(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -৭
সাক্ষীগোপাল
ডাঃ গৌতমের তো জয়জয়কার চারিদিকে।
একেবারে ছ ছ’খানা ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ আবিস্কার করে রীতিমত হিরো হয়ে গেছেন। একদিন
তাঁর এক বন্ধুর একটা কেস নিয়ে তাঁকে কোর্ট বা আদালতে যেতে হয়েছিল।
বন্ধুর একখানা দামী জিনিস চুরি
হয়েছিল। তা বন্ধুর সৌভাগ্যে কিংবা চোরের দুর্ভাগ্যে একজন দেখে ফেলেছিল সে চুরির
দৃশ্য। লোকটা আর কেউ নয় রোজ ভোরে যে বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ দিতে আসে সেই টুকাই।
চোরটা নলীনবাবুর জানলার গ্রিল খুলে জিনিসটা নিয়ে পালাতে যাবে এমন সময় সেখানে কাগজ
ফেলতে চলে আসে টুকাই।
চোর হল পেয়ারা বাগানের ভজা। একটা
চায়ের দোকানে কাজ করে আর সকলের অগোচরে এই অকাজ করে। এমন কৌশলে হাত সাফাই করে যে
শিবের বাবাও টের পায় না। কিন্তু টুকাই তো শিবের বাবা নয়। সোজা গিয়ে ব্ল্যাক মেলিং
করতে লাগল ভজাকে। যদি বিক্রি করে যা দাম মিলবে তার অর্ধেক টুকাইকে না দেওয়া হয় তো
পুলিশ আর নলীনবাবুকে সব বলে দেবে।
ভজা কেয়ারই করল না। মাল সে এমন
জায়গায় হাপিস করে দিয়েছে যে শিবের বাবাও টের পাবে না। টুকাই গিয়ে বলল নলীনবাবুকে।
আরও বলল যদি দরকার হয় তো পুলিশ কিংবা আদালতে গিয়ে সাক্ষী দিতেও সে রাজি।
নলীনবাবু আর পুলিশ দুজনেই খুশি।
বেশ হাতে-গরমে সাক্ষী পাওয়া গেল। কেস একেবারে জলের মত সহজ হয়ে গেল। চোর এবার আর
যাবে কোথায়? মালও উদ্ধার হবে।
চোর ধরা পড়ল কিন্তু মাল উদ্ধার হল
না। সেটা পাচার হয়ে গেছে যেখানে হবার। ভজাকে আদালতে তোলা হল। প্রধান সাক্ষী
টুকাইকেও তোলা হল কাঠগড়ায়। প্রত্যক্ষদর্শী মানে আই উইটনেস। এবার জেলের হাওয়া খাওয়া
থেকে বাঁচতে হবে না আর বাছাধনকে।
জেরায় টুকাই বলল, আমি তো ভজাকে
চুরি করতে দেখি নি হুজুর। চোর কি কাউকে দেখিয়ে দেখিয়ে চুরি করে বলুন ধর্মাবতার?
ভজা খালাস। নলীনবাবুর গালে হাত আর
পুলিস হতভম্ব। পরে একটু খোঁজ নিয়েছিলেন ডাঃ গৌতম। যত যাই হোক বন্ধুর ব্যাপার কিনা।
আসলে মাল বিক্রির সিকি দামের ওপরেই রাজি হয়ে গেল টুকাই।
পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা আর কি। তাই সাক্ষী বেগড় বাঁই।
খুব দুঃখ পেলেন ডাঃ গৌতম। শুধু
বন্ধুর ব্যাপার বলেই নয়। আদালত একটা পবিত্র সত্যের জায়গা। এখানে কিনা সত্য এভাবে
বিক্রি হয়ে যাবে মিথ্যের কাছে আর অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাবে?
আর একটা কেস। খুনের কেস। রাম খুন
করেছে শ্যামকে। খুনী ধরা পড়ল। সাক্ষীও পাওয়া গেল। এবারেও একেবারে প্রত্যক্ষদর্শী।
কিন্তু আদালতে বিগড়ে গেল সাক্ষী। বলল, না না হুজুর এ লোকটাকে আমি চিনিই না। পুলিশ
ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে।
পরে জানা গেল আদালতে যাওয়ার আগের
দিন সাক্ষীর বাচ্চা ছেলেকে কিডন্যাপ করেছিল খুনীর সাগরেদরা। ছেলের মরণ আর কোন বাবা
চায়? সুতরাং খুনী বেকসুর খালাস। যেমন সিনেমায় দেখা যায় আর কি।
আর একটা ঘটনা। খুনী কিছুতেই ধরা পড়ছে না। কাগজ আর টিভিতে
এমন কি ফেসবুক টুইটারে অনেক সমালোচনা
সরকার আর পুলিশের। বাধ্য হয়ে পুলিশ একজনকে ধরল। সে বেচারি
রাস্তায় বাদাম বেচছিল। তাকে মারতে মারতে লক আপে ঢুকিয়ে দিল। পরের দিন আদালতে। সে
বেচারি তো ভেবেই অস্থির কোথা থেকে কি হয়ে গেল। মশা মারতে মনে কষ্ট হয় বলে হাত নেড়ে
উড়িয়ে দেয় তো সে করবে মানুষ খুন?
কিন্তু গরিব লোকের আর দামী উকিল কি
করে হবে? সস্তার এক উকিল তার কানে ফিসফিস করে বলল, যা বলছি কর। দোষ স্বীকার করে
নাও। ফাঁসি না হয়ে যাতে যাবজ্জীবন হয় সেটা আমি দেখছি। চোদ্দটা বছর আর তোমায় রোদ্দুরে
ঘুরে বাদাম ভাজা বেচে পেটের দানা পানি জোটাতে হবে না। ওরা কিন্তু জব্বর সাক্ষী
কিনেছে বলে দিলুম।
কিন্তু লোকটা রাজি নয়। কেঁদে বলল,
আপনি জজসাহেবকে একটু বুঝিয়ে বললেই হবে স্যার। পুলিশ আমাকে শুধু শুধু ধরে এনেছে।
পুলিশের সেই কেনা সাক্ষী তো দিব্বি
সাক্ষী দিল। বাদাম ভাজার উকিল কি যে সব বলল তা কেউ শুনতেই পেল না। লোকটার শাস্তি
হয়ে গেল। কিছুদিন পরে অবশ্য আসল খুনী ধরা পড়ল বিহার পুলিশের হাতে। বাংলার পুলিশ
বিহার পুলিশকে বলল, চেপে যান মশায় চেপে যান। ওসব এখানে চুকে বুকে গেছে। ও ব্যাটাকে
বরং অন্য কোনও কেসে ঢুকিয়ে দিন।
বিহার পুলিশ বলল, সে কি –
বাংলা পুলিশ বলল, মিডিয়াকে তো
জানেন না। একেবারে ঠুসে দেবে আমাদের আসল কথা জানতে পারলে।
বিহার পুলিশ বলল, বুঝেছি আর বলতে
হবে না।
ফোন রেখে সেই “আসল খুনীর” নামে
চার্জ শীটের ফাইল তৈরি হল। সে বাদাম ভাজায় ছোলাভাজা ভ্যাজাল দিয়েছে। সোজা adulteration in food –এর কেস। খুনী আদালতে বলল, হুজুর আমি তো
বাদাম ভাজতেই জানি না। আর ছোলা ভাজতেও পারি না। তা দুটোকে মেশাবো কেমন করে বলুন?
আমি তো বাড়ী বাড়ী ছুরি কাঁচি ধার দিয়ে বেড়াই।
সুতরাং কেস ডিসমিস। বিহার পুলিশ যা
পেল বাংলাকে তার অর্ধেক চালান করে দিল।
এবারেও খুব দুঃখ ডাঃ গৌতমের। হায়
হায় বেচারা নিরীহ নির্দোষ বাদামভাজাওলার প্রাণটা বাঁচলেও জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল। চোদ্দটা
বছর জেলের ভেতরে কাটবে।
ডাঃ গৌতম শুধু ভেবেই চলেছেন আর
ভেবেই চলেছেন। সত্যিই তো আদালতে দুটো জিনিস খুব দরকার। একটা হল সাক্ষী আর একটা হল
প্রমাণ। তা প্রমাণ জোটাতে পারলেও সাক্ষী যদি অস্বীকার করে? আবার সাক্ষী যদি
বেমালুম মিথ্যে কথা বলে? গীতা কোরান বাইবেল হাতে ছুঁইয়েও তো সাক্ষীরা বেমালুম
মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে। এর একটা বিহিত যদি না করতে পারেন তো তিনি কিসের ডাঃ গৌতম?
অতএব আবার সেই সিনথেটিক বটগাছের
নীচে লাল মেঝেতে বসা। আবার সেই ধ্যান। আর ছ মাস পরে যেন ‘অন্য এক ডাঃ গৌতমের’
আবির্ভাব। মাথার মধ্যে যার সপ্তম ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় দিন
গুনছে।
ছ’ মাস পরে আবার এক সাংবাদিক
সম্মেলন। এবার আর প্রেস ক্লাবে নয়। ওখানে অত জায়গা নেই। হচ্ছে ডাঃ গৌতমের বাড়ির
বাগানে যেখানে অঢেল জায়গা। ডেকরেটর ডেকে বানানো হয়েছে একটা অস্থায়ী আদালত কক্ষ।
সাংবাদিকরা সব দর্শকের আসনে। বিচারক, উকিল, সাক্ষী, পুলিশ। আসামী সব নকল। আদালতের
একটা নকল দৃশ্য আর কি।
সাক্ষীরা সব এসে শপথ নিয়ে সাক্ষ্য
দিচ্ছে।
সরকার পক্ষের উকিল (আসামিকে
দেখিয়ে), বলুন তো এই লোকটিকে আপনি চুরি করতে নিজের চোখে দেখেছিলেন কিনা?
সাক্ষী (চোখ পিটপিট করে আসামিকে
দেখে নিয়ে), না হুজুর, আমি কিছু দেখি নি। চোর কি কাউকে দেখিয়ে দেখিয়ে চুরি করে
হুজুর?
অমনি সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে একটা
যন্ত্র ক্যা ক্যা করে ডেকে উঠল, তুই মিথ্যে বলছিস, তুই মিথ্যে বলছিস, তুই মিথ্যে
বলছিস।
সাক্ষী তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
তোতলাতে থাকে, না হুজুর মিথ্যে বলছি না। একদম সত্যি বলছি।
যন্ত্র আবার চীৎকার করে বলে উঠল,
চোপ মিথ্যেবাদী কোথাকার!
বিচারক বললেন, এটার মানে কি
উকিলবাবু।
সরকারী উকিল বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা,
ইওর অনার। এই যন্ত্র হল এমন একটি যন্ত্র যা মানুষের বলা কথাটা সত্যি বা মিথ্যে
ধরতে পারে। সত্যি হলে যন্ত্র চুপ করে থাকবে কিন্তু মিথ্যে হলেই চেঁচাবে। ঠিক
যেমনটি এখন হল।
ডিফেন্স কাউন্সেল নাছোড়, এই যন্ত্র
যা বলছে তা ঠিক তার প্রমাণ কি? আমার সাক্ষীকে ভড়কে দিয়ে মক্কেলকে ফাসানোর চেষ্টা
করা হচ্ছে মি লর্ড।
বিচারক বললেন, অবজেকশন সাসটেনড।
আপনার যন্ত্র যে সত্যি কথা বলে তা প্রমাণ করুন।
পাবলিক প্রসিকিউটার এগিয়ে এলেন
যন্ত্রের দিকে। বললেন, সবার আগে জানতে হবে এটা কিভাবে কাজ করে। স্যার, এটা একটা উন্নত মানের কম্পিউটার যার মধ্যে আগে থেকে কিছু তথ্য
সেভ করা আছে যেগুলো আমাদের পুলিস, ফরেনসিক, পোষ্ট মরটেম রিপোর্ট থেকে তৈরি করা। আবার সাক্ষীদের বয়ান ও বিবৃতি এখানে নথিভুক্ত
করা হয়েছে।
সাক্ষীরা কাঠগড়ায় এসে যা বলবে তা এই
যন্ত্র মিলিয়ে দেখবে তার নিজের মধ্যে সেভ করা তথ্যের সঙ্গে। মিলে গেলে যন্ত্র চুপ করে থাকবে কিন্তু না মিললেই
চেঁচাবে একটু আগে যেমন চেঁচাল। এমন কি স্যর, পোষ্ট মরটেম যিনি করেছেন বা যিনি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তিনিও তাঁর বিবৃতি পালটে অন্য কিছু
বলতে পারবেন না।
সবাই স্বীকার করল মানুষ ভয়ে, ভাবনায় বা লোভে ভুল বা মিথ্যে বললেও যন্ত্র তা বলবে না কারণ তাতে
তার কোনও স্বার্থ নেই।
বিচারক বললেন, ঠিক ঠিক, ডিফেন্স কাউন্সেলের আপত্তি খারিজ
করা হল মানে ওভার রুল্ড।
সাংবাদিকরা সব ডাঃ গৌতমের নামে জয়ধ্বনি
করে উঠল। সত্যি এ একটা দারুন আবিষ্কার। এখন আর মিথ্যে সাক্ষী কেউ দিতে পারবে না। যন্ত্র ক্যাঁক ক্যাঁক করে উঠবে।
আইনসভায় নাকি একটা বিল আসতে চলেছে ডাঃ
গৌতমের নবতম আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিতে। এই যন্ত্রটির কিন্তু নাম দেওয়া হয়েছে সাক্ষীগোপাল। ডাঃ গৌতমেরই দেওয়া নাম।
[অরুণ
চট্টোপাধ্যায়]