>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • অরুণ চক্রবর্তী

    SongSoptok | 1/15/2016 |





    আমাদের বড়দা

    আমাদের বড়দা। আমার থেকে ১৩ বছরের বড়। আট ভাইবোনের দাদা ছিলেন বাড়ির সংস্কৃতির ক্রিস্টোফার কলোম্বাস। আমরা ছোটবেলায় দাদার মধ্য দিয়েই জেনেছিলেম বাংলার বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলটাকে। দাদা আইপিটি’এর গান গাইতেন, পাড়ার সবাইকে শেখাতেন। দাদার কলেজ জীবন ছিল কলকাতায়, পঞ্চাশের দশকেতাই জড়িয়ে ছিলেন সেই সময়ের টগবগে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেথাকতেন আড়িয়াদহে ছোটপিসিমার কাছে। পিসিমা তখন এক ছেলের আয়ে ছয় ছেলেমেয়ের সংসার নিয়ে হিমসিম। বড়দা সেখানে সপ্তম পেট। বড়দা পড়তেন বঙ্গবাসী কলেজে। ছুটি ছাটায় আসতেন দিনাজপুরে। সদ্য স্বাধীন হওয়া দু’দেশের মধ্যে তার ছিল বটে, তাতে কাঁটা গজায়নি তখনও। তাই কলকাতা থেকে দিনাজপুরে যাতায়াত ছিল সহজ। দাদা সঙ্গে আনতেন নিত্যনতুন গান নাটক কবিতা ম্যাগাজিন বইদাদা গাইতে পারতেন, কবিতা নাটক কিখতে পারতেনদাদার লেখা গল্প পড়িনি কখনো, তিনি লিখতেন তাও শুনি নি কোনদিন। দাদার লেখা নাটক পাড়ার ছেলেরা মঞ্চস্থ করত। 'মহেশ' গল্পের রূপান্তর করেছিলেন, সিঞ্জের 'রাইড টু দ্য সী' নাটকটির অনুবাদ করেছিলেন, গ্রাম বাংলার মাটি মানুষ নিয়ে নানা নাটিকা লিখতেন, তাতে প্রাধান্য পেত আইপিটিএ-র নানা গান। দাদার কবিতা আমাদের মেজদা আবৃত্তি করতেন নানা অনুষ্ঠানে। আমিও তা আবৃত্তি করেছি স্কুলের নানা অনুষ্ঠানে।

    দাদা ছিলেন সুপুরুষ, আমৃত্যু। দুধে আলতা গায়ের রং, এক গোছা কাল চুল, মুখে ভূবনমোহনী হাসি। দাদার হাসি দেখে মারমুখী বড় বড় মস্তানদেরও শান্ত হতে দেখেছিদাদা আমাদের জন্য কলকাতা থেকে দম দেওয়া কলের গান এনেছিলেন। সেই কলের গানেই আমরা শুনতাম 'গাঁয়ের বঁধূ' 'রানার' 'আলোর পথ যাত্রী' 'শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান'... এই সব। দাদা রানারের ছায়া-নাটক করিয়েছেন আমাদের দিয়ে, গায়ের বঁধূ নিয়ে নৃত্য নাট্য, এমন আরও কত কী।

