লালমোহনবাবুর কথা
থাক ৷অন্য একজনের কথা বলি ৷ যার কথা বলার জন্য আমি অনেকক্ষণ ধরে উৎসুক হয়ে আছি ৷ আমার তখনকার জীবনে সবচাইতে
সুন্দর মহিলা ৷ চেষ্টা করলে পঞ্চাশ বছরের আগে দেখা তার
মল এখনও এই বয়সেও মনে করতে পারব ৷ দিদিমণি ইংরাজী পড়াতে নতুন এসেছেন ৷ আর উনিই হয়েছেন আমাদের ক্লাস টিচার ৷ উনি কেমন পড়াতেন,কী পড়াতেন কিছু জানি না ৷ উনি কীভাবে দাঁড়াতেন,গলার স্বর কেমন ছিল,কীভাবে বোর্ডে লিখতেন,কীভাবে আমাদের(? আমার)দিকে তাকাতেন সব আমার মুখস্থ ৷
কয়েকদিন ঘোরের মতো গেল ৷ একদিন খেলাম ঝাঁকুনি ৷দিদিমণি,আমার নিজের দিদিমণি ৷ আমাকে বলল,তুমি কিন্তু ক্লাসে ভীষণ আনমাইন্ডফুল হয়ে পড়ছো ৷ কী চিন্তা কর এত ?
আমার মুখ লাল হয়ে গেল ৷মনে কষ্টও হল ৷ আমার দিদিমণির কাছে আমি খারাপ হয়ে গেলাম ৷ এরপরও বাকী ছিল ৷ আস্তে আস্তে বুঝলাম আমাদের ক্লাসের সবাই,এমন কি মেয়েরাও দিদিমণির ভক্ত ৷ মানে দিদিমণি আমার একার নয়৷ এরপরে আরো একটা দুঃখের খবর শুনলাম,সেজদার মুখ থেকে ৷ ও আমার এক ক্লাস উপরে পড়ত ৷ আমাদের কোয়ার্টাম থেকে একমাইল হেঁটে দিদিমণির বাড়িতে গিয়ে আমার সেই দাদা দিদিমণির সঙ্গে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলে ৷ সেই গল্প আবার আমাকে জমিয়ে গল্প করে ৷ মন খারাপ নিয়ে আমি পড়াশোনায় মন দিলাম৷ তবে এখনও মনে হয় দিদিমণি বোধ হয় অন্যদের চাইতে আমাক পছন্দ করত ৷ ক্লাসে আবার একটা ঘটনা ঘটেছিল ৷ তখন কিছুই বুঝিনি এখন কিছুটা অনুমান করতে পারি ৷ একদিন দিদিমণি বলল, আজ পিছনের বেঞ্চের ছাএরা উওর দেবে ৷ সাধারণ একটা প্রশ্ন এসে পড়ল ভবেশদার মাথায় ৷ ভবেশদা আমতা আমতা কিছু উওর দিচ্ছিল ৷ দিদিমণি বলল,বসে বসে কেন উওর দিচ্ছ ? উঠে দাঁড়াও ৷
ভবেশদা উঠল না ৷
-কী হল উঠে দাঁড়াও ৷ পড়াশোনায় তো গোল্লা, ভদ্রতাটাও শেখোনি ৷ টিচারের সামনে বসে
বসে উওর দিচ্ছ ৷ দাঁড়া উঠে ৷ দিদিমণি গলায় বেশ বিরক্তি ৷
-উঠলে সমস্যা আছে ৷
-সমস্যা টমস্যা জানি না আগে দাঁড়াও তারপর
কথা বলবে ৷
-বলালম না সমস্যা আছে ৷
-কী সমস্যা ? পড়া পারবে না সেটা দাঁড়িয়ে বলে দাও ৷
-কেন বোঝেন না আপনি ৷ আমার চাইতে আপনার
সমস্যা হবে বেশী ৷
তারপর কী হল বুঝতে পারলাম না ৷ দিদিমণির মুখ
কালো হয়ে গেল অদ্ভূতভাবে ৷ কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল ৷ তিন-চারদিন আর আমাদের ক্লাসেই এল না ৷ ভবেশদা কিছু নির্বিকার ৷ পরে এর উওর কাছ থেকে
শুনে যতোটা বুঝলাম,দিদিমণিকে দেখলে ভবেশদার বিশেষ অঙ্গের বিকৃতি হয়ে যায় ৷ তাই ভবেশদা উঠে
দাঁড়াতে পারে নি ৷ আমার দিদিমণির কথা ভেবে মন খারাপ হল ৷
আমি দিদিমণিকে হারিয়ে ফেললাম ৷
ক্লাস এইট আর একটা বড় ঘটনা ঘটেছিল ৷ আসলে এখনকার পাঠকদের ঘটনাটা বলার মতো ঘটনাই নয় ৷ কিন্তু আমার কাছে বিশাল ৷ ক্লাস এইটে আমি প্রথম একটা নতুন বই হাতে পেলাম ৷ মানে ক্লাস এইট পর্যন্ত দাদাদের পুরানো ছেঁড়াখ্যেঁড়া বই-ই ছিল আমার প্রাপ্ত ৷ India Reader বলে চকচকে বইটাতে আমি সারাদিন বুকের কাছে রেখে দিতাম ৷ রাতে থাকত বালিশের পাশে ৷ আমার স্কুলের কোনো বই-এর নাম মনে নেই ৷ এখনও বইটা চোখের সামনে দেখতে পাই ৷ আবছা হলদে মলাটের উপর ভারতের ম্যাপ আঁকা বই-India Reader-যেটার প্রথম গল্পটাই শুরু হয়েছে রিপ ভ্যান উইংকেলের ঘুমিয়ে পড়ার গল্প দিয়ে ৷ এই কথাটা তো বলতে হবে ৷ এটা ঘটেছিল বোধহয় ফাইভে বা সিক্সে ৷ ইংরাজী রচনা এল পরীক্ষায় –Your favourite hobby. যার ইংরাজীতে লিখতে মোটামুটি পারি ৷ কিন্তু কি নিয়ে লিখব ৷ না জানি favourite শব্দের মানে,না জানি hobby-র মানে ৷ ভাবলাম ঐ প্রশ্নটা ছেড়েই দি ৷ কিন্তু পাক্কা দশ নম্বর ছেড়ে দেওয়ার চাইতে বাবার কথা,প্রশ্ন ছেড়ে দেবে ৷ যা পারো তাই লিখবে ৷ সব অ্যাটেমপ্ট