ভোরে উঠে দরজা খুলতে চাইতেন না। সরমা এসে গোদরেজ লক বাইরে থেকে খুলে কাজ শুরু করে দিত।
ডাক্তারের বেডরুমের দরজা খোলা ছিল? সরমা আসবে জেনেও? Strange!”
থাকত না তো! আজ আধখোলা ছিল। সরমা তাই একটু অবাক হয়ে উঁকি মেরে দেখতে গেছিল ডাক্তার বাড়ীর বাইরে বেড়িয়েছে কিনা। দেখতে গিয়ে ওই ভাবে ডাক্তারকে আধঝোলা অবস্থায় বিছানায় দেখে প্রথমে ডাকাডাকি চেঁচামেচি করে। তারপর দরজা টেনে সোজা থানায় চলে আসে।

 এই সময়ে মিতা পুরো কম্পাউণ্ডটা ঘুরে গেটের কাছে এসে  বলল - " আসুন স্যার, we have checked the entire compound. Nothing noticeable! "

বাড়ির ভেতর ঢুকেই ডানদিকে সুসজ্জিত ড্রইং রুম। বাঁদিকে ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুমে ফ্রিজ আর চারজনের বসার মত ডাইনিং টেবিল। ডাইনিং আর ড্রইং রুমের মাঝখানের দরজাটি খোলা - ওটাই ডাক্তারের বেডরুমে ঢোকার দরজা। দরজাটি এখন পুরোপুরি খোলা। ডাইনিং রুমের অন্যপ্রান্তে রান্নাঘর এবং আরও একটা বেডরুম। তাই বেডরুমের দরজা খোলা থাকলে রান্নাঘরের দিকে যাবার সময় ঘরের ভেতরটা সরমার চোখে পড়তে বাধ্য। 
সজল বেড রুমে ঢুকে দেখলো বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন ডক্টর অভিরূপ সেন।  বছর পঁয়ত্রিশ বয়েস। পরনে ছিল সবুজ টি শার্ট আর ছাই ছাই ট্র্যাক প্যান্ট।  মাথার কাছে বালিশের পাশে একটা ম্যাকবুক - বন্ধ। তার পাশে ফোন।
মিতা আর অতীন কাজে নেমে পড়েছে। গোটা ঘরের এদিক ওদিক তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে - আর সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সাদা চক দিয়ে গোল দাগ দিয়ে ছবি তুলছে. অতীন গুনগুন করে গেয়েই চলেছে - " কেন তোমরা আমায় ডাকো......"

ঐশীকে নিয়েও ঘোরানো হয়েছে সারা বাড়ী। কুকুরের ঘ্রাণশক্তিতেও ধরা পড়েনি ব্যতিক্রমী কিছু।
সজলও দেখছিল তীক্ষ্ণ চোখে - কোথাও কিচ্ছু নেই। ডাক্তারবাবু যেন ঘুমিয়ে আছেন! বডি সোজা করেও কিছু বোঝা গেলো না। গোটা ঘরের কোথাও সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেলো না। ডাক্তারের মাথার দিকের জানালাটার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সজল। বাইরের বাগানে সবুজ হাসনুহানার ঝোপটার মাথায় সকালের আলো সাদা বেড়ালের মতো খেলা করছিলোজানলায় গ্রিল দেওয়া। গ্রিল অক্ষত আছে। ডাক্তার এসি চালাননি। অগ্রহায়ণের শেষে এই শহরতলিতে জানলা খুলে এসি ছাড়াও দিব্যি আরামে ঘুমনো যায়।

