>

কমলেন্দু চক্রবর্তী

SongSoptok | 1/10/2015 |



অষ্টম পর্ব

এবার আমার একটা কালো কাজের কথা বলি ৷ আংটি চুরির কথা ৷ এটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে ৷ নামটা মনে নেই ঠিক ওখানে একজন সিনিয়ার ইঞ্জিন ড্রাইভার থাকত ৷ তার বড় ছেলে আমাদের বয়সী ৷ ওদের কোয়াটার্সটা দূরে ৷ ওঠিক আমাদের বন্ধু না,সৎ মায়ের ছেলে ৷ পরে আরও তিন-চারজন ভাই-বোনও আছে ৷ নিয়মিত আমাদের সঙ্গে খেলতেও আসত না ৷ কখনও সখনও আসত ৷ বেশী কথা বলত না ৷ একদিন বিকালে ফুটবল খেলার সময় ও এল ৷ এসেই সবাইকে নিজের হাতে পরা আংটিটা দেখাতে লাগল ৷ আমিও দেখলাম ৷ কিন্তু এত খুশি হওয়ার কোনো কারণ দেখলাম না ৷ কেউ কেউ বলল সোনার আংটি ৷ আমার কাছে আংটি আংটিই , তা সেটা সোনার হোক, রুপোর ,লোহার কি পাথরের ৷ আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামালাম না ৷ তারপর ফুটবল খেলা শুরু হয়ে গেল ৷ কেন জানি না ছেলেটি আমাকে বলল, তুই আজ খেলিস না ৷ আমার আংটিটা পরে বসে থাক ৷ খেলার পরে নিয়ে নেব ৷ যদি খেলতে গিয়ে পড়ে যায় তাই ৷ আমি ওর কথা মতো না খেলে আংটিটা হাতে নিয়ে বসে বসে ওদের খেলা দেখলাম ৷ তারপর সন্ধে হল, সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে গেল , আমিও বাড়ি এলাম ৷ বাড়িতে ঢুকতেই মা বলল, একি তুই আংটি কোথায় পেলি ? সোনার আংটি ৷ যা এক্ষুণি যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আয় ৷ অতদামী জিনিস কেউ নেয় ৷ সাবধানে যাবি ৷

