>

কমলেন্দু চক্রবর্তী

SongSoptok | 3/10/2015 |

কথাটা হচ্ছিল আমাদের কোলকাতা যাওয়া নিয়ে ৷ আমরা মানে উওরবঙ্গের দার্জিলিং মেল শিলিগুড়ি থেকে সন্ধে নাগাদ ট্রেন ছাড়ত ৷ বড় ইঞ্জিন ৷ ওদের নাম ছিল ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিন সেই স্টীম ইঞ্জিনই কিন্তু বেশ বড় ৷ মাঝে  মাঝে ডাবল ইঞ্জিনও থাকত ৷ মানে দুটো ইঞ্জিন গাড়িটাকে টানত ৷ ট্রেনে ওটার আগে একবার অন্ততঃ ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনটাকে দেখতেই হবে ৷ সেই সময় কিন্তু যাএীদের দুধরনের টিকিটের কামরা থাকত ৷ ফার্স্ট ক্লাশ, সেকেন্ড ক্লাশ আর থার্ড ক্লাশএখনকার মতো কেবল ফার্স্ট ক্লাশ আর সেকেন্ড ক্লাশ না ৷ অনেক পরে থার্ড ক্লাশ তুলে দেওয়া হয়েছিল, মানে সরকার বোঝাতে চেয়েছিল সব নিন্মবিওের লোকেরা বড় লোক হয়ে গেছে ৷ অথবা আমাদের দেশে কোনো তৃতীয় শ্রেণীর লোক নেই ৷ যাকগে আমাদের পাশ ছিল সেকেন্ড ক্লাশের ৷ রিজারভেশন না থাকলেও আগে থেকে জায়গা নিলে বসা-শোওয়ার খুব অসুবিধা হত না ৷ ট্রেনে জানলার ধারে সবাই বসতে চায় ৷ আমাকে সবাই কেন জানি জানলার ধারটা ছেড়ে দিত ৷ জানলার ধারে আবার মজা আর সমস্যাও ছিল ৷ যদি খোলা হাওয়ায় ভালোভাবে  সব দেখতে চাও, তবে ইঞ্জিনের দিকে মুখ করে জানলায় বসতে হবে এটা সবাই জানে ৷ কিন্তু কয়লার গুঁড়োর ইঞ্জিন থেকে গরম ধোঁয়া সঙ্গে ছিটকে বেরোত কয়লার গুঁড়ো ৷ সেগুলো চোখে মুখে লাগত ৷ কুচি কুচি কয়লা হলে কী হবে মুখে লাগলে ব্যথাও হত ৷ আর জামাকাপড় গুঁড়িতে ভরে যেত ৷ নইলে ইঞ্জিনের দিকে পিছন করে জানলার ধারে বস ৷ কিন্তু হাওয়া প্রায় লাগবে না ৷ আর বাইরের জিনিস দেখাটাও কম এলাকা ধরে হত ৷ কাজেই  বুঝতে পারতাম না কোন সিটটায় বসা উচিত ৷ রাতে ট্রেন বিশাল গতিতে চলত ৷ সেকেন্ড ক্লাশের সিটে গদি পাতা থাকত ৷ আমরা শুয়ে বসে রাত কাটাতাম ৷ সকালের দিকে মালদা পৌঁছাতাম ৷ মালদায় একটু চা-টা খেয়ে আবার চলা ৷ সকাল কাটতেই আমরা পৌঁছে যেতাম খেঁজুরিয়া ঘাট ৷  আর এখানেই শুরু হত যাএীদের একেবারে অন্য চেহারা ৷ যেন শত্রুর আক্রমণে পালাতে থাকা শরনাহী ৷ ট্রেন থামার আগে থেকেই  সব মালপএ  নিয়ে গেটের কাছে ঠেলাঠেলি ৷ এখানই আসল সাম্যবাদ ৷ স্ত্রী-পুরুষ, ছোট-বড়, ধনী-গরীব, বিহারী-বাঙ্গালী সব একাকার ৷ আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান তারই লাগি কারাকারি ৷ব্যাপারটা মোটেই কাব্যিক নয় ৷ আসল ব্যাপারটা হল দৌঁড়ে এক-দেড় মাইল (আন্দাজ হিসাব) গঙ্গার চড় পেরিয়ে লঞ্চ ধরতে হবে ৷ 

পরিষ্কার করেই লিখি ৷ আজকাল উওরবঙ্গেও ব্রডগেজ লাইন হয়ে গেছে ৷ আর হয়েছে ফারাক্কা ব্যারেজ ৷ গঙ্গার উপর বিশাল লম্বা ব্যারেজের উপর দিয়ে সরাসরি রেললাইন চলে গেছে ৷ যাএীরা বুঝতেই পারে না কত সহজ আর কম সময়ে এই যাএা শেষ ৷ সন্ধ্যাবেলায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেলে উঠলে সকালে আরামসে পৌঁছে যাওয়া যায় ৷ কিন্তু সেই সময় ? শিলিগুড়ি থেকে আসতে হবে গঙ্গার ওপারে নামতে হয় ৷ তারপর বিশাল বালির চর হেঁটে যেতে হত গঙ্গার ঘাটে ৷ যেখানে থাকত দুধরনের যান ৷ একটা তো রেলওয়ের নিজস্ব বিশাল জাহাজ (বিশাল কথাটা তখনকার চোখে ) ৷ আসলে সেটা ছিল বড় একটা লঞ্চ ৷ দোতলা ৷ অনেক খোলা জায়গা বেশ খেলা যেত ৷ আর সবচাইতে মজার ছিল ওখানে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল ৷ কী আনন্দ যে জাহাজ চলছে আর আমরা ভাত খাচ্ছি ৷  তবে একটা বিরক্তির কারণও ছিল ৷ আগে ভাগে খাওয়ার জায়গা দখল না করলে খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে লাইন দিতে হত ৷ জাহাজে সমস্ত মাল তুলতে  সময় নিত, কিন্তু  সব মিলিয়ে যাএা খুব বেশী সময় নিত না ৷ আমরা খাচ্ছি আর লোকেরা লাইন দিয়ে আমাদের ঘাড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে , এটা আমার কাছে ভীষণ বিরক্তি লাগত ৷ আর একধরনের যান ছিল ছোট লঞ্চ ৷ ছোট লঞ্চ প্রাইভেট ৷ ওদের রেলের মালপএ এবং মেল (চিঠি-পএ)কিছুই নেওয়ার দায়িত্ব থাকত না ৷ কাজেই যাএী ভর্তি হলেই ছেড়ে দিত ৷ আর স্প্রীড বেশী বলে তাড়াতাড়ি ওপারে পৌঁছে যেত ৷ স্টীমারে কোনো ভাড়া লাগত না ৷ কারণ ওটা রেলের ডিউটির মধ্যেই পড়ত ৷ কিন্তু লঞ্চে ভাড়া লাগত ৷ বোধহয় চার আনা বা ছয় আনা ৷

