>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • শুক্লা রায়

    SongSoptok | 11/10/2014 |




















    চন্দননগরে থাকতেই কবি সন্ধ্যাসঙ্গীতের কবিতাগুলো লেখা শুরু করেছিলেন । কবির লেখার নানা সমালোচনার ছিল, যেমন তার লেখা ছায়া – ছায়া ,ধোঁয়া - ধোঁয়া। কবি নিজেই স্বীকার করেছেন যে বহির বিশ্বের সাথে যোগাযোগ না থাকাতে বাস্তব অভিজ্ঞতা তার ছিল না; সমালোচনার মধ্যে খোঁচা মেরে এটাও বলা হত যে তার লেখা যেন ফ্যাশান। এই খোঁচাটুকুই কিশোর কবির খারাপ লাগত। তবে সমালোচকরা যাই বলে থাকুন তিনি তার লেখার সেরা সম্মান পেয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমের কাছ থেকে। ঘটনাটি কবির ভাষায় এরকমরমেশ দত্ত মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহসভায় দ্বারের কাছে বঙ্কিমবাবু দাঁড়াইয়া ছিলেন; রমেশবাবু বঙ্কিম বাবুর গলায় মালা পরাইতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময় আমি সেখানে উপ স্থিত হইলাম। বঙ্কিম বাবু তাড়াতাড়ি সে মালা আমার গলায় দিয়া বলিলেন,"এ মালা ইঁহারই প্রাপ্য ---রমেশ তুমি সন্ধ্যাসংগীত পড়িয়াছ?" তিনি বলিলেন  "না"। তখন বঙ্কিমবাবু  সন্ধ্যাসংগীতের কোনো কবিতা সম্বন্ধে যেমত ব্যক্ত করিলেন তাহাতে আমি পুরস্কৃত হইয়াছিলাম।

    মোরান সাহেবের বাগানে যেকটি মাস ছিলেন কাদম্বরী ও জ্যোতিদাদার সঙ্গে তিনি তার সুখস্মৃতি মনে রেখেছেন আজীবন'এক একদিন রান্নার আয়োজন বকুলতলায়। সে রান্নায় মশলা বেশি ছিল না, ছিল হাতের গুণকখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাইতেন আমি গান গাহিতামচন্দননগর থেকে ফিরে রবি জ্যোতিদাদা- কাদম্বরীর সঙ্গে সদরস্ট্রীটে থাকতে শুরু করেন । এখানে থাকতেই তার কবি জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে। তিনি অনুভব করেন, 'সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধকরি ফ্রিইস্কুলের বাগানের গাছগুলি দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম ... হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে পরদা সরিয়া গেল। দেখিলাম এক অপরূপ মহিমায় বিশ্ব সংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে ও সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ের স্তরে স্তরে যে বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ' কবিতাটি নির্ঝরের মতোই উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল ।

    ১২৮৯এর কার্তিকে সস্ত্রীক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দার্জিলিং যান; সঙ্গী রবি কিন্তু প্রথম বারে দার্জিলিং তার মোটেও ভালো লাগেনি'আমি দেবদারুবনে ঘুরিলাম, ঝর্ণার ধারে বসিলাম, তাহার জলে স্নান করিলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘার মেঘমুক্ত মহিমার দিকে তাকাইয়া রহিলাম, কিন্তু যেখানে পাওয়া সুসাধ্য মনে করিয়াছিলাম, সেইখানেই কিছু খঁজিয়া পাইলাম না‌পরিচয় পাইয়াছি কিন্তু আর দেখা পাই না' কবি সদরস্ট্রীটে থাকতে লিখেছিলেন 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' যা প্রভাতসংগীতের অন্তর্ভুক্তএ ছাড়াও দার্জিলিং-এ গিয়ে কবিতা লেখেন 'প্রতিধ্বনি' আরও কিছু কবিতা নিয়ে 'প্রভাতসংগীত 'কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালে। কিন্তু কাব্যগ্রন্থটি হাতে নিয়ে তার মন খারাপ হয়ে যায়। প্রভাতসংগীত লেখা প্রসঙ্গে বলেন, 'গুটিকতক কবিতা ছিল ... অবশেষে সম্প্রতি তাহা ছাপা হইয়া গিয়াছে ... আজ সমস্ত দিন ... সদ্যপ্রসূত বইখানি হাতে লইয়া এপাতা ওপাতা করিতেছি, কিছুই ভালো লাগিতেছে না

