(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -১৪
গাড়িহীন বিশ্ব
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়
ডাঃ গৌতম শুনেছেন বর্ধমানে নাকি সীতাভোগ আর
মিহিদানা বিখ্যাত। তিনি এও শুনেছেন বর্ধমানের কাছেই শক্তিগড়ে আর একটা জিনিস খুব
নামকরা। সেটা হল শক্তিগড়ের ল্যাংচা। একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে বর্ধমানের দিকে
যাচ্ছিলেন। গাড়িতে আরও ক’জন ভি-আই-পি ছিল। বিজ্ঞানী মানুষ। সব সময় গবেষণায় ডুবে
থাকতে ভালবাসেন এটা ঠিক। তবে তাই বলে রসনাকে পুরোপুরি বেঁধে রাখতে পারেন কি করে। খেতে
ভালবাসেন এটা লুকোন না কারোর কাছে। আর তাই শক্তিগড়ের কাছে আসতেই মনটা কেমন আনচান
করে উঠল শক্তিগড়ের ল্যাংচা খাবার জন্যে। গাড়ির সকলের জন্যে বিরাট বিরাট বাক্স
বোঝাই ল্যাংচা কেনা হল। তারপর যাত্রা শুরু হল বর্ধমানের দিকে। যেখানে তাঁদের
বিজ্ঞান সম্মেলন। ঠিক আছে সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে সীতাভোগ আর মিহিদানা কিনে
নেবেন। কিন্তু বর্ধমান যাবার পথেই বিপত্তি। শহরে ঢোকার মুখেই গাড়ি আটকে দেওয়া হল।
শুধু তাঁর গাড়িই নয় সব গাড়ি। কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করে জানা গেল বর্ধমানে আজ
গাড়ীহীন দিবস চলছে। মানে আজ অর্থাৎ সপ্তাহের একটি দিন কোনও গাড়ি অর্থাৎ তেলের গাড়ি
চলবে না। তবে ব্যাটারি চালিত গাড়ি বা সৌরপ্যানেল যুক্ত গাড়ি চলার ক্ষেত্রে কোনও
বাধা নিষেধ নেই। তেলের গাড়ি দূষণ ছড়ায়। আর প্রতিটি শহরে এখন দূষণ ক্রমেই বেড়ে
যাচ্ছে। তাই উপায়ন্তর না দেখে এই ঠিক হয়েছে যে সপ্তাহের একটি দিন শহরে সমস্ত তেলের
গাড়ি বন্ধ থাকবে। চলবে একমাত্র ব্যাটারি বা সৌরবিদ্যুত চালিত গাড়ি আর অবশ্যই
সাইকেল, রিক্সা, সাইকেল ভ্যান ইত্যাদি যারা তেল ছাড়া শুধুমাত্র কল কব্জার কলকাঠিতে
নড়াচড়া করে অর্থাৎ দূষণ ঘটায় না।
তাঁদের পৌছানোর খবর পেয়ে উদ্যোক্তারা সঙ্গে
সঙ্গে ব্যাটারি চালিত একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিল। সেই গাড়িতে তিনি সম্মেলনে পৌছলেন আবার
সম্মেলন করে ফিরে আসার পথে কিনলেন সীতাভোগ মিহিদানাও। কিন্তু এই মিষ্টি দুটির
সঙ্গে নিয়ে গেলেন একটা তেতো চিন্তাও। তিনি ভাবলেন দূষণ থেকে আমাদের বাঁচতেই হবে।
কিন্তু সেই বাঁচার পথটা যেন কেমন কেমন মনে হল। গাড়িঘোড়া তো বিজ্ঞানের দান। সভ্যতার
উপকরণ। সেই গাড়ি বন্ধ রাখার অর্থ সভ্যতাকেই বিদ্রূপ করা। অথচ এটা না করেও উপায়
নেই। দূষণ থেকে মুক্তি পেতেই হবে। কিন্তু
এ কেন হবে? বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে রেখে গাড়ির বদলে সাইকেল ব্যবহারের অর্থ হল বেশ
কয়েক যুগ পেছিয়ে যাওয়া। সভ্যতার উল্টোমুখে গমন। কিন্তু সময় তো শুধু এগিয়েই যায়
পেছোতে তো সে জানে না। উন্নয়নের জয়রথ উল্টোমুখে চালিয়ে দেওয়া সভ্য মানুষের ধর্ম
হতে পারে না। দরকার হলে বিজ্ঞান দিয়েই দূষণকে কব্জা করতে হবে।
কিন্তু কেমনভাবে? তেলের বদলে বিদ্যুৎ ব্যবহার
করলে হয় বটে কিন্তু সেই বিদ্যুৎ তৈরি করতেও যে কয়লা পোড়াতে হয়। আর তাপবিদ্যুতের
বদলে জলবিদ্যুৎ হলেও তেল বা বিদ্যুতের সাহায্যে পাম্প চালিয়ে মাথার ওপরের জলাধারে
জল ভরতে হয়। তাছাড়াও আরও একটা সমস্যা থাকে। প্রতিটি শহরেই
জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যাও। রাস্তা কিন্তু
বাড়ছে না কারণ পৃথিবীটা রবার দিয়ে তৈরি নয় যে তা নিজে নিজেই বেড়ে যাবে। সুতরাং
জ্যামজট, ধাক্কাধাক্কি। গাড়ির গড় গতিবেগের হ্রাস আর গন্তব্যে পৌঁছোতে মানুষের
বিলম্ব। এ সব থেকে রেহাই পেতেই হবে। সভ্যতাকে থামিয়ে দিয়ে বা পিছিয়ে দিয়ে নয়। আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েই এর সমাধান করতে হবে।
-আসলে আমরা আমাদের বিজ্ঞানকে আর সামনে দিকে
এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছিলাম না বলেই পেছিয়ে আসার কথা ভাবতে হয়েছিল। বললেন ডাঃ গৌতম
দীর্ঘ ছ’মাস পরে। তাঁর চোদ্দ নম্বর একান্ত ব্যক্তিগত আবিস্কারের পরে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে
শুনছে তাঁর কথা যখন তিনি বলছিলেন, আচ্ছা বলুন তো মাথা ব্যথা করছে বলেই কি মাথাটা
কেটে ফেলতে হবে?
সবাই হৈ হৈ করে একসঙ্গে বলে উঠল, কক্ষনও নয়।
কভি নেহি। নেভার।
-তবে গাড়ি দূষণ ছড়াচ্ছে বলে আমরা গাড়িকেই
বন্ধ রেখে সাইকেলে অফিস করব কেন?
-তাইতো তাইতো।
-ঠিক কথা। সেন্ট পারসেন্ট করেক্ট।
জনতা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। আজ ডাঃ গৌতম এতই
জনপ্রিয় এতই লোকের প্রিয়পাত্র যে সবাই তাঁর কথায় সমস্বরে সায় দিতে পারলে বর্তে
যায়।
এবার আর কোনও কথা না বলে পকেট থেকে একটা
মানিব্যগের মত বস্তু বার করে মাটিতে ফেললেন বিজ্ঞানী। একি একি! এখন কি তাঁর অনেক
টাকাপয়সা হয়েছে যে টাকাভরা একটা মানিব্যাগ অনায়াসে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন
ডাস্টবিনে?
ডাস্টবিনে নয় রাস্তার মাঝখানে ফেলেছেন ডাঃ
গৌতম। মুহূর্তে হাতের রিমোট তাক করেছেন সেদিকে। আর আবার সেই সুকুমারের হজবরল। ছিল
ব্যাগ হয়ে গেল বাঘ গোছের। সেই মানিব্যাগে আসলে পাতলা কাগজের মত অনেক পাতলা
সিন্থেটিক কাপড় পরতে পরতে ভাঁজ করা ছিল। ঝট ঝট করে সেই পরতগুলো খুলে খুলে হয়ে গেল
একটা বেশ মজার জিনিস।
-আরে এটা তো একটা গাড়ি। জনতা উল্লাসে চেচিয়ে
উঠল।
-হ্যাঁ গাড়ি। ডাঃ গৌতম বললেন, আসুন আমরা
গাড়িতে চড়ি।
নিজে উঠে বসলেন একেবারে সামনের একটা সীটে।
ডাকলেন বাছা বাছা কিছু সাংবাদিক আর বোঝদার লোককে। তাঁর আবিস্কারের বিষয় তো আর সবাই
বুঝবে না।
সবাই উঠে বসেছে। মোবাইলের একটা বাটনের টিপুনি
খেয়েই গাড়ি নড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে উড়তে লাগল আকাশে। স্টিয়ারিং, অ্যাক্সিলারেটর,
ব্রেক, গিয়ার সব কিছু নিয়ন্ত্রন করছে ডাঃ গৌতমের হাতের ছোট্ট রিমোট। নিচে সার দিয়ে
শয়ে শয়ে কৌতূহলী জনতা ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
-এটা চলছে তেল বা বিদ্যুতে নয়। স্টিয়ারিং
ঘোরাতে ঘোরাতে ডাঃ গৌতম বললেন, চলছে পুরোপুরি সৌরশক্তিতে। তাই এর কোনও দূষণ
প্রতিক্রিয়া নেই। গাড়িটাতে কোনও মেটাল রবার প্লাস্টিক পলিথিন ব্যবহার করা হয় নি।
তাই এর কোনও ওজন নেই। ব্যবহার করা হয়েছে হাই পলিমার। যেগুলো খুব পাতলা আর খুব
হালকা হয়। প্রত্যেকটি অংশ ভাঁজ করা থাকে আর পরে সেগুলো খুলে গিয়ে একটা গাড়ির আকার
দেয়। অর্থাৎ ফোল্ডিং গাড়ি। তার সাইজ হল একটি ছোট মানিব্যাগের মত। এটি বার্ণ প্রুফ।
হিট প্রুফ।
চলতে চলতে দুপুরের রোদ অসহ্য হয়ে উঠল। কয়েকজন
বললও সে কথা। আবার ডাঃ গৌতমের মোবাইলের বাটন টেপা। মাথার ওপর তৈরি হয়ে গেল
অর্ধস্বচ্ছ রঙ্গিন এক ঢাকনা। আলো আছে কিন্তু তাপ নেই। একটু পরেই নামল বৃষ্টি। শনশন
হাওয়া। বৃষ্টির ছাঁট। ডাঃ গৌতম চারপাশে বানিয়ে দিলেন এক স্বচ্ছ দেওয়াল। অবশ্য এ সব
কিছুর জন্যে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন নি বিজ্ঞানী। পেরিয়ে গেল ঝোপঝাড়
খানাখন্দ বন জঙ্গল, খালবিল নদী। কোনও ঝাকুনি নেই, নেই কোনও শব্দ। আকাশ পথেই ঘুরে
ফিরলেন আগের সেই স্থানে। সবাই নামল। হাতের মোবাইল আবার তাক করলেন ডাঃ গৌতম। আবার
পরতে পরতে ভাজখোলা গাড়িটা ভাঁজ হতে হতে আকার নিল একটা মানিব্যাগের। যেমন অবহেলায়
তাকে রাস্তায় ফেলেছিলেন ঠিক তেমনই যত্নে কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ভরে রাখলেন তিনি। জনতা
জয়ধ্বনি করে উঠল, জয় ডাঃ গৌতমের। জয় বিজ্ঞানের। জয় মানুষের। ডাঃ গৌতম তো পেছনে
হাঁটতে জানেন না। সমস্যার সমাধানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেও পারেন না। তিনি শুধু জানেন
সামনের দিকে এগোতে। কারণ সময় যে শুধু এগিয়েই যায়। পেছোতে জানে না।
[অরুণ চট্টোপাধ্যায়]