করবে ৷ তাই বাধ্য হয়ে পাশের ছাএকে জিজ্ঞেস করলাম favourite hobby –মানে কিরে ? ও তখন নিজের লেখায় ব্যস্ত ৷ মাথা না তুলেই বলল,কেন ? মুখস্থ করিসনি ৷ এটা তো কমন প্রশ্ন ৷ বুঝলাম আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ৷ ঠিক করলাম নিজেই যা বুঝেছি ,তাই লিখি ৷ অনেক ভেবেটেবে বুঝলাম favourite কথাটার মানে বুঝলাম ভালো কিছু আর hobby? আচ্ছা Hobby-কে যদি বাংলায় ‘হবি’ ভাবি ? মানে তুই ভালো কী হবি ? যেই ভাবা অমনি লেখা শুরু ৷ আমি এই হবে,আমি ঐ হব বলে গোটা দশেক হওয়ার লিস্ট নিয়ে তিন-চার পাতার রচনা লিখে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে এলাম তারপর রেজাল্টের সময় কী হল,সেটা আর নাই জানলাম ৷ ক্লাস এইটে সব চলছিল যা হোক ৷ কিন্তু এমন সময় ঝা করে চলে এলেন কমলেশ্বর ঝা ৷ একেবারে আনকোরা ইউ পি থেকে সোজা আমাদের দোমহনী পলওয়েল রেলওয়ে হাইস্কুলে ৷ আমাদের হিন্দির মাস্টার ৷
সে একদিন অদ্ভূত পরিস্থিতি ৷ তার আগে বলি রেলওয়ে স্কুলগুলো কিন্তু কেন্দ্রীয় রেলওয়ে দপ্তর থেকে চালানো হয় ৷ এবং তখনকার দিনে যথেষ্ট ভালো স্কুল বলে ধরা হত ৷ এবং হিন্দি একটা অতি আবশ্যিক বিষয় ছিল ৷ আমরা ক্লাস টেন পর্যন্ত হিন্দি পড়েছি ৷ সে তো হল কমলেশ্বর ঝা-এর ব্যাপারটা বলি,বলতে গেলে খুব কষ্টের অথবা খুব আনন্দের ক্লাস ছিল কমলেশ্বর ঝা স্যারের ক্লাশে ৷ আমার হিন্দির দৌড় ছিল ‘লটরপটর গিরতা হ্যাঁয়, গরু ঘাস খাতা হ্যাঁয়’অবধি ৷ আর স্যারের বাংলা জ্ঞান ছিল তার চাইতে একেবারে শূন্য ৷ একঘন্টার ক্লাশ চলছে,মাষ্টার- ছাএ কথা বলে যাচ্ছে ৷ কিন্তু কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না ৷ কমলেশ্বর ঝা স্যার কত রকম অঙ্গভঙ্গি করতেন তা লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই ৷ একটা কথা জেনে রাখা দরকার,সেই সময়-উওরবঙ্গের ছোট ছোট জায়গায় সিনেমা হল বলে কিছু ছিল না ৷ কাজেই হিন্দি সিনেমা দেখে হিন্দি শেখার কোনো ব্যাপারই ছিল না ৷ আর একটা কথা,সেইসময় হিন্দি বলিয়ে লোকের সংখ্যাও খুব কম ছিল ৷ যাই হোক,হিন্দি শেখা যা হচ্ছিল,হচ্ছিল ৷ কিন্তু সব গুলিয়ে গেল লিংগে ৷ যাতা হ্যাঁয় না যাতি হ্যাঁ নিয়ে বছরটা শেষ হয়ে গেল ৷ ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল ৷ এবং একজন মাএ পাশ আর একজনই ফার্স্ট ৷ কে ফার্স্ট ? না জুতোর দোকানের মালিকের মেয়ে লক্ষ্মীমণি ৷ যাই হোক,ফেল করা মানা যায় কিন্তু লক্ষ্মীমণির ফার্স্ট হওয়া একেবারেই মানা যায় না ৷ লক্ষ্মীমণির বাবার ব্যবসার জন্য পয়সার দেমাগে কারো সঙ্গেই কথাই বলত না ৷ ওর ফার্স্ট হওয়া মেনেই নেওয়া যায় না ৷ তারপর প্রাইজ? ইলার কথা মনে পড়ল,ও চলে গেলে কমল ফার্স্ট হবে ৷ এর মধ্যে লক্ষ্মীমণি কোথা থেকে উদয় হল ?
ক্লাস সুদ্ধ মিছিল করে ৷ ফেলের খবরটা কিন্তু চারিদিকে ছড়ালো ৷ হেডমাস্টার এলেন ক্লাসে সঙ্গে কমলেশ্বর ঝা স্যার ৷ সবার সামনে দুজনের কথা হল ৷ সবটা বুঝলাম না ৷ তারপর হেডমাস্টারমশাই বললেন,লক্ষ্মীমণি উঠে দাঁড়াও ৷ হাসিমুখে ও উঠে দাঁড়াল ৷ এই যে তোমার হিন্দি খাতা ৷ পড়তো কি লিখেছো ৷ একটু ইতঃস্তত করে লক্ষ্মীমণি পড়তে শুরু করল, “ আজ দুজনার দুটি পথ গেছে বেঁকে….”৷রহস্য ক্রমে পরিষ্কার হল ৷ আমরা কেউই হিন্দি প্রশ্নপএের উওর পাশ করার মতো লিখতে পারি নি ৷ একমাএ লক্ষ্মীমণি পুরো পাতা জুড়ে হিন্দি অক্ষরে তখনকার হিট গানের পুরোটা লিখে এসেছে ৷ আমাদের পাতা প্রায় ফাঁকা আর খাতায় ‘ কম সে কম কুছ দো-চার পেজ তো লিখা’-এই যুক্তিতে ওকে পাশ মার্ক দিয়েছে ৷ আর অন্য সাবজেক্টে পাশ করেছে মাএ একজন ৷ কাজেই একজন পাশ মানে একজন ফার্স্ট ৷ অকাট্ট যুক্তি ৷ পরে অবশ্য হেড মাস্টার ফরমান দিলেন,তোমার হিন্দি ভালো করে শিখবে ৷ আর সবাই হিন্দিতে পাশ মার্ক এিরিশ করে পাবে ৷ ফলে নতুন রেজাল্টে আমি সেকেন্ড হলাম ৷ আর ক্লাসের শান্ত ছেলে বনিক হল ফার্স্ট ৷ এরপর আমি চ্যংড়া --- স্কুলে চলে যাই ৷
