টিভি দেখতে
দেখতে কখন চোখ লেগে গেছে খেয়াল হয় নি রমার। ঘুমের আমেজটুকও সম্পূর্ণ ছুটে গেল
দরজায় বেলের আওয়াজে। হাজার বার বলা সত্ত্বেও এরা কথা কানে তোলে না। রোবটা জড়িয়ে,
এলোমেলো অবিন্যস্ত চেহারায় দরজা খোলেন রমা, মেজাজটা তেতো হয়ে আছে। অবাক হয়ে দেখলেন,
একটি ঝাঁ চকচকে যুবক দাঁড়িয়ে আছে, মেগা ওয়াটের হাসি নিয়ে। “কি ব্যাপার? আমি কিন্তু
কিছু কিনতে রাজি নই।“ ছেলেটির হাসি তখনো ঝলমলে। চটপট বলে উঠল,“বৌদি আজ আপনার জলের
ফিল্টার চেক করার দিন, ভুলে গেছেন আপনি।।” আমরা প্রতি তিন মাসে একবার চেক করে যাই।
ঠিকে কাজের লোক চম্পার মা খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে এলো নিঃশব্দে। ওই
ছেলেটি থাকতে থাকতে রমা তার চাঁছাছোলা গলা বা কটু বাক্যমালা কিছুতেই মুখ থেকে বার
করবেন না। পাঁচবাড়ি কাজ করলে ঘড়ি ধরে যাওয়া আসা করা যায় না, এটা কোনো ফ্ল্যাটের
মালকিন বুঝতে চান না। রান্নাঘর জোড়া দেখে,
চম্পার মা ঘর মোছা শুরু করে। আড় চোখে দেখে, এতো অল্প সময়ের মধ্যেই বৌদি সালেয়ার
কামিজ পরে, চুল আঁচড়ে নিজেকে কিছুটা সাজিয়ে নিয়েছেন। টি ব্যাগ দিয়ে র টি বানিয়েছেন।
এই সব সাজসজ্জা চম্পার মার কাছে দৃষ্টিকটু হলেও বৌদি চলতি ফ্যাশানের অন্ধ ভক্ত,
মানান, বেমানানের ধার ধারেন না বিশেষ।
এইসময় সামান্য বেশি দুধ চিনি দিয়ে বেশিক্ষন ফুটিয়ে, বাসি
পাউরুটি বা হাত রুটি সহ দু কাপ চা পাওনা তার। সে জানে বউদি নিজে থেকে গরজ দেখাবে
না। আজ চা পাওয়ার আশা নেই। ফিল্টার কোম্পানির ছেলেটির সঙ্গে গলা বেশ কয়েক ধাপ নামিয়ে
কথা বলছেন বৌদি। রমার মেয়ে খুকুর এবার ক্লাস টেন।
মাধ্যমিকের বছর, রমা বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পৈতে সব নিমন্ত্রণ যথাসম্ভব বাঁচিয়ে চলেন
মেয়ের পরীক্ষার অজুহাতে। চম্পার মা ভাবতে থাকে, খুকুর বয়েসে প্রায় বছর তিনেক আগে
বেপাড়ার কিছু গুন্ডা চম্পাকে তুলে নিয়ে যায়। দিন সাতেক পর ফিরে এলেও তার মাথার
গণ্ডগোল দেখা দেয়। চম্পাকে মানসিক রোগের ডাক্তার দেখানো কিছুতেই হয়ে ওঠে না। দাদার
অনেক চেনাশোনা কিন্তু চম্পার ব্যাপারে করছি করব করেও ডাক্তারের কাছে ডেট পাওয়া হয়
না। চম্পা এমনি তে কাজ চালিয়ে নেয়, তবে মাঝে মাঝে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায়,
বস্তির পরিচিত লোকেরা খবর পেলে খুঁজে আনে।
প্রশ্ন করলে সঠিক জবাব পাওয়া যায় না, গুম মেরে বসে থাকে। চম্পার মার খেয়াল নেই, সে
একটা ঘরই মুছে চলেছে সাত রকম ভাবনা করতে করতে। বউদির গলা শুনে সম্বিত ফেরে।“ আমি
ফিল্টার পরিস্কার নিয়ে ব্যস্ত বলে কি তোমার কাজের কোন ছিরিছাঁদ থাকবে না? আধ ঘণ্টা
