>

লিপিকা দে

SongSoptok | 9/15/2015 |






শহর ছাড়িয়ে গাড়ীটা কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে পড়া মাত্রই ড্রাইভার শক্তিপদ রেডিওর ভলিউমটা বাড়িয়ে দিল। সকালের রোদ্দুরের সাথে মিলেমিশে সুরের ধারায় ভেসে গেল ইনোভার অন্দরমহল - “আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।F.M. এর কোন চ্যানেল যে রবীন্দ্র-সংগীত বাজায় তা রিয়ার ধারণার বাইরে ছিল। এবং কোন কমার্শিয়াল গাড়ীর ড্রাইভার যে তা ভালোবেসে শুনতে পারেন সেটা আরো অকল্পনীয়। পিছনের সীটে শরীর এলিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল রিয়া। শিল্পী অচেনা। উচ্চারণ মাঝে মাঝে কানে লাগলেও নিজের অজান্তেই শিল্পীর সাথে গলা মিলিয়ে গুনগুন করে উঠল রিয়া - “সারাদিন আঁখি মেলে - দুয়ারে রব একা, শুভক্ষণ হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা। ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন মনে, ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ” - আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। রবীন্দ্রনাথের পদটাকে নিজের মত করে বদলে নিল রিয়া। পথ চাওয়াতে নয় - পথ চলাতেই আনন্দ। শুভক্ষণ আসবে কি না-আসবে তার ভরসায় কি আজন্ম বসে থাকা যায়!
........................................................... 

দেবর্ষি রায় দুর্গাপুর শহর থেকে বোধহয় একমাত্র ছেলে যে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক দুটোতেই স্ট্যান্ড করেছিল। রিয়ার এক বছরের সিনিয়র। ওর বোন মৌসুমি রিয়াদের স্কুলে পড়ত - এক ক্লাস নীচে। দাদার গর্বে মাটিতে পা পড়ত না মৌসুমির। প্রতি বছর শিক্ষক-দিবস উপলক্ষ্যে যে আন্তঃ-বিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত - সেখানেই ওদের প্রথম পরিচয়। পরিচয় বলাটা অবশ্য বাড়াবাড়ি। দেবর্ষি নিজের বক্তব্যটুকু বলা ছাড়া আর কারুর সাথেই কোন বাক্যালাপ করত না। মেয়েদের সাথে তো নয়ই। দেবর্ষির বাংলা মিডিয়ম - রিয়ার ইংলিশ। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন একটানা এই মঞ্চেই দেখা-সাক্ষাত - বছরে একবার। রিয়া ভাবত অহংকারী - দেবর্ষি কি ভাবত কে জানে! রিয়া, দেবর্ষি, সহেলি, সুদীপ্ত, নীহারিকা, সৌম্য  - এরা ছিল পুরনো পাপী - পুরষ্কারও মোটামুটি এরাই পেত - যদিও প্রতি বছরই প্রতিযোগীর সংখ্যা বাড়ত। দেবর্ষির স্ট্যান্ড করার খবরটা তো খবরের কাগজ থেকেই জেনেছিল রিয়া। এও জেনেছিল যে  দেবর্ষি যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিল। তাই খড়গপুর আই আই টি তে প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকে দেবর্ষিকে সুদীপ্তর পাশে দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে গেছিল। সেই সন্ধ্যায় সুদীপ্তকে শুধু মারতে বাকি রেখেছিল রিয়া। গত একমাস ধরে ওরা দুজন প্রচুর আলোচনা করেছে খড়গপুর যাওয়ার ব্যাপারে - সুদীপ্তই ছিল রিয়ার যাবতীয় জ্ঞানের সরবরাহকারী - আর এত বড় কথাটা ও বেমালুম চেপে গেছিল! যাদবপুর ছেড়ে দেবর্ষি ওদের সাথেই আই আই টি তে মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছে।

সেই সন্ধ্যায় রিয়ার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে সুদীপ্ত একটাই গৎ ধরে থেকেছে - “তোর যে দেবর্ষির ব্যাপারে এত কৌতূহল আছে আমি জানতাম না!” কৌতূহল? একটা স্ট্যান্ড করা ছেলে - সে কেন একবছর নষ্ট করে আই আই টি তে মেক্যানিকাল পড়তে আসবে তা রিয়া কিছুতেই বুঝতে পারছে না। সুদীপ্ত এমন ভাণ করছে যেন এটা খুবই স্বাভাবিক। এমনকি দেবর্ষি প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স পড়তে গেলেও এত অবাক হত না রিয়া। বারবার একই কথা বলাতে সুদীপ্ত শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়েওকেই জিজ্ঞেস করিস কাল” - বলে গটগট করে হেঁটে ওর হোস্টেলে ফিরে গেছিল। রিয়ার আর উত্তরটা জানা হয়নি কোনদিন। 
...............................................................

