[পর্ব
ছয়]
আমি যখন প্রথম প্রথম কবিতা লিখতাম, মানে ওই ছন্দ মিলিয়ে খানিকটা গান, খানিকটা ছড়াগোছের আর কি, আমাকেও পাগল বলত বাড়ির লোকজন। ১৯৯৫-৯৬ সাল নাগাদ, তখন আমি ভুলভাল লেখায় ভর্তি করে দিচ্ছি পাতার পর পাতা। নষ্ট রক্তের মতো শরীরে জমা হচ্ছে সেইসব লেখা আর অন্তত একটা কাউকে তা শোনানোর জন্য সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে উঠেছি। তুতুল, মানে আমার বোনকে বললাম, "দুটো কবিতা শুনবি রে?" তুতুল বলল, "শুনব। পয়সা দে।"
সেই থেকে কবিতা পিছু চার আনা করে দিতে হত তুতুলকে। তখন আমি গাদা গাদা লিখতাম। ফলে একেকদিন একটাকা-দু'টাকাও বেরিয়ে যেত। অবশ্য ও এটা একটা প্রতিশোধ নিয়েছিল। আমাদের ইস্কুলে নাইন থেকে শাড়ি ছিল। আমি বেশ নিপাট শাড়ি পরতে পারতাম। তুতুল একেবারেই পারত না। মায়েরও অত ধৈর্য্য ছিল না পরিয়ে দেওয়ার। আমি দেখলাম, এখান থেকে একটা রোজগারের রাস্তা হতে পারে। বললাম, "পরাতে পারি, কিন্তু, রোজ দশ পয়সা চাই।" বেচারি তুতুল। বিকেলবেলায় "মা" "মা" বলে চিল্লোতে চিল্লোতে সারা পাড়া মাথায় করে বাড়ি ফিরত যখন, আদ্ধেক শাড়ি গায়ে আর বাকি আদ্ধেক পোঁটলা পাকানো। গেট থেকে শাড়ি খুলতে খুলতে ঘরে ঢুকেই একদিকে চটি আর একদিকে ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে "মা জানো তো..." বলে শুরু করত গোটা দিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। রোজ বকুনি খেত মায়ের কাছে। কিন্তু আমার মনে হয় মা এই ব্যাপারটা খুব উপভোগও করত। আর এই আপাততুচ্ছ মুহূর্তটার জন্য হয়ত মা সারাদিন ধরে অপেক্ষা করত।
সেই থেকে কবিতা পিছু চার আনা করে দিতে হত তুতুলকে। তখন আমি গাদা গাদা লিখতাম। ফলে একেকদিন একটাকা-দু'টাকাও বেরিয়ে যেত। অবশ্য ও এটা একটা প্রতিশোধ নিয়েছিল। আমাদের ইস্কুলে নাইন থেকে শাড়ি ছিল। আমি বেশ নিপাট শাড়ি পরতে পারতাম। তুতুল একেবারেই পারত না। মায়েরও অত ধৈর্য্য ছিল না পরিয়ে দেওয়ার। আমি দেখলাম, এখান থেকে একটা রোজগারের রাস্তা হতে পারে। বললাম, "পরাতে পারি, কিন্তু, রোজ দশ পয়সা চাই।" বেচারি তুতুল। বিকেলবেলায় "মা" "মা" বলে চিল্লোতে চিল্লোতে সারা পাড়া মাথায় করে বাড়ি ফিরত যখন, আদ্ধেক শাড়ি গায়ে আর বাকি আদ্ধেক পোঁটলা পাকানো। গেট থেকে শাড়ি খুলতে খুলতে ঘরে ঢুকেই একদিকে চটি আর একদিকে ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে "মা জানো তো..." বলে শুরু করত গোটা দিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। রোজ বকুনি খেত মায়ের কাছে। কিন্তু আমার মনে হয় মা এই ব্যাপারটা খুব উপভোগও করত। আর এই আপাততুচ্ছ মুহূর্তটার জন্য হয়ত মা সারাদিন ধরে অপেক্ষা করত।