নতুন জায়গা দোমহনী
বিশাল মাইনের পরমাইল জুড়ে শুধু রেল আর রেল ৷ না,রেল লাইন নয় ৷ রেল লাইন একটাই ৷ মিটার
গেজের লাইন ৷ বিকেলে মাঠে যেমন খেলতাম,তেমনি লম্বা প্লাটফর্মটা ও ছিল খেলার
জায়গা ৷ এবার ভানুর কথা বলি ৷ আমার দোমহনীর প্রথম এবং একমাএ বন্ধু ছিল ভানু ৷ কী করে ভানু আমাদের আসার দু-একদিনের মধ্যে আমার কাছে এল,কী হল বন্ধু হল –এসব আমি জানি না ৷ কিন্তু হল তো হল,একেবারে জব্বর বন্ধু হল ৷ স্কুলের সময়টা
বাদ দিলে সারাদিন আমরা দুজন একসঙ্গে ৷
ভানু আমাদের বাড়িতে একেবারে নিজেরে বাড়ির মতো আসত ৷ আমরা আমাদের মতো খেলতাম ৷ কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বটা অনেককে অবাক
করত ৷ দুই মেরুর দুই ছেলে কী করে এত বদ্ধ হয় ৷ আমার বাবা
দোমহনী স্টেশনের বড় কর্তা আর ভানুর বাবা পোর্টার ৷ মানে রেলওয়ের সবচাইতে নীচু তলার পোস্ট ৷ বয়সে আমার সমান হলেও ও পড়ত এক-দু ক্লাস নীচে ৷ আমার
হাড় জিরজিরে চেহারা আর ওর তখনই স্থানীয়বাসীদের মতো পেটানো লম্বা চওড়া চেহারা ৷ পার্থক্য আরো ছিল কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল ফেভিকলের মতো ৷ আমি আম
খাব-ওর কাজ তা পেড়ে দেওয়া ৷ আবার ওর অঙ্ক হচ্ছে না,আমি দেখিয়ে দেব ৷ কিন্তু আমাদের মধ্যে
দেওয়া-নেওয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না ৷ ছিল শুধুই বন্ধুত্ব ৷
সেই ভানুর সঙ্গে একদিন কথা বদ্ধ হয়ে গেল ৷ ভানু ভালো ছেলে ৷ কিন্তু কোথায় যেন আমার অস্বস্তি হত ৷ এক তো ও পড়াশোনা মন দিয়ে করত না ৷ আবার ও কিন্তু
খারাপ ছেলের সঙ্গে মিশত ৷ আগেই লিখেছি আমার ভিতরটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল ৷ ভালো-মন্দ কাজকর্ম ওভাবের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার ভিতরে একটা
বিরোধিতা তৈরী হচ্ছিল ৷ ব্যাপারটা আমার নিজের জোর করে করতে হয়নি ৷ আপনা থেকে হচ্ছিল ৷ এবং এরফলে আমি অন্যদের কাছে খারাপও হতে লাগলাম ৷
ভানুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের পরিণতি কেমন অদ্ভূত হল ৷আমরা একজন অন্যজনের পরম বন্ধু ৷সারাদিন একসঙ্গে ৷ আমাদের স্কুলে বিশাল করে বার্ষিক খেলাধুলার অনুষ্ঠান হত ৷ আমি কোনো দিনই খেলাধুলোয় অংশ নিতাম না,আমার মনে হত হেরে যাওয়ার জন্য কোনো প্রতিযোগীতায় নাম দেব না ৷ প্রতিযোগীতায় নাম দিলে আমাকে জিততে হবে ৷ যাইহোক,ভানুও কোনো খেলায় নামত না ৷ কিন্তু একদিন সকালে আমাদের বাড়ি এল ৷ বুঝলাম ওর মন খারাপ ৷ জিজ্ঞেস করে জানলাম ওর স্পোর্টসে নাম দেবার ইচ্ছে হয়েছে ৷ কিন্তু কোন খেলাটায় নামবে সেটা ঠিক করতে পারছে না ৷ তাই আমার কাছে আমাদের বাড়িতে এসেছে ৷ আমাদের বাড়িতে বেশী বন্ধুরা আসত না ৷ কারণটা পরে বলছি ৷ ভানুর জন্য সব ছাড় ৷ আমি ওর কথা শুনে কিছু না বলে ভাবতে লাগলাম ৷ ভাবতে ভাবতে একটা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম ৷ একটা শক্ত পাটের দড়ি নিয়ে পা পাট ৷ হাঁটুর কাছ থেকে পিছন দিকে মুড়ে ভালো করে দড়ি দিয়ে পা আর থাই জোড়া লাগিয়ে শক্ত করে বাঁধলাম ৷ মানে এখন একটা পা হাঁটুর পর থেকে আর দেখা যাচ্ছে না ৷ বাবার একটা লুঙ্গি পরে একটা লাঠিতে ভর করে বাইরে এলাম ৷ রবি ততক্ষণে খুব রেগে আছে ৷ আমাকে দেখেই বলল,আরে তোর পায়ের কী হল ৷ আমি বললাম,নেই,কেটে ফেলেছি ৷ তারপর সব ব্যাপারটা ওকে দেখিয়ে বললাম কেমন হয়েছে ?
-কিন্তু এভাবে আমি দৌড়াব কি করে ?
-দৌড়বি কেন? লাঠিটা ভর করে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে ঘুরে বেড়াবি ৷
-মানে ?