    'আজ সমস্তদিন ধরিয়া মুদ্রাযন্ত্রের লৌহগর্ভ হইতে সদ্যপ্রসুত বইখানি নিয়া এপাতা ওপাতা করিতেছি কিছুই ভালো লাগিতেছে না'এই ভালো না লাগার কারণ পান্ডুলিপির হস্তাক্ষরে যে ব্যক্তিগত স্পর্শ ছিল ছাপাখানার হরফে ঢালাই কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সেই ব্যক্তিগত স্পর্শ অনুপস্থিতসেই কাঁচা অক্ষর, কাটাকুটি, কালির দাগ দেখিলেই আমার সমস্ত কথা মনে পরে; কখন লিখিয়াছিলাম, কিভাবে লিখিয়াছিলাম, লিখিতে কি সুখ পাইয়াছিলাম সমস্ত মনে পড়ে। সেই বর্ষার রাত্রি মনে পড়ে, সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে । আর, আর একজন আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পাশে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল ! তাদের সেই সুখদুঃখপূর্ণ শৈশবের ইতিহাস আর তেমন স্পষ্ট দেখিতে পাই না তাই আর তেমন আর ভালো লাগে না। অনুমান করা যায় উক্ত আর একজন কাদম্বরীদেবী, সদরস্ট্রীট ও দার্জিলিং-এ প্রভাতসংগীত-এর অনেকগুলি কবিতা লেখার সময় অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে ছিলেন ।

    চন্দননগরে গঙ্গার ধারে বসে সন্ধ্যাসংগীতের কবিতা ছাড়াও 'বউ ঠাকুরাণির হাট' লেখা শুরু করেছিলেন; তাছাড়াও তিনি এইসময়ে কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। 'গঙ্গার ধারে বসিয়া সন্ধ্যাসংগীত ছাড়া কিছু কিছু গদ্যও লিখিতাম। সেও কোনো বাঁধা লেখা নহে--- সেও একরকম যা খুশি তাই লেখা ...শ্রাবন ১২৮৮- বৈশাখ ১২৮৯ সংখ্যায় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়; যার শুরু হয় মোরান সাহেবের বাগানে এবং সদরস্ট্রীটের বাসা অবধি এই প্রবন্ধগুলো লেখা চলে। এই পুরো সময়টা তিনি কাটিয়েছেন জ্যোতিদাদা - কাদম্বরীর সাথে। প্রবন্ধগুলি কথোপকথনের মতোই। যার মধ্যে লেখকের কথা জানতে পারি; অন্য পক্ষ যে কাদম্বরী সে কথা তিনি গোপন করেননিআমার পাঠকদিগের মধ্যে একজন লোককে বিশেষ করিয়া আমার এই ভাবগুলো উৎসর্গ করিতেছি ‌---এ ভাবগুলির সহিত তোমারে আরও কিছু দিলাম, সে তুমিই দেখিতে পাইবে! সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে?  সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎস্নালোক? সেই দুইজনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদুগম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা? সেই দুইজনে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকা? ... একদিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবনের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল ... এক লেখা তুমি আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে’ উপরের বর্ণনা পড়ে কেমন 'নষ্টনীড়' গল্পের কথা মনে হচ্ছে না? সেই অমল যেন রবি আর চারুলতা কাদম্বরী? বস্তুত কবির অনেক লেখার চরিত্র তিনি নিজেই।