শ্রাবণ মাস শেষ হতে চলল। মাঠ জুড়ে নানা রঙের সবুজ। কাঁচের জানালার বাইরে নারকেল গাছের পাতায় পাতায়, ধানের ক্ষেতে - রৌদ্র ছায়ার খেলা - আর ভেতরে একাকার হয়ে যাচ্ছে বর্ষা-বসন্ত। আজ দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন। নবীন শিল্পীরাও কিংবদন্তী শিল্পীর প্রিয় গানগুলোই গাইছেন।

এসো গো - জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি - বিজন ঘরের কোনে - এস
আনো বিস্ময় মম নিভৃত প্রতীক্ষায় যূথী মালিকার মৃদু গন্ধে

পঁয়ত্রিশ বছর বাংলার বাইরে। এমন জলভরা কাজল কালো মেঘ আর কোথাও দেখা যায় কি? মেঘ যদিবা নেমে আসে নারকেল গাছের মাথায় চুমু খেতে - রিয়ার এমন অবকাশ কোথায় ধানের ক্ষেতে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা দেখার! যতদূর চোখ যায় পিছনের দিকে - শুধুই স্বপ্নের পর স্বপ্ন দিয়ে জীবনের নকশিকাঁথা বুনতেই তো  ব্যস্ত থেকেছে রিয়া। রোহিত, পিয়ালি আর রিয়ার ষ্টার্টাপরিচলাইফএর বয়স এখন ১৫। প্রায় দেড় মিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। আমেরিকাতেই ওর আলাপ রোহিত আর আর ওর বউ পিয়ালির সাথে। ওরা দুজন ছিল Amherst Isenberg School of Management  এ।  রিয়া কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ তখন পি এইচ ডি শেষ করছে। তিনজনেরই ইচ্ছে দেশে ফেরার - কিন্তু পছন্দমতো চাকরি নেই। গুটিকতক লোক নিয়ে সেই শুরু। মূলত কন্সাল্টেন্সি। ফার্ম।  এখন ওদের ভরা সংসার। পেপার, ফুড এন্ড বেভারেজ, টেক্সটাইল - সব ধরনের ফ্যাক্টরির ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সলিঊশান দেওয়ার দায়িত্ব রিচলাইফের। বিদেশী কোম্পানির সাথে পার্টনারশীপ দিয়ে শুরু করে এখন ওদের নিজস্ব কারখানায় উৎপাদিত হয় নানা ধরনের এনজাইম।

জীবন বলতে আজ কন্ট্র্যাক্ট, ডেডলাইন, মার্জিন, রেভেনিঊ। খারাপ লাগে না রিয়ার। অন্তত লাগত না কিছুদিন আগে অবধি। দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়।  ক্বচিৎ কখনো ক্লান্ত বোধ করলে নিজেকে ফিরে পেতে চলে যায় কখনো বরফের পাহাড়, কখনো সমুদ্রের নীল বিস্তার, কখনো মরুভূমির বালিয়াড়িতে। বেশীর ভাগ জীবন কাটিয়েছে বাঁধনহীন। না - বাঁধন আছে অনেক - আলগা অথচ দৃঢ়। রিচলাইফের কয়েক হাজার কর্মী ও তাদের পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে, রোহিত আর পিয়ালির সন্তানদের প্রতি আছে, নিজের মা-বাবা, দাদা-বৌদি যারা কিছুই চায় না - তাদের প্রতিও কোথাও একটা প্রচ্ছন্ন দায়িত্ববোধ আছে রিয়ার। শুধু নিজের প্রতি কোন দায়িত্ব নিতে চায় না রিয়া। অলীক স্বপ্নময়তার জন্য একটা সুন্দর জীবনকে নষ্ট করা অর্থহীন। চোখ কান বন্ধ করে কাজের মধ্যে ডুব দিয়ে চাওয়া-পাওয়ার বাইরে যে নির্লিপ্ত নির্বাণশুধু  তাই চেয়েছে রিয়া আজ অনেক বছর ধরে। তবু বয়স বাড়ে - শরীর ভাঙ্গে। মনের বাঁধন আলগা হয়। কোন এক অলক্ষ্য চোরাপথ দিয়ে ঢুকে পড়ে বেহিসাবি কাজ-ভাঙ্গানি গানের সুর। সেই সুরের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে রিয়া আজ বাড়ী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে - কিন্তু কোথায় বা কিসের টানে - তা ও নিজেও ভেবে দেখেনি ঠিক করে। জলভরা মেঘটা হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে যায়।  জানলার কাঁচে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিরা মিলেমিশে জলপ্রপাত হয়ে যায় - ঝাপসা হয়ে যায় আকাশ-প্রান্তর-দিক-দিগন্ত। ভেতরে গমগম করে  

হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি
আমি কোন সুরে ডাকি তোমারে।
পথ চেয়ে থাকা মোর দৃষ্টিখানি
শুনিতে পাও কি তাহার বাণী?
কম্পিত বক্ষের পরশ মেলে কি সজল সমীরণে?”
......................................................

প্রথম বছর পূজোর ছুটিতে সুদীপ্তর আর রিয়ার একসাথে বাড়ী ফেরার কথা ছিল। কিন্তু খড়গপুর বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে সুদীপ্তকে কোথাও দেখতে পেল না রিয়া। ব্যাগ হাতে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল দেবর্ষি। রিয়া পৌঁছতে ও জানালো যে সুদীপ্ত খবর পাঠিয়েছে ও আসতে পারছে না। সুদীপ্তটা  ওরকমই। কথার কোন ঠিকঠিকানা নেই। ততদিনে রিয়ার সাথে দেবর্ষির মোটামুটি ভালই আলাপ হয়েছে  - কেমিস্ট্রি ল্যাবে ওরা পার্টনার। রিয়া একটু গুটিয়ে থাকে এই স্ট্যান্ড করা ছেলেটার সামনে। পদার্থবিদ্যায় রিয়া বরাবরই একটু কাঁচা। রিয়া ভেবে ওঠবার আগেই অঙ্ক-টঙ্ক দেবর্ষি ঝটপট করে ফেলে। রিয়াকে সাহায্যও করে। রিয়া নাটক -আবৃত্তি-গান এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে - এমনিতেই পড়াশুনো করার বিশেষ সময় পায় না। দেবর্ষির গাম্ভীর্যে ও আরো দিশাহারা বোধ করে। সুদীপ্ত সঙ্গে না থাকায় ওর স্বভাবসিদ্ধ চপলতা কি করে চাপা দিয়ে রাখবে তা নিয়ে রিয়া বেশ বিব্রত থাকে সারাটা পথ। বাস ছুটছিল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। আকাশে একফালি পঞ্চমীর চাঁদ। রিয়া চেষ্টা করছিল কথা বলতে। দেবর্ষি উত্তর দিচ্ছিল - কিন্তু মাঝে মাঝেই অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছিল। একবার জিজ্ঞেস করল - “তুই কি অঙ্ক নিয়েই পড়বি ঠিক করেছিস?”
হ্যাঁ সেরকমই তো ইচ্ছে।
তাহলে তুই কোলকাতার কলেজে না গিয়ে এখানে এলি কেন।
Million dollar question. কিন্তু বাড়িতে বাবার সাথে বহু চর্চার ফলে এর উত্তরটা এখন রিয়ার ঠোঁটের ডগায়। রিয়ার ইচ্ছে ভবিষ্যতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে কিছু করার। অঙ্ক নিয়ে পড়াশুনো করলে তার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা যায়। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়লে একবছর সময় নষ্ট হবে। বাবা কিছুতেই তাতে রাজি নন। দেবর্ষি অদ্ভুত চোখে রিয়ার দিকে তাকাল - “তুই বেশ বিজ্ঞের মত ভাবতে পারিস তো!” রিয়া লজ্জা পেল। সুদীপ্তর সাথে ওর যে সহজ বন্ধুত্ব - দেবর্ষির সাথে তা কিছুতেই পারে না।