-মানে,Go as you like . তাই Go as you like –এ নাম দিবি ৷ তুই কি জানিস ওটাতে খুব ভালো পুরস্কার থাকে ৷ ভানুর আইডিয়াটা পছন্দ হল ৷ বলল,আমার পাটা বেঁধে দেখতো আমি পারি কিনা ৷ ওর হাত পা সবই বেশ তাগড়াই ৷ আমার একার
সাধ্যে কুলাচ্ছে না দেখে দাদারা ওর
একটা পা বেঁধে দিল ৷ তারপর লাঠি নিয়ে হাটা প্রাকটিস চলল ৷ সব ঠিক আছে ৷ এখন সকালের দিক,go as you like হবে সব শেষে অর্থাৎ বিকেল তিনটা চারটা বেজে যাবে ৷
আমি বললাম,এখন বাড়ি যা ৷ দুপুরে আসিস তখন আবার বেঁধে দেব ভালো করে ৷
তারপর একসঙ্গে আমরা মাঠে যাব ৷
কিন্তু ভানুর আয়ত্বর সয় না ৷ ও দড়ি আর খুলবে না
৷ এভাবেই মাঠে যাবে ৷ আমরা বোঝালাম ওকে অনেক ৷ কিন্তু ওর এক কথা,আমি আর এটা খুলব না ৷ এখান থেকে তোদের সঙ্গে ইস্কুল যাব ৷ আমি,আমার মা অনেকবার
করে ভানুকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এতক্ষণ ধরে পা বেঁধে রাখাটা ঠিক না ৷ কিন্তু আদিবাসী গোঁরার ভানু সেই কথা,এটা খুললে যদি আবার কেউ বেঁধে না দেয় ৷ ভানু সকাল থেকে এক বা বাঁধা অবস্থার ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে কোনো রকম
স্নান যাওয়া সেরে নিল ৷ আমরা দুপুর বেলায় স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হলাম ৷ কিন্তু বাড়ি থেকে প্রায় মাইল খানেক দুরে স্কুল ৷ মাঝে বেশ কয়েকটা রেললাইন ৷
ল্যাংড়া অবস্থায় ভানুর মুখে আলতা আর কাজল মিশিয়ে গালে গলা অদ্ভূত ছোপ ছোপ দাগ করে দিয়েছে –ঘা বানিয়ে দিয়েছে ৷ এঅবস্থায় ভানুকে কীভাবে নিয়ে যাব ৷ শেষে একটা বুদ্ধি সবার মাথায় এল ৷ বামনহাটের মতো ডুয়ার্সের সব জায়গাতেই
পাটের চাষ হত ৷ আর এই পাটের বান্ডেল আনত,ঠেলা গাড়ি করে স্টেশন ওয়ার্ডে,যেখান থেকে মালগাড়িতে তোলা হত ৷ ঠেলা গাড়ির মালিককে বললে খালি ঠেলাগাড়ি দিতে আপত্তি করত না ৷
সেইভাবে একটা ঠেলাগাড়িও পাওয়া গেল ৷ তারপর ভানুকে
ঠেলাগাড়িতে তুলে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে পুরো শরীরটা ঢেকে আমরা কয়েকজন ওকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেলাম স্কুলে ৷ মাঝে রেললাইনগুলো পার করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল ৷
রাস্তায় কেউ দেখেনি ৷ আমরা লুকিয়ে ওকে স্কুলের অফিস বিল্ডিং-এর পিছনে ওভাবেই চাদর ঢেকে রেখে এলাম ৷ এদিকে স্পোর্টস চলছে ৷ আমরা ভানুর কথা ভুলে
খেলা দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম ৷ Go as you like হতে এখনও আন্দাজ দুঘন্টা বাকি ৷ হঠাৎ আমার মনে পড়ল ভানুর কথা ৷ গেলাম ওর কাছে ৷ জিজ্ঞেস করলাম সব ঠিক আছে
৷ একটু জল খেতে চাইল ৷ কিন্তু জল খাওয়ার কি করে ? এখনকার মতো সবার ব্যাগে জলের বোতল থাকত
না ৷ আমাদের জল খেতে হলে সোজা কুঁয়ো বা টিউবওয়েল থেকে জল
খেতাম ৷ ভানুকে জল খাওয়ানোর সমস্যার কথা বলল,জল লাগবে না ৷ একটু পেচ্ছাব করব ৷ কি
মুশকিল ৷ আমরা প্রায় সময় মাঠেই পেচ্ছাব
করতাম ৷ বাথরুমে কেবল মেয়েরা যেত ৷ এখন চারিদিকে ছাএ-ছাএিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ কি করে চাদরের বাইরে আসবে৷
ভানুকে কোনো সাহায্য না করেই ফিরে এলাম
৷
একসময় বিকেলের দিকে Go as you like-যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতা ৷ আমরা ভানুকে আনতে গেলাম ৷ কিন্তু একি ভানু ওখানে নেই ৷ বিল্ডিং-এর পিছন দিকে ওকে খুঁজতে থাকলাম ৷ কোথাও নেই ৷ বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করে মাঠে ফিরে এলাম ৷ দেখলাম ভানুও অন্যান্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েছে৷ অনেকেই অনেক রকম সেজেছে ৷ একজন ভিখারি সেজেছে একদম ভিখারির মতো সারা গায়ে ঘা-এর ছোপ ছোপ ৷ বেশ কিছুক্ষণ চলল প্রতিযোগী ঘুরে ঘুরে নিজেদের কায়দা দেখানোর,ওর যত সময় ধরে মাঠে ঘুরছে আমার মাথাটাও ঘুরছে ৷ বুকের ভিতর ধকধক করছে ৷ আমরা ভানুকে সাজিয়ে ছিলাম,কিন্তু কি করতে হবে বা কিভাবে বিচারকদের সামনে বলে ওদের আগ্রোহ নিজের দিকে আনতে হবে-এসব কিছুই শেখোইনি ৷ দেখছি ভানুকে একাএকা মাঠে এক পা আর লাঠি নিয়ে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে ৷ কে ফার্স্ট হবে না হবে এই নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই ৷ আমার একটাই চিন্তা ভানু কিছু একটা হবে তো ? যেন মনে হচ্ছে ভানু প্রতিযোগী নয়,আমিই প্রতিযোগী ৷ এবার ঘোষণার পালা ৷ ঘোষণা হল,প্রথম হয়েছে লেপার(Leper) ছেলেটি ৷ লেপার কে সেজেছে ? বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভিখারি বেশের ছেলেটি সামনের দিকে এগিয়ে গেল ৷ এরপর দ্বিতীয় আর তৃতীয় জনের নামও ঘোষণা হয়ে গেল ৷ ভানু তখনও ল্যাংড়ে ল্যাংড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ মনটা একেবারে ভেঙ্গে গেল ৷ এত কষ্ট করলাম,তার চাইতে বেশী কষ্ট করল ভানু একটা পা মুড়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছে ৷ আমরা মাঠে ঢুকে ভানুকে মাঠে শুইয়ে পায়ের দড়ি খুলতে শুরু করলাম৷ এমন সময় একজন এসে ভানুকে বলল,তোমাকে স্যার ডাকছে ৷
আমি বললাম দড়িটা খুলে দিই,তারপর যা ৷
ভানু বলল,না এভাবেই যাই ৷
ভানু আবার হাতে লাঠি নিয়ে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে জার্জদের টেবিলের কাছে গেল ৷ আমি পিছনেই ছিলাম ৷ লেপার বলে জার্জ আসলে ভানুকেই বোঝাতে চেয়েছিল,ভিখারি ভেবেছে ওকে লেপার বলেছে ৷ অর্থাৎ ভানুই ফার্স্ট হয়েছে ৷ এত বছরে জীবনে এত আনন্দ আর কখনো পাইনি ৷ ভানু ফার্স্ট-ভানু ফার্স্ট ৷ আমার বন্ধু ফার্স্ট ৷ তবে সঙ্গে যে এটাও ছিল,যে আমার দেওয়া বু্দ্ধিটাও ফার্স্ট ৷ ভানুর দড়ি খুলে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে আমাদের বাড়ি নিয়ে এলাম ৷ ভানু আমার মাকে প্রণাম করল ৷ মা আমাদের সবাইকে একটা করে নাড়ু দিল ৷ সেদিনের মতো দিনটা আনন্দে কাটল ৷সমস্যা হল পরের দিন সেই রাতে আর একটা ঘটনা ৷ বাবা সাধারণত ছেলে-মেয়েদের স্বাধীনতা বিশ্বাস করত ৷ অফিসে যাওয়ার আগেই ভানুর ব্যাপার স্যাপার কিছুটা দেখে অফিস চলে গিয়েছিল ৷ সন্ধ্যায় এসে জিজ্ঞেস করলেন,কীরে ভানু কি সেজেছিল ?
কিছু হল?
-লেপার সেজেছিল ৷
-লেপার ?
-হ্যাঁ ৷
-লেপার মানে জানো ?
-না ৷ তবে সবাই বলছিল একটা খারাপ অসুখ ৷
-তা,তোমরা ভানুকে লেপার সাজিয়ে ছিলে অথচ লেপারের মানেই জানো না ?
-আমরা তো ওকে ল্যাংড়াই বানিয়ে ছিলাম
কিন্তু মাস্টারমশাই ওকে লেপার সেজেছিল বলে প্রথম পুরস্কার দিয়েছে ৷
-ভানু ফার্স্ট হয়েছে ? ভালো,বেশ ভালো ৷ কিন্তু জেনে রাখো লেপার একটা গালি মানে খারাপ কথার মধ্যে পড়ে ৷
কাউকে কখনও লেপার বলবে না ৷
-আচ্ছা বলে আমি চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু বাবা বলল চলে যাচ্ছ যে ? লেপারের মানেটা না জেনেই চলে যাচ্ছো যে ৷
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম ৷ বাবা বলল,এভাবে অর্ধেক জ্ঞান কিন্তু না জানার চাইতে আরো খারাপ ৷ শোনো লেপার কথাটা এসেছে লেপ্রোসি
মানে কুষ্ঠ রোগ থেকে ৷ কারো লোপ্রোসি হলে বলতে হয় লোকটির লেপ্রোসি হয়েছে ৷ কিন্তু লেপার বলতে নেই ৷ যাও ৷ ভানুকে বলো আমি খুব খুশি হয়েছি ৷স্কুলে
ছুটি থাকলে আমরা সকালে আমাদের বাড়ির সামনেই খেলতাম ৷ সেটা বেশিরভাগ সময়ই হাই জাম্প নয় লংজাম্প ৷ মাটি সামান্য গর্ত করে চৌকো মাপের একটা পিট
বানিয়ে তারমধ্যে বালি দিতাম অনেকটা ৷ ব্যাস তৈরী হয়ে গেল হাইজাম্পের জায়গা ৷ আর দুদিকে দুটো বাঁশের খুঁটি পুতে তাতে একটা দড়ি বেঁধে হয়ে যেত হাইজাম্পের
ব্যবস্থা ৷ অনেক ছেলেরাই আসত ৷ আগের দিন ভানু Go as you like-এ ফার্স্ট হয়েছে ৷ ও এসেছে ৷ খুব মনের
আনন্দে আমাদের সঙ্গে লাফালাফি করল ৷ তারপর হঠাৎ
আমার পাশে বসে পড়ে বলল,আমি তোর সঙ্গে আড়ি দেব ৷
-আড়ি? কেন? কি হয়েছে ? আমি অবাক ৷
-হ্যাঁ ৷
-কেন ?
-অত বলতে পারব না ৷ তুই ভালো ছেলে-ভালো ছেলে থাক ৷ আমি পড়াশোনায়
খারাপ ৷ তোর সঙ্গে তাই আড়ি ৷ আজ,এখন থেকেই ৷ বলেই উঠে চলে গেল ৷ আমি বসেই রইলাম ৷ এত বন্ধুত্ব এভাবে কি করে শেষ হয়ে যায় ? কি করছে আমি৷ আমি তো ওর কোনো ক্ষতি করিনি ৷ বরং ভালো করবার চেষ্টা করে গেছি
৷
ভানুর ব্যবহারে যতোটা কষ্ট পেয়েছি,তার চাইতে বেশী অবাক হয়েছি ৷ সবাই খেলা ছেড়ে চলে গেছে ৷ কিন্তু আমাকে এক অদ্ভূত চিন্তা ঘিরে ধরেছে ৷ বন্ধু কাকে বলে ? কেন একজন অন্যজনের বন্ধু হয় ৷ মিল বেশী থাকলে বন্ধু হয়,না অমিল এসব প্রশ্নের ঢেউ মাথায় এলেও তখনও উওর বের করার মতো চিন্তাশক্তি হয়নি ৷ অনেকক্ষণ বসে থাকার পরে বাড়ি গেলাম,সেজদাকে বললাম,বন্ধুর মানে কি ? বন্ধু কেন হয়?
সেজদা বলল,এসব চিন্তা তোর মাথায় আসে কি করে ? বন্ধু আছে ভালো ৷ না থাকল তাও ভালো ৷ নিজের কাজ কর ৷ বন্ধু কখনও আপন হয় না ৷ এই হল সেজদা ৷ পরিস্কার কথা ৷ ওকে বোধ হয় আমি বড় হয়েও যাকে বলে ইমোশনাল হতে দেখিনি ৷
যাই হোক ৷ এখন আড়ির পরে ভানুর সঙ্গে দেখা হলে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলি না পাশ কাটিয়ে চলে যাই ৷ এর মধ্যে আমি একদিন আম গাছ থেকে চিল মেরে আম পাতার ব্যর্থ চেষ্টা করছি ৷ ভানু এল গাছে উঠল ৷ একটা ধরে ঝাঁকুনি দিল ৷ বেশ কয়েকটা আম নীচে পড়ল ৷ হাতে করে একটা বড় পাকা আম নিয়ে নামল ৷ কোনো কথা না বলে আমটা হাতে দিয়ে চলে গেল,অদ্ভূত ব্যাপার ৷ আমি অবশ্য সব আমগুলোই কুড়িয়ে নিয়েছিলাম ৷ ওদিকে অন্য একটা কান্ড ধীরে ধীরে পাকছিল ৷ আমার সেজদার কথা একটু বলতে হয় ৷ সেজদা vs.নানু ৷ বাবা-মা আমাদের অভিভাবক ৷ কিন্তু আসল অভিভাবক ছিল সেজদা ৷সেজদার কথাই ছিল আমাদের বেদবাক্য ৷ এক কথায় আমাদের কাজকর্মের একমাএ গুরু হল সেজদা ৷ কথা বেশী বলত না ৷ খুব বেশী হলে একটু মুখের কোণ দিয়ে হাসত ৷ আর রেগে গেলে চুপ করে যেত ৷ সেজদা চুপ মানে আমরা চুপ ৷ তখন যদি ‘মস্তান’ কথাটা চালু থাকত,তবে সেজদাকে নিশ্চিতে মস্তান বলা যেত ৷ ওর কাজকর্ম বিবরণ দিতে গেলে ‘আমার সেজদা’ বলে একটা মোটা বই লিখতে হবে ৷ তাই সংক্ষেপে ওর সমন্ধে কিছু বলি ৷
একদিন আমাদের মানে ছোট ভাইদের নিয়ে চলল একটা কোয়াটার্সে,ওখানে একটা পেয়ারা গাছে প্রচুর বড় বড় পেয়ারা হয়েছে,পেকেও গেছে ৷ আগের দিন সেজদা একটা পেয়ারা পেড়ে ছিল দেখে ঐ কোয়াটার্সের মহিলা,সেজদাকে খুব বকেছে ৷ সেটা সেজদার কানে গেছে ৷ তাই আজ সদল বলে অভিযান ৷ আমি সেজদাকে একবার মিনমিন করে বললাম,ঐ ভদ্রমহিলা খুব খারাপ খারাপ কথা বলে,ঝগড়া করে ৷ ওর মধ্যে না যাওয়াই ভালো ৷ সেজদা একটু হাসল এবং বলল,সেটাই তো মজা ৷ কোনো কিছু তালবাহানা না করে সেজদা সোজা গাছে উঠে পড়ল ৷ আর টপাটপ পেয়ারা পেড়ে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিতে লাগল ৷ হেনকালে গলার ফাটানো চিৎকার সহ মূর্তিমান মহিলা হাজির ৷ মহিলা বারবার করে সেজদাকে নামতে বলছে৷ কিন্তু সেজদার কোনো বিকার নেই ৷ অভদ্র ভাষা ক্রমে আরো অভদ্রতে পরিণত হল ৷ সেজদা একবার বলল,গালি ফুরিয়ে গেলে বলবেন,আমি সাপ্লাই করব৷ আর টপাটপ পেয়ারা পড়তে লাগল ৷একসঙ্গে মহিলার গালাগালি চলতে থাকল আর পেয়ারা পাড়া চলতে লাগল ৷ আর চলল সেজদার মাঝে মাঝে ছোট করে ফুঁট কাটা ৷ ততক্ষণে পেয়ারা পাড়া প্রায় শেষ ৷ সেজদা গাছে বসেই বলল,পেয়ারা তো সব শেষ,আপনা গালি স্টক তো প্রায় শেষ ৷
তারপর ভদ্রমহিলা একটা উক্তি যা বহু বছর আমাদের আলোচনায় বস্তু হয়ে গিয়েছিল ৷ ‘এই ছেলেটা তো মারত্মক ৷ ভালো ঝগড়া করতে পারে ৷ আমাকে মানে আমাকে ঝগড়ায় হারিয়ে দিল ৷’
অর্থাৎ উনি জানতেন উনি শ্রেষ্ঠ ঝগরুটে,কিন্তু সেজদার কাছে হেরে যাওয়াটা খুব আশ্চর্যের ৷ সেজদার অনেক কীর্তি ৷ তবে এটা না বললে ওর সম্বন্ধে কিছুই বলা হল না ৷ তখন কালি পূজোর সময় ৷ এখন যাকে বলে কালি পটকা আমরা বলতাম লঙ্কা বাজি ৷ সেই লঙ্কা বাজি পোড়ানো চলছে টুকটাক স্টেশনের প্লাটফর্ম ৷ ছোটরা ঐ নিয়ে মেতে আছে ৷ কিন্তু সেজদা ওসব ছোটখাট ব্যাপার নেই ৷ ও কোথা থেকে একটা সাইকেল নিয়ে প্লাটফর্মে চালাচ্ছে ৷ কায়দা দেখাচ্ছে ৷ প্লাটফর্ম পাহারা দেবার পুলিশ থাকত ৷ একজন পুলিশ সেজদাকে বারণ করেছে প্লাটফর্মে সাইকেল চালাতে৷ না বন্ধ করলে স্টেশন মাস্টারকে বলে দেবে ৷ বাবাকে বলে দেবে শুনে সেজদা আর কিছু না বলে সাইকেল নিয়ে চলে গেল ৷ এত সহজে সেজদা মেনে নিল দেখে আমরা একটু অবাকই হলাম ৷ তবে ওতে না মাথা ঘামিয়ে আমরা আবার আমাদের খেলায় মেতে গেলাম ৷ বেশ কিছু সময় হয়ে গেছে ৷ এবার আমাদের বাড়ি ফেরার কথা ৷ বাড়ি অবশ্য স্টেশনটার প্রায়ই গায়েই ৷ শুধু একটা রাস্তার ওপরে ৷ আমরা বাড়ির দিকে রওনা হয়েছি দেখি একটু লোক তারশ্বরে চিৎকার করছে ৷ আমরাও দৌড়ালাম সেই দিকে ৷ স্যান্ডো গ্যাজ্ঞি আর খাকি হাফপ্যান্ট পরা একটা লোক মুখটা হাতে ঢেকে দৌঁড়ে যাচ্ছে ৷ আমাদের অবাক করে দিয়ে লোকটা দেখি আমাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে ৷ আমরাও গেলাম ৷ বাবা তখন ঘরেই ছিল ৷ লোকটা আমাদের বাড়ির বাইরে দাড়িয়ে চিৎকার করতে শুরু করল,মাস্টারমশাই, মাস্টারমশাই বাহার আইয়ে ৷
বাবা বাইরে বেরিয়ে
আসতেই লোকটা হাতটা মুখ থেকে সরালেন ৷বাবা দেখেই বলল,একি এটা কিভাবে হল ? তোমার একদিকের গোঁফ কোথায় গেল?