কিন্তু কেন খেজুরিয়া স্টেশনে নেমে এত তাড়াহুড়ো ৷ কারণ আগে গিয়ে লঞ্চ ধরতে হবে ৷ কেন আগে গিয়ে লঞ্চ ধরতে হবে লঞ্চ ধরতে পারলে আগে ওপারে পৌঁছানো যাবে ৷ আর তখন ওখানে দাঁড়ানো দার্জিলিং নামের একই ধরনের অন্য একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকবে ৷ ফাঁকা ৷ আগে ভাগে সীট দখল করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা যাবে ৷ উপরে বাঙ্ক দখল করে শোয়াও যাবে ৷ আর জাহাজে গেলে অনেক দেরী হবে ৷ গিয়ে জায়গা পাওয়া যাবে না ৷ মেঝেতে বা এর ওর সীটের কোণায় বসে থাকতে হবে ৷ খেজুরিয়া ঘাটে নেমে সব বিশাল বিশাল ভারি মোট নিয়ে সবাই দৌঁড়াতে শুরু  করত ৷  কত লোক যে বালির উপর হাঁটতে গিয়ে উল্টে পড়ত ৷ কিন্তু কার সময় আছে কাকে দেখাবে ৷ পঙ্গপাথেরী দল শুধু দৌঁড়াচ্ছে ৷ সবাই যে গরীব লোক বলে মাথায় বাক্স প্যাটরা মাথায় তুলেছে তা কিন্তু নয় ৷ পয়সাওয়ালা লোকেরই একই কান্ড করছে ৷ কারণ কুলি ৷ ভাবা যায় না ৷ একবার ডাক্তারী পড়ার সময় উওরবঙ্গ থেকে ফিরছি ৷ মালপএ একটু বেশী ছিল, ভাবলাম একটা কুলি করি ৷ আমার হিসাব পাঁচ টাকা মতো খরচা করা যাবে ৷ কুলি বলল, এক লাখ লাগবে ৷ না, না কুলি এক লাখ বলেনি ৷ ও বলেছিল পঁচিশ টাকা ৷ আমার মনে হচ্ছিল একলাখ  না হলে পঞ্চাশ হাজার তো হবেই ৷ এদিকে সবাই চলে গেছে প্রতিবারের মতো আমি একা দাঁড়িয়ে ৷ আমি কুলির সঙ্গে দড়াদড়ি চালিয়ে গেলাম ৷ প্রায় কাকুতি করে বললাম, স্টুডেন্ট হ্যাঁয় ৷ কষ্ট করকে পিতা রুপয়া দেতা হ্যাঁয় ৷ উতনা পয়সা তোমাকে দিলে সারামাস খাবো কি ? 

কুলিটির বোধহয় আমার ভাষা জ্ঞান দেখে একটু দয়া হল ৷ বলল, বিশ ৷
 আমি বললাম, দশ ৷
কুলিটি আর কোনো কথা না বলে উল্টোদিকে হাঁটা দিল ৷
আমি দেখলাম এতো মহামুশকিল ৷ নিজের তিন চারটা ভারি বাক্স ব্যাগ সব করে একবার তুলতে গেলাম ৷ কিন্তু আমি ব্যাগদের তুলব কি, ওরাই আমাকে টেনে ফেলে দিল ৷ একটু দূরে অন্য একটা কুলি দাঁড়িয়ে ছিল ৷ 
আমি বললাম, যাবে ?
-নাহি ৷
-কিতনা দিলে যায়গা ? 
-নাহি যায়গা , ব্যাস নাহি  যায়গা, এসময় দেখি প্রথম কুলিটা খৈনী টিপতে টিপতে হাজির ৷ মুখে ব্যাঙ্গের হাসি ৷ 
-আমি তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ৷ একেবারে desparate ৷ আমি তখন খৈনী টিপাকেই ধরে বললাম বেশ পঁচিশ টাকাই দেব ৷ নিয়ে চল ৷
-এখন একশো দিলেও হবে না ৷ হামি যে মাল নাহি লেতে, সে মাল দুসরা কেউ নেবে না ৷ 
মহাবিপদ ৷ এদিকে আর দেরী করলে স্টীমার পাব না, মানে ওপারের দার্জিলিং মেল ও পাব না ৷ চলে এল জেদ ৷ তুললাম সব ঘাড়ে মাথায় হাঁটা শুরু করলাম বালির রাস্তায় ৷ হাঁটলাম দাঁতে দাঁত চেপে ৷ স্টীমার ছাড়ার আগে ওতে উঠেও পড়লাম ৷ মানুষ সব পারে ৷ 
ফারক্কা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকত অন্য একটা দার্জিলিং মেল ৷ ওটাতে উঠে পরের দিন বিকালে শিয়ালদহ ৷ এখন আর ওসবের বালাই নেই ৷ কয়েকদিন থাকতাম জানতাম ওটা আমাদেরই বাড়ি ৷ কিন্তু পরে জানলাম বাস্তব অতি কঠিন ৷ 