পয়সা নিয়ে কাজ করার এই ব্যাপারটা শুরু করেছিল মেজমামা। মেজমামার মাথায় তখন সবে দুটো-চারটে চুল পাকতে শুরু করেছে। বলত,"তুলতে পারলেই পয়সা। চুলপিছু দশ পয়সা রেট।" আমরা সোৎসাহে কাজে লেগে যেতাম। দেয়ালে নখ ঘষে খরখরে করে নিলে চুল তুলতে খুব সুবিধে হ'ত। মা আর বড়মার পাকাচুল তুলেও পয়সা নিতাম। বড় মেসোমশাইয়ের মাথায় পাকাচুল বেশি ছিল বলে রেট কম ছিল। পাঁচ পয়সা। মা, বড়মামা, মেজমামার পায়ে আবার বাত ছিল। পা টিপে দিতে হ'ত। সেখানেও পয়সা। দশ মিনিটে চার আনা। তখনও আমরা জানতাম না যে আমেরিকার ছোট ছোট ছেলেপুলেরা বাপের গাড়ি ধুয়েও রোজগার করে। জানলে আমি নিশ্চিত যে আমরা সেই রাস্তাতেই হাঁটতাম। আক্ষরিক অর্থেই হাঁটতাম কারণ বাবার গাড়ি ছিল না আর দেশটাও আমেরিকা নয়।
আমাদের হাঁটার রাস্তা কি পূর্বনির্দিষ্ট থাকে? আমার এক স্বনামধন্যা বান্ধবীর মা খুব তোল্লাই দিতেন আমাদের। বলতেন, "এই যে তোমরা লেখালেখি করছ, অন্যরকম করে ভাবছ, এই যে তোমরা মানসিকভাবে অনেক স্বতন্ত্র, উন্নত, এ শুধু এক জন্মের অর্জন নয়। এর পেছনে অন্তত গত কয়েক জন্মের হাত আছে।" হাত আছে না পা আছে, ‘স্বতন্ত্র’ কী আর ‘উন্নত’-ই বা কী, কিছুই তেমন বুঝতাম না। শুধু মনে হ'ত, এই যে কষ্ট, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই, এই যে চলা, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোথায় গিয়ে শেষ হবে এইসব? কোন মহাকাল ম্যানহোলের অন্ধকারে গিয়ে আছড়ে পড়বে এই জীবন? কেমন সে অন্ধকার? কেমন সেই মৃত্যু? যাকে আমি চোখে দেখিনি? যার বাঁশি আমি রোজ শুনতে পাই ঘুমের অতল থেকে উঠে আসা গোঙানীর মধ্যে? যে আমায় বিশাল অজগর সাপের মতো প্রতিদিন টেনে নিচ্ছে এই জীবনের একমাত্র সত্যের দিকে আর আমি নাস্তিকতার খোলস ছাড়তে ছাড়তে প্রতিদিন একটু একটু করে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে উঠছি? এমনকী জন্মান্তরেও বিশ্বাস এসে যাচ্ছে আমার আর পরেরবার কোথায়, কার পেটে জন্মাব সেই ব্যাপারেও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি।
আমাদের হাঁটার রাস্তা কি পূর্বনির্দিষ্ট থাকে? আমার এক স্বনামধন্যা বান্ধবীর মা খুব তোল্লাই দিতেন আমাদের। বলতেন, "এই যে তোমরা লেখালেখি করছ, অন্যরকম করে ভাবছ, এই যে তোমরা মানসিকভাবে অনেক স্বতন্ত্র, উন্নত, এ শুধু এক জন্মের অর্জন নয়। এর পেছনে অন্তত গত কয়েক জন্মের হাত আছে।" হাত আছে না পা আছে, ‘স্বতন্ত্র’ কী আর ‘উন্নত’-ই বা কী, কিছুই তেমন বুঝতাম না। শুধু মনে হ'ত, এই যে কষ্ট, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই, এই যে চলা, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোথায় গিয়ে শেষ হবে এইসব? কোন মহাকাল ম্যানহোলের অন্ধকারে গিয়ে আছড়ে পড়বে এই জীবন? কেমন সে অন্ধকার? কেমন সেই মৃত্যু? যাকে আমি চোখে দেখিনি? যার বাঁশি আমি রোজ শুনতে পাই ঘুমের অতল থেকে উঠে আসা গোঙানীর মধ্যে? যে আমায় বিশাল অজগর সাপের মতো প্রতিদিন টেনে নিচ্ছে এই জীবনের একমাত্র সত্যের দিকে আর আমি নাস্তিকতার খোলস ছাড়তে ছাড়তে প্রতিদিন একটু একটু করে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে উঠছি? এমনকী জন্মান্তরেও বিশ্বাস এসে যাচ্ছে আমার আর পরেরবার কোথায়, কার পেটে জন্মাব সেই ব্যাপারেও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি।
[ক্রমশ]