>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • নন্দিতা ভট্টাচার্য্য

    SongSoptok | 11/15/2016 |



    শনিবারের দুপুর। সবে ভাতঘুম দিতে যাব। এমন অসময়ে দরজায় করাঘাত। মনে মনে একটু বিরক্ত যে হলাম না তা নয়। দরজার মাঝখানে ছোট ফুটোয় চোখ রাখতেই আবছায়া অবয়ব। ঠিক বুঝতে না পেরে দোনামনা করে দরজাটা খুলেই ফেললাম। অবাক হয়ে দেখলাম বিনু। বিনয় চক্রবর্তী। ছেলেবেলার বন্ধু। এই শহরেই একই পাড়ায় বড় হওয়া আমাদের। পরীক্ষা, পড়াশোনা, চাকরি নিয়ে আমি এই শহরে থেকে গেলেও, বিনু চাকরি নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে এসে সবার সাথে দেখা করলেও বছর দশেক কোন যোগাযোগ নেই। আমিও পুরনো পৈতৃক বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দায়মুক্ত হয়ে শহরের দক্ষিণ দিকে নিরিবিলিতে ছোট ফ্ল্যাটে নতুন আস্তানা গেড়েছি। অফিসের ফ্ল্যাট বা সরকারী ধ্বজাধারী গাড়ি কোনোটাই আমার ধাতে সয় না। এইখান থেকে বেশ ফাঁকা রাস্তা ধরে মিনিট পনেরো হাঁটলেই আমার অফিস। মাটিতে পা রাখাই আমার চিরকালের অভ্যেস।

    --কি রে, তুই কোত্থেকে উদয় হলি? আর বাড়িই বা চিনলি কি করে?

    বিনু কোন উত্তর দিল না। কেমন স্বপ্নাবিষ্টের মতো একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

    --কি রে বিনু? এই…………..বলে বিনুকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। চমক ভাঙতেই আমার দিকে সহজ হেসে তাকাল। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,

    --কত দিন পর তোকে দেখলাম তপু, কেমন আছিস রে?

    উত্তর দিলাম কি দিলাম না আবার বিনু আনমনা। এবার আমি ওকে জোর করে ধরে ভেতরে নিয়ে এলাম। দরজাটা ভেজিয়ে এসে বসলাম দুজন মুখোমুখি। বিনু যেন এই জগতে নেই। কি যেন চিন্তায় মগ্ন। আমার ডাকে মাঝে মাঝে সম্বিত ফিরে আসছে বটে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার আনমনা। আমি এবার ওর হাত ধরে বললাম,

    --বিনু, তোর কি হয়েছে বলত? তুই কেমন যেন বদলে গেছিস। বাড়ির সবাই ভাল তো? তোর মেয়ে, কি যেন নামটা……. হ্যাঁ, মিমি। মিমি কেমন আছে? কোন ক্লাস হোল রে ওর?

    মিমির নাম করতেই কেমন যেন ছটফট করে উঠলো বিনু। এবার আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বলল,

    ---তপু, আমি অনেক আশা নিয়ে তোর বাড়ি এসেছি। আমার সঙ্গে একটু যাবি? শ্যামল, আমাদের সাথে কলেজে পড়তো, ওর কাছেই তোর ঠিকানা জোগাড় করেছি। না করিস না প্লীজ।

    কি ব্যাপার, কোথায় যাব, কেন যাব, কিছুই বলল না। একদম স্পিকটি নট হয়ে বসে রইল। আবার আনমনা। সমস্যা যে একটা হয়েছে এবং বেশ বড় ধরণের, তা আমার বুঝতে বাকি রইল না।

