>

মিতুল দত্ত

SongSoptok | 6/15/2015 |




পরগাছা পর্ববারো

১৯৫১ সালে বাবা গোপালপুর পপুলার একাডেমিতে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয় তার বছর খানেকের মধ্যেই ঠাকুরদা, কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ি ছেড়ে নন্টু মিত্তিরদের মাটির চালাঘরে ভাড়া চলে আসেন সেখানে থাকতে বাবার আরও চার ভাইবোন জন্মায় তাদের মধ্যে প্রথমটি, জন্মের পরে পরেই মারা যায় বাকি তিনজন, চণ্ডী, দেবু আর মনা, এখন যে যার নিজের সংসারে রাজ্যপাট করছে এই রাজ্যপাটের গল্পও খুব মসৃণ নয় অনেক বাঁক, অনেক চড়াই-উৎরাই আছে এসব গল্পে অনেক স্বার্থপরতা, ঈর্ষা, চোখের জলের নুন লেগে আছে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে বাবার ভাইবোনদের আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না সবাই যেন কেমন ছাড়া ছাড়া যেন বহুকালেন পুরনো একটা সাদা কাপড়ের আটখানা আলাদা আলাদা টুকরো কোনওটা একটু বেশি ময়লা, কোনওটা একটু কম বাবা মাঝে মাঝে চেষ্টা করে টুকরোগুলো সেলাই করে জোড়ার পেরে ওঠে না বেচারা মাঝখান থেকে আঙুলে ছুঁচ ফুটে যায়, অনর্থক রক্তারক্তি ঘটে আগে তবু চাকরি ছিল, পয়সার জোর ছিল বছর কয়েক হল সেই জোরটাও নেই

নন্টু মিত্তির পরবর্তীকালে বাবার বড় ভগ্নীপতি হয়েছিল লোকটা ছিল একাধারে পাজির পাঝাড়া আর কিপ্টের হদ্দ এখনও অবিশ্যি বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি লোকটার সম্প্রতি বংশের ধারা অনুযায়ী আমার ছোটকাকার মাথা খারাপ হয়েছে সারাক্ষণ ভয় পাচ্ছে এর ছায়া, তার ছায়া দেখে বেড়াচ্ছে গোপালপুরে আমাদের বাড়িতে এখন থাকার মধ্যে আমার ছোটকাকা আর ঠাকুমা কদিন ধরে সেজপিসিও রয়েছে ঠাকুমার দেখভালের জন্য কাছাকাছি নিজের লোক বলতে একমাত্র বড়পিসিরা নন্টু মিত্তির একবারও বলে না, কদিন নাহয় আমার বাড়ি এসে থাকো অথচ অত বড় বাড়ি, খাঁ খাঁ করছে, ছেলেরা বাপের মর্জিমাফিক চলতে না পেরে সরে গেছে যে যার মতো বাপ মনে হয় তাতে খুশিই খরচা কমল আগে যখন গোপালপুর যেতাম, এক-আধবার যেতে হত ওদের বাড়ি কখনও বাতাসা, কখনও কদমা, কখনও দু-এক কুচো নিমকি জুটত কপালে দুপুরের ভাত তো দূরস্থ বাবা মাঝেমধ্যেই ঠাকুমাকে দেখতে যায় এখন মা পইপই করে বড়পিসির বাড়ি যেতে বারণ করে বাবা তবু যাবেই ছেলেবেলার বন্ধু বলে কথা ঘন্টার পর ঘন্টা বকবক করে দুজনে ছেলেগুলো মানুষ হল না, পয়সাগুলো জলে গেল, জামাই একটা খোঁজও নেয় না, এইসব সংসারের হিসেবের গপ্পো কোনওরকমে হয়তো এককাপ আদা দেওয়া চা, মিস্তিরিদের কাপে করে দেওয়া হল বাবাকে আমার বাবা তাতেই খুশি একদিন সিঙাড়া খাইয়েছিল সে গল্প বাবা যে কতবার করেছে