 হঠাৎ বড়োবাবুর গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরলো সজলের, "সজল, এই কেসটা তুমি investigate করবে। বডি পোস্ট মর্টেম করতে পাঠাও। দরজায় আর গেটে তালা লাগিয়ে পুলিশ পোস্টিং করে আপাতত থানায় এস।"
বেরোনোর মুখে সজল বললো, "স্যার, মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবু রাত্তিরে ল্যাপটপএ কাজ করছিলেন। ওটা নিয়ে নি? যদি কিছু তথ্য মেলে!"
" হ্যাঁ! অবশ্যই মোবাইল, ল্যাপটপ সব নিয়ে নাও! "
*****************************
পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আসতে দিন দুয়েক লাগলো। কিছু পাওয়া যায়নি। কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। বিষ প্রয়োগের কোনো লক্ষ্মণও নেই। সাধারণ স্বাভাবিক মৃত্যু।  হার্ট ফেল করতেই পারে।
মোবাইল ফোনটি স্মার্টফোন হলেও লক করা ছিল না। দেখা গেল তাতে কল আর মেসেজ ছাড়া আর কিছু করতেন না ডাক্তারবাবু। কণ্ট্যাক্টলিস্ট, কল রেকর্ড, মেসেজ অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও কিছুই পাওয়া গেল না।  বেশীর ভাগই পেশেণ্ট, অন্যান্য ডাক্তার, হসপিটাল ইত্যাদির সাথে যোগাযোগ - বিশেষ কিছুই না।

সজল কিন্তু  এতো সহজে মেনে নিতে পারলো না। রিপোর্টে লেখা আছে পেটে না হজম হওয়া রাতের খাবার পাওয়া গেছে। তার মানে ডিনারের খানিকক্ষণ পরেই মৃত্যু হয়েছে ডক্টর অভিরূপের।  
কেন কে জানে সজলের মনে হচ্ছিলো কিছু একটা ব্যাপার আছে যা ওদের চোখে পড়ছে না।

সজলের সেদিন রাতভর ডিউটি থানায়। অতীন আজ অনেকক্ষণ বসেছিল ওর কাছে। একবার জিজ্ঞেসও করল - সজলদা আমি থেকে যাব নাকি আজ আপনার সাথে?”
সজল নাকচ করে দিল - আরে না!
অতীন তাও ছাড়তে চায় না - না মানে আপনি একটু টেনসড আছেন এই কেসটা নিয়ে তাই বলছিলাম!
সজল হেসে ফেলে - বাজে কথা বোল না তো! মিতা তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ী গেছে তাই আজ তোমার ডেটিংএর ফুরসৎ!
এই প্রথম অতীনকে একটু অপ্রস্তুত হতে দেখল সজল।
সজল ওর পিঠে হাত রেখে বলল - তুমি বাড়ী যাও অতীন। আমি একটু একা থাকতে চাই।
অতীন আর কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে গেল - দরজায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই ওর গুনগুন শুনতে পেল সজল - হে সখা বারতা পেয়েছি মনে মনে - তব নিশ্বাসপরশনে - এসেছ অদেখা বন্ধু - দক্ষিণসমীরনে

-----------------------------------------------------

রাতের সব কাজ সেরে সজল ডাক্তারবাবুর ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। অভিরূপের ল্যাপটপটা ফেরত এসেছে আজকেই।  সি আই ডির এক্সপার্টরা জানিয়েছেন তারা পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করতে পারেনি। প্রয়োজন হলে ওরা Apple কোম্পানিকে যোগাযোগ করবে - তবে তার জন্যে ওদের একটা কেস বানাতে হবে। ততদিন ল্যাপটপটা থানার কাষ্টডিতেই রাখা থাক।
সজলের কম্পিউটার জ্ঞান কাজচালানো গোছের। তবু ও ল্যাপটপটা নিয়ে বসলো। User ID, password কোনটাই জানা নেই - তবু দুটো কম্বিনেশান চেষ্টা করল আনতাবড়ি। একাঊণ্ট খুলল না। সজল আর চেষ্টা করতে ভয় পেল - তিনবার ভুল হলে একাঊণ্ট লক হয়ে যেতে পারে। থাক। আরেকটু ভাবতে হবে।
দুহাতের মধ্যে নিজের মাথাটা ধরে কবি সুকান্তর স্টাইলে স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে বসেছিল সজল।