পূজোর কটা দিন কেটেছিল হইহই করে। সাইকেল নিয়ে সারা দুর্গাপুর টহল দিয়েছিল তিনজনে। দশমীর পর পড়ার বাহানা করে রোজই রিয়ার বাড়িতে একত্রিত হত ওরা - এবং বইতে হাতও দিত না। লক্ষ্মীপূজোর আগেরদিন বিকেলে সুদীপ্ত এলো রিয়ার বাড়ী। পরের দিন ওদের ফেরা। মন খারাপ হলেও ওদের বাড়ীর লোকেরা মেনে নিয়েছিল এটা।

আমার সাথে চল তো একবার - দেবাটার কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে বাড়িতে।দেবর্ষি থেকে দেবা - ছেলেদের হোস্টেলে নামের মর্যাদা ধরে রাখাটা বেশ কঠিন ব্যাপার। রিয়ার তো আরো ঝামেলা। মৌসুমির দাদাকে না পারে নাম ধরে ডাকতে - না পারে সহপাঠীকে দাদা বলতে। সুদীপ্ত বলা মাত্রই রিয়া সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল ওর সাথে। দেবর্ষির বাড়িতে আগে কোনদিন আসেনি রিয়া। রিয়াদের মতো বাংলো নয়। ছোট কোয়ার্টার। মৌসুমি বাড়িতে নেই। রিয়ার মনে হল ইচ্ছে করেই বেড়িয়ে গেছে ও। বাইরের ঘরে লক্ষ্মীপূজোর আয়োজন করছিলেন ওর মা। ওদের দেখে ঘরে চলে গেলেন। মিষ্টি, শরবত, জল নিয়ে এসে দেবর্ষি বসল ওদের সাথে। গম্ভীর, অন্যমনষ্ক। 

সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল - “কাল দুটোর বাস ধরছ তো?”
তখনো সার্বজনিক তুই-তোকারি শুরু হয়নি।
না - আমি পরশু যাব! কাল বাড়িতে পূজো আছে!”
এই না প্লীজ চল কাল আমাদের সাথে। পরশু কেমেষ্ট্রি ল্যাব - তুমি না থাকলে আমাদের গ্রুপ তো ডুবে যাবে!” সম্বোধনের ব্যাপারটাকে এড়িয়ে রিয়া আবদার করে দেবর্ষির কাছে।

দেবর্ষি রিয়ার চোখে চোখ রেখে কি বোঝার চেষ্টা করল কে জানে - “চল তোদের এগিয়ে দিয়ে আসি” - বলে প্রায় ঠেলেঠুলেই বাড়ী থেকে বার করে দিল দুজনকে। সাইকেল নিয়ে ওদের পাশে পাশে এল প্রায় অর্ধেক রাস্তা - তারপর সুদীপ্তকে বলল - “তুই নিশ্চয়ই রিয়াকে বাড়ী অবধি পৌঁছে দিবি। আমি চললাম।
কাল আসছ তো আমাদের সাথে?”
দেবর্ষি ততক্ষণে উল্টোদিকে চলতে শুরু করেছে। রিয়ার প্রশ্নের উত্তরে বাতাসে ভেসে এলো একটানা

পরের দিন দুটোর বাস ধরতে এসে ওরা দেখল দেবর্ষি ওদের আগেই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে। বাস ছাড়ল। তিনজনের সীটে বসেছে ওরা। রিয়া জানালার ধারে। মাঝখানে কখনো সুদীপ্ত, কখনো দেবর্ষি। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। বাস এসে যখন পৌঁছল খড়গপুরে - তখন রাত প্রায় সাড়ে-আটটা। দেবর্ষি আর রিয়া এক রিক্সায় ফিরছিল। রিয়ার হোষ্টেল আসার একটু আগে দেবর্ষি ওর স্বেচ্ছা-আরোপিত মৌনতা ভেঙ্গে রিয়াকে বলল -  “তুই কাল বিকেলে আমাদের বাড়ী না এলেই পারতি। খামোকা খানিকটা জটিলতা বাড়িয়ে দিলি। কি জটিলতা, কার জটিলতা, কেন জটিলতা - কোন ব্যাখ্যা নেই।  অভিমানে দম বন্ধ হয়ে আসছিল রিয়ার। তবু সহজ গলায় বলল
 - “তা নাহলে তো তুমি আজ আসতে না।
তাতে তোর কি! যা ঘরে যা।

