ছোটব্বলায় শীতকালিন ছুটি – ‘উইন্টার ভ্যাকেশান’ এলে আমরা
প্রায় প্রতিবছরই ছুটিতে শীতের পিঠা খেতে গ্রামে নানুবাড়ী, দাদাবাড়ী যেতাম। সেইবার শীতের ছুটিতে গ্রামের বাড়ী বেড়াতে
গেলাম। মামাদের চাষের কাজ করা,
গরু গেরস্থালি
দেখাশুনা করার জন্য এক কাজেরলোক
মোহসিন মিয়া। গ্রামের পাশেই আরেক পাড়ায়
তাঁদের বাড়ী। কাজে ফাঁকি দেয়া তার অভ্যাস ইদানিং
বেশ উদাসীন সে, একথা আমরা
ছেলে বুড়ো সবাই জানি।
প্রায় দিন মামা তাঁকে সকালে
খেজুরের রস আনতে পাঠায় মাঠের দিকে কিন্তু সে বহু দেরী করে বাড়ী ফেরে।
ততোক্ষণে রসের স্বাদ পাল্টে যায়, খুব
ভোরে খেজুরের রস রঙ ও গন্ধে বেশ চনমনে স্বাদের
হয়ে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে হালকা
লালচে রঙ ক্রমশ সাদাটে ঘোলা এবং
স্বাদ টক জাতীয় হয়ে যায়। এই কথা
মোহসিন মিয়ারও অজানা নয়, তবুও গাফিলতির
জন্য প্রায় সে বকুনি খাচ্ছে, গরু সকাল বেলা মাঠে নিচ্ছে, আশেপাশে
বাড়ীর সবার গোয়াল যখন বাইরে বেরিয়ে
গরু শুন্য হয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে মোহসিন
মিয়া আসছে গরু চরাবার জন্য মাঠে নিয়ে যেতে। নানি রোজ বকছেন তাকে, বাছুরটা দূরে বাঁধার
জন্য যাতে করে দুধ দুইয়ে নেবার পর
ছাড়তে - সে বাছুর বাঁধেই নাই। এমন সব ভুল করেই যাচ্ছে প্রতিদিন।
কি কারণে তাঁর এমন উদাসীনতা? এই নিয়ে সবাই
চিন্তিত ও বিরক্ত। এর
কারণ সনাক্ত যখন করা হলো, আবিস্কার করা
গেলো যে - তাকে নাকি মাঝে মাঝেই ভুতে ধরে। ভূতগ্রস্ত
হয়ে সে বিভিন্ন ভুল কাজ করে বেড়ায় বেখেয়ালে। নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে থাকে এখানে
সেখানে, এমন কি গাছের
মগডালে, মানুষের টিনের চালে, পানা পুকুরে
ডুবিয়ে চোখ লাল করে চেয়ে থাকে।
কি সব অদ্ভুতুড়ে – ভুতভুতুড়ে কাজ কর্ম করে বেড়াচ্ছে সে আজকাল
মোহসিন মিয়া। একদিন দুপুরবেলা
আমরা ভাই বোনেরা মিলে দল বেঁধে
পুকুরের পানিতে লাফিয়ে
ঝাঁপিয়ে – ডুবাচ্ছি। পুকুরের এ মাথা থেকে ওইপারে কে যেতে পারে এমন
প্রতিযোগীতা করছি। মতি মামা এসে জানালেন যে, মোহসিন নাকি মোসাব্বিরদের গহীন আম বাগানের সামনে পথের
ধারে এক প্রকান্ড কাঁঠাল গাছের আগায় - মাচার মতো করে বাসা
বেঁধেছে। ঘোষণা করেছে যে, এখন থেকে