হঠাৎ - একদম হঠাৎ সজল দেখল ল্যাপটপের স্ক্রিন সজীব হয়ে উঠছে - User Id নিজে নিজেই টাইপ হয়ে যাচ্ছে - AbhiroopSen333. পাসওয়ার্ডটাও টাইপ হচ্ছে অদৃশ্য হাতে - তবে সেটা সজল দেখতে পাচ্ছে না - কেবল কিছু ফুটকি .
হতবাক সজল এই চিচিং ফাঁকের রহস্য বুঝতে না বুঝতেই হঠাৎ দেখল - ওর সামনে উন্মীলিত হয়ে পড়ে আছে ডাক্তারের ব্যক্তিগত জীবন। Google Chrome এ একের পর এক উইন্ডো খোলা রয়েছে! Gmail, Wikipedia, Facebook ইত্যাদি ইত্যাদি।
সজল দ্রুত একবার gmail টা খুলল - নাঃ সেরকম কিছু নেই। ব্যাঙ্কের মেইল, বিক্রেতাদের মেইল, হাবিজাবি আরও কত কিছু। 
সজলের কৌতূহল এখন আকাশচুম্বী! ও সোজাসুজি ফেসবুকের উইন্ডোটাতে চলে গেল।
প্রোফাইল পিকচারটা থেকে অভিরূপকে চেনা যাচ্ছে ঠিকই - কিন্তু ওর কপালের ওপর একটা লাল ক্রস বা ঢেরা কাটা দাগ!  অদ্ভুত তো! ডাক্তার বলে? একটু আজগুবি বটে!
সময় নষ্ট না করে সজল মন দিল দেওয়াল লিখনে।
আর পড়তে গিয়েই এক ধাক্কা।
“Happy Birthday Abhirup!” “Wish you a very happy birthday Doctor!” - জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা উপচে পড়ছে অভিরূপের দেওয়ালে। ১লা নভেম্বর রাত বারোটা থেকে শুরু হয়েছে শুভেচ্ছার ঝড়। চলেছে কাল সন্ধ্যে অবধি। মানুষটা নেই - মারা গিয়েছে ১ লা নম্ভেম্বর রাত্তিরেই - কিন্তু ইথার তরঙ্গে তার অস্তিত্বটা এখনো জ্বলজ্বল করছে। দেশী-বিদেশী বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বন্ধুরা অকাতরে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাচ্ছে অভিরূপ সেনকে? সেগুলো কি তার কাছে গিয়ে পৌঁছচ্ছে?        
 শুভেচ্ছার ঢল বেয়ে সজল চেষ্টা করছে নীচের দিকে নামতে - ডাক্তারের ব্যাক্তিগত জীবনের কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে কি তার পুরনো পোস্টে?
ফেসবুকের টাইমলাইন কভারে অভিরূপের ছবি সমুদ্রের তীরে। কি হ্যান্ডসম ছিল ছেলেটা! হ্যাঁ ছেলেটাই ভাবছে সজল। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস।
হঠাত সজলকে চমকে দিয়ে ফেসবুক পেজের ডানদিকের কোনায় ভেসে উঠল মেসেঞ্জারের ছোট্ট বাক্স!
সজল তো খোলেনি! তবে কি কেউ চেষ্টা করছে অভিরূপের সাথে যোগাযোগ করতে?
সজল চুপ করে অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ - কিন্তু না কোন নতুন বার্তা ভেসে উঠল না খোলা মেসেঞ্জারের জানালায়।
মেসেঞ্জারে যিনি এসেছেন তিনি তরুণী -  নাম দেখা যাচ্ছে মাধুরী।
মাধুরীর নামে ক্লিক করে সজল মাধুরীর হোম পেজে যাবার চেষ্টা করল। সংরক্ষিত - পারমিশন নেই।  ছবির মুখটা যেন সজলের খানিক খানিক চেনা - কিন্তু ঠিক কার মত বা কে হতে পারে সে বিষয়ে কোন সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারল না।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সজল ডুব দিল মেসেঞ্জারের লেখায়।
অদ্ভুত ব্যাপার! সংলাপের শুরুও ১লা নভেম্বর রাত বারোটায়! তার আগে অভিরূপের সাথে এই মহিলার কথোপকথনের  কোনো চিহ্ন নেই। অবশ্য হতেই পারে অভিরূপ তা আগেই ডিলিট করে দিয়েছে।

সজল কৌতূহলী হয়ে পড়তে শুরু করলো।
……………………………………………..