রিয়া চলে গেল। দেবর্ষির সাথে সেই ওর শেষ কথোপকথন - নির্জন নিভৃতিতে। এর পর বছর খানেক ক্লাস ছাড়াও দেখা হয়েছে এদিক ওদিক - প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা রিয়া আর কোনদিন বলার চেষ্টা করেনি দেবর্ষির সঙ্গে। কারুর জীবনে অকারণ জটিলতা হয়ে থাকার কোন মানে হয় না। নিজের মতো করে সেই জটিলতার কিছু কিছু অর্থ করে নিয়েছিল রিয়া। সেকেন্ড ইয়ারে রিয়া কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ চলে গেল। অঙ্ক তখন আর ওর ভালো লাগে না। সেকেন্ড ইয়ার থেকে ওদের আর কোন কমন ক্লাস রইল না। দেবর্ষির সাথে ক্যাম্পাসেও দেখা হত না রিয়ার। দুএকবার বাড়ী যাওয়ার সময় সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করেছে। ভাসা ভাসা উত্তর পেয়েছিল - ও ক্যাম্পাসের বাইরেই বেশিক্ষণ কাটায়। প্রচুর ছেলেমেয়েকে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য physics পড়ায়। তাতে বিশেষ আশ্চর্য্য হয়নি রিয়া। নাচ-গান-নাটক- আবৃত্তি - রিয়া ভেসে গিয়েছিল - বন্ধুর  সংখ্যাও  অনেক।  চার বছর শেষ হতে চলল। ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবার আগে প্রায় সব পুরনো বন্ধুরাই মেয়েদের হোস্টেলে এসে রিয়াদের সাথে দেখা করে গেল। কিন্তু দেবর্ষি একবারও এল না। রিয়ার কষ্ট হয়েছিল - কিন্তু কেনই বা ওর সাথে দেখা করতে আসবে দেবর্ষি - এ প্রশ্নেরও কোন সদুত্তর ছিল না ওর কাছে। কয়েকদিনের ল্যাব পার্টনার - কিছুদিনের সহপাঠী। বয়স যখন উনিশ - কোন স্মৃতিই মুছে ফেলা খুব কঠিন নয়।
হারিয়ে ফেলাও খুব সহজ ছিল তখন।

...................................................               

ক্ষণিকের বিজ্ঞাপন বিরতির পর এবার শুরু হয়েছে।

চলে যায় দিন যত খন আছি
পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি
তোমার মুখের চকিত সুখের হাসি দেখিতে যে চাই
তাই অকারণে গান গাই
মনে রবে কি না রবে আমারে।

হারিয়ে ফেলা যেমন সহজ ছিল একদিন - এখন তেমনি সহজ খুঁজে পাওয়া। ফেসবুকে সুদীপ্তর ফ্রেন্ড লিস্টে দেবর্ষিকে যেদিন দেখতে পেল রিয়া সেদিনই দেবর্ষি ওকে মেসেজ পাঠাল - “আমি কি তোমার বন্ধু হতে পারি?”  দেবর্ষির মুখে তুমিশুনে ধাক্কা খেল রিয়া। রিয়া ওর অনুরোধ রাখতে দায়বদ্ধ নয়। ইচ্ছে করল জিজ্ঞেস করে - “আমি? কেন অকারণ জটিলতা?” কিন্তু করা হয় না। আঠেরোতে যে মূহুর্ত হারিয়ে গেছে - আটচল্লিশে তা ফেরানো যায় না।   

