“এক একজন মানু্ষ আসে পৃথিবীতে যাদেরকে হিসেবের
মধ্যে ধরা যায় না”। - ১৯৫৪ সালে স্ত্রী সুরমা ঘটককে একটি ব্যক্তিগত
পত্রে লিখেছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। বিশ্ব চলচিত্রের অঙ্গনে ঋত্বিক যেন সত্যিই এক
সংশপ্তক। বরেণ্য চিত্র পরিচালক সত্যজিত রায় যথার্থই বলেছেন- তার দেশের মানুষ তাকে জীবদ্দশায় বুঝতেই পারেননি। পারলে এতবড়ো প্রতিভার এমন
অকাল প্রয়াণ হতো না। ঋত্বিকের জীবনে একটা মিশন ছিল: বৃহত্তর জনমানসের অন্তরে পৌঁছানোর। শুধুমাত্র
নিজের জন্যে বা গুটিকয়েক সিনেমা বোদ্ধাদের তারিফ কুড়োবার জন্যে কিংবা বিদেশী
পুরস্কারের লক্ষে তার কর্মকাণ্ড ব্যস্ত ছিল না। নাট্যচর্চা দিয়ে যে যাত্রা শুরু
সিনেমার পর্দায় সেই পথচলাকে আরও বিস্তৃত ক্যানভাসে ধরতে চেয়েছিলেন। ধরতে চেয়েছিলেন
শুধুমাত্র আরও বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য। এই যে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলা এটাই ছিল ঋত্বিকের
অন্তরে তার সকল কর্মের মূল চালিকাশক্তি, এবং লক্ষ্যও। আর এই লক্ষ্যই হল তার জীবনের
চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি। পঁচিশ বছরের চলচিত্র জীবনে মোট আটটা পূর্ণাঙ্গ ছবি সমাপ্ত
করতে পেরেছিলেন। এর মধ্যে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছাড়া আর কোনো ছবিই সেভাবে দর্শনাকুল্য লাভ
করেনি। শুরু করেছিলেন ‘নাগরিক’ দিয়ে। অথচ ভাগ্যের এমনই করুণ পরিহাস যে, ১৯৫৩ সালে সমাপ্ত হওয়া ছবিটি প্রথম মুক্তি পায় তার মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে নিউ
এম্পায়রে। শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ ১৯৭৪ সালে শেষ হলেও মুক্তি পায় সেই ১৯৭৭ সালেই, মিনার বিজলী ছবিঘরে। এবং এর ঠিক আগের নির্মিত ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পশ্চিমবঙ্গে প্রথম মুক্তি পেল ১৯৯১ সালের মে
মাসে কলিকাতার নন্দন প্রেক্ষাগৃহে, নির্মাণের দুই দশক পরে! স্রষ্টা যখন তার সৃষ্টির পরিণতিকে চাক্ষুস করতে পারেন না, তাকে ট্র্যাজেডি ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? কিন্তু ঠিক কোন কারণে তৎকালীন সেন্সর বোর্ড ছবিগুলিকে ঠিক সময়ে মুক্তি দেয়নি তা আজও
রহস্যের আড়ালেই।
মনে রাখতে হবে ঋত্বিকের ছবিগুলিতে প্রচলিত টালিগঞ্জ ঘরাণার কাহিনীকেন্দ্রিক
প্রথাগত নায়ক নায়িকা নির্ভরতা নেই। যে সময়ের পরিধিতে তার কর্মজীবন সেই সময়কে
বাংলায় উত্তম-সুচিত্রার যুগ বলা যায়। জনপ্রিয় সাহিত্য নির্ভর
কাহিনী বিন্যাসের চৌহদ্দিতে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগের বাংলার মধ্যবিত্ত ও
উচ্চবিত্ত সমাজের পারিবারিক চালচিত্রের হাসি কান্নাতেই মশগুল থাকতে অভ্যস্ত ছিল
আপামর দর্শককুল। আর এই সময়েই মূলত দেশভাগে বিধ্বস্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দিশাহীনতায় দিগভ্রান্ত ছিন্নমূল মানুষের কঠিন জীবন বাস্তবতায়
যন্ত্রণার মন্থনজাত, অন্তর্লীন সন্তাপের অনুভবকেই চলচিত্রের মননশীল
শিল্পনৈপূণ্যে মুক্তি দিলেন ঋত্বিক; সিনেমার বিস্তৃত ক্যানভাসে- বড়ো পর্দায়। মুক্তি দিলেন চলচিত্রের নিজস্ব ভাষাতেই। যে ভাষা আবার হলিউডি
প্রকরণ থেকে ধার করা নকলনবিশী অনুকরণ নয়! স্বদেশপ্রেমের অন্তর্দীপ্ত চেতনায়, দেশকাল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে প্রবুদ্ধ বোধির আলোর উদভাসনে প্রজ্জ্বলিত নিজস্ব
অননুকরনীয় ভাষায়। দুঃখের বিষয় যে ভাষা
অনুধাবনে প্রস্তুত ছিল না তাঁর সমসাময়িক বাঙালি চলচিত্রপ্রেমী দর্শককুল!
