হেরিটেজ ভিলেজ “রঘুরাজপুর”
ভারতের
সাংস্কৃতিক পটে ‘রঘুরাজপুর’ গ্রাম একটি মাস্টার স্ট্রোক বললে
অত্যুক্তি হবে না। অতুলনীয় শৈল্পিক ঐতিহ্য এবং সবুজ নারকেল গাছের ছায়ায় শিল্পীদের
নিরাঢ়ম্বর বাসস্থান অথচ তাদের হাত থেকে নির্গত
শিল্পকলার নৈপুন্যতা সত্যি না দেখলে বোঝান যায়না ।
নারকেল,তাল,আম,কাঁঠাল...পানের বরজের সঙ্গে সবুজ ধান ক্ষেতের এক
বৈচিত্র্যপূর্ণ শোভা বর্ধক চিত্রপট শিল্পীর ক্যাপশনে তুলীর টান যেন লীলাময় জগন্নাথ
মহাপ্রভুর অস্তিত্ব প্রত্যেক শিল্পে বিদ্যমান। এই সরল শান্ত মনোরম পরিবেশ প্রতিটি
পরিবারের পূর্বপুরুষদের শিল্পের উত্তরাধিকার পৃষ্ঠপোষকতার এক নিদর্শন । শুকনো তাল
পাতার ওপর বহু পুরাতন শিল্পকলা , প্রস্তরের ওপর শিলালিপির ভাস্কর্য
এবং সুন্দর প্রস্তর মূর্তি , কাষ্ঠ শিল্প এবং ভাস্কর্য ,
এপ্লিকের কাজ ইত্যাদি এই গ্রাম থেকে বিভিন্ন দেশ বিদেশে হস্তশিল্প
সামগ্রী হিসেবে রপ্তানি হয় ।
পাশা
পাশী গোটিপুও এবং গুরুকুল একাডেমী নাট্য গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রর সৃষ্টি ওড়িশি
নাচের ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে এক সাধনা স্থল । গ্রামের ঘরগুলি সারি সারি গায়ে লাগান একে
অপরের মুখ মুখি জগন্নাথ সংস্কৃতির একটি ধর্মীয় বাতাবরণের মাধ্যমে সঞ্চালিত হয় ।
এনাদের প্রত্যেক কলাকৃতি জগন্নাথ সংস্কৃতি সম্পন্ন বার্তার এক মাধ্যম
। উড়িষ্যার
,
পুরী জেলার ‘রঘুরাজপুর’ গ্রাম
কলা ভাস্কর্যের এক পীঠস্থান। ভুবনেশ্বর থেকে পুরী যাওয়ার পথে NH 203 এ পুরীর প্রায় ৮ কিলোমিটার আগে চন্দনপুর নামে একটি ছোট্ট যায়গা পড়ে ।
চন্দনপুর থেকে ভার্গবী নদীর ধারে চন্দনপুর বাজার এর পাশদিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলেই দেখবেন লেখা আছে “Way
to Heritage village Raghurajpur 1.5 K.M. ->” ওই ছোট্ট
রাস্তা রঘুরাজপুর গ্রাম অবধি চলে গিয়েছে । এখন ওই রাস্তা পাকা হয়ে
গিয়েছে তাই পর্যটকদের স্রোত ছোটে ওখানে যাওয়ার জন্য , বিশেষ
করে বিদেশী পর্যটকদের । ভুবনেশ্বর থেকে রঘুরাজপুর ,
এন।এচ।২০৩ ধরে গেলে প্রায় ৫২ কিলোমিটার। এখন ছয় লেনের রাস্তা হওয়াতে
কারে কিম্বা ট্যাক্সিতে মাত্র ১ ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা
২০ মিনিট সময় লাগবে। যারা ট্রেনে যেতে চান তাদের জানকাদেইপুর (চন্দনপুর) ষ্টেশন
নামতে হবে । ভুবনেশ্বর থেকে ট্রেনে গেলে
একটি ছোট্ট প্যাসেঞ্জার হল্ট ষ্টেশন ,
নাম - জানকাদেইপুর(চন্দনপুর) এ নেমে ওখান থেকে হাঁটা পথে যাওয়া যায় ।
নারকেল গাছের ছায়ায় ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামটি কলা ভাস্কর্যের এক পীঠস্থান বললে
অত্যুক্তি হবে না। এখানকার কলা কুশলীরা তাদের
কলা এবং ভাস্কর্যের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। এই গ্রামে নাট্যগুরু
পদ্মবিভূষণ ঈশ্বর কেলুচরন মহাপাত্র মহাশয়ের জন্ম যিনি ওড়িশি নৃত্যকে
সারা বিশ্বে পরিচিত করান তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং একাগ্রতার জন্য। ঈশ্বর মাগুণী
চরণ দাস , গোটিপুও নাচের গুরু ।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত
থেকে ওড়িশি নাচ শিখতে ছাত্র ছাত্রী আসেন রঘুরাজপুরে এবং সেখানে
থেকে নাট্য শিক্ষা করেন। নাট্য গুরু কেলু চরণ মহাপাত্রর দেহ অবসানের পর এখন সেরকম
ছাত্র ছাত্রী আসেন না।
কেন্দ্র সরকারের পর্যটন বিভাগ রঘুরাজপুর