প্রতীকের সাথে ওর সম্পর্কটা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ওটা যে আর বেশিদিন টিঁকবে না রিয়া জানত। অনেক দেরীতে বিয়ে। বিশেষ কোন টানে নয় - খানিকটা একাকীত্ব আর খানিকটা এক্সপেরিমেন্ট। দুবছরের বেশী টেঁকেওনি। হাঁপ ছেড়ে বেছেছিল দুজনেই। ফেসবুকের কল্যাণে রিয়া জানল দেবর্ষি ছবি আঁকে। ওর রং-তুলিতে মূর্ত হয়ে ওঠে আকাশ-পলাশ-আগুন-ফাগুন। আর ছবি প্রকাশের সাথে সাথেই দেবর্ষির হাজার হাজার মুগ্ধ বান্ধবীরা অসম্ভব সুন্দর সুন্দর কবিতার পঙক্তিতে ভরিয়ে দেয় ওর দেওয়াল। রিয়া তাদের নামের ঝঙ্কারে সুর খোঁজে, যন্ত্রণা খোঁজে, সুখের ভাঙ্গা-গড়া খোঁজে। দেবর্ষি নিজেও ভালো লেখে। ছবির গায়ে দুএক কলি কবিতায় ছবিরা হয়ে ওঠে বিষণ্ণ-বিধুর।  মাঝে মাঝে দেবর্ষির ছবির নাম দেয় রিয়া - “ইচ্ছেঘোড়া কিংবা অগ্নিবৃক্ষ। কোন কোনদিন উড়ে যাওয়া, ভেসে যাওয়া মেঘের আড়ালে এক নারীর ভ্রূ-পল্লবে সন্ধ্যা নামে - সে ছবির  নামমেঘমল্লার না মেঘবালিকা” -কি দেবে তা ঠিক করতে পারে না রিয়া।
একদিন রিয়া ফেসবুকে বসা মাত্রই দেবর্ষির মেসেজ পায় - “কেন - কেন তুমি সর্বদা এত ব্যস্ত থাকো?”

দেবর্ষির প্রশ্নের উত্তরে রিয়া বলতেই পারত - “তাতে  তোমার কি?”
কিন্তু বলা হয় না - জিজ্ঞেস করেকেন বল তো?”
আরে - তোমাকে তো কারুর কিছু বলার থাকতে পারে না?”
কি বলবে বল না - আমি তো আছি।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে রিয়া - লিখেই যাচ্ছে দেবর্ষি। কিন্তু কিছুই এল না।
রিয়া খোঁচাল - “কই হল?”
না - সময় লাগবে - লিখব - বলব একদিন।
মাস গেল - বছর গেল - সে লেখা আর হলো না।
একদিন রিয়ার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল।
টিকিট কেটে ফেলল কোলকাতার - “আমি আসছি। তুমি আসবে একদিন দেখা করতে? বলবে সেদিন কি বলতে চাও? ”
আসব। বলব। যা জানতে চাও সব বলব। কবে আসবে বল।
.....................................................................।।

যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে?”

তিরিশ বছর পর একে অন্যকে কিভাবে চিনে নেবে সেটা ভাবেনি রিয়া। দেবর্ষি এখন I.A.S. officer. হলদিয়া, মেদিনীপুর এসব দিকেই কাজ। কখনো কোলকাতায়, কখনো বাইরে বাইরে থাকে। কোন পজিশনে আছে রিয়া ঠিক করে জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি। রিয়া শুধু জিজ্ঞেস করেছিল - “আসবে?” দেবর্ষি বলেছিল আসব। সেদিন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।মেঘ কেটে গিয়ে শরতের মত রোদ্দুর উঠেছে এখন।

সে কি আপন রঙে ফুল রাঙ্গাবে
সে কি মর্মে এসে ঘুম ভাঙ্গাবে

দিদি - একটু থামব এখানে - চা খাব।” - ড্রাইভারের কথায় ঘোর কাটল রিয়ার।  
অর্ধেক রাস্তা পার হয়ে গেছে।
হ্যাঁ চল - আমিও খাব।
গাড়ী থামল।

কোলকাতা গেলে ওরা যাওয়া আসা করত ট্রেনে - এই রাস্তায় শুধু বাস আর লরি চলত তখন। এখন আর গাড়ী ছাড়া কেউ খড়গপুর থেকে কোলকাতা যায় না। দোকানে বেশ ভিড়। ড্রাইভার নিলেন টোষ্ট আর চা। রিয়া নিল কচুরি। লাগাম যখন ছিঁড়ছে - তখন সর্বতো ভাবেই ছিঁড়ুক। চা খেতে খেতে ড্রাইভার রিয়াকে জিজ্ঞেস করল - “দিদি খড়গপুরে কোথায় যাবেন?”  তাই তো! কোথায় দেখা করবে দুজনে  এটা তো ঠিক  করা হয়নি। দেবর্ষি কি বলেছিল যে ও খড়গপুরে আসবে? কোথায় যে আসবে বলেছিল তাও মনে করতে পারছে না রিয়া। আদৌ কোন জায়গার কথা বলেছিল কি দেবর্ষি? ফোন নাম্বারটাও কণ্ট্যাক্টে সেভ করা হয়নি। ফেসবুক খোলার চেষ্টা করে রিয়া। সিগন্যাল কাজ করে না ঠিকঠাক। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ঘুরেই যায় চক্রাকারে।  