বস্তুত ঋত্বিক কুমার ঘটক তাঁর সমসাময়িক সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। আর
যেহেতু তাঁর সৃষ্টির উদ্দিষ্ট লক্ষ্য সিনেমা-বোদ্ধারা ছিলেন না, ছিলেন সাধারণ বাঙালি জনগণ, তাই তাঁর সৃষ্টি ও চলচিত্র দর্শককুলের মধ্যে গড়ে
উঠল না সহজ যোগাযোগের কোনো সেতু। ঋত্বিকের সঙ্গে বাংলার দর্শককুলের প্রথম পরিচয়
ঘটল সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের গল্প অবলম্বনে তৈরী ‘অযান্ত্রিক’ দিয়ে ১৯৫৭-এ। রূপক সাংকেতিক গল্প অযান্ত্রিকে মানুষ ও
যন্ত্রের আত্মমগ্নতায় বুনে তোলা জীবনের গল্প উপলব্ধি করার মতো কোনো প্রস্তুতিই ছিল
না সে যুগের বঙ্গজীবনে। ফলে প্রথম সাক্ষাতেই ঘটল অঘটন! ১৯৫৯-এ মিনার বিজলী ছবিঘরে মুক্তি পেল তাঁর তৈরী
তৃতীয় ছবি ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। সাহিত্যিক শিব্রাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে বুনে তোলা এই
ছবিতে একটি বালকের চোখ দিয়ে ধরতে চাইলেন নাগরিক জীবনের অন্তঃসারশূন্যতাকে। দেখার
বিষয়, তাঁর তৈরী করা মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম দুটি ছবিই
সাহিত্যাশ্রয়ী হলেও টালিগঞ্জ ঘরাণায় অভ্যস্ত চোখে পূর্বাপররহিত এই ধরণের সিনেমাটিক
ট্রিটমেন্টে একেবারেই অনভিপ্রত ছিল। বলাই বাহুল্য চূড়ান্ত ফ্লপ করল এই ছবিটিও!
১৯৪৭-এর দেশভাগের পর এই খণ্ড বাংলার জনজীবনে
প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায় ঘটে গেল এক বড়ো রকমের অদলবদল। বেঁচে থাকার জন্যে তীব্র
থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল জীবনযুদ্ধ। আর সেই জীবনযুদ্ধের কষ্টপার্জিত অর্থে মানুষ
মুক্তি খুঁজতে চাইত সিনেমার চটুল বিনোদনে। পয়সা
খরচ করত আলো আঁধারীর পর্দায় নায়ক নায়িকার মিলন দেখার জন্য। দরিদ্র নায়কের ধনী হয়ে
ওঠার গল্পেই ভাঙা তক্তপোশের বাস্তবতা থেকে স্বপ্নের উড়ানে তৃপ্তির ইন্ধন খুঁজত।
ঋত্বিকের সিনেমা সেই তৃপ্তির চাহিদায় যোগান দিতে পারেনি সুখের চাবিকাঠি!
ঋত্বিক কুমার ঘটকের স্বল্পায়ু জীবনের ট্র্যাজেডির মূল সুত্রটা এইখানেই, বাংলা দর্শককুলের চাহিদা মাফিক সিনেমা তৈরীর ব্যাবসা তাঁর উদ্দিষ্ট সাধনা নয়; আবার তার সাধনার সৃষ্টিকে আরও বেশি মানুষের চেতনায় জাড়িত করার তাগিদ তাকে
তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এই দুই বিপরীত স্রোতের ঘূর্ণীতে মেঘে ঢাকা তারার মতোই ঢাকা পড়ে
গেল অপরিমেয় ঋত্বিক প্রতিভা!
