>

অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য





এদেশের গণতন্ত্রের পূজারী তথা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর বক্তব্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রায়শই শোনা যায়, আমরা মানুষের পাশে আছি অর্থাৎ ভারতীয় গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষই শেষকথা সাধারণ মানুষের উন্নতিসাধনেই দেশসেবায় জীবন উৎসর্গীকৃত করেছেন এ দেশের সুমহান নেতৃবর্গ। এ হেন সুমধুর সুবচন শুনে পুলকিত হন সাধারণ মানু্ষ। আর সেই গভীর বিশ্বাসে, দৃঢ় আশ্বাসে এবং অপার আস্থায় দলে দলে তারা যোগ দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক পতাকাতলে। শামিল হন নির্বাচনি যজ্ঞে। নিজ হাতে মুষ্টিমেয়কে তুলে দেন দেশসেবার ভার, প্রকারন্তরে নিজেদের সুরক্ষা কবচ। এভাবেই স্বধীনতা পরবর্তী কাল হতে এ যাবৎ গঙ্গা-যমুনা কাবেরী-গোদাবরী বিধৌত পথে বয়ে আসছে ভারতীয় গণতন্ত্র। কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত আমজনতার শেষ রক্ষা হয় কি? এ প্রশ্ন নতুন নয়। বহুবার বহুভাবে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে এ দেশের গণতন্ত্র। তবু সদুত্তরের অভাবে রয়ে গেছে একরাশ ধ‌োঁয়াশা। আর সেই ধোঁয়াশার আড়ালে আজও এই একবিংশ শতাব্দীর যুগেও এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রকৃত সার্বিক শিক্ষার অভাব বা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ছড়ি ঘোরায় রাজনৈতিক দলগুলি। মদমত্ত ক্ষমতার লোভে নিজেদের আখের গোছানোর সুচিন্তিত অভিলিপ্সায় আমজনতার ‘শকটে’ সওয়ার হয়ে সেই লক্ষ্য অবতীর্ণ হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-নেত্রী। দেশের কথা দশের কথা তাদের কাছে শুধুই মুখের কথা।  মনের কথা থেকে যায় মনের অন্তরালেই। অবশ্য বর্তমানে তা-ই বা থাকছে কই। ‘আদর্শ’, ‘ইজম’-এর অবগুন্ঠন- সে তো আলগা হয়ে গেছে কোনকালে। তাতেও কিছু যায় আসে না তাদের। মানুষকে পাশে পেলেই হল। আর মানুষকে পাশে পেতে হলে যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন পড়ে, সেইসব কৌশল করায়ত্ত উনিশ বিশ সব দলেরই। ধারাবাহিক ভাবে শুধু স্বপ্নের পসরা সাজিয়ে দাও জনতার সামনে। জনতা জনার্দন তাতেই খুশ। স্বপ্নভঙ্গ হলেও সেখানে চিন্তার কিছু নেই। নতুন স্বপ্ন নিয়ে শীতল বাতাসের মতো শূন্যস্থান ভরিয়ে দেবে নতুন কোনো স্বপ্নের সওদাগর! একটা গেলে আর একটা, তারপরেও আরও আরও। দেশের বুকে এই রাজনৈতিক মেগাসিরিয়াল চলছে চলবে। যে যত স্বপ্ন দেখানোয় পারদর্শী, বর্তমান রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় সে তত যোগ্যতর। স্বপ্নবিলাসী আমজনতা শুধু  খুঁজে নেবে মন্দের মধ্যে ভালো কে। ব্যাস, তারপরই রঙিন হতে থাকে স্বপ্ন। কখনও লাল, কখনও সবুজ, কখনও গৈরিক। বাইরের বাস্তব জমিটায় যতই অন্ধকার ঘনায় ততই যেন রঙিন হতে থাকে স্বপ্নগুলো। বুঁদ হয়ে যাই ‘আমরা’।