দোমহনীর কথা যেন শেষই হয় না ৷ মোটামুটি ভাবে তিন বছর পরপর বাবার নতুন জায়গায় বালি হত ৷ সেই হিসাবে সব জায়গার ঘটনাই প্রায় একই সংখ্যায় হওয়াটাই স্বাভাবিক ৷ কিন্তু দোমহনীর ঘটনা বেশী হয়েছিল ৷ আসলে ঘটনা বেশী হওয়ার চাইতেও খুলে গিয়েছিল আমার চোখ, মনের ভিতর আসতে শুরু করেছিল ৷ যুক্তি-বিবেক আর চিন্তা ৷ দোমহনীতে আমাদের মাকে সবাই বলত অমল-কমলের- মা৷ লোকে বলত, দেখ ওদের দেখ ৷ দেখে শেখো ৷ এটাতে বুঝতাম মা একটু খুশিই হত ৷ ছেলে-মেয়েদের পরিচয়ে বাবা-মায়ের পরিচয় বাবা-মায়েদের একটা প্রসন্নতা এনে দেয় ৷ কিন্তু সে অর্থে আমরা কিন্তু বিশেষ কিছুই করতাম না ৷ যেমন আর পাঁচজন ছেলে মেয়েরা করে ৷ আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি ৷ যেমন চুরি ৷ হ্যাঁ, আমি বাজার থেকে চুরি করেছিলাম ৷ ঠিক আমি করিনি ৷ করেছিল বাদল, আমি সাগরেদ ৷ বাদল ঠিক আমাদের পাশের কোয়াটার্সেই থাকত ৷ কিছু একটা গোলমাল ছিল বাড়িতে ৷ বাদল কারো সঙ্গে মিশত না ৷ একা একা চুপ করে বসে থাকত ৷ বাড়িতে বোধহয় খাওয়াদাওয়া ও দিত না ওর মা ৷ কিন্তু তাই বলে কারো বাড়িতেও যেত না শুকনো মুখ করে ৷ স্কুলেও যেত না ঠিক মতো ৷ আমি বাদলের সঙ্গে কথা বলতাম ৷ ওর সঙ্গে মিশতাম ৷ কিন্তু ও বেশী কথা বলত না ৷ আমার ওর জন্য বেশ কষ্ট হত ৷  দু-একবার আমাদের বাড়ি থেকে রুটি গুড় নিয়ে গিয়ে দিতাম ৷ কিন্তু ও খেতে চাইত না ৷ আমিই জোর করে খাওয়াতাম ৷

একদিন বাদল সারাদিন আমাদের গরুদের জন্য রাখা খড়ের গাদায় শুয়ে ছিল ৷ সকালে স্কুল যাওয়ার পথে যেমন দেখেছি, ফিরে এসেও দেখি একইভাবে শুয়ে আছে ৷ বাড়িতে বইটই রেখে গেলাম ওর কাছে ৷ দেখি ঘুমোচ্চে ৷ একটু ডাকতেই ধরফর করে উঠে দাঁড়াল ৷ তারপর ছোট্ট একটা কথা, আয় ৷ বাদল হাঁটা দিল ৷ আমিও কিছুই বুঝতে না পেরে ওর পিছন পিছন চলতে লাগলাম ৷ কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে উওর পাব না ধরেই নিয়েছিলাম ৷ কাজেই ওর পিছন পিছন চলতে লাগলাম ৷ আজ ছিল হাটবার ৷ সপ্তাহে দুদিন হাট বসত ৷ বাদল সোজা গেল সবজি বাজারে ৷ বসল একটা তরমুজের দোকানের সামনে ৷ বসেই একটা তরমুজ দুপায়ের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে পিছনে এনে ফেলল যাতে দোকানদারের চোখে না পড়ে ৷ তারপর অন্য একটা তরমুজ হাতে নিয়ে দরাদরি করতে লাগল ৷ বাদল মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর চোখের ইশারায় বলছে তরমুজটা তুলে সরে যেতে ৷ আমি তো তখন পুরো ভ্যাবাচাকা খাওয়া ৷ অনেকবার ওরকম করার পর আমি ওর পিছনে রাখা তরমুজটা হাতে নিয়ে ওখান থেকে সরে এলাম ৷ বাদল ওদিকে দরাদরির নামে দোকানদারের সাথে তর্কাতর্কি করতে শুরু করেছে ৷ কিছুক্ষণ বাদে বাদল এল আমার কাছে ৷