বক্স অফিসের বিচারে তার সফলতম ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ মুক্তি পায় শ্রী প্রাচী ইন্দিরায় ১৯৬০ সালে।
কিন্তু সেই প্রথম আর সেই শেষ! জীবদ্দশায় মুক্তি প্রাপ্ত পরের দুটি ছবি ‘কোমলগান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ কোনো প্রেক্ষাগৃহেই বিশেষ চলল না। নায়িকার
দ্বিধাবিভক্ত মন, গণনাট্য আন্দোলনের দ্বিধাগ্রস্ত নেতৃত্ব এবং
দ্বিখণ্ডিত বাংলাদেশের মর্মবেদনা একসূত্রে গ্রথিত করে, দেশপ্রেম ও মিলনের সুরে তৈরী ভালোবাসার গল্প ‘কোমলগান্ধার’ মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে রাধা পূর্ণ পূরবীতে। যে
ছবিটা হতে পারত ঋত্বিকের ‘ম্যাগনাম ওপাস’,
বাংলার
অপ্রস্তুত দর্শকের অনভ্যস্ত রুচি ও সিনেমাবোধের পূর্ণতার অভাবে তা শুধু চূড়ান্ত
ফ্লপই করল না, ঋত্বিকের চলচিত্র জীবনে অভিশপ্তকালের অশনি-সংকেত নিয়ে এল। শুরু হল চূড়ান্ত আর্থিক বিপর্যয়। ১৯৬২ সালে বসুশ্রী বীণা
লোটাসে মুক্তি পেল তাঁর জীবদ্দশায় শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘সুবর্ণরেখা’। জীবনের মূল থেকে বিচ্ছিন্নতাজনিত শিকড়হীন উদ্বাস্তু জীবনের
বাস্তবতাকে ধরলেন পূর্ববঙ্গ আগত শরণার্থী জীবনের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু পর্দায় বিনোদন খোঁজা দর্শকের পথ, ঋত্বিকের পথ থেকে ভিন্ন। সেই সত্যই হয়তো আরও অনেক কূটস্বার্থের সঙ্গে যোগ হয়ে
ঋত্বিকের সৃষ্টির পথরোধ করে দাঁড়ালো। পরের দুটি ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ প্রথমে মুক্তি পায় ঢাকার মধুমিতা গুলিস্তান সহ
নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। আর পশ্চিমবঙ্গের দর্শক সেই ছবি দেখার সুযোগ পায় ১৯৯১
সালের ১৯শে মে নন্দনে। কিন্তু দর্শকের জয়তিলক এবারেও জুটল না ঋত্বিকের পোড়া কপালে।
তার শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’-তে প্রোটাগনিস্ট নীলকণ্ঠের চরিত্রে নিজেই অভিনয় করলেন চিত্রপরিচালক! তার সেই অবিস্মরনীয় উক্তি—‘I’m confused’ যেন সমগ্র ঋত্বিক প্রতিভার মর্মস্থল থেকে উঠে
আসা মর্মবাণী যা দেশকালের গণ্ডী পেড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানবতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল।
মৃত্যুর পরই মুক্তি পেল এই যুগান্তকারী প্রতিভার শেষ স্বাক্ষর। এর আগেই ১৯৭৬
সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী নিভে গেল মেঘে ঢাকা তারা ঋত্বিক কুমার ঘটকের জীবন প্রদীপ।
কিন্তু সেই প্রদীপের শিখা আজও অম্লান প্রজ্জ্বলনে দেদীপ্যমান তাঁর সৃষ্টির সাদাকাল
ক্যানভাসের অন্তর্দীপ্ত জীবনের রামধনুতে! তাঁর সৃষ্টিশীলতার ঐশ্বর্য্যের জাদুতে। তাঁর
সমকাল তাকে অনুধাবন করতে পারেনি কেননা সেই প্রস্তুতি ছিল না সেই কালের। তা সেই
কালেরই দুর্ভাগ্য! ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁকে যতই পুনরাবিষ্কার করবে
ততই খুলে যাবে আমাদের অন্তর্লীন চেতনার নবদিগন্ত! ততই আমরা দেশকাল সন্ততিতে আবিষ্কার করতে পারব
আমাদের শিকড়, আমাদের আত্মপরিচয়।
তাই তার সম্বন্ধে বিখ্যাত চিত্র সমালোচক সিডনি টিনানের মন্তব্যটি অমোঘ হয়ে
ওঠে। “No filmic gauge is sufficient for Ritwik,
because he can enlarge his screen with such a divinity that immediately it is
destined to become a classic.”
[শ্রীশুভ্র]