    শুধুমাত্র সাহিত্যচর্চা আর উদ্দেশ্যহীনভাবে রবির ঘুরে বেড়ানোয় শঙ্কিত হয়েছিলেন মহর্ষি। নানান ক্থা তার কানে আসে। রবির বিবাহের জন্য পাত্রী খোঁজার নির্দেশ দেন তিনি। কাদম্বরী, জ্ঞানদা, রবি, জ্যোতি পাত্রী দেখতে যান যশোরের দক্ষিণ ডিহির চেঙ্গুটয়ায়। সেখানে জোড়াসাঁকোর কাছারির কর্মচারী বেণীরায়ের কন্যা ভবতারিণীকে তাদের পছন্দ হয়। পিরালী ব্রাহ্মণ ঠাকুরদের সাথে অন্য ব্রাহ্মনেরা বৈবাহিক সম্পর্ক রাখত না। তাই সবখানে তাদের পাত্রীসন্ধান চলত না। প্রায় নিরক্ষর এই কন্যাকে রবি পছন্দ করেননি। তাই মুসৌরি থেকে তিনি পত্রযোগে ডেকে পাঠান পুত্রকে। রবি; তুমি অবিলম্বে এখানে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। অনেকদিন পর তোমাকে দেখিয়া আমার মন অত্যন্ত আনন্দ লাভ করিবেতুমি সঙ্গে একটা বিছানা এবং একটা কম্বল আনিবে। তুমি এইপত্র জ্যোতিকে দেখাইয়া সরকারি তহবিল হইতে এখানে আসিবার ব্যয় লইবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর রেলগাড়ির Return Ticket লইবে আমার স্নেহ ও আশীরবাদ গ্রহণ কর রবি সুরেন্দ্র ও ইন্দিরাকে সঙ্গী করে মুসৌরি যান। তারপর এই বিবাহে সম্মতি দেন মুসৌরি থেকে ফিরে রবি জ্যোতি, কাদম্বরী, স্বর্ণকুমারী, জ্ঞাণদানন্দিনী এদের সাথে কর্ণাটক রাজ্যের কারোয়ায় যান। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে


    কারোয়া থেকে ১৮৮৩ সালের জুন্ মাসে পুত্র-কন্যা সহ জ্ঞানদা, স্বর্ণকুমারী ফিরে আসেন। কারোয়ার থেকে জাহাজে বোম্বাই এসে রেলপথে রবি, জ্যোতি, কাদম্বরী কলকাতায় ফিরে আসেন সম্ভবত কার্ত্তিক মাসের শেষের দিকে। বিয়ে ঠিক হলে মহর্ষি দক্ষিন ডিহির বাড়িতে অনেক রকম খেলনা, বসন ভূষণ কর্মচারী সদানন্দ মজুদারের সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। সদানন্দ মহর্ষির কথা অনুসারে গ্রামে নানা মিষ্টি তৈরী করিয়ে কন্যার ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এভাবেই রবির বিবাহের প্রস্তুতি চলতে থাকে। গায়েহলুদের পর অবন ঠাকুরদের বাড়িতে তার আইবুড়োভাতের ব্যবস্থা করা হয়। এলাহি আয়োজন; আর রবিকে সেদিন দেখাচ্ছিল যেন দিল্লির বাদশা [অবন ঠাকুরের উক্তি] তিনি ঘাড় নিচু করে খাচ্ছেন,  পিসি জিজ্ঞাসা করছেন কনে পছন্দ হয়েছে কিনা, রবি লজ্জা পাচ্ছেন এইসব। নিজের বাড়িতেই কবি বিয়ে করেন।