-কিরে এটা কি করলি তুই ৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম ৷ 
-কেন ? চুরি ?
-চুরি করিস ৷ তুই চোর ?
-চল এখন এখানে দাঁড়ানো যাবে না ৷ 
আবার আমরা আমাদের বাড়ির খড়ের গাদায় ফিরে এলাম ৷ আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে বাদলের উপর ৷ কিন্তু কিছু বললাম না ৷ ভাবছি বাড়ি যাই ৷ সন্ধ্যে হয়ে এসেছে ৷ বাদল পকেট থেকে একটা ছুরি বের করল ৷ তারপর তরমুজটাকে ফালাফাল করে কেটে ৷ আমাকে একটা টুকরো দিয়ে বলল, নে,যা ৷ বেশী দিতে পারব না ৷ 
-আমি খাব না ৷ আমি বললাম ৷
-কেন চুরির মাল বলে ? খা খা চুরি করলেও এটা খিদে মেটাবে,---- দিলেও ওটা খিদে মেটাবে ৷ খিদে কী জিনিস জানিস না তো !
-বেশ জানি ৷ খিদে আমারও পায়, কিন্তু চুরি করে খাই না ৷ 
-নে, কাল রাত থেকে আজ এই সন্ধ্যে এই প্রথম খাবার ৷ একে তুই চুরি বলবি ৷ আমি তো আজকাল এভাবেই বেশীরভাগ সময় পেট ভরাই ৷ চোর তো চোর, কিন্তু মায়ের মতো তো না যে বাদল চুপ করে গেল ৷ চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ৷
আমি কী করব বুঝতে না পেরে ওর  হাত থেকে তরমুজের টুকরোটা নিয়ে খেলাম , তারপর ধীরে ধীরে ওখান থেকে চলে এলাম ৷ জীবনকে ধীরে ধীরে কঠিন মনে হতে শুরু করল ৷

কী করে যেন ঠিক হল যে দোমহনী রেলওয়ে ক্লাবের সঙ্গে লাটাগুড়ির একটা ক্লাবের খেলা হবে ৷ ফুটবল ম্যাচ ৷ আসলে ঐ নামের কোনও ক্লাবের ছিল না ৷ শুধু একটা ফুটবল ম্যাচের জন্য নামেই ঐ ক্লাবের ছিল ৷ প্লোয়ার বাছাই হল ৷ একটু মনোমালিন্যও হল ৷ তারপর জোরকদমে শুরু হল প্রেকটিস ৷ আমার সেন্টার ফরওয়ার্ডের পজিশন পাকা ৷ সেজদা ব্যাকে ৷ সব রেডি ৷ খালি পায়ে খেলা হত ৷ খেলার দিন সকালে মনে হল আরে খাবো কী করে ? ওসময় তো কোনো ট্রেইন নেই ৷ ওদিক যে কোনো জায়গায় যাতায়াতের একমাএ ভরসা ট্রেইন ৷ অনেক চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করলাম বাবাকে বলবে হবে সাটেল ইঞ্জিন দিতে হবে ৷ রেলওয়ের কোনো বিশেষ দরকার হলে আলাদা করে শুধু ইঞ্জিনটা যেত ৷ আর একটা ব্যবস্থা অবশ্য ছিল-ট্রলি ৷ ট্রলি দুরকমের হা একটা সাধারণ ঠেলা-ট্রলি আরেকটা মোটর ট্রলি ৷ ঠেলা ট্রলি খুব সাধারণ দেখতে চারটা ট্রেনের চাকার মতো একজোড়া করে চাকা থাকে ৷ একটা কাঠের পাটাতনের মাঝ বরাবর একটা কাঠের হেলান দেওয়া বেঞ্চ থাকে ৷ ট্রলির পিছন দিকটা হাতে ধরে ঠেলার জন্য দুদিক দুপাশের দুটো করে লোহার হ্যান্ডেল থাকে ৷ যারা বেঞ্চে দুজন খুব জোরে তিনজন লোক বসতে পারে আর দুজন লোক ট্রলিকে ঠেলে ৷ এই ঠেলা ট্রলি এমন হয় যে যখন তখন উপরের পাটাতন নামিয়ে চাকা জোড়া দুটোকেও রেললাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া যায় ৷ এটা খুব জরুরী ৷ কারণ, যদি ট্রেন আসে তখন লাইন ঠেলা ট্রলিতে না আটকা পড়ে বা ধাক্কা মারে ৷ এসব আমরা নিজেরাই শিখে গিয়েছিলাম ৷ এরজন্য কেউ কিছু বলত না ৷ আরো একটা মজার ব্যাপার ছিল ৷ সেটা একটু প্র্যাকটিস করতে হত ৷ যে দুজন লোক ট্রলি ঠেলত,তারা রেললাইনের উপর দিয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ট্রলিকে ঠেলত ৷ এভাবে ঠেলতে ঠেলতে যখন ট্রলির স্পীড বেড়ে যেত,তখন সাময়িকভাবে ট্রলিতে লাফ মেরে উঠে পড়ত ৷ চলন্ত ট্রলিতে বসে একটু জিড়িয়ে নিত ৷ আমরা ট্রলি ভালই ঠেলতে পারতাম ৷ 

