কী কথা তাঁহার সাথে
ঈশ্বরের নিজের হাতে আঁকা উপারা নারীটি আপনি
। চিরকালীন ম্যাগনেোলিয়া
। আয়নায় কখনো নিজের শঙ্খওড়াটি দেখেছেন ? কথা
বলেছেন একার সঙ্গে ?
ভুলো না , এ মুখের অন্য মানেও আছে । এই যেমন ধরো এই মুহূর্তে আমার মুখটি লোকসঙ্গীত । একতারায় স্নান ওড়ানো বাউল । খুব ইচ্ছে উড়ে যাই ... অনেক দূর... কুচি কুচি পান্নার চুমকি
... ঢাকের শব্দ কোঁচড়ে পুরে শুধু উড়তেই চাই ... এই যে তুমি । আমাকে শুনছো খুব মন দিয়ে আর ফুলের কুচিপুড়িতে ভেসে আসছে তাজা
গান আর অঢেল রক্ত । মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তোমার পাপড়ি আর দলমণ্ডলে
এখন হইচই হচ্ছে খুব ...
নিজের মুখের দিকে যখন তাকাই , সত্যি বলছি তেপান্তরের শস্যখনি ছাড়া কিছুই দেখি
না ... তুমি কি আরও কিছু দেখো , দেখতে পাও ?
নিশ্চয়ই । আমি আরও অনেক কিছু দেখি ... নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে নিয়ে যাই আপনার অস্ত্রাগারে
। যুবতী মারণাস্ত্র । ক্ষয় নেই শোধনের । আপনার সামনে আমাদের বাদ্যযন্ত্রটি কয়েক ফোঁটা
সানাই । তার বেশী কিছু নয় । বিবাহবাসর করে আবহাওয়ায় মিশে যাচ্ছে বিপন্নতা ... চন্দ্রবাতাস
... আপনি কি টের পান না , আপনার সমস্ত মন্ত্রসম্ভাবনায় আমরা লাগাতার অভিজ্ঞান হয়েই
যাচ্ছি ... যদিও এখন সমুদ্র অনেক শান্ত , যদিও বকুল দেবদারু এখন জারণ তিথিময় , ধুলো ধুলো যন্ত্রণায় আমাদেরও কিন্তু
অনেক অগ্রন্থিত কবিতা আছে । আপনি যেমন এখানে আছেন । আপনি সেখানেও থাকেন । কী মনে হয় আপনার
? ... নদীর বিশেষণে এইটুকুই আপনার নিজস্ব সর্বনাম ?
এ আমার স্বপ্নভ্রমণ । সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে অগুরুচন্দন চেয়েছিলুম একদম শুরুপর্বে
। তোমরা কেউ তার টুঁ শব্দটি টের পাওনি । আমি নিজেও কি সম্পূর্ণ আমার করে পেয়েছিলুম সেই জল অথবা না-জলের
সারসপ্রধান এলাকা । মথসাঁতারের অদ্ভুত অনুভূতি ... জানো , এখনো
সেই সমস্ত পাখিবোনা আকাশকেদারায় সময় কাটে আমার । হাতে গোণা প্রজাপতি ... বাদলভিক্ষু । লালনআধুলিতে আক্রান্ত এই ভিক্ষাপাত্র ...
এবার একটি ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করছি । কখনো পাইনবনে লুকিয়ে শিলং পাহাড় ছুঁয়েছেন ? অথবা প্রকাশ্যে
পঞ্চবটীর নাগাতরঙ্গ । উন্মাদ হাত ধরাধরি ?
তুমি দেখেছ কখনো অন্ধকার রঙের রোদ ? অথবা রোদ রঙের অন্ধকার ? কখনো ভালবাসা দেখেছ , রাই থেকে রক্তাক্ত হয়ে ওঠা মাহেন্দ্রক্ষণ ? ধরো
দুটি চাঁদ একটি বৃক্ষকে আশ্রয় করে রয়েছে ... আর প্রজাপতিরা গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে শিকারের
উদ্দেশ্যে । বৃক্ষ বুঝে উঠতে পারছে না সে এখন কি করবে
? শরীর থেকে একটি চাঁদ ঝরিয়ে দেবে ? নাকি দুটি চাঁদের উষ্ণতায় মুখ ডুবিয়ে দেখতে পাবে
সমান্তরাল আরেকটি ক্যানভাস ... মীনরাশিতে ঝরানো চাঁদ ... আপেলের রাতভোর গেঁথে আছে ...
নাকি চাঁদের মত অন্য কেউ ... দেওয়ালের কৃপাণ বুকে ঠেকে গেলে কেউ কি আর হাত ধরাধরি করে
? বালুকণার লাল , নীল চতুষ্কোণ । তোমাদের বিরামপেন্সিলে আমি বুঝি এখনো অদৃশ্য হতে পারি নি
...