মাধুরী - শুভ জন্মদিন অভিরূপ!
অভিরূপ -  ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না।
মা : আপনি আমায় চেনেন না. আমি মাধুরী
অ : আপনি কি আমার ফ্রেণ্ডলিষ্টে আছেন?
মা : আপনি তো ডাক্তার!
অ: সে তো আমার প্রোফাইল দেখলেই বোঝা যায়। বললেন না তো আপনি কি আমার ফ্রেণ্ডলিষ্টে আছেন?
মা : এতো রেগে রেগে কথা বলছেন কেন ? কোনো অপারেশন বিগড়ে গেছে নাকি?
অ : দেখুন, ফালতু কথা বলবেন না। অভিরূপের হাতে আজ পর্যন্ত কোনো অপেরাশন ফেল করেনি।
মা : শুধু ফোর্থ ইয়ারে স্মিতার কেসটা গড়বড় হয়ে গিয়েছিলো.
অ: কে আপনি? কে?
মাঃ - আহা অধৈর্য্য হচ্ছেন কেন? ক্রমশঃ প্রকাশ্য!
অঃ - আপনি স্মিতাকে চিনতেনকি জানেন আপনি স্মিতার সম্বন্ধে? আপনি কে? স্মিতার কোন আত্মীয়? বন্ধু?
মা : ধুর, এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? রাতের খাওয়া হয়েছে ?
অ : হ্যাঁ! এই খেয়ে উঠলাম একটু আগে।
মা : এখন কথা বলে বিরক্ত করছি না তো ?
অ : না না, কোনো অসুবিধে নেই।  আচ্ছা , একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
মা : করুন
অ : প্রোফাইলের ছবিটা কি আপনার ?
মা : আবার কার হবে?
 অ : কি সুন্দর সাগর গভীর চোখ....
মা : বলছেন ?
অ : হ্যাঁ তো!
মা : এই প্রথম কাউকে বললেন  বুঝি এমন কথা?
অ : কি বলতে চান কি আপনি? কে আপনি?
মা : আহা, রেগে যাচ্ছেন কেন!
অ : আপনি খোলসা করে বলুন তো কি চাইছেন?
মা : তমসাকেও তো বলেছিলেন - সাগরগভীর চোখ - যার গভীরতায় আপনার আজীবন সাঁতার! বলেননি?
*****************************************
তমসা! 
সজলের মনে পড়ে গেলো। মাধুরীর মুখের সাথে কি তমসার মুখের মিল আছে?
তমসা এই চন্দনপুরেরই মেয়ে। সজলের সঙ্গে পড়তো কলেজে। ডানাকাটা পরী না হলেও - সুন্দরী।  ভীষণ চঞ্চল ছিল। ছটফট করে কথা বলতো। শুধু সজল না - ওই সময়ে এমন কোন ছেলে ছিল না কলেজে যার তমসার প্রতি দুর্বলতা ছিল না। তবে তমসা ছিল উচ্চাকঙ্খী। পরবর্তীকালে একটা স্কুলে পড়াত। একাই থাকতো একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে।  খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও মোটামুটি বন্ধুত্ব ছিল ওর সজল আর সজলের বৌয়ের সাথে। সৌজন্য বজায় রাখলেও তমসাকে সজলের বৌ রীণার বিশেষ পছন্দের ছিল না - তবে কিনা কোন গৃহিণী আর স্বামীর প্রাক্তন heartthrob কে সুচক্ষে দেখে! বিশেষ করে সে যদি আবার কর্মরতা স্বাধীন নারী হয়!  
 তমসা কিছুদিন আগেই মারা গেছে।  সেও রহস্যজনক ভাবে।  ওই কেসটা দেখার ভারও পড়েছিল সজলের ওপর। মৃত্যুর কারণ কিছু বোঝা যায় নি। ওই কেসটা দেখার সূত্রেই যে অভিরূপের সঙ্গে তমসার সম্পর্কটা সজলের নজরে আসে তা অবশ্য ঠিক নয়। তবে কিনা ঘি আর আগুন একত্র থাকলে ধোঁয়া উঠবেই - এই সব ছোটখাট শহরগুলোতেও একথা আজকাল লোকে মেনে নেয়। ও তদন্ত করতে গিয়ে জেনেছিল তমসার মা পছন্দ করতেন না ডাক্তারকে - আপত্তিও করেছিল অভিরূপের সাথে মেলামেশায়। অভিরূপ সুপুরুষ - বহু মহিলার সাথে তার মাখামাখি সম্পর্ক। তবে তমসাও আধুনিক মেয়ে - এসবে পাত্তা দিতো না। অভিরূপের প্রেমে ও অন্ধ ছিল। মায়ের থেকে আলাদা হয়ে তাই একাই থাকতে শুরু করেছিল। তমসা তখন অভিরূপকে বিয়ে করে ঘর বাঁধার স্বপ্নে পাগল।