সেই স্বপ্নই তো দেখেছিল বীরভূমের পাড়ুই বা ওই প্রত্যন্ত মাকড়া গ্রাম। যেখানে ভোর হয় প্রাত্যহিক দিন গুজরানের রুটি রুজির তাগিদে আর দিন শেষে রাত্রি ঘনায় মুনিষ খাটার কায়িক পরিশ্রমে। তারাও তো দেখেছিল পরিবর্তনের স্বপ্ন। এই তো সেদিনের কথা। খুব বেশিদিন তো নয়। দীর্ঘ তিন দশকের বুকের উপর চেপে বসা অবদমনের জগদ্দল পাথরটাকে সরিয়ে নতুন দিনের সন্ধানে অনুব্রতে ব্রতী হয়েছিলেন তারাও। তবে এমন কি ঘটল যেখানে অচিরেই মোহভঙ্গ ঘটে গেল ওই সব ছাপোষা মানুষগুলোর। এর যথার্থ উত্তর সম্ভবত ওরাই দিতে পারেন। কিন্তু শুনবে কারা? কেউ তো শোনার জন্য বসে নেই। সদাব্যস্ততা শুধু ‘কথা শোনানোর, সবক শেখানোর।‘ শিখিয়ে পড়িয়ে নিজেদের প্রয়োজন মতো নিয়ে চলাই যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তখন ওই প্রান্তিক মানুষগুলোর মর্মকথা শুধুই দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঝড়ে পরে দমবন্ধকর পাকদণ্ডী বেয়ে। শুধুই পাড়ুই বা মাকড়া নয়, এভাবেই রাজনৈতিক চালিকাশক্তির পদতলে চালিত হয় গ্রামবাংলা। হয়ে পড়ে ক্ষমতা আহরণের বুনিয়াদ। বাম রাজত্বে যারা বিবেচিত হত লালদূর্গের পলেস্তরা হিসেবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই নবলব্ধ ক্ষমতাবৃত্তের ‘ভোটব্যাঙ্ক’। ভাষাহীন দিশাহীন মানুষগুলো পরিচিত হন রাজনৈতিক দলগুলির কাছে স্রেফ ‘সংখ্যা’ হিসেবে। এইসব অসংখ্য মানুষের কাঁধেই ভর দিয়ে প্রতিভাত হন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। আর তাই মানুষগুলো যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, তার জন্য তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে তপন-শুকুর, অনুব্রত-আরাবুলদের। ধমকে, চমকে, আধিপত্যের দাপটে কলার তোলা দাদাগিরিতে অবদমিত মানুষগুলোর কাছে এভাবেই নিয়তি হিসেবে ধরা দেয় ভারতীয় গণতন্ত্র।  বোঝানো হয় বেঁচে থাকার জন্য এটাই দস্তুর। আর ওদিকে নিশ্চিন্তে আশ্বস্ত হয় শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রচার মঞ্চে গর্বিত কণ্ঠে বলে ওঠেন ‘মানুষ আমাদের পাশে আছে’।

স্বাধীন ভারতে স্বাধীন মতবাদ হরণ করে চাপিয়ে দেওয়া মানসিকতাকে ‘জনমত’ বলে প্রতিষ্ঠা করাটাই তাদের কাছে রাজনৈতিক অহমিকা। করে খাওয়ার মুক্ত বিচরণস্থল। আর মানুষকে পাশে রাখার তাগিদেই চলে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের নিরন্তর কর্মসূচী। ‘দেশসেবা’র বিজ্ঞাপনি চাকচিক্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের আপন মহিমা স্থাপনের এহেন সুবন্দোবস্ত বোধহয় একমাত্র এদেশেই সম্ভব। আর এ ছবি যখনই প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের কাছে, যখন তারা উপলব্ধি করতে শুরু করেন শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষের বিলাস বৈভবের জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছেন- তখনই দেখা দেয় অসন্তোষ, যা অচিরেই পর্যবসিত হয় হতাশার আস্ফালনে। এভাবেই জন্ম হতে থাকে সদাই শেখ-দের। স্বপ্নভঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গে নিমেষেই বিশ্বাসঘাতক হয়ে যান সদাই শেখ সাবির আলিরা। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারাও। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারেন সেই পরিবর্তন আদতে হয়েছে এক দলের, আর নিজেরা রয়ে গিয়েছেন অপরিবর্তিত সেই বঞ্চিতের দল হিসেবেই তখন তাদের চোখে ‘লাল’ অথবা ‘সবুজ’ সবই হয়ে যায় একরঙা। আর ঠিক তখনই প্রয়োজন পড়ে নতুন আশ্রয়ের। যেখানে নতুন রং নিয়ে হাজির হয়ে যায় অন্য কোনো ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’। এভাবেই নিহত সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষ থেকে সদাই শেখরা বাহিনী হয়ে ওঠে আর এক দলের।। সেখানে ধর্ম কোনো বাধা নয়, মতাদর্শের কোনো স্থান নেই। আছে শুধুই ‘পরিত্রাণ’ পাওয়ার আকাঙ্খা। যে আকাঙ্খার জন্যই ইতিমধ্যে কিছুদিন আগেই একবার আশ্রয় বদল করে ঠকে যেতে হয়েছিল তাদের। কথায় বলে আশায় বাঁচে চাষা। সেই আশা থেকেই আবার নতুন করে জমায়েত হওয়া নতুন আলোর সন্ধানে। রং তার যাই হোক না কেন!

আর তখন হৃদয় ঘোষ কিংবা সদাই শেখরা ‘সংখ্যাগুরু’ কিংবা ‘সংখ্যালঘু’-র বন্ধনীতে আটকা থাকে না, তখন তাদের একটাই পরিচয় ‘অত্যাচারিত’। এইসব অত্যাচারিতদের অত্যাচারের পিছনে যেসব ‘কেষ্টবিষ্টু’র সবিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য, ক্ষমতার তোলাবাজির মত্ততায় প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে দু-একজনের চাপা আর্তনাদ কানে না গেলেও যখন তাদের টনক নড়ে পাশ থেকে সরে গিয়েছে গোটা মহল্লাটাই- তখনই তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় ‘ঘুমোচ্ছিলেন’ কিনা! এভাবেই একদিন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কাণ্ডে হূঁশ এসেছিল কমরেড বাহিনীর। আর এখন তারই ছায়া এসে পড়েছে ভাঙড় কিংবা পড়ুইয়ে। কিন্তু তখন হাজরো ‘মাস্কেট বাহিনী’ দিয়েও আর কিছু করার থাকে না। একটা তৌসিফের কৈশোর কেড়ে নিলেও বিনিময়ে প্রাণ যায় শেখ মজাম্মলে বা শেখ সোলেমানদের। অপরদিকে, ক্ষমতার মধুভাণ্ডের বখরা নিয়ে রেষারেষিতে প্রাণ যায় বাপন মণ্ডল বা রমেশ ঘোষালদের। আর এভাবেই আকালমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে রাজ্যে ঘনায় নৈরাজ্যের অশনিসংকেত। অথচ ‘মানুষের কারবারি’দের পর্দার আড়ালে নিরন্তর হিসাবনিকেশের মধ্যেও বলতে শোনা যায়- ‘যে কোনো মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক’, ‘আইন আইনের পথেই চলবে’। আর সেই আইনকেই ইচ্ছেমত নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে রাখার জন্য কতই না ছলাকলা!। রাজনৈতিক কৃতকৌশল! আরাবুলি অ্যাকশান আর বাঁধাবুলি রিঅ্যাকশান। একদল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত পাওয়ার হাউসে বসে আশঙ্কিত হয়- এই বুঝি মানুষ পাশ থেকে সরে গেল, অন্যদল শামিয়ানা টাঙিয়ে উৎফুল্ল হয় আরও কিছু মানুষকে পাশে পাওয়া গেল বলে। আরাবুল অনুব্রতদের যে কায়দায় পৃষ্ঠপোষকতা দেওযা হয়, সেই একই কায়দায় একই প্রয়োজনে নতুন করে বোমা বাঁধতে উৎসাহিত করা হয় সদাই শেখদের।

মানুষকে পাশে পেতে মানুষেরই জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কি চমৎকার গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত! স্বধীনতা উত্তর রাজনীতির এটাই বর্তমান চালচিত্র। যে খেলার শুরু আছে শেষ নেই। এ খেলার নিয়ন্ত্রণে যে কঠোর কঠিন রেফারির বাঁশির প্রয়োজন, সেই পুলিশ-প্রশাসনও যে আজ মানুষের মতোই পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে অনৈতিক, অসাধু এই ষড়যন্ত্রী কর্মকাণ্ডের সাথে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সেটাই সত্যি। ভাগ্যের দোষ দিলেও সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে তাদের এই দুর্ভাগ্যের জন্য তারা নিজেরাই দায়ীদেওয়ালির রঙিন আলোয় বিভোর হয়ে পড়া শ্যামাপোকার মতোই রাজনৈতিক দলগুলিকে অন্ধ সমর্থন দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ যায় তাদেরই। যখন ঘর অন্ধকার করে চলে যায় কাছের মানুষগুলো তখন আনোয়ারা বিবি কিংবা তনজিরা বিবিদের চোখের জলের কোনো রং থাকে না। সেখানে শুধুই স্বজনহারানোর শোক। অথচ অন্যের  মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের দুটো হাতের ওপর ভরসা রেখে তারাই পারেন মাঠে রোপণ করতে সোনার ফসল। এ কথা বুঝতে হবে তাদেরকেই। পারস্পরিক হানাহানিতে প্রাণ না দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ, দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষেনিজেরা অলীক স্বপ্ন না দেখে নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে গেলে নেতা-নেত্রীদের পাশে নয়, বুক চিতিয়ে দাঁড়তে হবে সামনাসামনি।  


[অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.