আচ্ছা , এবার বলুন ... আপনি অন্ধকারকে ভয় পান
? না আলো ?
আলো মানেই অনেক ভয় । নক্ষত্রের বাজুতে প্রহর হারানোর ভয় । চিঠিফেরত খোলা বাগানে ডাকবাক্স হারানোর ভয় । যেন আর কোনোদিন আমাকে কেউ চিঠি লিখবে না । যেন জড়োয়া বাতিস্তম্ভটি সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে গেছে । যেন অস্তাচলে দাঁড়িয়ে এক বৌদ্ধভিক্ষু আমাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা
করেছেন ... ভিড় জমে গেছে চারদিকে । পুরোহিত চিৎকার করছেন ... না না ... তোমার
হাতের আষাঢ় ... তোমার বুদবুদবৃষ্টি আজ থেকে আর কেউ ছোঁবে না ... কেউ ছোঁবে না
তোমার রাধাভাবের দুঃখবিলাস ...রাস্তা থমকে যাচ্ছে ল্যাম্পপোষ্টে , সাইক্লোন
ভেঙ্গে পড়ছে পিঠের ওপর ... আঙ্গুলের টরেটক্কা ... অই যে ম্যাজিক আঁকা অ্যালবাম । স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে
চরাচরের অহল্যা ।
সমস্ত আয়ু উথালপাতাল করে আমার থেকে আমাকেই
যেন কেউ কেড়ে নিচ্ছে ...
এবং ঘুম
। ঘুম ভাঙছে আমার । আমি যেন আর শুয়ে বসে থাকতে পারছি না । মন দিয়ে বসে আছি তরুণ তানপুরায় । রোগা চেহারার মধ্যবয়েসী লয়কারি আমাকে ডেকে বলছে , শোনো শোনো
... মেয়ে , তোমাকেই বলছি ... অই যে তানপুরা দেখছ । বালি কাঁকড় আর মাঠ সরিয়ে দক্ষিণঘরের দরজা ... ওর গায়ে আলো
নেই এতোটুকু ... সুর আছে শুধু । অন্ধকারের সুর । তোমার জন্যে ছটফট করছে কালো বোরখা ... আমি লয়কারিকে ছুঁয়ে
ফেলেছি ততোক্ষণে । বিপুল আমোদে কেঁপে উঠছি । বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে বলছি ... সুরে সুরে কোনো অজুহাত নয়
। আমিও অপেক্ষায় । অন্ধকারে কাউকে হারাবার ভয় নেই । এমনকি স্বয়ং অন্ধকারকেও নয় ...
আপনি কি অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছেন
? বা অন্য কোন স্বপ্ন ... যেমন ছবি আঁকা , মৃৎ-শিল্পী অথবা ধরুন কনকাঞ্জলির বিপুল সেই
বিপুল মায়ামৃগটি ?
আমি তো অভিনয়কে পেশা হিসেবে বাছিনি কখনো । অভিনয় নিজেই আমাকে নেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে । অভিনয়ের কী উদ্দশ্য হয় ।? অথবা পেশাদার ক্যামেরা ? দেখেছ কখনো ? হয়তো আমিই সেই ত্রিভুজক্যামেরা
। শেষ রাতের ফিনফিনে অভিনেত্রী । মেঘকে আঁকড়ে ধরি ... হাল্কা বাতাসে উড়ে যায় আবেশের আইলাইনার
। মাস্কারায় ধোয়া আমার নিজস্ব কোন অতীতনাম ... হয়ত স্ফটিকে লেখা সেই মাধুকরী হরফ । হয়তো সেই নাম আজ অব্দি কেউ উচ্চারণই করেনি ... যার মজ্জায়
আমি শুধু হেঁটেই গেছি বছরের পর বছর আর জ্বর
হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়েছে রঙদার ত্রিশুলের ভুল ... তরবারির লৌকিকতা ... আমার লাজুক
স্কুলপাঠ্যসূচি ... ইঞ্চিদুয়েক পাতাঝরা ।
আশ্চর্য টানা টানা চোখ । চর্যাপদ ... অথচ নিজস্ব কোনো দৃষ্টি নেই আমার । যেন সেসব কবেই বিলিয়ে
দিয়েছি পাড়া প্রতিবেশীর সন্ন্যাসযাত্রায় । যেন আমার নিজস্ব কোন আমিও নেই ... নাকি আছে
