মধুচন্দ্রিমা (১ম পর্ব)
বারো বছর পর আবার সেই একই মোটেলের একই ঘরে
থাকতে পারবে ভাবেনি সুভদ্র। অলিকে কথা দিয়েছিলো তাই দশম বিবাহবার্ষিকীতে আবার সেই
খানেই এসেছে যেখান থেকে ওদের পরিচয় বা বলা যায় এই গল্পের শুরু।
অফিসের কাজের সূত্রে অ্যামেরিকা প্রবাসী
সুভদ্র,বছর দু'য়েক হয় এসেছে এদেশে। ঘুরে বেড়ানো সুভদ্রর
বরাবরের অভ্যেস, কাজেই এখানে এসেও তার ব্যতিক্রম হয় কি করে?
আর এদেশের মানুষের থেকে একটা জিনিষ খুবই চটপট অ্যাডাপ্ট করেছে সে,
তা'হল, জীবনকে সম্পূর্ন
উপভোগ করা। বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় পরিজন কেউ থাকলে ভালো; না
থাকলে একা একাই এঞ্জয় করা। একাকিত্ব কাটানোর মোক্ষম উপায় হিসাবে সে ছুটিছাটা
পেলেই অ্যামেরিকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে আরম্ভ করে। মধ্য অ্যামেরিকার একটা রাজে্য
থাকে সে, তার আশেপাশের দ্রষ্টব্য মোটামুটি ঘোরা হয়ে গেছে
তবে দেশের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি যাবে বেশ লম্বা ছুটি নিয়ে, আর স্প্রিং এর সময়ে যাতে চেরী ব্লসম দেখতে পায় এটা বহু দিনের প্ল্যান
সুভদ্রর। সেই অনুযায়ীই এসেছে। যদিও ছবিতে যেমন চেরীব্লসম দেখতে পায় অমন সচক্ষে
দেখতে পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। কারন ফুলফোটা ঘটনাটা পুরোপুরি আবহাওয়ার ওপর
নির্ভর করে। এদেশের উত্তরাংশে বেশিরভাগ পর্ণমোচী গাছ, কাজেই
শীতের সময় সব পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়া ন্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে; মৃতগাছ জীবিতগাছ পার্থক্যই করা যায়না। কিন্তু শীত শেষে যেই তাপমাত্রা
বাড়তে শুরু করে অমনি গাছগুলো পাতা গজানোরও আগে ফুলে ফুলে ভরে যায়। দেখলে মনে হবে
বুঝি ঝুড়ি ভরেভরে কেউ চাপিয়ে দিয়ে গেছে ফুল। কাজেই যদি ঠান্ডা বেশিদিন ধরে থাকে
তবে ফুল ফুটতেও দেরী হয়। প্রুন জাতীয় নানান গাছের ফুল ফোটাই চেরী ব্লসম, মূলতঃ জাপানিজ সাকুরা জাতীয় চেরীই থাকে তবে বিভিন্ন অন্য প্রজাতির চেরী
ফুল ফোটে তাছাড়াও ম্যাগনোলিয়া, আপেল এসব ফুলও থাকে। সাদা
আর গোলাপীর আধিক্য, কিছু হলুদ ফুল দেখা যায়। তবে এগুলি সাধারণতঃ
অর্নামেন্টাল অর্থাৎ ফল ধরেনা, ফলের জন্য চাষ করতে হয় অন্য
দু এক ধরনের চেরী। ফুল ফুটলে আবার এতো রেনু ওড়ে গাছের নীচে গাড়ী দাঁড় করানো থাকলে
তার ওপর ধুলোর আস্তরনের মতো হলুদ করে রেনুর আস্তরন পরে। আর বহু মানুষের চূড়ান্ত
সব অ্যালার্জী দেখাদেয় শুধু রেনুর থেকে। সুভদ্র একটু ভয় ভয় পায়নি তাও নয়;
বিদেশ বিভুঁই চেরী ব্লসম দেখতে গিয়ে বেশি অসুস্থ হলে দেখবে কে?
আর দেশের মতো তো হয়না যে শরীর খারাপ হ'ল আর
ভর্তি হয়ে গেলাম নার্সিংহোমে; সেটা সাংঘাতিক এক্সপেন্সিভ,
ইন্সোরেন্স কোম্পানী কভার না ও করতে পারে। যাইহোক 'জয়মা' করে চলে গেল সুভদ্র, সঙ্গে
কিছু ওভার দ্য কাউন্টার অ্যালার্জীর ওষুধ নিয়ে। ডি.সিতে চেরীব্লসম দেখতে যাওয়ার
আরোও একটা কারন ১৯১২ সালে জাপান ইউনাইটেড স্টেটস্ মৈত্রীর প্রতীক হিসাবে জাপান থেকে
কয়েক হাজার চেরী গাছ উপহার দেওয়া হয়, যার একটা বড় অংশ
ওয়াশিংটন ডি.সি তে পোটোম্যাক নদীর টাইডাল বেসিনে লাগান হয়। সেসব গাছের কিছু নষ্ট
হয়ে যাওয়ায় অবশ্য পরে আবার লাগানো হয়েছে। পুরো এলাকা জুড়ে এতো গাছে ফুল ফোটে
একসাথে খুবই মনোরম হয় সেই দৃশ্য। সুভদ্র থাকল অবশ্য ডি.সির থেকে একটু দূরে,
যেখান থেকে টে্রনে যাওয়া যাবে। এতে সুবিধা হোলো তুলনামূলক অনেক সস্তায়
থাকা যাবে, আর বেশ দেশটাকে আরেকটু কাছের থেকে দেখা যাবে। কতো
রকমের মানুষ তাদের কতো বিচিত্র সব ধরন, এক সাথে ট্রেনে করে যাবে।
সুভদ্র লক্ষ্য করল বেশ বড় একটা দেশীদের গ্রুপও রয়েছে তার মোটেলে আবার কিছু কিছু একা
মানুষ ও আছে; তার মধ্যে একটি মেয়েও আছে যে কিনা একা।
মেয়েটি দেশী না স্প্যানিশ বোঝা গেলোনা। স্প্যানিশ বা মেক্সিকান মেয়েরাও অনেকটা
বাঙালি মেয়েদের মতোই বেশ গোলগাল ট্যাপাটোপা কালো চুল, ঝট
করে তফাৎ করা যায়না। মোটেলে পৌঁছতে বিকেল অতএব পরদিন সকাল থেকে ডি.সি দর্শন শুরু
করবে তেমনটাই ঠিক করল সুভদ্র। এখানে একসাথে এতো দেশী দেখে ভারি পুলক হোলো, কারন সে যেখানে থাকে সেখানে তো দেশী প্রায় দেখাই যায়না। ওই সুভদ্রর
অফিসে আছে ক'জন, তাদের পরিচিতি দিয়ে
আরোও কয়েকজনকে চেনে। ওরা রাস্তায় হাঁটলে বহু সময় এদেশীয়রা গাড়ী স্লো করে,
জানলার কাঁচ নামিয়ে ওদের দেখে; যেন ওরা অন্যগ্রহের
প্রাণী। দেশী অর্থে ভারতীয়, বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, শ্রীলঙ্কান প্রায় সকলকেই বোঝান হয়।
এখানে সন্ধ্যের পর বেশ ঝড়বৃষ্টি শুরু হোলো,
মোটেলের নিজস্ব কোনো খাওয়ার জায়গা নেই। কি করবে ভাবছিলো সুভদ্র,
অচেনা জায়গা রেস্তোঁরাঁ কোথায়বা সে আবার খুঁজতে হবে, তায় সে তো গাড়িও আনেনি ছাতাও আনেনি কাজেই বৃষ্টি মাথায় হাঁটতে হবে।
কারন বৃষ্টি থামবে কখন কেউ জানেনা, রাত হলে তো খোঁজাও
মুস্কিল বন্ধও হয়ে যেতে পারে সব অথচ পুরো রাত না খেয়ে থাকবে যে, সেটাও পারবে না। হঠাৎই শোনে দরজায় নক্, কী? না পিৎজা ডেলিভারি দিতে এসেছে। আকাশ থেকে পড়ল সুভদ্র সে তো অর্ডার করেনি
ইনফ্যাক্ট এটা তার মাথায়ও আসেনি এতক্ষন। কিন্তু রিসিটে তার নামই লেখা! বাক্স খুলে
দেখে তার অতি পছন্দের পেপরনি পিৎজা অর্থাৎ যিনি এই অর্ডার করেছিলেন তাঁর সাথে
সুভদ্রর শুধু নামেরই নয় খাদ্যরুচিরও মিল আছে। দোকানের কিছু ভুল হয়েছে বুঝলেও সে
ওই রাত্রে আকস্মিক পাওয়া পিৎজাকে তার বরাদ্দ হিসাবেই গ্রহন করেছিলো। যদিও সুভদ্র
ফোনে খাবার অর্ডার করলে নিজের ডাক নাম ঋজুটাই ব্যবহার করে, ইংরেজীতে
বানান সহজ বোঝানোও সহজ।
পরদিন ঋজু সক্কাল সক্কাল রওনা দিলো ডি.সির
উদ্দেশ্যে,
ট্রেন বেশ ফাঁকা। তবে তাদের মোটেলের ওই মেয়েটিও চলেছে, অন্য দেশী গ্রুপ না গেলেও। ডি.সিতে পৌঁছে যা বুঝল শহরটার এতোগুলো দ্রষ্টব্য
পায়ে হেঁটে দেখতে গেলে সারাদিন লেগে যাবে সাথে এতো লম্বালম্বা হাঁটা যে দিনের
শেষে হয়ত দেখবে দু'চারটের বেশি কিছু দেখেই উঠতে পারলনা অথচ
এতো ক্লান্ত যে, পরেরদিনকে আবার বের হয়ে ঘুরে দেখবার
উৎসাহটাই নিভে যাবে। কাজেই টু্যর বাসে করে ঘোরাই সমীচীন মনে করল; খরচ বেশি হলেও ঘোরাটা সুন্দর হবে। কিছু ট্রলি ট্যুরও আছে, মিনিবাসের মতো গাড়ীতে করে ঘোরা যায়, তাতে মুস্কিল
একটাই নিজের জ্ঞান থাকতে হয়, কখন কোথায় নামব আর মেমরিয়াল
গুলি সম্পর্কে আলাদা করে কেউ কিছু বলে দেবেনা অথচ সে ট্যুর যে খুব সস্তা তেমন নয়।
হাতে মোটেল থেকে নেওয়া ম্যাপ খুলে বিজ্ঞের মতো বোঝার চেষ্টা করছে যে কোথা থেকে
শুরু করবে, বাসগুলো কোথায় পাবে এরই মধ্যে শোনে কলর কলর
বাংলা কথা। চমকে তাকিয়ে দেখে বাঙলাভাষীদের একটা বেশ বড় গ্রুপ তারাও ওই টু্যরের
বাস ধরবে বলেই চলেছে। ঋজু ম্যাপ দেখতে দেখতে যেন কিছুই বুঝতে পারছিনা ভাষা এমন মুখ
করে ওই গ্রুপটার পিছে পিছে চলল। ওদের সাথে আলাপ করুক বা না করুক অন্ততঃ মাতৃভাষায়
আলাপচারিতা শুনতে তো পাচ্ছে সেই বা কম কি।
(চলবে...)
[©মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী]