>

জয়া চৌধুরী

SongSoptok | 1/15/2016 |





ঐতিহ্য ঐতিহ্য আরে বাবা হেরিটেজ... হেরিটেজ এর কথা ভাবছি। বাংলা টা এত কঠিন ভাষা বলে বুঝতে অসুবিধা হলো আপনাদের। আসলে বর্ধমান এর রেফ টেফ এর গন্ডগোলের চেয়ে ঢের সহজ বার্ডওয়ান বলা। কি বললেন? এটাতেও রেফ? কি যে বলেন আপনি রেফ তো কি হলো ইংরিজী ভাষাটা যদি অকারণ ব্যবহারই না করলাম তো হেরিটেজ কিসের! নকলনবিশী তো বাঙালি দের শয়ে শয়ে বছরের পুরোনো অভ্যেস। সেই ডিরোজিও র শিষ্যদের সময়কার কথা ভাবুন। আধুনিক হবার মরীয়া চেষ্টায় তারা ভালোর সঙ্গে কত কী মন্দ কাজ করতেন? তবে কি না সেসব রেনেসাঁ যুগের কথা। সে যুগ তো স্বর্ণ যুগ। তাদের ভুলভাল কাজকেও আমরা মন্দ বলতে পারি না একটিই কারণে। তাদের এত কিছুর মধ্যেও বাঙ্গালিত্ব ঘোচে নি। এখন হয়ে গেছে সেই যুগ। বাঙালি আজ আর বাঙালিই থাকতে চায় না। হেরিটেজত্ব এখন বাংলা সিরিয়ালের ব্যাপার। আমি কতটা সংস্কৃতি প্রবণ তা আমার সিরিয়ালের চওড়া করে সিঁদুর আর ঘোমটায় নাক পর্যন্ত ঢেকে প্রমাণ দিই কিংবা পুজো পাঠ জাঁক জমক কড়েয়া চৌথ ইতু পুজো কিচ্ছু আর বাকী রাখল না এই সোপ অপেরাগুলো। ব্যাটাদের দেখলে মনে হয় টিভি টাই ভেঙে ফেলি। শরীরে লবাবি রক্ত যাবে কোথায়!

পথে ঘাটে তাকান । মেয়েরা বরাবর চোখের আরাম দেয় । সে আমায় যাই গালি দিন । বাস্তব টি হলো মেয়েরা বেশী সুন্দর তাই হাঁ করে তাদের দিকে পুরুষরা যে তাকায়ই কিংবা আড় চোখে সে কথা সবাই জানে...এমনকী মেয়েরাও। আজকাল মেয়েদের পোশাক দেখুন... কি কান্ড ! সব তরুণীই ফিগার কনশাস ও জিনস পরিহিত কিংবা টাইট টপ কিংবা যাই হোক ঝলমলে আধুনিক পোশাক আঙুলের ফাঁকে পলা পোখরাজ আর বার ব্রত না করতে পারলেও শনি মঙ্গলবার নিরামিষ আর হনুমান চাল্লিশার বইটি ব্যাগে পোরাই থাকে। অফিস বেরোনোর আগে সোমবার বাবার মাথায় ঢুক করে এক ঘটি জল কিংবা হনুমান চল্লিশা র মন্ত্র গুলো একবার বিড়বিড় করে না নিলে সেদিন যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির অফিসে বসের কাছে স্পেশাল ঝাড় জুটবে সে বিষয়ে মেয়েরা টনটনে খেয়াল রাখে। একে ধর্ম বলুন বা জিরাফ বা হেরিটেজ... যা ইচ্ছে।

ওদিকে চন্দ্রকেতুগড়ের পুরোনো ইট হোক কিংবা ভাডনগরের শর্মিষ্ঠা সরোবরের মধ্যেকার প্রাচীন মূর্তি – সব হাপিস হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। ওইসব বস্তু আগলে রাখায় দায় রাষ্ট্রের ও নয় জনগণেরও নয়। হেরিটেজ!!! ফুঃ... এর চেয়ে রক্তদান শিবিরের কাজ ঢের বেশি জনকল্যাণকর ও ভোট বাড়ানোর উপযোগী। ঐতিহ্য দিয়ে কি সরকার ধুয়ে খাবে?

তবে হ্যাঁ হেরিটেজ গল্প কিম্বা চলচ্চিত্রের ব্যাপারে সিল্পিরা খু উ উব সচেতন। হেরিটেজত্ব মেইনটেইন করার জন্য সে সব মূল গল্প বা চলচ্চিত্রে তারা হাত লাগান না। খালি এদিক ওদিক টুকে টাকে খামচি দিয়ে নতুন ছবি কিংবা বই লেখেন।

আপনি বলবেন ঐতিহ্য কি সবই ভালো? আমার পূর্ব পুরুষ বাইজি বাড়ি যেতেন আর মেয়েছেলে পুষতেন... আমাকেও তা বজায় রাখতে হবে? আরে ধুর ... এ কথা কি বলতে গেলাম? আমরা তাকেই ঐতিহ্য বলিই যা আমাদের উন্নতির চিহ্ন ও যা ধরে না রাখলে আমাদের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি যে কোন ঐতিহাসিক সৌধ বেড়াতে যান। কাঁধে ক্যামেরা আর সঙ্গিনীর কোমর বেষ্টন করে একটু হাঁটতে না হাঁটতেই দেখতে পাবেন অজন্তা গুহার মর্মর মূর্তি উধাও কিংবা কোথাও অশোকের শিলালিপির গায়ে লেখা মুন্না + তিতলি কিংবা পাপ্পু + মোহিনী... কারো কি মনে হয় যে এই সব সৌধ তাদের ইস্কুল ঘরের শ্লেট নয়!