এই প্রথম যেন স্বপ্নের ঘোর থেকে বাইরে বেড়িয়ে এল রিয়া। কেন ছুটছে ও? কোন অজানার উদ্দেশ্যে? কি শুনতে? আঠেরো বছর বয়সে যখন দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ - জীবন সহজ সরল - তখন যে জটিলতার কোন তল খুঁজে পায়নি রিয়া আজ কি করে পাবে?  বৃষ্টিধোয়া ভেজা মাঠের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে - দেবর্ষি কোনদিন কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি ওকে। ও প্রশ্ন করলে উত্তর দেবে বলেছে। এটা কোন অঙ্গীকার নয় - নিছক ভদ্রতা। কি প্রশ্ন করবে রিয়া ওকে? I.A.S. officer হয়ে কি কি দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়? কোন পদ অধিকার করে আছে ও এখন? কেন করবে রিয়া ওকে এসব প্রশ্ন? কি হবে এসব জেনে? দেবর্ষির সুন্দরী বৌ আর ফুটফুটে ছেলের ছবি ও ফেসবুকেই দেখেছে।
বৌ কি করে? মা কেমন আছেন?”
মৌসুমি কেমন আছে?”
শুধু এইসব জানতে ও ছুটে এসেছে মুম্বাই থেকে?

সত্যিই কি কোন কথা আছে দেবর্ষির? এমন কোন কথা যা ও কিছুতেই বলতে পারে না রিয়াকে - কোনদিন পারেনি? কেন পারেনাযে জটিলতাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল দেবর্ষি সারাজীবন - হঠাৎ কেন রিয়া উঠে পড়ে লাগল তাকে ফিরিয়ে আনতে? বয়স? এককীত্ব? নাকি অন্য কিছু? নিজের এলোমেলো ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে রিয়া। মরীচিকার পেছনে মানুষ কেন ছোটে তা তো সে জানে না। শুধু জানে - মরীচিকা ধরা দেয় না। দেবর্ষির সাথে আজ খড়গপুরের পথ হাঁটলেই কি ওর অতীতটা ফিরে পাবে রিয়া? আর যদিবা পায় - তার পর?

অন্তবিহীন প্রশ্ন পাক খেতে থাকে রিয়ার মনে। এক সীমাহীন ক্লান্তিতে ছেয়ে যায় চরাচর।
অবসন্ন পায়ে গাড়িতে উঠে বসে রিয়া।

দিদি খড়গপুর আই আই টি তে যাবেন?”
নাঃ - যাব না - গাড়ী ঘোরাও। কোলকাতা ফিরে যাব।
বিনা বাক্যব্যায়ে গাড়ী ঘোরায় ড্রাইভার শক্তিপদ।
দেউলটি পেরোতে পেরোতে কি মনে হয় - বলে - “দিদি জানেন তো এখানে শরৎচন্দ্রের বাড়ী - নদীর ধারে - খুব সুন্দর একটা রিসর্ট আছে। যাবেন?”
শরৎচন্দ্র? নাঃ - আজ শুধু রবীন্দ্রনাথই থাক।
শক্তিপদ রেডিওর ভলিউমটা বাড়িয়ে দেয়।
92.7 Big F.M. - আজ সকালের শেষ গান - শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া চিনিলে না আমারে কি চিনিলে না ...”
দেবর্ষির মেসেজ আসে ফোনে - “কোথায় আসবে? কখন আসবে?” ফোন সুইচ অফ করে দেয় রিয়া।  তোমার যদি সত্যিই কিছু বলার থাকে এবার তুমি আমায় খুঁজে নিও দেবর্ষি।

গাড়ীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে উদাত্ত আর্তি -
দ্বারে এসে গেলে ভুলে পরশনে দ্বার যেত খুলে
মোর ভাগ্যতরী এটুকু বাধায় গেল ঠেকি ...”

[লিপিকা দে]




Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.