ওখানেই নাকি সে থাকবে, বাড়িমুখো কোনদিন আর হবেনা। মড়ার মাথার খুলি ঠুলি জোগাড় করে গাছে টাঙ্গিয়ে রেখেছে যাতে করে ভয়ে
কেউ যেনো সহজে গাছে না উঠতে চায়।
মতিমামা জানালো ভুতেই নাকি এমন বাড়ী বেঁধে দিয়েছে
বেশ মজবুত করে বাঁশ খুঁটি দিয়ে।
যেই না শুনতে পেলাম, হৈ চৈ করে সবাই মিলে ভুতের বাড়ী দেখতে ছুটলাম মোসাব্বিরের আম
বাগানে। যাওয়ার পথে কিছুদূর এগুলেই শুনতে
পেলাম বেজায় বেসুরো গান। মনের সুখে
গাছের পনের বিশ ফুট
উপরে বাঁশের - উঁচু ‘ট্রি হাউজে' চড়ে তিনি
মহাসুখে গান ধরেছেন - '’ যকন তুমার
কেউ ছিলোনা - ছিলাম শুদুই আমি রে এ এ, একন তুমার সব
হয়েচে পর হয়েচি আমি গো পর হয়েছি আমি ... ‘’ওখানে বসে, উনি কি খাচ্ছেন? জোরে বৃষ্টি এলে কি করবেন? এইসব চিন্তা মাথায় নিয়ে মামাবাড়ী ফিরে এলাম।
পরের দিন সকালে পদ্মবিলে শাপলা
তুলতে গেলাম সব ছেলে মেয়েদের সাথে। কি সুন্দর
পদ্মবিল ! লাল পদ্ম সাথে সাদা শাপলায় মশগুল
হয়ে আছে তাঁরার মতো অসংখ্য ফুল। গাদাগাদি করা চকচকে পাতা, কচি পাতা
কিছুটা লালচে আর বড় পাতাগুলো গাঢ় সবুজ। ডিঙ্গি নৌকা
করে ছেলেরা পাতা কাটছে সেগুলো নাকি ওরা পুজোর সময়ে অনেক মানুষ হলে এই পদ্মপাতাতেই ভাত
খেতে দেয়। মিষ্টি জাতীয় খাবার বিক্রিতে এসব পাতা
ব্যাবহার করা হতো যখন ঠোঙ্গা বা প্যাকেট এর আবিস্কার হয়নি। বিয়ে বাড়ীর দাওয়াতেও গ্রামে পদ্মপাতা
ব্যবহার করে প্লেটের বিকল্প হিসাবে।
এসব কথা গ্রামের বন্ধুদের থেকে
জেনে নিয়ে সাঁতরে শাপলা তুলে কাঁধে করে মামাবাড়ীর দিকে যাচ্ছি। সবাই আমার
শাপলার পরিমাণ দেখে আজব হয়ে গ্রাম সম্পর্কে নানি, মামি, বুবুরা জিজ্ঞাসা করছেন কি করবে এতো শাপলা দিয়ে? আমি উত্তর দিলাম মামী বলেছেন রান্না করে দিবেন, কিছু চিংড়ি
মাছ দিয়ে আর কিছু কুঁচো মাছ দিয়ে। আমি কখোনো শাপলা খাইনি শুনেই
মামীর এই প্রস্তাব। সোমমামাদের বাড়ীর উপর দিয়ে যাবার
সময় তাঁর মা কিছু শাপলা চাইলেন, বেশ কিছু শাপলা তাঁকে দিলাম। আকবর নানাদের
বাড়ীর পাশ দিয়ে যাবার সময় ওই বাড়ীর নানীও কিছু চাইলেন, তাঁকেও দিলাম। অবশেষে মামা
বাড়ীর উঠোনে নিয়ে ধুপ করে শাপলার
বোঝা ফেলতেই মামী চেঁচিয়ে বললেন,
পাগলী মেয়ে' এতো
শাপলা দিয়ে কি হবে?
আমি বললাম, শুনেছি
রান্না করলে নাকি কমে যায়, সেইজন্য বেশী
করে আনলাম, সবাই খাবে তো।
তাই শুনে হেঁসে সবাই কুটিপাটি, যাহোক গোসল
সেরে জামা কাপড় বদলাচ্ছি।
এমন সময় মামাতো এক ভাই এসে বললো, জানো, মহসিন মিয়াকে
আবার আজ ভুতে ধরেছে। ওর বাবা ওঝা এনেছে এই বলেই সে
ভুত দেখার জন্য দৌড় দিলো মোহসিন
মিয়ার বাড়ীর দিকে।
আমি সবে ভিজা কাপড় ছেড়ে
চুল আঁচড়াচ্ছি। আঁচড়ে উঠোনে নেমে দেখি বাড়ী লোক
শূন্য। কি ব্যাপার গেলো কোথায় সবাই কয়েক মুহূর্তের ভিতরে। নানি রান্নাঘর থেকে কাঠের চুলোয়
ফুকনি’ দিয়ে ফুঁ
দিতে দিতে ধোয়ায় চোখ বুজে বললেন -
‘ওই মোহসিনির নাকি ভুতি ধরেছে, এই কথা শুনার
পর কি আর কেউ বাড়ী দাঁড়ায়? সব দেখতি
গেছে, উগার বাড়ী ‘। সব্বাই ভুত দেখার জন্য ভুতের বাড়ী অর্থাৎ মোহসিন মিয়ার বাড়ী গেছে, এমন কি মামীও
গেছেন ওদের সাথে সাথে। আমিও ছুটলাম
ধানের গোলার গলি দিয়ে। হঠাত মনে হলো, সত্যিই ভুত' কিনা একটু
পরখ করে দেখলে হয়। তা কি দিয়ে দেখা যাবে?
মনের ভিতরে বুদ্ধি এলো, ভুতেরা
আলৌকিক কিছু বলতে পারে যেমন অনেকের নাকি
মনের কথা, ভবিষ্যৎ বাণীও বলে দিতে সক্ষম হয়। বেশ আজ হয়ে
যাক তার একটা পরীক্ষা। চাক্ষুষ ভুতেধরা মানুষ দেখা এও
কম নয়। চিন্তায় পড়লাম কি করে আলৌকিকতার
পরিচয় পাওয়া যায়?
হুড়োহুড়ি করে ঘর উঠোন দৌড়া দৌড়ী
করছি তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা।
এমন সময় হেঁসেলের দরোজা ঠেলে ঢুঁকে
দেখি নানিও নেই ! শেষ সময়ে উনিও
কৌতূহলে ভুতের আলৌকিক কিছু
দেখার ইচ্ছাতে চলে গিয়েছেন। আমি একটা
কিছু দ্রুত খুঁজতে থাকি। চোখে পড়ে
মাটির উনুনের অর্থাৎ চুলোর মুখে পড়ে আছে আধপোড়া একটা ম্যাচের কাঠি। সেটাই হাতের
মুঠোয় চেপে ভুতের সন্ধানে ছুটতে থাকি।
মহসিন মিয়াঁদের বাড়ী ভর্তি পাড়া
গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে। উঠোন গোল করে
ঘিরে অনেক মানুষ, এঁদের ভিড়ে
কিছুতেই ভিতরে ঢুঁকে পুরো ঘটনা বুঝে উঠতে পারছি না। ওঝার হুংকার
কানে আসছে, 'নাম কি তোর', কোত্থেকে এলি?'
মহসিন মিয়াঁর চার হাত -পা' উঠোনের
মাটিতে বাঁশ পুতে তাতে দড়ি দিয়ে চার দিকে টান টান করে বাঁধা। 'ছাড় আমাকে, ছেঁড়ে দে
বলছি নুয়াখেলে মৌলবি !' এমন বলে
মোচড়াচ্ছে দড়ি ছিড়বার মতলবে। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেনা বলেই
আবার চেঁচাচ্ছে। খুলে দে, জলদি খুলে দে বলছি মইলবি, তোর
গুষ্টি ধ্বংস কইরে দিবানে, আমারে আগে
খুইলে দে বলতিছি। ‘
মৌলবি বলছে, ‘বানদিছি তোর
দোষে ! এমনিই কি খুইলা দিবো?