-উড়িয়া গেছে ৷ বোমা দিয়ে উড়ারা দিয়া ৷
-কি বোমা দিয়ে গোঁফ উড়িয়ে দিয়েছে ? কে এমন করল ?
-আপকা লেড়কা ৷ বাবা খুব অবাক হয়ে আমাদের
দিকে তাকাল ৷ আমরা কিছুই জানি না বলতেই বাবা বলল তোমাদের সেজদাকে ডেকে আনো ৷ সেজদা কিন্তু কাছেই ছিল ৷ পালিয়ে যায়নি ৷ এসে সামনে দাঁড়ালো ৷
তারপর বাবা-সেজদা আর ঐ লোকটির কথাবার্তা দিয়ে যা বুঝলাম যে সেজদার প্লাটফর্মে সাইকেল চালাতে বারণ করেছিল এই পুলিশটি বদলে সেজদা একটা কালি পটকার
(আমরা বলতাম লঙ্কা বাজি)সুতোটা পুলিশের গোঁফের এক সঙ্গে পেঁচিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ৷ পুলিশটি তখন আরাম করে প্লাটফর্মের বেঞ্চে ঘুমোচ্ছিল ৷ এখন
পুলিশটির একদিকের গোঁফের সঙ্গে মুখের চামড়া কিছুটা পুড়ে গেছে ৷ বাবা যখন মেজদাকে
জিজ্ঞেস করল কেন সে এখন করেছে ?
মেজদার সোজা উওর পুলিশটি কেন ডিউটির সময় ঘুমোচ্ছিল ৷ কিন্তু ওতে মেজদার শাস্তি মকুব হয়নি ৷ বেআইনি সাইকেল চালোনোর জন্য তিনদিন ঘর বন্দী আর গোঁফ ওয়ানের জন্য চব্বিশ ঘন্টার জন্য যাওয়া বন্ধ ৷ মেজদা কিন্তু সেই শাস্তি অক্ষরে পালন করেছিল ৷
মেজদার কথা এখন থাক ৷ তার প্রতিপক্ষ নানুর কথা একটু বলি ৷ নানুর পরিচয় ওর বাবাও রেলওয়েতে কাজ করে তবে কোনও সাধারণ কর্মচারী হিসাবে ৷ অফিসারদের কোয়াটার্সের একই সারিতে হলেও ওদের বিল্ডিংগুলো আমাদের বিল্ডিং থেকে একটু তফাতে ৷ নানুর সম্বন্ধে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল,ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময় একদিন সাইকেল চালাতে চালাতে পড়ে গিয়ে ওর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা কেটে-পা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায় ৷ সেই অবস্থায় পকেট বুড়ো আঙুলটা নিয়ে প্রায় একমাইল দূরে রেলওয়ে হাসপাতালে গিয়ে বলে ওটা সেলাই করে জোড়া লাগিয়ে দিতে ৷ কিন্তু ডাক্তার সেটা করতে পারবে না বলাতে সেই আঙুল পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরে পড়ার টেবিলে রেখে দিয়েছিল ৷ পরে নিজে সেলাই করে নেবে বলে ৷ এই নানু ভয়ডর বলে কিছু নেই ৷
আমার আগেই নানুই ছিল সেখানকার একছএ নায়ক ৷ মস্তান ৷ পড়াশোনায় বিশেষ মন নেই ৷ সারাদিন একদল ছেলেদের নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াত ৷ ওর দলে ওর কথাই ফাইনাল ৷ গাছের আম-কাঁঠাল পাড়া,ডান্ডাগুলি খেলা,প্যামেঞ্চাদের কাছ থেকে জোর করে নানা অজুহাতে চাঁদা আদায় করা-এসব নিয়েই ও থাকত ৷ ওকে বড়রাও ভয় পেত ৷ এক কথায় ওর কোনো বিরোধী পক্ষ ছিল না ৷
এরপর আমরা দোমহনী এলাম ৷ মেজদাও এল ৷ফুটবল খেলার চাইতেও মেজদার নেশা ছিল গুলি খেলা আর খাপ খেলা ৷ গুলি খেলা মানে সবাই যেমন কাচের গুলি নিয়ে খেলে,সেই একই টিপ করে একটা গুলিকে অন্য গুলিকে মারা ৷ আর খাপ খেলা ? ছোটবেলার পরে আর খাপ খেলা আমি দেখিনি ৷ খাপ মানে সিগারেটের খালি প্যাকেট ৷ সবার একটা সর্বক্ষণের কাজ ছিল ফেলে দেওয়া সিগারেটের খালি প্যাকেট কুড়ানো ৷ বাবা সিগারেট খেত না,কাজেই আমাদের সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে আনতে হত ৷ খাপ যে শুধু ছেলেরাই কুড়াতো এমন নয়-মেয়েরাও চোখে পড়লে কুড়িয়ে নিয়ে ভাইদের দিয়ে দিত ৷ এই সিগারেটের প্যাকেটের আবার মূল্য করা থাকত ৷ যেমন,যে প্যাকেট সবচাইতে বেশী পাওয়া যেত,তার মূল্য তত কম ৷ আর প্যাকেট যত কম পাওয়া যেত,তার মূল্য সবচাইতে বেশী ৷ সিজার নামের সিগারেট সবচাইতে বেশী লোক খেত ৷ ক্যাপস্টেন সিগারেটও বেশী পাওয়া যেত ৷ এ ছাড়াও আরো দুচার রকম খাপ পাওয়া যেত ৷ সিগারেটের আসল দামটা আমাদের কাছে ছিল মূল্যহীন ৷ আমাদের কাছে বেশী পাওয়া প্যাকেটের দাম কম,আর কম পাওয়া যাওয়া প্যাকেটের দাম বেশী ৷ খাপ খেলাকে আমরা তাস খেলাও বলতাম ৷ কী করে খেলা হত এই খাপ ? একটা চ্যাপ্টা পাথরের টুকরো নিয়ে দুজন প্লোয়ার একটা এবড়ো খেবড়ো জায়গায় বেছে নিয়ে খেলেন ঐ পাথরের টুকরোর বদলে লোগার চ্যাপ্টা টুকরে খেলোয়ার নিজের পছন্দ মতো নিতে পারে ৷ আমরা ঐ টুকরো বলতাম ডিগ্গেল ৷ একজন প্লেয়ার নিজের ডিগ্গেল এমনভাবে এমন একটা জায়গায় ছুঁড়ে দেয় ৷ এরপর অন্য প্লোয়ার ঐ ডিগ্গেলকে লক্ষ্য করে নিজের ডিগ্গেলকে ছুঁড়ে আগের ডিগ্গেলের এ বিঘত তফাতের মধ্যে নিজেরটা রাখার চেষ্টা করতে যদি পরের জনের এক বিঘাতের মধ্যে থাকে,তার যে সেই দান জিতল আর যদি না পারে তবে হেরে গেল ৷ ডিগ্গেল ছোঁড়ার আগেই হার-জিতের জন্য কটা খাপ দেওয়া নেওয়া হবে,সেটা ঠিক নেওয়া হয় ৷ অর্থাৎ ঠিক মতো ডিগ্গেল ছুঁড়ে খাপ জেতা ৷