আর এক ধরনের ট্রলি ছিল ৷ যাকে বলতাম মোটর ট্রলি ৷ এখানে ট্রলিকে ঠেলতে হয় না ৷ মোটর লাগানো থাকে ৷ একজন চালায় ৷ এই মোটর ট্রলির আবার অনেক ধরনের হয় ৷ সাধারণভাবে মোটর ট্রলি একটু উঁচু পদের লোকেদের জন্য ৷ মাথার উপর বিরাট একটা ছাতা লাগানো থাকে ৷ সব চাইতে রাজার মতো ট্রলিকে আমরা বলতাম কেবিন ট্রলি ৷ কেবিন ট্রলি খুব কম আসত৷
ট্রলির কাজ হল সেইসময় ট্রেন নেই বলে কোনো জায়গায় রেললাইন মেরামত বা অন্যান্য কাজ করা ৷ ট্রলির গল্প তো হল ৷ কিন্তু কাজের কাজ কী হল আমরা ফুটবল খেলতে যাবো কী করে ? ঠেলা ট্রলি দু-একটা জোগার করা যায় হয়তো কিন্তু কে ঠেলবে ৷ আর কতজনই বা যাবে ৷ 
তাই সেটাই সাব্যস্ত হল সাট্ল ইঞ্জিন চাই ৷ বাবাকে গিয়ে বলতেই বাবা এক কথায় প্রস্তাব নাকচ করে দিল ৷ খেলার জন্য ইঞ্জিন দেওয়া যাবে না ৷ তারপর একেতাকে ধরে কোনো রকম একজন ড্রাইভার কাকাকে ধরেটরে ব্যবস্থা হল ৷ 
আমরা সবাই যেখানে কয়লা থাকে সেই কয়লার উপর বসে পড়লাম ৷ লাটনগুড়ি গেলাম আর ফুটবল খেলে,গোল খেয়ে আবার দাঁড়িয়ে থাকা সেই ইঞ্জিন করে বাড়ি ফিরলাম ৷ সারা শরীরে কয়লার কালো,না হারার কালো এই নিয়ে মাথা ঘামালাম না ৷ ফিরতি ম্যাচে অবশ্য আমরা লাটাগুড়িকে হারিয়েছিলাম ৷ 
দোমহনী কথাটা যেন শেষই হয় না ৷ কিন্তু মাএ তিন বছর সময় ৷ 