মায়ের কথায় এই প্রথম আমার চিন্তা শুরু হল ৷ ঘন্টা দুয়েক আমি আংটি পরেছি ৷ ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা ৷ মায়ের কথায় বুঝলাম মারাত্মক ভুল কাজ করে ফেলেছ ৷ সঙ্গে সঙ্গে আমি বেরিয়ে গেলাম আংটি ফেরত দিতে ৷ আংটি নিয়ে আমার চিন্তা ক্রমেই বাড়তে থাকল ৷  যতো তাড়াতাড়ি পারি ওটা ফেরত দিতে হবে ৷ আমি ওদের বাড়ির দিকে রওনা হলাম ৷ আংটিটা এতক্ষণ আমার আঙুলেই ছিল ৷ সাবধান হওয়ার জন্য ওটা খুলে দুহাতের তালুর মধ্যে চেপে ধরে রেখে আমি এগোতে লাগলাম ৷ ওদের বাড়ি গিয়ে শুনি বন্ধুটি কী  এক কাজে অন্য পাড়ায় গেছে ৷ শুনেই আমি ওর উদ্দেশ্যে সেই পাড়ার দিকে রওনা দিলাম ৷ বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে ৷ আমি শক্ত করে আংটিটি হাতের তালুর মধ্যে রেখে হাঁটছি ৷ একটু ভয় ভয়ও লাগছে ৷ পথে রেললাইন পেরোতে হয় ৷ তিন-চারটা লাইন ৷ একজোড়া লাইন পেড়িয়ে পরের জোড়ায় যেতে গিয়ে একটু ছোট্ট হোঁচট খেলাম ৷ আমার হাত ছিটকে আংটিটা পড়ে গেল ৷ কোথায় আর যাবে , এখানেই আছে ভেবে খোঁজা শুরু করলাম ৷ কিন্তু আংটিটা চোখে পড়ল না ৷ ক্রমে খোঁজার জায়গাটা বাড়তে লাগল ৷ কোথায় গেল ? আমি দু হাত দিয়ে রেললাইনের পাথরগুলো সরাতে লাগলাম ৷ কিন্তু আংটিটা কোথায় গেল ? আমার ভয় লাগতে লাগল ৷ মায়ের কথা মনে পড়ল ৷ সাবধানে যেতে বলেছিল আর আমি এটা কি করলাম ৷ ক্রমে একজন দুজন করে লোক জড়ো হতে লাগল ৷ আংটি হারিয়েছে শুনে তারাও খুঁজতে শুরু করল ৷ রেললাইন ভীর কেন দেখতে স্টেশনমাস্টার হিসাবে বাবা এসে পড়ল ৷ খোঁজা তখন জোর কদমে চলছে ৷ এমন সময় কে একজন বলে উঠল, হারিয়েছে না ঘন্টা ৷ দেখুন, নিজের পকেটে লুকিয়ে বলছে হারিয়ে গেছে ৷ আজকালকার ছেলে, লোভ সামলাতে পারে ৷ সোনার আংটি বলে কথা ৷ বাবা ঘটনার কিছুই জানে না ৷ শুধু জানে আমি ওখানে আংটি হারিয়ে ফেলে খুঁজছি ৷ ঐ লোকটার কথা শুনে আর বোধ হয় ধৈর্য রাখতে পারল না ৷ জুতো পায়ে আমার হাঁটুর কাছে জোরে একটা লাথি মারল ৷ ব্যথা লাগল কিনা জানি না ৷ বাবা কোনোদিন আমাদের গায়ে হাত দিত না ৷ আজ কতটা কষ্ট পেয়েছে, কতটা অপমানিত হয়েছে, সেটা ভেবেই আমার লজ্জায় একে বারে মাথা নীচু হয়ে গেল ৷ শেষ পর্যন্ত আমাকে চুরির অপবাদ ৷ আরও কিছুক্ষণ খোঁজার পর অন্ধকারে যে যার মতো চলে গেল ৷ বাবও আর ওখানে দাঁড়াল না ৷ আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলেই ৷ আমি আস্তে আস্তে স্টেশনে গিয়ে একেবারে শেষের দিকের একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম ৷ দাদারা আমাকে কয়েকবার ডাকার জন্য এসেছিল ৷ কিন্তু যাইনি ৷ অনেক রাত পর্যন্ত একা বেঞ্চে বসে ছিলাম ৷ একটাই কথা , সবাই আমার সম্বন্ধে কী ভাবছে ? আমি আংটি চুরি করেছি ? সবাই কী ভাবছে সে নিয়ে যতটা চিন্তা হচ্ছে তার চাইতেও বেশী কষ্ট হচ্ছে মা কী ভাবছে সেটা ভেবে ৷ আচ্ছা ওরকম একটা সোনার আংটি কত দাম পঞ্চাশ টাকা একশো টাকা ? কিন্তু অত টাকা কোথায় পাব ? টাকা থাকলে এক্ষুণি কিনে দিতাম ৷

অনেক রাত হয়েছে ৷ আমি একভাবেই বসে আছি ৷ মেজদা এল ৷ বলল, মা বলেছে খেয়ে আসতে নইলে মা খেতে বসতে পারছে না ৷ তারপর ইচ্ছে হলে আবার রাতে এসে বসিস ৷ মা খায়নি ? আমি আস্তে আস্তে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম ৷ কোনো রকম একটু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লাম ৷

বাড়ির কেউ এ ব্যাপারে কোনো কথা কোনো দিন বলেনি ৷ শুধু  শুনেছিলাম বাবা নাকি ছেলেটির বাবা ঐ ড্রাইভারকে একটা আংটি বানিয়ে দিতে চেয়েছিল ৷ কিন্তু ড্রাইভার রাজী হয়নি ৷ বলেছিল বাচ্চারা হারিয়ে ফেলেছে ৷ এতে মাথা ঘামানোর কিছু নেই ৷ সব মিটে গেল কিন্তু মিটল না ৷ দুটো জিনিস মিটল না ৷ এক, আমাকে ঐ ছেলেটার বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে যেতে হত ৷ আর আমার যাতায়াতের পথে ড্রাইভার কাকুর কয়েকটা ছোট ছোট মেয়ে কিচির মিচির করে বলেই যেত, আংটি চোর, আংটি চোর , আংটি চোর ………..’ ৷ আমি চুপচাপ ওখানটা পেরিয়ে যেতাম ৷ দুই নম্বর যেটা মিটল না সেটা হল আমার প্রতিজ্ঞা, জীবনে কোনো দিন আংটি পরব না- সোনার আংটি তো নয় ৷ মাকে এটা বলেছিলাম এবং এখনও সেই প্রতিজ্ঞা কেউ ভাঙেনি বা ভাঙার চেষ্টা করেনি ৷ শুধু বিয়ের মায়ের অনুরোধে একবার মায়ের সোনার আংটিটা আঙুলে স্পর্শ করেছিলাম ৷ বিয়ের নিয়ম বলে ৷ ব্যাস্, আমি আর কোনোদিন আংটি পরিনি ৷