তবে পণ নেওয়া আমাদের পরিবারের হেরিটেজ এ সাফাই পুরুষেরা অনেকেই আজও দেন । বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে সামান্য পরিবর্তন হলেও পাহাড় প্রমাণ টাকার গদীতে বসে থাকা অবাঙ্গালি বিশেষ করে উত্তর ভারতীয় পুরুষদের পণ  নেওয়ার স্বভাব হল হেরিটেজ। ঘর কি ইমান ... তাই মেয়ের বাবার গলা টিপে সে ঐতিহ্য রক্ষা করেন তারা। অনাদায়ে বধূ নির্যাতন ও শেষে বধূ হত্যা।  একবারে বড়বাজারের দোকান গুলিতে যে মার্কেটে তারা আছেন গিয়ে দেখেছেন কি? দেওয়াল জোড়া পানের পিক বিড়ি ধুলো কাপড়ের টুকরো প্লাস্টিক ইত্যাদি চারশ বিশ জিনিষ ছড়ানো চতুর্দিক। ঠিক মত রক্ষণ করা গেলে বোঝা যেত এক একটি বিল্ডিং কম ঐতিহ্যময় নয়। কিন্তু এই বেলা হেরিটেজ রক্ষার দায় কারো নেই।

কোন কোন রাজ্যে তো একাধিক ভাইয়ের একটি বৌ কিংবা দেশের কোন কোন রাজ্যে মেয়ে ভ্রূণ হত্যার হেরিটেজ তো সোনায় বাঁধানো। আজ তাদের পুরুষ নারীর ভারসাম্যই বদলে যাচ্ছে। কোন কোন রাজ্যে তো একাধিক ভাইয়ের একটি বৌ কিংবা স্বামী শ্বশুর সবাই মিলে একটি মেয়েকে ভোগ করার মারাত্মক বিপদ আজ শোনা যাচ্ছে। এর কারণ কিন্তু নির্বিচারে নারী হত্যা। কোন কথা বলতে যান... হেরিটেজ! কেউ ভাববে না নারী হত্যার ঐতিহ্য না ভেবে পণ গ্রহণ করার ঐতিহ্য বন্ধ করুন। কেউ বলবে না।

তবু তার মধ্যেও শোনা যায় উল্টো কথা। কখনো  কোন গ্রামে দুর্গা পূজার যোগাড় করেন মুসলমানরা সে তাদের ঐতিহ্য বরাবরের কিংবা ক্রিসমাস খ্রিষ্টানদের হলেও ঐতিহ্য মেনেই হিন্দুদের বেলুড় মঠে সেদিন বিশেষ পুজো হয়...এও তো ঐতিহ্য।

কাজে কাজেই হেরিটেজ আমাদের পুরো বিলুপ্ত তা বলা  যায় না বোধহয়। সাবেকী নীলকন্ঠ পাখি ওড়ায় না হয়ত আজ আর উত্তর কলকাতার কোন বনেদী বাড়ির দুর্গা পূজায় কিন্তু বিজয়ায় কোলাকুলি আর মিষ্টি মুখের ঐতিহ্য আজো একই রকম। ব্রিটিশের প্রাক্তন রাজধানী হিসাবে কলকাতার তো অগাধ হেরিটেজ সম্পদ। পুরসভা দাগিয়েও দিয়েছে। তবু তাদের দেখভাল হয় কই! আবার উল্টো দিকে অশোকের স্তূপ গুলি দেখেছেন? দেখবেন জাপানিরা হেরিটেজ রক্ষার নামে সে সব পালিশ করে নতুনের মত চকচকে করে ফেলেছে অথবা দক্ষিণেশ্বরের মূল মন্দিরের গর্ভ গৃহে দেওয়াল চিরে নতুন দরজা বানিয়ে, শ্রীরামকৃষ্ণের শয়ন কক্ষের দেওয়ালে ছবির মালা ইচ্ছামতো অদল বদল করেছে তাতে আর যাই থাক ঐতিহ্য যে অবশ্যই ক্ষুণ্ণ হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং  কি করব আর কীভাবে ঐতিহ্য রক্ষা করব তার দায় আমাদের সবার। রক্ষা করব কি না ভেবে প্রতিটি পা এগোনো উচিৎ। অন্যথায় সে হেরিটেজ হয়েই থাকবে , তার আর ঐতিহ্য হয়ে ওঠা হবে কি?  উত্তর আপনাদের হাতেই রইল।

[জয়া চৌধুরী]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.