? তোমরা কি দেখতে পাও কখনো ... আমার দরজা খোলা ... হাট করে মেলা রামধনু ... আমি ঠিক
কী যে চাই ... নিজেকে বুঝিয়ে উঠতে পারি না
।
খুব ইচ্ছে ছিল , রবিঠাকুরের গানগুলো এক এক
করে সব এঁকে ফেলি । জানো , এঁকেও ছিলুম ক’টি ... ঘোর গ্রীষ্মে একবার আঁকতে চেয়েছিলুম দারুণ অগ্নিবাণ
... কি আর বলি ... সে অবাক কাণ্ড ... যতই আমি
আঁকছি আর অগ্নিবাণের ভেতরে ডুবিয়ে দিচ্ছি আগুনের কুণ্ডলী ... আগুন কোথায় ... হল্কাই
বা কই । ঝিনুক উঠে আসছে শুধু ... মুক্তোর গহ্বর থেকে
উঠে আসছে আমার ধনুকভাঙা ইচ্ছেঝিনুক ... এতোটুকু
গরম বোধ হচ্ছে না ...... তাপ নেই ... হাজার
দুয়ারের পাতালরেল নেই ... আমাকে আঁকড়ে ধরে
কেদারের চালে চালে নাচছে বরফের সাপ , ব্রহ্মান্দের নাকের দু’পাশে কৃষ্ণগহবর ... পোষা
বিষের থলি , শেষনাগের আভাষ পাচ্ছি ... তাকে ধরি নাকি ছুঁই ...ভাবতে ভাবতে গড়িয়ে যায় বেলা ... কি করি বলো ? অরণ্যে ফেলে আসি তবে অসহ্য সিংহের
রঙতুলি আর কেশর ?
আপনি মুখ না মুখোশ ? আপনি কী রঙিন কাগজে ছাপা
মায়াবিনী নক্সা ...
বরং বলতে পারো আমি মুখহীন মুখোশহীন । মুখোশের তো অনেক শরীর । অনেক মন । কখনো প্রবল ক্যানসার দিয়ে তোমার গা মুছিয়ে
দেবে । কখনো সুখি ব্রেইল । নীলচাঁদের মুখোশের পারে যে রমণী আসর সাজিয়ে
, তার অগুনতি বাসরহীরে ... না গো কোন মায়াবিনী
হরিণী তো দূর , আমার কাছে ফাল্গুনীরাতের কমলহিরেও নেই ...
বোধিগাছের কোটর খুঁড়ে পরমান্ন পাবো এমন সুজাতাই
বা আমার কোথায় ? আর নক্সার কথা বলছ ? তাই বা কোথায় পাই ... অই যে দ্যাখো রুলটানা পলাশের
তত্ত্ব... শেকড় জড়িয়ে যাচ্ছে জালে ... অনন্ত রূপকথা কাঁধে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে মাছরাঙাদের
গ্রাম্যমা । অপূর্ব সৌন্দর্যে লাল হয়ে যাচ্ছে মাধবীলতার
কুসুম ... কি অপরূপ তার জরিবৃত্ত ... ঘূর্ণির ঘুঙ্গুরে ঘুরছে , ঘুরেই যাচ্ছে তার চুপপায়ের
নূপুর অথচ হৃদয়খানি চাকা হয়ে যাচ্ছে না ... আহা ! এমন নক্সাদার নক্সা আমি পাই কোথায়
বলো ... আমি কী আর নোলকভরা সন্ধ্যাতারা ? আমার কি গা ভর্তি সোনাঝুরির লালবাঁধ ? আমি
কী আর পূর্ণিমার ঘোরলাগা ময়ূরের আদি কৃষ্ণচূড়া ?
তুমি আমার সমস্ত রঙিন কাগজ খুলে দাও । ধূপকাঠি দেখাও বৃষ্টির ধ্রুব । বর্ষামঙ্গল তোমার অক্ষয়সিন্দুকের নাম বুঝি ? বেশ বেশ । পাশের জানালাটি খুলে দাও একটু । আমি শ্বাস নিই । অই রোহিণী শতভিষা , অই জারুলের মৃগশিরা । হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ... তারায় তারায় কেটে যাচ্ছে কালপুরুষের
কবজ ... আমার মৃত্যু তোমরা শুনো না কেউ
...
এখনো কত তারা চেনা বাকি । কত ছায়াপথ । অলিগলি । সপ্তর্ষিমণ্ডল যদি সঠিক চিনতে পারি এক বাক্যে ... আমাকে অহঙ্কারি
ভেবো না । শয্যাটি মেলে দিও দীঘিবাতাসে ... শুকতারা কমে
এলে আমি নিজেই গাল থেকে মুছে নেব ঘাম । তেলরঙে আগুন করবো নিজেকে ...
প্রেক্ষাগৃহের
কোনো অঙ্কই আমার নিজস্ব জ্যামিতি নয় ...
[রত্নদীপা দে ঘোষ]
[প্রচ্ছদশিল্পী: মেঘ
অদিতি]