    তবে কোথায় যাব, কেন যাব তা নিয়ে বিস্তর চিন্তায় পড়লাম। বিনুর সঙ্গে শেষ বার দেখা হওয়া আর তার হঠাত আমার বাড়ি আসার মধ্যে দশ বছরের ফারাক। এর মধ্যে কত কিছুই তো ঘটে থাকতে পারে। বিনু হয়ত কোন কুচক্রে জড়িয়ে পড়েছে। সেখানে বোঝাপড়া করতে চায়। এমন সময়ে হয়তো তার আমার কথা মনে পড়েছে ত্রাতা হিসেবে। অথবা কোন বিশেষ কারণে টাকাপয়সার প্রয়োজন পড়েছে তাই আমার ঠিকানা জোগাড় করে ছুটে এসেছে এই ভরসায় যে ছোটবেলার বন্ধুকে আমি নিশ্চয় ফেরাব না। মিমির কথা বলাতে কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। হতে পারে মেয়েটার কোন সমস্যায় বিনু আমার সাথে আলোচনা করতে চায়। তাই যদি হয়, তাহলে তো বাড়িতে বসেই কথা বলা যেতে পারে। আকাশপাতাল ভেবেও আমি কোন কূলকিনারা দেখলাম না। তাই ভাবলাম হাজার হোক ছোটবেলার বন্ধু। দেখাই যাক না কোথায় নিয়ে যায়।

    --কি রে আমায় বিশ্বাস করতে পারছিস না?

    আচমকা বিনুর গলা শুনে আমার ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। কিকরে যেন ও আমার মধ্যের দোটানা আঁচ করতে পারল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলাম,

    --আরে ধুর(খানিকটা নিজের গলাটাকেই যেন জোরে শোনার জন্যে)..দাঁড়া, শার্টটা গলিয়ে নিই। তারপর চল কোথায় নিয়ে যাবি।

    আমার একলার সংসার। কাউকে কোন কৈফিয়ত দেবার নেই। হঠাত বাবা চলে যাওয়ার পর সংসার এসে পড়ল কাঁধে। আমি তখন পড়াশোনা সবে শেষ করেছি। ভাইবোনেরা ছোট। মার পাশে দাঁড়ানোর জন্যে চাকরির চেস্টা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কপাল গুনে সরকারী চাকরি জুটেও গেল একটা ভাল রেজাল্টের সুবাদে। আজ এত বছর পর সেখানেও অল্প বিস্তর প্রভাব যে নেই তা নয়। ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্না,ভাগ্নীগুলোর মাঝে থাকতে মন্দ লাগে না। বিয়ে করে তাই সংসার বাড়াতে আর ইচ্ছেই করে নি। মাও কয়েক বছর হল গত হয়েছেন।

    বিনু যেন হঠাত কেমন বদলে গেছে। ওকে মনে আছে খুব হাসিখুসি প্রাণোচ্ছল একটি মানুষ হিসেবে। তবে হাসির পেছনে ছিল আসাধারণ চিন্তাশীল এক মনন। বিকেলে পাড়ায় সাইকেল নিয়ে চক্কর মারতে বার হতাম দুই বন্ধু। ওই বয়েসেই ওর জীবনবোধ ছিল পরিপূর্ণ। আসাধারণ ভাল মনের মানুষ বিনু। কোনোদিন সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে, বা কোনোদিন সবুজ ঘাসের গালচেতে শুয়ে মাথার ওপর নীল আকাশ দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম মানুষকে ভালবাসার গল্প, সমাজের গল্প, সম্পর্কের গল্প। ওই বয়েসেই নানা বিষয়ের বই পড়াতে ওর জুড়ি ছিল না। সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এসবের ওপর প্রবল বিরাগ ছিল। পরীক্ষার আগে আমরা সবাই সরস্বতীর পায়ে বই ঠেকাতাম উদ্ধার হওয়ার তাগিদে। বিনু বিরক্ত হত। বলত,

    --পরীক্ষার হলে কিন্তু কলমখানা তোদের হাতেই থাকবে রে, ঢ্যাঁড়সের দল।

    আর একবার শীতের ছুটির সময় বন্ধুরা সবাই পিকনিক করতে গিয়েছি। রান্নাবান্নার পর খাওয়াদাওয়ার সময় ওখানে হাজির কতগুলো অভাবী শিশু। দুএকজন ওদের দূরে যেতে বলছিল। আমরা কয়েকজন ব্যস্ত কোথায় বসব, কতটা কব্জি ডুবিয়ে খাব এই চিন্তায়। বিনু ওই বাচ্চাগুলোর সাথে ভাব জমিয়ে ওদের আদর করে নিয়ে এল। নিজে কিছু খেল না সেদিন বিনু। অভুক্ত বাচ্চাগুলোর মুখে খাবার তুলে দেবার যে কি আনন্দ বিনুর জন্যে তা আমিও বুঝেছিলাম সেদিন। ক্লাসে বিনু ছিল সবার থেকে আলাদা। গতানুগতিক পরীক্ষা পাশের পড়া ওর দ্বারা হতো না। ওর মনন, ওর আত্মা আরও সুদূরের পিয়াসী ছিল। পরীক্ষায় প্রথম না হলেও মাস্টারমশাইদের কাছে ছিল ও বিস্ময়বালক।