১৯৫৭- বাবার স্কুল ফাইনাল আর ১৯৮৮-তে আমার মাধ্যমিক তাহলে হিসেব অনুযায়ী আমি আমার বাবার থেকে একত্রিশ বছরের ছোট তাহলে, এখন আমার বয়েস বত্রিশ বছর হলে বাবার বয়েস কত? এসব অঙ্ক আমাদের ক্লাস টু-তে কষতে হত এখন বোধ হয় পেট থেকে পড়েই কষতে হয় নিজের তিনগুণ ওজনের ম্যাথস, হিস্ট্রি, সায়েন্স, জিওগ্রাফি, সোশ্যাল স্টাডিজের বোল্ডারভর্তি ব্যাগ নিয়ে বাচ্চাগুলো যখন স্কুলে যায়, মনে হয় যেন কোনও দুর্গম পাহাড়ি রাস্তার কুলি যেন জীবনে আর শিরদাঁড়া সোজা হবে না তাদের আমি স্কূলে ভর্তি হয়েছিলাম -বছর বয়েসে, ক্লাস ওয়ানে এখন বাচ্চা পেটে থাকতেই বাপ-মা তার স্কুল আর কেরিয়ারের জন্য পারলে নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দেয় আমাদের এক দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি, তার মেয়ের বয়েস তিন বছর এখন থেকেই মেয়ে সুইমিং পুলে যায়, অখাদ্য স্বাদের পুষ্টিকর আর ফ্যাটহীন খাবার খেয়ে বড় হচ্ছে আলাদা আলাদা ফিজিশিয়ান, ডায়টেশিয়ান, বিউটিশিয়ান, অমুক শিয়ান, তমুক শিয়ান, অষ্টপ্রহর ঘিরে আছে তাকে কী, না মেয়ে মডেল হবে দিনকাল কী হয়ে গেল আমার দিদা বেঁচে থাকলে হয়তো ছড়া কাটত, কালে কালে দেখব কী আর / জাঙিয়া নেই, কোটের বাহার!

যে কথা বলছিলাম, ১৯৫৭ সালে বাবা স্কুল ফাইনালে বসে সিট পড়েছিল ধান্যকুড়িয়ায় সেই সময় সকাল আটটা থেকে পরীক্ষা শুরু হত চলত বেলা এগারোটা অব্দি ধান্যকুড়িয়াতে ছিল গাইনদের বাগানবাড়ি, বল্লভদের মার্বেল প্যালেস আর সাউদের বাগানবাড়ি সাউদের এই বিশাল বাগানবাড়িতে অস্থায়ী বোর্ডিং করে থাকতে দেওয়া হয়েছিল পরীক্ষার্থীদের বাবাকেও থাকতে হয়েছিল সেখানে

স্কুল ফাইনাল পাশ করে বাবা আবার চলে আসে দত্তবাগানে মামার বাড়িতে বিদ্যাসাগর কলেজে আই এস সি-তে ভর্তি হয় এরপরেই শুরু হয় কলেজের মাইনে বাড়ানোর প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন বাবাও হাল্কাভাবে জড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলনে সেইসময় কলেজে পরীক্ষা চলছে বেঞ্চ ভেঙে, প্রশ্নপত্র ছিঁড়ে, পরীক্ষা ভণ্ডুল করে দিয়েছে ছাত্রেরা পরীক্ষার নাম করে বাবাও বেরতো রোজ বাড়ি থেকে, মিছিলের সঙ্গে ধর্মতলায় জমায়েত অব্দি হাঁটত সেখানে শুরু হত বিক্ষোভ, জ্বালাময়ী বক্তৃতা, আর শেষমেষ পুলিশের আবির্ভাব, ধরপাকড় প্রতিদিন 'য়ে 'য়ে ছাত্র গ্রেপ্তার হত পুলিশ আসার আগেই কেটে পড়ত আমার বাবা কোনওদিন কোনও ঝুটঝামেলায় নেই লোকটা একদিন শুধু রাত 'টা পর্যন্ত ছিল জমায়েত তাতেই বাড়ির লোকের কী দুশ্চিন্তা

[মিতুল দত্ত ]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.