ধরে এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছ সে খেয়াল আছে? এখনি তো সৃষ্টির কাজ ফেলে, তড়িঘড়ি
পালাবে।” রাগ হলেও বউদির সতর্ক নজরের তারিফ না করে পারে না চম্পার মা। এখুনি কেমন
চটপট ম্যাগি নুডূল বা বেসনে ডুবিয়ে পাউরুটি ভেজে খুকুর জন্য রেডি রাখবে। খুকু এসেই ব্যাগ, জুতো ছুঁড়ে, টিফিন খাবে
কলকল করে কথা বলতে বলতে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু
অবাক হয় সে। রমাও একই সময় ঘড়ি দেখেন, বারান্দায় বেরিয়ে দুজনেই দেখতে পায় স্কুল বাস
থেকে নেমে গলি দিয়ে হেঁটে আসছে অন্য কিছু মেয়ে। অন্যদিন এরাই খুকুর সঙ্গী থাকে।
“যাও ত চম্পার মা একবার জেনে এসো খুকুর কথা ওরা কিছু জানে কি না? আমার হাত পা
কাঁপছে” চম্পার মা খোঁজ নিয়ে জানল ওরা
কেউই খুকু অর্থাৎ মউলিকে দেখে নি। চম্পার মা বলে, “দাদাকে একটা ফোন করে দাও, বউদি এসব ব্যাপারে দেরী হোলে... ।” কথা শেষ না হতেই বাড়ির ল্যান্ড লাইন টা বেজে ওঠে, রমা কাঁপা গলায় হ্যালো
বলতে ওপাশে একটা ভারী গলা শনা যায়। “মাদাম আমি
বালীগঞ্জ থানা থেকে বলছি। জুভেনাইল
স্কোয়াড।” জবাব দিতে গিয়ে, রমার কণ্ঠস্বর
খাদে নেমে যায়। চম্পার মা শুধু এইটুকু ধরতে পারে, যে খুকুর খবর পাওয়া গেছে। দ্বিধাগ্রস্থ
ভাবে জানতে চায় কি বললো থানার বড়বাবু।
“বলল আমার মাথা আর মুণ্ডু। মেয়ে নাকি মেট্রোর সামনে
অনেকক্ষন ঘুরঘুর করছিলো। পুলিশ তুলে নিয়ে
থানায় জমা করেছে। জুভেনাইল স্কোয়াডএর
এটাই কাজ। আমাকে মেয়ের বাবার সঙ্গে গিয়ে,
পরিচয় দিয়ে তবে ছাড়িয়ে আনতে হবে। যতো দুর্ভোগ কী আমার কপালেই জোটে? খুকু নাকি
কম্পিউটারে কোন বদ লোকের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচালি করছিলো। সেই শয়তানটার সঙ্গেই দেখা
করার জন্য মেট্রোরও বাইরে দাঁড়িয়েছিলো। পুলিস দেখে বদমাইশটা সরে পড়েছে। ঐ এলাকায়
এরকম, বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায়, পুলিশ নাকি কমবয়সী মেয়েকে একা ঘুরঘুর করতে দেখলেই আটক
করে মা বাবাকে ডাকছে। খুকুকে একবার হাতে পাই তারপর দেখো কি করি ওর।” রমা পায়ে চটী গলিয়ে, ঘরে
তালা দিয়ে রিক্সায় উঠতে যাবে তখন রাস্তায়
বেরিয়ে চম্পার মা আস্তে করে বলল, “খুকুকে বেশি
বকাঝকা করবেন নি যেন, আমার চম্পার
মত ঠাকুর না করেন ওরও যদি মাথার দোষ দেখা দেয়।” অন্য সময়
ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মউলির সঙ্গে চম্পার তুলনা চলে না, আজ আর রমার মুখে কোনও কথা যোগাল না। ফ্যাকাসে হেসে, যন্ত্র
চালিত পুতুলের মত রিক্সায় বসে বললেন, “চলো ষ্টেশন মোড়ে নামব।”
[রিমি পতি]