গ্রামকে “হেরিটেজ ভিলেজ” আখ্যা দিয়েছেন এই গ্রামের
কলা এবং ভাস্কর্যের শিল্পীদের বিভিন্ন কলা কীর্তি দেখে। ইন্টাক INTACH, ( Indian National Trust for
Art and Cultural Heritage) ১৯৯৮ সাল থেকে এই
রঘুরাজপুরের ওপর তথ্য চিত্র প্রদর্শন করে । ২০০০ সালে এই গ্রামটি কেন্দ্র
সরকারের পর্যটন বিভাগ রঘুরাজপুর গ্রামকে “হেরিটেজ ভিলেজ” আখ্যা দিয়েছেন এই গ্রামের কলা এবং ভাস্কর্যের
শিল্পীদের বিভিন্ন কলা কীর্তি দেখে। এই গ্রামের বিভিন্ন কলাকারদের জন্য ঘর এবং
পর্যটকদের জন্য
বিশ্রাম স্থল তৈরি হচ্ছে । নব-কলেবরের ২০১৫ আগে এটি পূর্ণ হেরিটেজ ভিলেজে রূপায়িত
হবে ।
ওই এক ই গ্রামে পৃথিবী প্রসিদ্ধ পট্ট চিত্র শিল্পীরা
পট্ট চিত্র তৈরি করে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও হেন্ডিক্রাফটসের স্টলের মাধ্যমে পট্ট
চিত্র বিক্রয় করে থাকেন। এ ছাড়া প্রস্তর মূর্তি , তালপাতার ওপর নানা চিত্র , কাগজের তৈরি মুখোশ , টসর পেইন্টিং ইত্যাদি
নানান হস্তকলা সামগ্রী প্রস্তুত করেন। শিল্পীদের গ্রাম হিসেবে এটি পৃথিবী
প্রসিদ্ধ। প্রত্যেক দিন বিদেশি পর্যটক রঘুরাজপুরে গিয়ে নানান সামগ্রী ক্রয় তথা
শিল্পীদের ভিডিও চিত্র তুলে নিয়ে-যান তাঁদের দেশে।
পট্ট
চিত্র কি?ঃ- তসরের কাপড়ের ওপর কিম্বা শুকনো
তালপাতায় পট-চিত্র তৈরি হয় । প্রথমে খড়ি এবং গাছের আঠা দিয়ে একটি প্রলেপ দেওয়া হয়।
এর রং সাদা । ওই সাদা রঙের পৃষ্ঠ-পটের ওপর হার্বাল রং তৈরি করে জগন্নাথের মন্দিরের
ভেতর আঁকা ছবি যেমন দশাবতার:-
মৎস্য
অবতার ,
কূর্ম অবতার , বরাহ অবতার , নৃসিংহ অবতার ,বামন অবতার , পরশুরাম
অবতার , রাম অবতার ,
কৃষ্ণ অবতার , বুদ্ধ অবতার , কল্কী অবতার । এ ছাড়া মথুরা বিজয় , অযোধ্যা বিজয় ,
শ্রী কৃষ্ণের রাস লীলা , বিভিন্ন দেব দেবীর
চিত্র যথা:- রাধা মোহন , গোপীনাথ , রঘুনাথ , লক্ষ্মীনারায়ণ
এবং গৌরাঙ্গ র চিত্র অঙ্কন হয়। সাধারণত ৪৪ ইঞ্চ চওড়া ৫৫ ইঞ্চ
লম্বা পটচিত্রের মূল্য ২৫৮৫ টাকা । এই চিত্র পাকা রঙ্গে তৈরি হয় তাই অনেক বছর
অক্ষুণ্ণ থাকে।
|
বসন্ত
উৎসব ঃ- ‘পরম্পরা’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বসন্ত উৎসবের
আয়োজন করেন । ফেব্রুয়ারি ৪ এবং ৫ রাজ্য সরকারের পর্যটন বিভাগের দ্বারা রঘুরাজপুরে
ওই উৎসব সরকারি সাহায্যে কুশলী এবং অন কুশলী গ্রাম্য কলাকারদের জন্য আয়োজিত হয় ।
কলাকারদের উৎসাহ বৃদ্ধি এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ।
ভারতের
অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যগত মত প্রকাশের ফর্ম, মৌখিক সাহিত্য,সঙ্গীত, নৃত্য, ক্রীড়া , পুরাণ, ধর্মানুষ্ঠান, পোশাক
এবং ভাস্কর্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে. এই ঐতিহ্য জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যগত
সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ঘনীভূত পদ্ধতিতে সঞ্চালিত যেখানে সাংস্কৃতিকে , অন্তর্ভুক্ত
করা হয়েছে. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, জীবিকা
এবং আয়বর্ধক কর্মকান্ডে সাথে সংযুক্ত করা হয় । এরই
এক প্রয়াশ পরম্পরা স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা । তাই রঘুরাজপুরের কলা
কুশলিরা আজ পরিত্যক্ত নন বরং তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার পথে উভয় কেন্দ্র সরকার এবং
রাজ্য সরকারের উদ্যম প্রশংসনীয় ।
[ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী]