>

ঐশী দত্ত

SongSoptok | 6/15/2015 |





          ()
আজ সকালে রাস্তার পাশের একটি ডোবা থেকে এক কিশোরীর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ ।
এই খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে শহরে ।এর মধ্যেই মৃতদেহকে ঘিরে সাংবাদিকদের কৌতূহল ও ডাক্তারের ময়নাতদন্ত এই দুয়ের আড়ালে পড়ে আছে ধর্ষিতার মুখ। হালকা তুলোর মতো এই শোক, বাতাসে দোল খেতে খেতে ভেসে গেল শহর থেকে গ্রামে ।


        ()

গ্রামে এখন গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরম। রোজকারের মতোই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ঘোষবাড়ির তনিমাও দুপুরের রান্নায় মেতে ওঠেছে । আজ দুপুরে কই মাছের ঝোল রাঁধতেই হবে তাকে। নিজেদের বিল থেকে এই মাছ ধরেছে তার ভাই। ভাই দোকানে যাওয়ার সময় বারবার বলে গেছে, "মেজদি তো আয়বো আইজ, তাই কই মাছ রাঁনধো বড়দি" হঠাত্‍ মোবাইলের রিংটোন শুনে, রান্নাঘর থেকে দৌড়ে গেল তনিমা।

-হ্যালোও কেডা?
-আমি কোতয়ালী থানা থেকে বলছি।
-কই থিক্যা?
-থানা থেকে পুলিশ সাঈদুর কবির বলছি।
-ওহ, কেইলাইগা করছেন?
-এটা কি বাবুল ঘোষের নাম্বার?
-, বাবা তো বাড়িত নাই। আমারে কইতারুইন কী দরকার।
-একটু জরুরী থানায় আসতে হবে তাঁকে। তাঁর মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে আজ সকালে।

তনিমার মুখ শুকিয়ে গেল এই খবরে ! বুকের ভেতরটা দোমড়ে মোচড়ে ভেঙে যাচ্ছে । নিঃশ্বাস নিতে বড্ডো কষ্ট হচ্ছেএইরকম একটা সকাল কখনোই আশা করেনি ! ফোনসেটটা টেবিলের উপর রেখে, কলতলায় চলে গেল । চোখেমুখে  জল দিয়ে নিজেকে  সতেজ প্রমাণ করার আর কোন পথ খোলা নেই তার ।আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে হাজারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল নিজের দিকে । আজ শুধু নিজের ওপর রাগ কীভাবে এই খবরটা নিজের বাবা ও ভাইকে দিবে ভেবে পাচ্ছে না । বাবা তো আগেই বলেছিল,
"এলহা কইরা মেয়েডারে শহরে দেইছছনা, গেরামে যে ইসকুল আছে ঐডাতই পড়ুক। যে পর্যন্ত পড়তারে পড়বোনে" বাপকে অনেক বুঝিয়ে তনিমাই তার আদরের বোনকে শহরে পাঠিয়েছিল । নিজে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পারেনি তাই বোনের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে এই কাজটা করেছিল । কে জানতো তার বোনের ভাগ্যে এই পরিণতি !


তনিমার জীবনে আরো একটি সূর্যাস্ত। প্রথম সূর্যাস্ত ঘটেছিল যখন তিন ভাইবোনকে রেখে তার মা চলে গিয়েছিল । সে কী কষ্ট তাঁদের ! তখন এই ঘোর বিপদে কোন আত্মীয় স্বজন তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি শুধু বড়মামা ছাড়া ।  নিজের আপন এক কাকা তিনি থাকেন শহরে । তনিমা মায়ের শ্রাদ্ধের খরচের জন্য গিয়েছিল, টাকা দেয়া তো দূরের কথা, বাসায় একটু জলও খেতে দেয়নি সেইদিন। সেদিন থেকেই তনিমার মনে এক আকাশ ক্ষোভ আর অভিমান । আর এই ক্ষোভ থেকেই বোনকে শহরে পাঠিয়েছিল। বোন পড়ালেখা করে বড় হবে, বড় একটা চাকরি করবে এই আশায়।
         

 ()

শহরের হাসপাতালগুলোতে সবসময় খুব ভয় করে তনিমার । নিজের মা কে নিয়ে অনেকদিন কাটিয়েছে সরকারী হাসপাতালে । হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার প্রায় একমাস পর্যন্ত ওর নাকে শুধু ওষুধের গন্ধ লেগে থাকতো । কী ভয়ানক দিন ছিল ঐগুলি ! আজ অনেক দিন বাদে আবারো সেই হাসপাতালে সে ।
তবে এইবার সরাসরি মর্গের দিকে তার পা ! এইতো এটাই তার আদরের বোনের মুখ । পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিরশির করে উঠল । বোনের মৃতদেহের দিকে হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিল সে। হুহু করে কেঁদে ওঠলো মন !-না না এইডা হতে পারেনা ঠাকুর। এ যেন ঈশ্বরের প্রতি তীব্র এক কষ্ট ছুঁড়ে দেওয়া । সেইসাথে তনিমার চোখ জ্বলছে ক্ষোভের আগুনে। চোখ জুড়ে আজ শুধু লাল আর তার বুকের যন্ত্রণার উচ্চশব্দে কাঁপছে শ্মশাণের আগুন । বড় বেশি আওয়াজ হচ্ছে..তার বোনের মৃতদেহ পুড়ছে...সেইসাথে তনিমার মন পোড়ছে... ভোরবেলায় মানুষ পোড়া গন্ধে গ্রামের পরিবেশ আরো ভারী হয়ে গেলেও পুলিশের কাছে ধর্ষকের কোন খোঁজ মেলেনি এখনোও ।

        ()

সকাল থেকেই ঘোষ বাড়িতে লোকজন । চারদিক থেকে নানারকম কথা । কেউ কেউ সমবেদনা জানাচ্ছে আবার কেউ কেউ নিন্দে করছে । সবার মাঝ থেকে গ্রামের সম্মানিত ব্যক্তি লিয়াকত হোসেন এগিয়ে গেলেন ।-মেয়েরে শহরে দেওনের কী দরকার ছিল বাবুল? পর্দা ছাড়া ঘুইরা বেড়াইলে এইরহম তো অয়বোই । যে মেয়ের চরিত্র ভালা না, হের লাইগা কাইন্দা কী লাভ? চুপচাপ  থাহো। আল্লার কাছে মেয়ের লাইগা ক্ষমা চাও। এই কথা শুনে বাবুল ঘোষের চোখের জল হঠাত্‍ স্তব্ধ হয়ে গেল । নিজের বাবার এই অসহায়তা দেখে তনিমা বিছানায় উপুড় হয়ে খুব কাঁদছে । শরীর থেকে মন কোথায় জানি ছিটকে সরে গেছে। বুকের ভেতর অদ্ভূত এক চাপ বাড়ছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই বেড়ে চলছে । বোনের মুখটা বারবার ভেসে ওঠছে মনে ।
'-কেডা করলো এমন পৈশাচিক কাজ? ঠাকুর একটাবার তার লগে আমারে দেহা করাইয়া দাও।' এই একটা প্রশ্ন তনিমার মনে তোলপাড় করে যাচ্ছে সবসময় ।


   ()

হঠাত্‍ সন্ধ্যার দিকে গ্রাম জুড়ে হৈচৈ। কিন্তু বাইরে বের হয়ে কোনকিছু জানার আগ্রহ আর নেই তনিমার ! হঠাত্‍ ছোট ভাই তার কাছে দৌড়ে এল,

-এ দিদি, গেরামে পুলিশ আয়ছে। -হু কার বাড়িত?-ঐ যে শয়তান লিয়াকত আছে না, তার বাড়িত। -ক্যান?
-হের ছেরা যে ডা, শহরে পড়তো। হেইডা নাকি এক মেয়েরে মাইরালছে । পুলিশ হেরে সন্দেহ
করছে।
-! বুঝছি। লাভ কি ধইরা? আইজ বাদে কালকাই ছাড়াইয়া নিয়া আয়বো।
-না অত সহজে নাকি পারতো না! ইসকুলের নাইমুর স্যার কয়ছে। এইডা নাকি অন্যরহম কেইস!
-কী রহম? তর দিদির লাহান?
-, স্যার তো তাই কয়লো । আইচছা দিদি, আমগর দিদিরডা কী ধরা পড়তো না?
-না রে ভাই। আমগর তো অত টেহা নাই। হের উফরে আমরা তো হিন্দু । তর দিদি তো মানুষ না,
 তর দিদি তো হিন্দু ! দেখছস না, ঐদিন টিভির খবরে কী কয়ছিন!
-কী কয়ছিন দিদি?
-এই তো "শহরে এক হিন্দু মেয়েকে গণধর্ষণ" !
হু বলে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ভাই ও বোন।

.
পরেরদিন টিভিতে ব্রেকিং নিউজ "কিছুদিন আগে এক হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণের অপরাধে, ধর্ষককে গ্রেপ্তার"
থানা থেকে পুলিশ সাঈদুর কবির এই খুশির খবরটা দেওয়ার জন্য, খুব সকালেই চলে আসেন ঘোষ বাড়িতে ।উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে ডাকলেন -বাবুল ঘোষ বাড়িতে আছেন? বারবার ডাকার পরেও কোন সাড়াশব্দ নেই ! পাশের বাড়ির নাদিরার বাপ এসে বললো, বাবুল ঘোষ তার পরিবার নিয়ে, বাড়িঘর ছেড়ে ভোরে চলে গেছেন! কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলেন পুলিশ ! ভয়ের মুখে আরো একটি পরিবার দেশ ছাড়লো ।



[ঐশী দত্ত]

Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.