সজল আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে  চোখ রাখলো.

অ : অদ্ভুত তো! আপনি কি করে জানলেন? বুঝেছি! তমসা আপনাকে বলেছিল!
মা : ও কি করে মারা গেলো ডক্টর ? আপনি তো পি এম দেখেছিলেন !
অ : হার্ট ফেল.
মা : আহা, হার্ট তো ফেল করেছিল, কিন্তু কেন?
অ : জানি না।
মা : সত্যি জানেন না ? আচ্ছা তমসার মৃত্যুর আগের রাতে আপনি ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন, না ?
অ : কি বলতে চাইছেন ? আমি তমসাকে খুন করেছি ?
মা : আপনি তো ওকে ভালোবাসতেন।
অ: হ্যাঁ. ভীষণ।
মা: কিন্তু বড্ডো বেশি demanding হয়ে পড়ছিলো না তমসা? বিয়ের তাড়া দিচ্ছিলো না খুব?
অ : আপনি তো সবই জানেন দেখছি?
মা : শুধু এটাই কি ওর দোষ ?
অ: না ওর আরো অনেক দোষ ছিল.
মা: যেমন
অ : আমার মনে হয় ওর অন্য বয়ফ্রেন্ডও ছিল। শারীরিক সম্পর্কও ছিল অন্য পুরুষদের সাথে।
মা : আর আপনার ? বিপাশা,দীপা, সুদেষ্ণা এদের সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিল আপনার ?
অ : কে আপনি? কি চান বলুন তো ?
মা : দীপাকে কিভাবে মারলেন অভিরূপ ?
অ : আমি মারি নি। আমি কিছু জানি না।
মা : আচ্ছা  ডাক্তার আপনারা তো রুগীকে সুস্থ করতে পটাসিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করেন - তাই না ?
অ : করি।  ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
মা : পটাসিয়াম ক্লোরাইড বেশি পরিমানে ইনজেকশন দিলে মানুষ তো মরে যাবে! হার্ট ফেল করে! আর পোস্ট মর্টেম করে কিছু বোঝা ও যাবে না - তাই না? পটাসিয়াম ক্লোরাইড তো আর বিষ নয়!........কি বলুন অভিরূপ?
অ : জানিনা আমি কিছু বলবো না. কিছু না. কিছু না।
মা: বিচলিত হবেন না অভিরূপ। ভারী মজার কথা হলো দীপাও কিন্তু ভালোবেসে আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। 
অ : আমি তো আপনাকে বললাম আমি কিছুই বলবো না... প্লীজ গেট লস্ট!
মা : আর বিদিশা ?
অ : বিদিশার তো হার্ট ফেল করেছিল।
মা : ওর বাবা বোধ হয় হার্টের রোগে ভুগছিল. তাই না ?
অ : তো ? তাতে আমার কি দায়?
মা : আপনি তো ওর বাবার ট্রিটমেন্ট করতেন ?
অ : ডাক্তারের তো সেটাই কাজ.
মা : আপনি ডিজিটালিস ওষুধটা ব্যবহার করেন?
অ : পৃথিবী সুদ্ধু ডাক্তাররা ব্যবহার করেন।
মা : তবে পৃথিবী সুদ্ধু ডাক্তার রোগীর মেয়ের সাথে প্রেম করে না, সেই প্রেমিকা আবার ডাক্তারের গলায় ঝুলে পড়তে চায় না, বাবাকে মৃত্যুশয্যায় দেখে ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্যে বিয়ের চাপ দিতে চায় না. তাই না ডাক্তার ? আপনি তো জানেন ডিজিটালিস একটু বেশি নিলেই হার্ট এট্যাক হবে আর মানুষ