    একদিন সব বন্ধ হয়ে গেল। দাদা ভর্তি হলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। আমরা পাড়ার সবাই ততদিনে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে জড়িয়ে গেছি, এমন কি কখনো সখনো পড়াশুনোর ক্ষতি করেও। বাবার ক্রমাগত জেলে বন্দী হওয়ায় আমাদের সংসারে তখন খুব আর্থিক সঙ্কট। আমি আর আমার ওপরের ভাই সাবানের কারখানে থেকে বাঁশের বাঁকে সাবানের জল বালতিতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছি মা'র কুয়োর পাড়ে, মা কাপড় কাঁচেন তা দিয়ে। পুজোয় আমাদের পায়ে ক্যাম্বিসের কেডস জুতো, পরনে দড়ি বাঁধা ইজের। মা কিন্তু দাদার ডাক্তারি পড়া বন্ধ হতে দেন নি। অন্যদিকে দাদাও প্রতি বছর ডাক্তারি ক্লাশে সেরা রেজাল্ট করে বাবার বন্দী জীবনের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে চলেছেন। এভাবেই একদিন দাদা সম্পূর্ণভাবে ছিটকে গেলেন সংস্কৃতি আর সাহিত্যের জগত থেকে, দ্রুত ফিরে এসে দ্রুত মা’র পাশে দাঁড়াতে। এ ছাড়া ওই সময়কালে বাকি সাত ভাই বোনকে বড় করার আর কোন উপায় মা বা দাদার কাছে ছিল না। তাই রাতদিন ডাক্তারি পড়াশুনোছুটিতে বাড়িতে এলেও কুয়োর পাড়ে রোগা লিকলিকে আমি তার কাছে ব্যাঙ। আমাকে খালি গা করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাড় মাস পেট টিপে পরখ করতেন নিজের অ্যানাটমি বিদ্যার দৌড়। আমরা সংগ্রাম কাকে বলে কোনদিন শেখার সুযোগ পাই নি। শুধু জানতাম, বাবা জেলে বন্দী থাকলে অমন জীবনই আমাদের সংস্কৃতি। দাদাও মানতেন। কৃচ্ছতায়ও জীবনে সেরা ডাক্তার হওয়া যায়, মানতেন। এভাবে একদিন দাদা শুধু ডাক্তার হয়ে গেলেন। সারা শরীরে ভাইবোন আর সমাজের তাবৎ মানুষের জন্য অপার মমতা ছাড়া দাদার কাছে আর সব মূল্যহীন হয়ে গেল।

    এই সময় দাদা বিলেত যাবার সুযোগ থেকে মুখ ফেরালেনপরবর্তিতে সেই কাহিনী উদ্ধার করে জেনেছিলাম, কী নির্মম ছিল সেই সিদ্ধান্ত, কী নির্মম ছিল নিজের মন ও শরীরে ওপর ক্রমাগত কষাঘাত, আজীবন।  '....’দিদি'র প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, ফিরে এলেন দিনাজপুরে। মা'র পাশে দাঁড়িয়ে বাকি সাত ভাইবোনদের জীবন স্থিত করার কাজে লেগে পড়লেন। আজো মনে পড়ে সেই দৃশ্য। বাড়ি ফিরে দেখি, রান্নাঘরের মেঝেতে দাদা খেতে বসেছেন। মুখ চোখ উত্তেজনায় লাল। আমি রান্নাঘরে উঁকি মারতেই বললেন, 'এই বাবলু, শোন শোন। আমি আজ দশ টাকা ফি পেয়েছি। কলে গেছিলাম। আমার জীবনের প্রথম ভিজিট, প্রথম ফি..'

    দাদা আমাদের মধ্যে আর নেই। তবে আজো দাদার সেই আনন্দমুহূর্ত আমার চোখ ভিজিয়ে তোলে।

    আমাদের মেজদা

    আমাদের মেজদা আমার থেকে ছয় বছরের বড়। আমাদের ছোটবেলার হোম মিনিস্টার। ভাই বোনেরা কে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে কী বলছে সে সব লক্ষ করে শাস্তি বিধানের ক্ষমতা তাকে যে কে কবে দিয়েছিল জানি না। কিন্তু বড়দার অনুপস্থিতিতে (বড়দা চিরকাল বাইরে বাইরে) মেজদাই আমাদের ডিফ্যাক্টো গার্জিয়ান। আমরা নিষ্ঠুর মারের ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারতাম না। মা'র কাছে নালিশ করার সাহসও জুটত না, ওই একই কারণে। মা টের পেতেন কিনা জানি না। তবে আমাদের ভাই বোনের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার এক্সপোর্টার ছিলেন মেজদা। বড়দার সাংস্কৃতিক প্রবাহের বহির্স্রোত আর মেজদার রাজনৈতিক সচেতনতার অন্ত্রর্স্রোত বাড়ির ছোটদের মধ্যে এক চমৎকার রসায়ণ তৈরি করেছিল। বাবা-মা’র কারণে বাড়ির রাজনৈতিক পরিমন্ডল তো এসবের অনুকূল ছিলই। তাই আমারা ভাইবোনেরা কেউই রাজনীতি থেকে কখনই দূরে থাকি নি।