মজাটা হল না গুলি খেলায় বা ডিগ্গেল খেলায় মেজদার সঙ্গে কেউ পারত না ৷ নানু খুব ঠান্ডা মাথায় ছেলে ৷ মুখে কিছু বলত না ৷ কিন্তু শোধ তুলতে অন্যভাবে ৷ গুলি আর খাপ জমতে জমতে এমন হল যে উঠোনের একদিকটা বস্তা বস্তা গুলি আর খাম জমতে থাকল ৷
আমরাও নিজেদের বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম ৷ অল্প খাপ বাজি ধরতাম ৷ হারতাম বেশী সময় ৷ কোনো কোনো দিন হারতামও মেজদা মাঝে মাঝে বাড়ির কাজে এদিক ওদিক যেত ৷ আর যে দিন মেজদা থাকত না,সেদিন নানু এসে আমাকে খাপ বা গুলি খেলার জন্য বলত ৷ আমি বস্তা থেকে খাপ আর গুলি আনতাম আর হারতাম ৷ নানুকের কাছে হারা আর মেজদার খাপের বস্তা খালি হয়ে যাওয়ার জন্য আমার জেদ চেপে যেত আর নানুর চেলারা নানুর জেতা খাপ নিয়ে মজা করে ফিরে যেত ৷ মেজদা ফিরে এসে সব শুনে বলল, ও কিছু হয়নি ৷ আমি এক বেলাতেই সব তুলে নেব ৷ আর তাই হত ৷ একটা জিনিস দেখে আমার খুব অবাক লাগত ৷ মেজদা বা নানু কেউ কারো সঙ্গে কথাকাটি করত না,ঝগড়া বা মারামারির তো প্রশ্নই নেই ৷ মুখে কথা না বলে নিজের কাজ করে যাওয়া ৷
সব মিলিয়ে একরকম চলছিল ৷ একদিন দোলের দিন বিকেলে আমরা আমাদের বয়সী বন্ধুদের সঙ্গে আবির নিয়ে খেলছিলাম ৷ এমন সময় নানু ওখানে এল ৷ নানু একটু ফিটফাট থাকত ভালোবাসত সেদিনও একটা সাদা টি শার্ট পরে এসেছিল, এসেই কোনো কথা বলে আমার হাত থেকেই আবির নিয়ে আমার মাথায় ভালো করে লাগিয়ে দিলাম ৷সত্য বলতে নানুকে আমার বেশ ভয় লাগত ৷ কিন্তু সেদিন আমি পিছন থেকে গিয়ে আঙুলের মাথায় একটু আবির নিয়ে লাগিয়ে দিলাম ৷ নানু চট করে আমার হাতটা ধরে ফেলল ৷ ওর শক্ত হাতের চাপে যেন আমার রোগা লিকলিকে হাতটা প্রায় ভেঙ্গেই ফেলল ৷ কিন্তু তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে হাতটা ছেড়ে দিল ৷ ওর তাকানোতে আমার ভয় আরও বেড়ে গেল ৷ কিন্তু ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে গেল সেদিনের মতো ৷ রবির সঙ্গে আড়ি হওয়ার পরে রাস্তায় দেখা হলে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলি না ৷ দুজনই মুখ ঘুরিয়ে নিই ৷ ভানু এখন আমাদের দলে আসে না ৷ নানুর দলে যোগ দিয়েছে ৷ নানুর গায়ে আবির লাগানোর পরে কয়েকদিন কেটে গেছে ৷ একদিন আমি সন্ধ্যার দিকে বাজারের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছি, একা ৷ আসলে রেল কোয়াটার্সের বিল্ডিংগুলো সব একই সারিতে আর সেই বিল্ডিংগুলো সমান্তরাল একটা রাস্তা ৷ সেটা রেলের এরিয়া ছড়িয়ে বাজারে গিয়ে পড়েছে ৷ একটু অন্ধকার ভাব হয়ে এসেছে ৷ হঠাৎ দেখি নানু আর কয়েকজন সাথি রাস্তার ধারে বসে আছে ৷ কেন জানি আমার মনে হল ওদের বদমতলব আছে ৷ ভয়ে বুক ধকধক করলেও খুব স্বাভাবিকভাবে আমি এগিয়ে গেলাম ৷ ওদের দলটা পেরিয়ে কয়েক পা হেঁটেছি,দেখলাম ভানু হনহন করে আমার দিকে আসছে ৷ মুহূর্তের মধ্যে আমি ঠিক করলাম আমার কর্তব্য ভানু কাছে এসে ‘কেন তুই…..’ বলে শুরু করতেই আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ঘুষি মারলাম ওর কানের উপরে ৷ আর কিছু না বুঝতেই দেখি ভানু কাটা গাছের মতো মাটিতে ধপ করে পড়ে গোঙাতে লাগল ৷ আমি বীরদর্পে ওর গায়ে দু-চারটে লাথি মেরে এগিয়ে গেলাম ৷ পিছনে ফিরে দেখি নানুর দল ভানুকে নিয়ে পড়েছে ৷ আমার দিকে আর নজর নেই ৷ জীবনে এই প্রথম আমি কাউকে মারলাম এবং ভানুর মতো অত বড়বড় শরীরকে এক ঘুষিতে কাত করে দিলাম ৷ এখনও বিশ্বাস হানা ৷ আসলে আমি মারপিটে বিশ্বাসই করি না ৷
(ক্রমশ)