    সাধারণ ঘরোয়া ভাবে কবির বিয়ে হয়। নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে অন্দর মহলে আসেন বিয়ে করতে। বর সজ্জার শালখানি গায়ে জড়ানো। বাসরে ভাঁড় উলটে দিয়ে মজা করে বলছেন সব যে ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে কাকিমা। বাসরে গান গাওয়ার অনুরোধে গাইছেন দুষ্টুমি করে কনের দিকে তাকিয়ে - মরি লাবন্যময়ী কে ও স্থির সৌদামিনী---গান শুনে কনে জড়োসড়ো; ওরনায় মুখ ঢেকে মাথা হেঁট করে বসে আছেন । বিয়ের পর পৌষ মাসে তারা জোড়াসাঁকোয় থাকেন, মাঘ মাসে চলে আসেন লোয়ার সারকুলার রোডে জ্ঞাণদানন্দিনীর বাড়িতে। ঠাকুরবাড়িতে ভবতারিনীর নূতন নাম হয় মৃনালিণী। লরেটো হাউসে পৃথকভাবে মৃনালিণীর শিক্ষার ব্যবস্থা হয়; গান শেখানোর ব্যবস্থাও হয় তার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যবসা, নাটক, জমিদারী নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাদম্বরী একা হয়ে যান। তার উপর রবির পরিবারকে জ্ঞানদা নিজের কাছে বুদ্ধি করে টেনে নিয়েছেন। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা গ্রাস করতে থাকে কাদম্বরীকে । তার উপ্র বাড়ির অন্যদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। সুন্দরী -বিদুষী -লেখিকা সবার উপরে তার গুনাগ্রাহী বহু বিখ্যাত পুরুষ সব মিলিয়ে  অন্দরমহলে হিংসার পাত্রী ছিলেন তিনি। উপরন্তু স্বর্ণকুমারীর ছোট মেয়েকে বড় কর ছিলেন তিনি। একদিন তার অসাবধনতায় সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বাচ্চাটি মারা যায়। এরপর নিঃসন্তান কাদম্বরীকে ক্ষমা করা আর বাড়ির মহিলাদের সম্ভব হল না। কাজেই কাদম্বরী একাই ঘরে গুমরে মরতেন।


    জ্যোতি জাহাজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন; রোজ বাড়িতে রাতে ফেরার সময় হয় না তার। মাঝে মাঝে জ্ঞানদার বাড়িতে কাটান সেটা তিনি জানেন। কিন্তু সব রাতেই কি ওখানে থাকেন? সে কথা ঠিক জানেন না তিনি। পড়ানোর ছলে মৃনালিণীকে তার বাড়িতেই নিয়ে গেছেন। নববিবাহিত রবিও তাহলে ওখানেই থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। একদিন সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি! আর আজ! একাই কাটে দিনরাত তার। রবির জগত এখন অনেক বড়। তার নাগাল পান না তিনি। আর বিয়ে করেও রবি কিন্তু পুরোপুরি বউ কে নিয়ে মেতে না উঠে সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছে। অবশ্য বউ কে নিয়েও যে একেবারে মাতেনি তাই বা বলেন কি করে। স্বর্ণকুমারীর বড় মেয়ের বিয়ের গায়েহলুদের দিনে সবাই মিলে মিউজিয়াম যাওয়া হবে ঠিক হয়েছে। জ্ঞানদা এই ব্যপারের উদ্যোক্তা।  সেদিন বাসন্তী রঙের লালজড়িপাড় শাড়িতে মৃনালিণীকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। হঠাত রবি এসে ঠাট্টা করে গান ধরে, হৃদয়কাননে ফুল ফোটাতে চাও্/ আধো নয়নে সখি চাও চাও/ ধীরে ধীরে প্রাণে আমার এসো হে/ মধুর হাসিয়ে ভালোবেসে হে...এরপরেও তার অভিমান না করার বা দুঃখ না পাবার কোনো কারণ থাকল কি? তার -ই দুঃখের দিনে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভালবাসা ? তাও সবার সামনে?