    মেজদা ছিলেন দুরন্ত সাহসী। কট্টর, একগুঁয়ে। প্রত্যুৎমণ্য। ভাষা আন্দোলনের সময় রাতে আমাকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে ঝাঁটার শলার ডগায় কাপড় জড়িয়ে, বাটিতে আলতা ঢেলে বসিয়ে দিত পোস্টার লিখতে, কেননা, আমার হাতের লেখা ভালো। আমি খাতার পাতায় আগে থেকে লিখে রাখা স্লোগান দেখে দেখে লিখতাম গোটা গোটা অক্ষরে, খবরের কাগজের শিটে। কে যে বাটি ভর্তি আটার আঠা জ্বাল দিয়ে রাখত মনে নেই। মা কি? নাকি পাশের বাড়ির রেণু কাকিমা? বাচ্চু আমি আর মেজদা এই তিন ভাই মিলে মাঝরাতে পাড়ার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটতাম গভীর রাতে। আমার বয়স তখন সাত-আট, বাচ্চুর  দশ-এগার, মেজদা তের-চোদ্দ। আমি ঐ বয়সী মেজদার বক্তৃতা শুনেছি দিনাজপুর ইনস্টিট্যুটের চত্বরে। মেজদা প্রতিবাদ করছিলেন কী করে বন্দীদের 'গরু ছাগলের মত' কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তারমেজদা শক্ত মুঠি তুলে প্রতিবাদ তুলছেন, উপস্থিত তরুণ কিশর যুবা বৃদ্ধ সবাই তাকে সাবাসী দিয়ে চলেছে গলা মিলিয়ে, হাতে তালি দিয়ে। একবার দিনাজপুর কোর্টে এসডিও-কে যখন ঘেরাও করে রাখা হয়েছে, মেজদা পাঁচিলে উঠে এসডিওর জানালার শিক ধরে ঝুলে চোঙা মুখে চিৎকার করে স্লোগান দিতে থাকে, 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, কালা কানুন বাতিল কর।' পুলিশ ছুটে গিয়ে মেজদাকে পাঁজা কোলে নামিয়ে আনে।

    একবার, বাবা তখন জেলেবাবা জেলে থাকলে আমরা দু সপ্তাহে একবার সবাই মিলে বাবার সঙ্গে জেলে দেখা করতে যেতে পারতাম। একবার পারমিশন মিলছিল না কিছুতেই। মেজদা, সোজা বড় মাঠের ধারে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের (আমানুল্লাহ সাহেব নাম) রেসিডেনসে গিয়ে হাজির। মেজদাকে অফিস ঘরে অপেক্ষা করতে বলা হল, 'সাহেব ব্রেকফাস্ট করছেন। পরে নামবেন।' মেজদা বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ দে দৌড়! দৌড়ে বাংলোর বাগান পেরিয়ে একেবারে দোতলায়। এঘর সেঘর করে ডাইনিং রুমেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। 'আমরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই!' পিছনে ছুটে আসা পুলিশদের চলে যেতে বলে সাহেব মেজদাকে চেয়ারে বসিয়ে ফল খেতে দিলেন, বললেন, 'পারমিশন দেব, যদি তুমি আমাকে একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও।' আবৃত্তিতে ওইটুকু বয়সেই শহরে মেজদার সুনাম ছিল। মেজদা পরে বলেছেন, 'আমিও সুযোগ পেয়ে কায়কোবাদের কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালাম

    এই কবিতাটার একটা মজার কাহিনী আছে কবিতাটি ছিল বাবার জেলখানায় বসে লেখালেখির একটা  ঢাউস খাতায় এখন মনে পড়ছে না, সেটা কবিতার খাতা নাকি নানা লেখার খাতা যা হোক, কবিতাটা বাবার হাতের লেখায় ছিল আমিও পরে বহু জায়গায়, নানা ভাবে এটা আবৃত্তি করেছি কবিতাটার শিরোনাম ছিল, 'রবীন্দ্রনাথ, নিচে কবির নাম কায়কোবাদ বাবা এত বড় কবিতা নিজের হাতে লিখে রাখবেন কেন? কবিতায় কাটাকুটি অবশ্য ছিল না আমার কাছে আজও ধন্দ, এটা বাবার লেখা নয় তো? কবিতাটার অনেকগুলো অনুচ্ছেদ প্রতিটা শুরু হচ্ছে, ‘রবীন্দ্রনাথএই উচ্চারণে যেমন, ‘রবীন্দ্রনাথ, এই যে রাজপথ তোমার চোখের সামনে প্রসারিত... সে পথে তো পা ফেলার উপায় নেই, হাঁটবার উপায় নেই সে পথ ধরে, তবু যদি দাঁতে দাঁত চেপে, দু চোখে দুহাত রেখে এগুতে চাই সে পথ ধরে, তখুনি লাখ লাখ ক্ষুধার্ত নরনারী আমার সে পথরোধ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে... দাঁড়িয়ে থাকে আমার শীর্ণা জন্মভূমি...' (উদ্ধৃতে ভুল হতে পারে) বাবা এই কবিতাটি আমাদের সবার জন্মদিনেই আবৃত্তি করতে উৎসাহ দিতেন আমরা শুধু নামটা পালটে পালটে নিতাম নজরুলের দিনে নজরুল, সুকান্তের দিনে সুকান্ত, এমনকি আমি স্কুলে কায়েদ--আযমের জন্মদিনেও কায়েদ--আযম বসিয়ে আবৃত্তি করেছি এই কবিতা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার লেখা কবিতাগুলোর শব্দচয়ন আর ছন্দ দেখে আমার অনুমান, বাবা এটা নিজেই লিখেছিলেন, কোন রাজনৈতিক কারণে নাম গোপন রেখেছিলেন কায়কোবাদ ছিলেন বিপ্লবী বাঙালি কবি। ১৯৫১ সালে, আমার বয়স যখন ছয়, কায়কোবাদ মারা যান, ৯৪ বছর বয়সে কবিতাটা, বাবা যদি লিখে থাকেন, কায়কোবাদ মারা যাওয়ার পরেই লিখে থাকবেন, ভাষা আন্দোলনের অগ্নি-উজ্জল সময়ে

    মেজদা প্রচন্ড বদ রাগী ছিলেন। মিতব্যায়ীতা ছিল তাঁর বাঁচার মন্ত্র। এটা না থাকলে আমরা সবাই আমাদের সংগ্রামী জীবনকে জলভাত করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। আমি ছিলাম উল্টো, তাই মেজদার হাতে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছি আমি। আমি আর সবার মত মেজদার শাসন মানতে চাইতাম না। মা বলতেন মেজদাকে, 'ওকে বাদ দে।' মেজদা বলতেন, 'বাদ দিলে ওর কারণেই বাকিরা নষ্ট হয়ে যাবে।' কেননা, মেজদার আদর্শের ধারেকাছে ছিল না আমার চালচলন, ভাবনা চিন্তা

    আমরা দুই ভাই

    বাচ্চু আমার তিন বছরের বড়। কোনদিন দাদা বলে ডাকিনি, 'বাচ্চু' বলে এখনো ডাকি, এখন সে শিলিগুড়ির নামী চোখের ডাক্তার আমার ছোটবেলায় আমার যদি ঘোষিত শত্রু বলে কেউ থেকে থাকে সে এই বাচ্চু। বাজারে যাবে না, হাটেও না। 'মা, আমি পড়ছি, বাবলুর পড়াশুনো সেই সকালেই শেষ। ও যাবে।' এক অর্থে ঠিক, খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করত বাচ্চু, বেশির ভাগ সময়েই। আমার পড়াশুনোয় মন ছিল না একদম এখন বিষয়টা সাজিয়ে ভাবলে মনে হয়, আমার পড়ায় কোন আগ্রহ কোনদিনই ছিল না  কিন্তু জানার আগ্রহ ছিল অসীম তাই বাচ্চু আমাকে হাটে বাজারে পাঠাতে ষড়যন্ত্র করলেও, তাতে আমার আগ্রহ কম ছিল না হাট থেকে ফেরার সময় রিকশা না করে কাঁধে করে হাট নিয়ে এলে মা আমাকে দিতেন চার আনা (পঞ্চাশের দশক). বাজারের ফ্ল্যাট রেট এক আনা। রসগোল্লা জিলিপি বোঁদে চানাচুর কমলা লজেনস টোস্ট বিস্কুট... সপ্তাহে অন্তত একটা দিন তো আমি টাটা-বিড়লা! এর আরো একটা কারণ ছিল, স্কুলে চন্দ্রবাবু স্যার একবার সকলের সামনে আমার 'সংগ্রামী' চরিত্রের প্রশংসা করেছিলেন। 'হাটের কাছে আমার বাড়ি। নিজে চোখে প্রতি হাটবারে অরুণকে পাহাড় কাঁধে মাল বইতে দেখি। ওর মত নিরহঙ্কারি পরিশ্রমী হতে হবে সবাইকে..', তিনি একদিন ক্লাশে তার পাশে আমাকে ডেকে সবাইকে বলেছিলেন। স্যার জানতেন না, এজন্য আমি রীতিমত চার আনা পয়সা পেতাম। সবার কাছ থেকে হাততালি পেতে কার না সাধ হয়?

    বাবা আমাদের দি ভাইকে এক ঘরে থাকতে আদেশ করেছিলেন, কেন জানি নাতার ব্যবস্থাও করেছিলেনঘরের দুটি জানালার পাশে একটি করে টেবিল। পাশে একটি করে বই-খাতা রাখার নড়বড়ে শেলফ পাশে একটি করে বিছানা। আমার বিছানা একটা লম্বা জানালার পাশে। বাইরে বেল কাঁঠালের দুটি মস্ত গাছ। শিরশিরে হাওয়া আসে সর্বক্ষণ। বাচ্চুর এসবে কোন বাছ বিচার ছিল না। তার পড়াটা নির্বিঘ্নে হলেই হল। তাই ও বেছে নিয়েছিল, দেয়ালমুখী টেবিল

    আমরা দুই ভাই পিঠাপিঠি হলে কী হবে, আমাদের দুই চরিত্রে কোন মিল ছিল না। আমি ওর সব স্বভাবের উল্টো স্বভাবের। বাচ্চু শান্ত, ধীর স্থির। পড়াশুনো ফার্সট প্রেফারেনস। সুস্বাস্থ্য, বড়দা ওকে আদর করে নাম দিয়েছিল 'ভুটু'. বাচ্চু পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত থাকত বলে ওর বন্ধু সংখ্যা কম ছিল। মিথ্যে কথা বলা সে জন্যেই শেখেনি সে। স্থির মস্তিষ্ক, মা'র কাছে কিছু চাইত একবার মাত্র, আমার মত ঘ্যান ঘ্যান করত না। তাই বাচ্চুকে নিয়ে কারো নালিশ ছিল না। চিন্তাও না।  অন্যদিকে আমাকে উঠতে বসতে মেজদার কাছে ধাতানি খেতে হত, কথায় কথায় বলত, 'বাচ্চুকে দ্যাখ!' আমারও প্রাণপণ, বাচ্চুর মত আমি কখনই হব না। পড়াশুনা করবই না। অন্যদিকে সবার মত বাচ্চুরও ধারণা হয়ে গিয়েছিল আমি বখে গেছি। তাই আমাকে শাসনে রাখা ওর যেন একস্ট্রা ডিউটি। একসঙ্গে থাকতাম বলেই এই দায়িত্বটা বাচ্চু নিজেই নিয়েছিল মনে হয়। আমার সঙ্গে ওর লড়াইয়ের মূল এইখানে। ও পড়তে বসত, আর আমি ন’টা বাজলেই, 'একটু ঘুমিয়ে নি। তুই শুতে যাবার আগে ডেকে দিস' বলে নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমোতাম। বাচ্চু ঘুমোতে যেত রাত এগারোটায়। ঘড়ির কাঁটা ধরে। তাই ধাক্কাধাক্কি করে আমাকে ওই এগারটায় তুলে দিত। আমি তখন পড়তে বসতাম। বাচ্চুর কিন্তু নাক ডাকতে পনেরো মিনিটও লাগত না। আমি কষ্টেসৃষ্টে খোলা বইয়ের দিকে চেয়ে বা খাতায় আঁকিবুকি এঁকে ওই পনেরো মিনিট পার করে দিয়েই টেবিল ঘড়ির কাঁটা পোঁ পোঁ করে আড়াইটায় এনে, টেবিল খাট ইত্যাদিতে দুমদাম আওয়াজ তুলে, বাচ্চুকে আধঘুম করে আবার বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আওয়াজে বাচ্চুর ঘুম ভেঙ্গে যেত, ঘুম চোখে বাথরুমে যাবার সময় ঘড়ির ওপর ঝুঁকে দেখত আমি রাত আড়াইটাতেও জেগে পড়ছি, মানে, রাত জেগে সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে পড়াশুনা করছি একটানাআমাকে বকাঝকা করে ও লন্ঠন নিভিয়ে দিত, 'এত রাত জেগে পড়িস না। শরীর খারাপ হয়ে যাবে, ঘুমোতে যা' ও ঘুমোলে আবার ঘড়ির কাঁটা যথাস্থানে ফিরিয়ে দিতাম। পরদিন বাবা মা মেজদা ঘটনা শুনে আমাকে খুব প্রশংসা করত। আদর করে বলতেন, ‘রাত না জাগলে বাবুর পড়াশুনো হয় না!’বেশ কিছুদিন এই রকম খুশি খুশি চলল, কিন্তু মিথ্যের দৌড় তো অনন্তের না, একদিন হাতে নাতে ধরা পড়ে গেলাম। বাচ্চু মিছিমিছি নাক ডাকছিল, চোখ পিটপিট করে আমার কীর্তি দেখে একইভাবে আমাকে শুতে বলে পরদিন সকালে সব ফাঁস করে দিল। মেজদার হাতে সে যে কী পিটুনি, কী আর বলব।

    আমার সঙ্গে ওর শত্রুতার হাজার খানেক ঘটনা আছে। আর একটা বলি। মেজদার আদেশ ছিল, স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষা দেবার সময় কোশ্চেন পেপারের পাশে উত্তর লিখে আনতে হবে। আমিও লিখলামকিন্তু বাইরে এসে ফার্সট বয় মলয়ের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখি, প্রায় সত্তর ভাগ অঙ্ক ভুল করেছি। এইবার উপায়? কোশ্চেন পেপারে লিখে ফেলা উত্তর তো কাটা যাবে না!  দোয়াত কলমে পরীক্ষা দিতাম আমরা। আমি দোয়াতের কালি কোশ্চেন পেপারের ডানদিক বরাবর ঢেলে দিলাম। উত্তর হাওয়া! বাচ্চু একই স্কুলে, তিন ক্লাশ ওপরে পড়ত। দেখেছিল নাকি শুনেছিল, মেজদাকে গিয়ে আমার কীর্তি ফাঁস করে দিল, আবার পিটুনি! মেজদার হাত ব্যথা করতে লাগল। মা কিচ্ছু বলল না। বাচ্চুর সে কি হাসি!

    বাড়ির কারো কাছে আমি ভালো ছেলে ছিলাম নামা না থাকলে, আমার কোন অবস্থাতেই বাড়ির কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে না জানতাম মাঝেমধ্যে, বড়দা বাড়িতে এলে, আমার চারপাশে প্রশ্রয়ের নানা গাছ-গাছরা মাতা ঝাঁকাতো।  সত্যিই , আমার পড়াশুনো করতে ভালো লাগত না। সারাদিন টোটোবাজিতেই যেন আমার রক্ত চলাচল চাঙা থাকত। আমি খোলা মাঠে গান গাইতে পারতাম, চিনামাটির বাটি সাজিয়ে, তাতে জল ঢেলে ঢেলে টিউন করে জলতরঙ্গ বাজাতে পারতাম, ব্যাঞ্জো বাজাতাম, মাউথ অর্গ্যান, তবলাও বাজাতে পারতাম। দিনাজপুরের বিখ্যাত দীপালী উৎসবে গান গেয়ে ফার্স্ট হয়েছি, স্কুলের বার্ষিক উৎসবে মঞ্চে নেচেছি, দিনাজপুরের তাবৎ গায়ক ও গীটার বাদকদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেছি, মঞ্চে মঞ্চে জলতরঙ্গ, ব্যাঞ্জো, নাটক, এক্সটেম্পো প্রতিযোগিতা, বিতর্ক ইত্যাদি, অর্থাৎ, মঞ্চের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই অংশ নিয়েছি। অন্যদিকে কৃষি ফার্মে আঁখ চুরি করা, স্কুল পালিয়ে টম্যাটো ক্ষেত থেকে টম্যাটো চুরি করে খাওয়া, গরুর গাড়ির পিছনে ঝুলে ঝুলে মাইল খানেক চলে যাওয়া, কাঁটাপাড়ায় প্রতিমা শিল্পী রাখালদার চালাঘরে বসে থাকা, হড়মুড় করে এ ওর বাড়িতে ঢুকে খেতে বসে যাওয়া, সাইকেল চড়ে গার্লস স্কুলের আশেপাশে পাক খাওয়া, গেটকীপার কালুয়াদাকে পটিয়ে লিলি টকিজে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখা, স্টেশন রোডের এ দোকান সে দোকানে গল্প করা, চায়ের টেবিলে বসে পড়া... বাচ্চু যা কল্পনাই করতে পারত না, আমি সহজেই সেসব করে ফেলতাম মেজদার পিটুনির রিস্ক নিয়েই।

    কৈশোরের মধ্য গগনের আগুন তখন আমার বুকে, সর্বক্ষণ। ভিটেমাটি থেকে উৎখাত বিহারীদের কাছে তাঁদের জীবন সংগ্রামের কথা শুনতাম, আর মনে হত, নিজভূম বলে কি কিছু হয়? সারা পৃথিবীটাই তো নিজভূম, নইলে মানুষ আবার শিকড় খুঁজে পায় কী করে? ওই বয়সে প্রশ্ন থাকলেও উত্তর তো খুঁজতাম না! তবে পৃথিবিটা অনেক বড় হয়ে উঠতে থাকে আমার কাছে। রেডিওতে অজয়দা আর কমলদার কথায় ভেসে চলে যেতাম কলকাতার ফুটবলের মাঠে, ক্রিকেটের কমেনন্টারি শুনতে শুনতে চলে যেতাম বোম্বাই। তখন তো টেলিভিশন নেই (শহরে বিদ্যুৎই আসে নি!) তাই দেখা নয়, ভাবনায় পৃথিবীটায় ঘুরপাক খেতাম।

    বিপরীতে বাচ্চুর পৃথিবী ছিল সরল সহজ আর প্রত্যয়ের। আমার ছিল উড়ান। শুধুই উড়ান। সারা বিশ্ব জুড়ে। আর্জেন্টিনা, সুইডেন, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, সেই সঙ্গে কলকাতা বোম্বাই দিল্লি... তাই যেদিন সকালে বাড়ি থেকে পালাচ্ছি, রেল গেটের কাছে ট্রেনের অপেক্ষায় (যাতে স্টেশনে কেউ জানতে না পারে কোথায় যাচ্ছি) মাদারির খেলা দেখছি, কাঁধে টোকা। মুখ ঘুরিয়ে দেখি, বাচ্চু। বলল, 'তুই বাড়ি থেকে পালাচ্ছিস?' আমি থ। 'যাস না বাবলু। এ কাজ আমাদের পরিবারে মানায় না। বাবা এখনো জেলে। দাদা সবে ডাক্তারি শুরু করেছেন, কষ্ট করছেন আমাদের জন্য, আমাদের কলেজ জীবনই শেষ হল না। যাস না।' আমি জোরে হেসে উঠেছি, 'পাগল? তোকে কে এই সব আজগুবী খবর দিয়েছে? আমি তো কোর্টে যাচ্ছি! মা'র কাজ আছে।' বাচ্চু সরল, ভাই বোনদের কথায় তার অগাধ বিশ্বাস। বলল, 'তাহলে ঠিক আছে।' বাচ্চু বাড়ির পথ ধরল। খানিক পরে আমি লুকিয়ে দৌড়ে লাফিয়ে ট্রেনে চড়ে বসলাম....

    এর পর পরবর্তী সংখ্যায়……………….


    [অরুণ চক্রবর্তী]


    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.