আমাদের বাড়ির একটা অলিখিত নিয়ম ছিল যেমন,তেমনি ছিল অফুরান মুক্তি ৷ আমাদের কোনো কাজেই কেউ বাঁধা দিত না ৷ আবার ভুল করলে মারধর বা বকাবকি না করে মা বুঝিয়ে দিত যে কাজটা মোটেই ভালো করিনি ৷ এবং হয়ত কারোর বিশ্বাস হবে না ৷ মায়ের অপছন্দের কাজ একবার করলে আর দ্বিতীয়বার করতাম না ৷ এখনও করি না ৷ 

যেমন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরা ৷ সন্ধ্যা হলেই যে যেখানেই থাকুক আমরা বাড়ি ফিরে আসতাম ৷ যা হোক রুটির টুকরো মুখে দিয়ে পড়তে বসতাম ৷ একদিন আমি বাড়িতে বসেই কিছু করছিলাম ৷ অনেকক্ষণ সন্ধ্যা হয়ে গেছে সেটা আমি জানি ৷ কিন্তু হাতের কাজটা শেষ না করে উঠতেও ইচ্ছা করছিল না ৷ মা রান্নাঘর থেকে একবার বলল, কমল সন্ধে কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে ৷ সেদিন আমি বিদ্রোহ করলাম ৷ আমি আমার পড়াশোনার ব্যাপারে সজাগ ৷ কাজেই মা কেন আমার ঘুরিয়ে পড়তে বসার কথা বলল ৷ আমি উঠলাম না ৷ তিনদিন আমি বই নিয়ে বসিনি ৷ কেন আমার দায়িত্ব জ্ঞান নিয়ে মা প্রশ্ন তুলবে,এটাই ছিল আমার মত বা জেদ ৷ এই তিনদিন মা ও কিন্তু আমাকে কিছু বলেনি ৷ তিনদিন পরে মা বলল,রাগ কমেছে ? ভুল হয়েছে বাবা তোমাকে সেদিনের কথাটা বলে ৷ 

তাই বলে কেউ যেন না ভাবে আমার মা নরম মনের ৷ বরং উল্টো ৷ মায়ের কাছে আমার বন্ধু-বান্ধবরা আসত না ৷ বলত তোর মাকে দেখলে খুব ভয় লাগে৷ তবে যারা ভালো ছেলে তারা কিন্তু মায়ের কাছে আসত ৷ নাড়ু টাড়ু খেত গল্প করত ৷ এখন মনে হয় আমার মায়ের মতো আরও অনেক মা থাকলে অনেক ছেলে-মেয়ে দেশের কাজে লাগত ৷ মায়ের নীতি আমরা সবসময় ধরতে পারতাম না ৷ একদিন মাকে এসে বললাম,মা জানো বিকাশ আমাকে মেরেছে ৷ মা গম্ভীরভাবে বলল,কই আমাকে তো মারে না ৷ 

মায়ের কথাটার মানে বুঝলাম না ৷ অন্যদের মায়েরা ছেলে-মেয়ে মার খেলে ঝগড়া করতে বেরোত ৷ আর আমার মা আমার এতটা মার খাওয়ার পরেও কেমন নির্বিকার হয়ে বলে দিল,কই আমাকে তো মারে না ৷ বহুবছর কথাটা নিয়ে মায়ের উপর অভিমান করেছিলাম ৷ নিজের ছেলে মার খেলে,কোনো মা এমন বলে ৷ পরে বুঝেছিলাম মায়ের কথার মানে ৷ মায়ের কথার অর্থ হল তুমি নিশ্চয়ই কিছু করেছো,তাই মার খেয়েছো ৷ আমি তেমন খারাপ কিছু করিনি,তাই আমাকে কেউ মারতে আসেনি ৷ তুমি যেমন করবে,তেমনই ফল পাবে ৷ এটা বোঝার পর থেকে মায়ের শিক্ষার উপর আমার ভক্তি আরো বেড়ে গেল ৷ 

(ক্রমশ)

[কমলেন্দু চক্রবর্তী]









Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.