    জ্যোতি বিনোদিনী নামে এক অভিনেত্রীকে 'সরোজিনী' নাটকের অভিনয় শেখাচ্ছেন, প্রায়ই সেখানে অনেকটা সময়ই কাটে কানাঘুষোয় শুনেছেন কাদম্বরী। একদিন প্রমাণ এসে গেল হাতেনাতে। ধোপাকে কাপ্ড় দিতে গিয়ে জেবের পকেট থেকে বেরোলো বিনোদিনীর লেখা চিঠি। আগে এই নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছে তার জ্যোতির সাথে। এবারে আর নতুন করে তাকে কিছুই বলার নেই। অভিমান বাড়তে থাকে সাথে সাথে আসে অসহায়ওতাও। তাহলে এতদিন যা শুনেছিলেন সব সত্যি! একদিন তার এত আদ্র ছিল আজ সব শূন্য! বাড়িতে কাপড় বিক্রি করতে আসা বিশু কাপড় ওয়ালির কাছ থেকে বেশ কিছুটা আফিং জোগাড় করেন তিনি। আগে একবার আফিং খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু সফল না হওয়ায় অনেক কথা শুনতে হয়েছে পরিবার -পরিজন এমনকি আশ্রিতদের কাছ থেকেও। এবারে আর সেই ভুল যাতে না হয় তার জন্য অনেকটা পরিমাণে  আফিং কিনেছেন। জ্যোতি জাহাজের খোল কিনে জাহাজ বানিয়ে নিয়েছেন Kelso Stewert কোম্পানিকে দিয়ে। জাহাজের নাম সরোজিনী। এখন জ্যোতির জীবনে কোথাও তার বিন্দুমাত্র স্থান নেই, এমন কি রবির জীবনেও। রবি এখন থাকেন লোয়ার সার্কুলার রোডে জ্ঞানদার কাছে। ওখানে বসে তিনি 'ছবি ও গান' কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলি কাব্য লিখেছেন; যেমন 'মধ্যাহ্নে', 'একাকিনী' , 'বাদল' , 'গ্রামে'চৌরঙ্গির কাছে লোয়ার সার্কুলার বাগান- বাড়ির দোতলার জানলায় বসে পাশের বসতির মানুষদের কাজ, বিশ্রাম, খেলা, আনাগোনা নিয়ে কবিতাগুলি লিখেছেন সাথে আরও গান, প্রবন্ধও। সেও ভালো আছে। শুধু ভালো নেই কাদম্বরী।

    সরোজিনী জাহাজের ভেতরটা সাজানোর দায়িত্ব জ্যোতি দিয়েছেন জ্ঞাদাকে। তিনি বহুবার বিলেত যাতায়াতের সুত্রে জাহাজের অন্তরসজ্জা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল; সেজন্য সেই দায়িত্ব দিয়েছেন তাকে। নতুন কিছু চালু করতে হলে তার অনেক ধরনের কাজ থাকে। সেইজন্য তিনদিন ধরে জাহাজেই রয়েছেনকাদম্বরী একাই রয়েছেন জোড়াসাঁকোয়এই জাহাজ বানানো প্রকল্পে কোথাও তিনি নেই জ্যোতি অবশ্য বলেছেন তাকে চমক দিতে উদ্বোধনের দিন নিয়ে যাবেন। এটাই অভিমানের কারণ তার ১৮৮৪ সালের ১৯ শ সরোজিনী জাহাজ চালু হবেপ্রচুর ঋণ নিয়ে জ্যোতি জাহাজ সাজিয়েছেন। বিলিতি জাহাজ কোম্পানি ফ্লোটিলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুলনা বড়িশাল জলপথে জাহাজ চালাবেন তিনি

    জাহাজ উদ্বোধনের একদিন আগে থেকেই জ্ঞানদা জাহাজে রয়েছেন। তিনি জ্যোতি কি পোষাক পরবেন তাও ঠিক করে দিয়েছেন। এই প্রকল্পে কাদম্বরী শুধুমাত্র দর্শক। আর কোনো ভূমিকা নেই তার। স্বভাবতই অভিমান হয় তার। অথচ ভারতী পত্রিকা চালানোর সময় তিনি এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অথচ আজ তার কোনো গুরুত্ব নেই? তিনি এমনিতেই সুন্দরী; তার উপর সেদিন দারুন সেজেগুজে যাবেন। দেখা যাক তার রূপের ঝলকে সবার নজর কেড়ে নিতে পারেন কিনা? হলুদ রঙের লাল পাড় রেশম শাড়ী পরে তার সাথে মানানসই গহনা, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা জড়িয়ে নিয়েছেন। আর কানের পেছনে লাগিয়েছেন চন্দনগন্ধী আতর। পূর্ণাবয়ব আয়নায় নিজেকে দেখে আর তার আশ মিটছে না। অপেক্ষা করছেন কখন আসবেন জ্যোতি তাকে নিতে।