    বিনু যেন উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছে। ওর সাথে তাল মেলানোর জন্যে আমাকে প্রায় দৌড়তে হচ্ছে। এইভাবেই আমরা ছোট টিলাটার দিকে এগোচ্ছি। এদিকটায় আজকাল বড় একটা আসা হয় না। ছাত্রাবস্থার বহু স্মৃতি বিজড়িত এই পথ। নগরোন্নয়নের সুবাদে এই পথ এখন জীর্ণ প্রায়। টিলার পূর্ব দিকে নবনির্মিত বাইপাসই এখন পথচারী বা যানবাহনের প্রধান যাতায়াতের পথ। টিলাটার নিচ দিয়ে নাকি ভবানী পাঠক দ্বারা ব্যবহৃত একটি সুড়ঙ্গ ছিল যা গিয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের রংপুর জেলায়। এই পথ দিয়েই নাকি বিপ্লবীরা গোপনে আসা যাওয়া করত। ইতিহাসে ভবানী পাঠক একটি সর্বজনবিদিত নাম। সেই নামের সাথে আমাদের এই ছোট্ট শহরের জুড়ে যাওয়াতে আমরাও কিছু কম রোমাঞ্চিত হতাম না। যদিও সুড়ঙ্গের মুখ এখন নানা আগাছার জঙ্গল আর বড় বড় পাথরে বদ্ধ, এবং ব্রিটিশ শাসনকালেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, তথাপি ইতিহাসের ঘটনাবলীর কল্পনা করে শিহরিত হতাম। বন্ধুরা মিলে ছুটিছাটার দিনে সাইকেল নিয়ে পাড়ি দিতাম এইখানে। যে জীর্ণ পথ দিয়ে এখন হাঁটছি, সেই পথ এককালে ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল। শহর তৈরির জন্যে যদিও সেই জঙ্গল অনেকটাই কেটে সাফ করা হয়েছিল, তবু এই দিকটায় মালভূমির বিক্ষিপ্ত অঞ্চল জুড়ে মাইলের পর মাইল শুধু শাল, মহুয়া, সেগুন, বহেড়া, বাবলা, পলাশের জঙ্গল..মাঝে মাঝে ধুতরো, নিশিন্দা, আশশেওড়ার ঝোপ ছিল। টিলার ওপর উঠে দাঁড়ালে দূরে দেখা যেত মরা নদীর সোঁতা। এখন এই জঙ্গলও বিলুপ্তপ্রায়, তাই পথও উন্মোচিত।

    আমরা দুজন ঠিক কোথায়, কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছি জানিনা এখনো। কৌতূহল বশে বিনুকে একবার জিজ্ঞেসও করলাম। কিন্তু ও নির্বিকার। সামনে তাকিয়ে সমানে হাঁটছে। আমার ওর এই রূপ দেখে আর শুনশান পথ দিয়ে হেঁটে যেতে এবার বেশ গা ছমছম করে উঠল। ভাবলাম একবার উল্টো দিকে ফিরে ছুট লাগাই। কিন্তু কেন জানিনা পারলাম না। কিসের যেন এক অমোঘ আকর্ষণে মন্ত্রাবিস্টের মতো আমিও চলতে লাগলাম বিনুর সাথে। হাঁটতে হাঁটতে টিলাটা পার করে আরও এগিয়ে যেতে থাকলাম। চারিদিকে জনমানব হীন ধূ ধূ প্রান্তর। মাঝে মাঝে শুধু ছোট ছোট ঝোপ। কতক্ষণ এই ভাবে হেঁটেছি ঠিক মনে নেই। হাঁটতে হাঁটতে আঁধার হয়ে এসেছে। অন্ধকারে ভাল দেখাও যাচ্ছিল না। হঠাত দেখি দূরে একটা আলোর বিন্দু। বিনুর ভাবগতিক দেখে মনে হল ও ওই দিকেই যাচ্ছে। খানিক পর বিন্দু স্পষ্ট হল। আমরা নিশ্চিত ওই বিন্দুর দিকেই চলেছি। কিন্তু ওখানে বিনুর কি কাজ থাকতে পারে কিছুতেই বুঝতে পারলাম না।

    দূর থেকে প্রবল কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ, শত কন্ঠের মা.মাধ্বনিতে যেন চমক ভাঙল। আরে এতো মন্দির!!!!!!!!!!! আমরা প্রায় তিনশো গজের মধ্যে এসে পড়েছি। বিনু যেন কেমন উৎসাহের আতিশয্যে প্রায় দৌড়তে আরম্ভ করেছে। আমিও ওর সাথে তাল মেলানোর জন্যে দৌড়চ্ছি। বিরক্তিতে মন জর্জরিত। তবু এখন আমারও জেদ চেপে গেছে এর শেষ দেখব। যে বিনু মন্দিরের নামেই শত হস্ত ছিটকে যেত, সেই কিনা আমাকে টেনেটুনে এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে মাঠের মাঝখানে মন্দিরে নিয়ে এল? এতখানি বদলে যায় নাকি কেউ? হয়তো যায়। মাঝের অসাক্ষাতের দশ বছরের গর্ভে হয়তো আমার সব প্রশ্নের উত্তর সমাহিত। কিন্তু এমন কি ঘটেছে যাতে বিনুর মত বাস্তববাদী, সচেতন মানুষও এমন বদলে যায়?

    এই পাণ্ডব বর্জিত মাঠের মাঝখানে মন্দিরে কোথা থেকে এত লোক এল সেও এক বিস্ময়। মন্দিরের দাওয়ার কাছে পৌঁছে বিনু কেমন শান্ত হয়ে গেল। দাওয়ার ওপর আছড়ে পড়ে মা, মাগো দয়া কর মা। মুখ তুলে তাকাবলে চিৎকার করে উঠল। তারপর দণ্ডী কেটে দরজার সামনে গিয়ে উঠে বসল। ওকে দেখে চারপাশের ভিড় আরো উৎসাহিত হয়ে মা,মাবলে চিৎকার করে উঠল।

    আমি গিয়ে মন্দিরের দরজার পাশে থামের আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়ালাম। প্রায়ান্ধকার টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয় প্রথমটায় কিছু দেখে গেল না। ক্রমে চোখ সয়ে এলে দেখলাম মন্দিরের ভেতর অস্পষ্ট দেবী মূর্তি। ধোয়াচ্ছন্ন সামান্য আলোয় ঠিকমত ঠাহর করা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে দেবী মূর্তি  ভয়ঙ্করী। প্রথম দর্শনেই বুক কেঁপে ওঠে। ব্যথা উপশমকারিনী, আশ্রয়দাত্রী মাএর প্রতিমূর্তি এই দেবীকে মনে হলনা। সামনের আসনে কাপালিক উপবিষ্ট। মাথায় বিশাল জটা, কপালে উল্লম্ব সিঁদুরের তিলক, রক্তচক্ষু, গলায় রুদ্রাক্ষ, পরনে গেরুয়া ধূতি। বিনুকে দেখে মা..মা গো, মনোবাঞ্ছা  পূর্ণ করবলে চিৎকার করে বিনুর মাথায় হাত ঠেকাল। বিনু কাপালিকের পায়ে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। এতক্ষনে মেঝের দিকে নজর যেতে দেখলাম দরজার সামনে বাঁশের খাটিয়ায় একটি অল্প বয়েসী মেয়ে শুয়ে আছে। অচৈতন্য মনে হল। রোগাটে গড়ন। অন্ধকারে বয়েস আন্দাজ করতে পারলাম না। বিনু মেয়েটির দিকে করুন চোখে তাকিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।  বুঝলাম ওই মিমি। পুরো ব্যাপারটা ঠিক বুঝে ওঠার আগেই বিনু আমাকে দেখতে পেয়ে গেল। হঠাত এসে আমার হাত ধরে টেনে কাপালিকের সামনে নিয়ে এল

    --বেটা, এখানে বস। তোর বন্ধুর মেয়ে কিন্তু ভাল নেই। বাঁচবে না। একমাত্র মাযদি কিরপা করে তবে হয়ত বেঁচে যাবে। মাকে খুশি করতে তাই যজ্ঞ করতে হবে। তোর বন্ধুর তো ক্ষমতা নেই খরচ করার। তোর তো সংসার নেই। তবে তুই ওর মেয়েকে বাঁচা। তবে মাপ্রসন্ন হবে।

    পুরো কেসটা এতক্ষণে বুঝলাম। বিনুর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এই ভণ্ড কাপালিক টাকা পয়সার টোপ ধরেছে। একমাত্র সন্তানকে যে করেই হোক বাঁচাতে বিনু খড়কুটোর মত এই পাষণ্ডকেই আঁকড়ে ধরেছে। মাপ্রসন্ন হবে কিনা জানিনা, তবে আমি যে প্রসন্ন হলাম না সেটা আমার মুখ দেখে বিনু বোধ করি আন্দাজ করতে পারল। আমার হাত ধরে বলল,

    --তপু, আমার মিমিকে তুই পারিস বাঁচাতে। এটুকু করবি না রে আমার জন্যে?

    মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তড়িৎ গতিতে মনে মনে ঠিক করে ফেললাম কি করব। কৃষ্ণপক্ষের রাত। চারপাশ নিকষ কালো অন্ধকার। যা করার এখনই করতে হবেলোকজনের ভিড়ও খানিক হাল্কা হয়ে এসেছে। পুজোর জোগাড় করতে কাপালিকটা ঘরের ভেতর গেছে আর বিনু দরজার সামনে বসে দেবীমূর্তির দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বিভোর হয়ে বসে আছে। আমি সন্তর্পণে খাটিয়ায় শুয়ে থাকা মিমিকে কাঁধের ওপর চাপিয়ে নিয়ে ওই অন্ধকার ভেদ করে ছুটতে লাগলাম। বিনুর কথাটা যে রাখতেই হবে।

    পত্নীবিয়োগের পর বিনু আঁকড়ে ধরেছিল মিমিকে। কিন্তু ডাক্তার যখন বলেছিল মিমি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত তখন বিনুর পৃথিবীটা দুলে উঠেছিল। স্ত্রীর চিকিৎসা, মিমির প্রতি মাসে ব্লাড ট্রান্সফিউসন, বিনুকে কপর্দকশূন্য করে দিয়েছিল।ডাক্তার যখন আর কোন আশার আলো দেখাতে পারে নি বিনু ভেঙে পড়েছিল। দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে যে যা বলেছিল তাই করছিল মিমিকে যদি বাঁচানো যায় তাই ভেবে। মন্দির, মসজিদ, দণ্ডী কাটা কোন কিছুই আর অবিশ্বাস করতে পারে নি। লোকের কাছে ধারদেনা করতেও দ্বিধা করে নি। একেবারে যখন নিঃস্ব, তখনি তার আমার কথা মনে পড়েছিল কেন জানিনা। হয়তো বিশ্বাস ছিল অকৃতদার আমি বন্ধুকে ভেসে যেতে দেব না। পিতৃ স্নেহে অন্ধ অসহায় বিনুর চিরকালের বিশ্বাস স্খলিত হয়ে গেছিল। বন্ধু হিসেবে বিনু আমার অনেক সুখদুঃখের সাথী। সেই মুহূর্তে ওকে বোঝাবার সাধ্য আমার ছিল না। ওর চেতনা জাগরিত করার সময়ও আমার ছিল না। এই একবিংশ শতকেও বিনুর মত শিক্ষিত মননের পরিনতি দেখে শিউরে উঠেছিলাম। প্রতিদিন খবরের কাগজে পড়া ভুরিভুরি এমন উদাহরন চাক্ষুস করব কল্পনাও করিনি কখনো। কিন্তু কন্যাসমা মিমির আরোগ্যহেতু কিছু যদি করতে পারি, তাই হবে যথার্থ বন্ধুত্বের মর্যাদা।

    মুম্বাই শহরের বিশ্ববিখ্যাত হেমাটলজিস্ট ডঃ কে. বিশ্বনাথনের চেম্বারের সামনে আমরা তিনজন………বিনু, আমি আর মিমি অপেক্ষমাণ। এবার আমাদের ভেতরে যেতে হবে।


    নন্দিতা ভট্টাচার্য্য

    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.