তুই জলদী জবাব দে, ভালোয় ভালোয় ! নাইলে কঠিণ শাস্তি পাবি কইলাম ! ‘
আমি এর গায়ের ফাঁক ওর গায়ের ফাঁক
দিয়ে দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ভিতরে ঢুকতে চাইছি। এতো জমাট
ভিড় যে কিছুতেই পুরো শরীর নিয়ে ঢুঁকে যেতে পারছিনা জটলার
ভিতরের দিকে। জায়গা বদল
করে অন্য জায়গা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি, ভুতের কাণ্ডের
সম্মুখিন হতে, কিছুতেই পারছিনা।
মৌলবি সরিষা পড়ে হুম হুম করে
ছুঁড়ে মারছে ভুতের শরীরে লেগে- মাগো ! বাবাগো ! বলে চীৎকার দিয়ে উঠছে।
'একবার ছাড়া পাই, মৌলবি তোর চৌদ্দ পিড়ি সাফ করে দেবো, দেখে নিস !
আমারে
জলদি যেতে দে, শেষ বারের
মতো কলাম। ''
এসব শুনে অবাক হয়ে 'ভুতেধরা
মানুষ ' দেখছিলাম।
এবার গায়ের জোর দিয়ে ঠেলে ঠুলে
ভুতে ধরা মহসিন মিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। চোখ বড় বড়
করে সে নুয়াখেলে’
মৌলবির দিকে চেয়ে
আছে, সারা
শরীরে উঠোনের ধুলো কাঁদায়
মাখামাখি।
খালি শরীরে বেশ
জখমের টানা হেঁচড়ার দাগ। একটা নীল রঙের
চেক লুঙ্গি পরা মোহসিন মিয়ার করুণ দশা। ভুতের
উপর মনেমনে একটু রাগ হয়, কি দরকার বাপু এই খেঁটে খাওয়া লোকটাকে হেনস্থা
করার? ভুতে এর কাছে কি চায়? কেনোই বা এই
আছর’ করা? এটাকি
আসলেই ভৌতিক কিছু, নাকি রোগ
ব্যারাম জাতীয় কিছু হবে। এসব চিন্তার
মাঝখানে ভুতের আলৌকিক ক্ষমতা দেখার লোভও
সংবরণ করতে পারছিনা। যাহোক, সেটাও যাচাই করে দেখার ইচ্ছেতেই –
মনে সাহস সঞ্চার করে বলি, 'আচ্ছা 'মহসিন মামার
ভুত', বলেন তো দেখি
আমার হাতের মুঠোয় কি?'
আমি মহসিন মিয়া থেকে চার পাঁচ ফুট
দূরে দাঁড়ানো।
মামা বাড়ীর রান্নাঘর থেকে নিয়ে
আসা পোড়া ম্যাচের কাঠির কথা আমি ছাড়া দুনিয়ার কেউ জানেনা। বাড়ীতে সে সময় আমি ছাড়া কেউ ছিলোনা। রান্না ঘরের
মেঝে থেকে কাঠিটা কুড়িয়ে
নিয়ে আমি মামাদের উঠোন পেরিয়ে মশিয়ার মামাদের বাড়ীর উপর দিয়ে গোলা ঘরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে,খোকাদের গোয়াল ঘর পার
হয়ে - মোহসিন মিয়াঁদের উঠোনে এসে পৌঁছেছি। তখন আমার
সাথে কেউ ছিলোনা।
আমার হাতের ভিতরে ছোট্ট পোড়া
ম্যাচের কাঠির কথা ঘুণাক্ষরেও
তাঁর জানবার কথা নয়।
মোহসিন মিয়া’ - সেতো উঠোনে চিত হয়ে শোয়া, যার চার হাত
-পা' চারদিকে
খুঁটিতে বাঁধা।
এসব কথা অতিক্রম করে দিয়ে
ভুত মশাই
- খেঁকিয়ে বলে ওঠে, 'ধুত ছেমড়ি' !
‘ম্যাচের পুড়া কাঠি নিয়ে একেনে ফাইজলামি মারতি এসেচো?'
আমি তো -
ভীষণ রকমের অবাক !
আরো অবাক
ভূতের সঠিক ‘আন্দাজ’ করতে পারার
এমন আলৌকিক ক্ষমতা
দেখে !
এখোনো যা কিনা মনে মনে ভাবিয়ে তোলে, এ কি করে সম্ভব?
হাসিদা মুন