 মারা যাবে. আপনার চোখের সামনেই বিদিশার হার্ট এট্যাক হয় ওই রাত্রে. আপনি ডেথ সার্টিফিকেট দেন. পোস্ট মর্টেম হয় না. হলেও কিছু বোঝা যেত না সেটা আপনি জানতেন. কি ডক্টর , ঠিক বলছি তো? বিদিশার মৃত্যু ডিজিটালিসের অতি - প্রয়োগেই হয়েছিল, তাই তো ?
 অ : oh my God.
মা: তমসা কে কি করে মারলেন বলুন না ?
অ : কেন আমাকে জ্বালাচ্ছেন? পুলিশ তো পোস্ট মর্টেম করে বলেছে স্বাভাবিক মৃত্যু.
মা : আর আপনি কি বলছেন?
অ : কি আর বলবো !
মা : একটা কাজ করবেন ? আপনার ফ্রিজটা একবার খুলবেন?
অঃ এখন? কেন?
মাঃ  করুন! যা বলছি তাই করুন! 
অ : খুলছি।
অ: আরে আমার ফ্রিজে দেখছি এত্তো ইনসুলিনের এম্পুল! কোত্থেকে এলো ?
মা : আমি রেখেছি. ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা আর ইনসুলিনের এম্পুলগুলো বের করুন.
অ : না. আমি করবো না
মা : আর না করতে পারবেন না ডাক্তার. এখন আমি যা বলবো আপনি তাই করবেন. হ্যাঁ, বার করুন.
অঃ ওকে! করেছি।
মাঃ এবার এম্পুল থেকে সিরিঞ্জে ভরুন.
অঃ - করেছি
মাঃ- বাহ. গুড বয়! এবার পুশ করুন. পেটের চামড়ায়.
অঃ করলাম!
মা -  নিন আর একটা নিন।  আবার পুশ করুন.
অঃ - করলাম
মা - গুড! এবার আরেকটা নিন। মনে পড়ছে ঠিক এভাবেই তমসার পেটে এক এক করে দিয়েছিলেন ইনসুলিন ইঞ্জেকশান? কি হলো ? নিন.
অ - নিলাম
মা -  আরেকটা নিন।
অ - নিলাম
মা - বেশ।  এবার এম্পুল আর সিরিঞ্জ টয়লেটের কমোডে ফেলে ফ্লাশ টেনে আসুন।
অঃ  এলাম
 মা - বাহ। বসুন এবার খাটে. ডাক্তার, আপনি জানেন বেশি ডোজে ইন্সুলিন নিলে কত সহজে মরা যায়, মারাও যায়. কি, তাই নাজানেন তো?
অ: আমার ঘুম পাচ্ছে.
মা : পাবে. এমনি করেই তমসা ঘুমিয়ে পড়েছিল চির ঘুমে আপনার হাতের মধ্যে.
অ: একি ? মাধুরী, আপনার প্রোফাইল পিকটা পাল্টে যাচ্ছে. আপনি কে? তমসা? তমসার ছবি তো এটা? তমসা তুমি কোথা থেকে এলে ?
মা : আমি তো তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি. এসো অভিরূপ, এসো.
--------------------------------------------------------------------------------
শেষ সংলাপ রাত একটা দশ

সজলের মনে পড়ে গেলো তমসার কেসটা। ওই কেসেও পোস্ট মর্টেমে কিছু পাওয়া যায় নি। এখন সজল বুঝতে পারছে কি হয়েছিল।

হঠাৎ সজলের চোখ গেলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে। মাধুরীর ছবিটা তমসার ছবি হয়ে উঠে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। স্ক্রিন থেকে আবছা হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেলো পুরো কথোপকথন - অভিরূপের দেওয়াল। স্ক্রিন লকড।
সজল পাগলের মতো কিপ্যাডের সুইচ টিপতে থাকলো.............কিন্তু নাঃ কোথাও কিচ্ছু নেই - শুধু নিঃসীম ধূসর স্ক্রিন বসে আছে সঠিক User ID আর password এর অপেক্ষায়।  


কল্যাণ মুখোপাধ্যায়

Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.