    জ্যোতি যে কাজের ফাঁকে ঠিক তাকে নিতে আসবেন এটা তার স্থির বিশ্বাস। অধীর আগ্রহে ঘরে বসে সন্ধ্যে থেকে অপেক্ষা করছেন তিনি। নতুন জাহাজ কোম্পানি চালু করবার জন্য শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। তাদের খানাপিনা ও অন্যান্য ব্যবস্থা নিয়ে জ্যোতি ব্যস্ত। এদিকে সময় গড়াচ্ছে; বিকেল  সন্ধ্যে থেকে রাত হতে চলল। উদ্বেগে কাদম্বরী ঘর বার করছেন। রাতও যেন মায়াবী চাদর জড়িয়ে সময়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাদম্বরীর অপেক্ষার বুঝি আর শেষ নেই। হঠাত দেয়ালের পেটা ঘড়িতে ঢংঢং করে বাজে বারোটা। কাদম্বরী বোঝেন আর কেউ তাকে নিতে আসবে না। তাকেই এবারে যেতে হবে নিজের গন্তব্যে। রাগে  দুঃখে নিজের সব সাজ খুলে ফেলেন। এদিকে ভাটার টানে জাহাজ আটকে গেছে। অনেকক্ষন কাজে এদিক ওদিক করে কাজে আটকে থেকে এবার ইচ্ছে হলেও কারো পক্ষে তখন জাহাজ ছেড়ে বেরোনো সম্ভব নয়। অনেক রাতে উঠে কাদম্বরী হাতির দাঁতের কৌটো খুলে আগের থেকে কিনে রাখা আফিং-এর পুরোটাই খেয়ে শুয়ে পড়েন। যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকেন তিনি। ২৫ বছরের সৌন্দর্যরাশি যেন ক্রমশ বিষাক্ত আইভিলতার চেহারা নেয়‌।


    সকালে দরজা বন্ধ; জানলা দিয়ে দেখা যায় মৃতপ্রায় কাদম্বরীকে। যন্ত্রনায় ছটফট করছেন তিনি। রবি টানা দুদিন তার শয্যার পাশে বসে রইলেন; জ্যোতি উদ্ভ্রান্তপ্রায়। কাদম্বরী যে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন একথা তিনি ভাবেননি; অথচ ভাবা উচিত ছিল। কারণ আগেও একবার তিনি এই চেষ্টা করেছিলেন। দুই বিখ্যাত ডাক্তার নীলমাধব হালদার ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বাড়িতে রেখেও কিছু করা গেলনা। ২১শে এপ্রিল ভোরে কাদম্বরী চলে গেলেন সব অভিমান যন্ত্রণা হতাশার অবসান ঘটিয়ে। তার শেষযাত্রায় সঙ্গ দিলেন রবি, সোমেন্দ্র, দ্বিপেন্দ্র, অরুনেন্দ্র। সারাটা পথ একটি কথাও বললেন না রবি। ফিরে এসেও না। তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথম মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখলেন রবি। তার সবচেয়ে কছের মানুষটি অভিমান করে চলে গেলেন, রয়ে গেল কত অকথিত কথা, অপূর্ণ সাধ। আর একটু মনোযোগ যদি তিনি দিতেন তাহলে হয়ত এই ঘটনা ঘটত না। এই আপশোষ তার জীবনে যাবেনা।

    কাদম্বরীর মৃত্যুর পর তার পোষ্টমরটেম-এর জন্য মৃতদেহ বাড়ির বাইরে পাঠানো হয়নি। মহর্ষির প্রভাবে করোনার কোর্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই বসেছিল। ক্রোনার সাহেব মৃত্যু সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তা হয়ত কোনো সরকারি দপ্তরে রক্ষিত আছে। কিন্তু কাদম্বরীর লেখা আত্মহত্যার চিঠি, তার লেখা সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর খবরের কাগজগুলো এই খবর প্রকাশ না করার জন্য টাকা পেয়েছিল। নূতন বধূ ঠাকুরাণীর মৃত্যু হওয়ায় উক্ত সংবাদ নিবারণ করার জন্য ব্যয় --৫২ টাকা। ক্যাশ বহি থেকে এই হিসেব পাওয়া গেছে। এই মৃত্যুশোক কবি সারাজীবন নানাভাবে স্মরণ রেছেন। কবিতায়, চিত্রে, প্ল্যানচেটে কখনো কোনো আলোচনা্য। সারাজীবন্ ধরে তাকে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন





    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.