হঠাৎ কানে কানে প্রচার হয়ে গেল যে তিস্তাবুড়ি এসেছে ৷ সাবধান ৷ এবার একটু তিস্তার কথা লিখি ৷ তিস্তা মানে তিস্তা নদী ৷ আমাদের বাড়ি থেকে আধমাইল হাঁটলে তিস্তার পাড় ৷ তবে কোনো পথ নেই ৷ প্রথমে একটু শুরু লোহার পাটাতনের উপর দিয়ে রেলের একটা চওড়া খাল পেরোনো ৷ একটু ব্যালান্সের খেলা ৷ ওটা পেরোলে একটা কাঁটা তারের বেড়া ৷ সেটার ফাঁক দিয়ে শুরু শরীরটাকে পার করানো ৷ তারপর হালকা গাছপালার ভিতর দিয়ে এবড়ো খেবড়ো পথে অনেকটা হাঁটা ৷ পায়ে দু-চারটা কাঁটা অবশ্য ফোটানো ৷ তারপর বেশ কিছুটা বড় বড় বোল্ডার মানে গোলাকার পাথর ৷ সেই পাথর বেয়ে উঠলেই তিস্তা ৷ তিস্তার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই ৷ তখন যা দেখেছি, তার যতোটুকুও মনে আছে সেটা লেখার ফাঁক কিছুটা থাকবে ৷ আমরা প্রথম প্রথম মেজদার নেতৃত্ব অনেকে মিলে তিস্তায় যেতাম ৷ কেন যেতাম ৷ না, তিস্তাকে দেখতে নয় ৷ মাছ ধরতে ৷ তিস্তার দুধারে সারে করে বোল্ডার দেওয়া যাতে তিস্তার জল খেঁপে গিয়ে পার ছাপিয়ে না দেয় ৷ সেই বোল্ডারের উপরে বসলে বেশ প্রায় দুজন মানুষ সমান নীচুতে থাকত তিস্তার জল ৷ সারাবছর যা জল থাকত তাতে হেঁটেই পেরিয়ে যাওয়া যেত ৷ কিন্তু ঠিক মাঝখানটা ছিল জলের তোড় ৷ আমরা কোনোদিন তিস্তা পেরোনোর চেষ্টা করিনি ৷ আমরা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম ৷ বাঁশের কঞ্চির ছিপের মাথায় শক্ত সুতো বেঁধে তাতে বড়শি বাঁধতাম ৷ তখন বাচ্চাদের নানামাপের বড়শি পাওয়া যেত ৷ একেক ধরনের মাছের জন্য একেক ধরনের বড়শি ৷ এক্কেবারে হাতে ধরা যায় না এমন বড়শিও পাওয়া যেত ৷ বড়শিতে লাগাতাম কেঁচো ৷ আমার কেঁচোতে খুব ঘেন্না ৷ কিন্তু মাছ ধরার উৎসাহে কেঁচো ঘাটতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না ৷ একটু মাটি খুঁড়লেই কেঁচো দেখা যেত ৷ সেগুলো হাত দিয়ে ধরে কৌটোয় ভরতাম ৷ তারপর মাছ ধরার অভিযান ৷ বড়শিতে কেঁচো ঢুকিয়ে বেশি থাকা কেঁচোর শরীরটা নখ দিয়ে কেটে আবার রেখে দিতাম ৷ তিস্তার সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য যে হালকা জলের তলাতেই বড় বড় বোল্ডার দেখা যেত ৷ আমরা দুটো বোল্ডারের বড়শিটা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ফাঁকে করতাম ৷ কারণ বেশীরভাগ মাছই পাথরের তলায় থাকত ৷ বড়শি ফেলে বেশী বসে থাকতে হত না ৷ কারণ ভ্যাদা মাছ ৷ এই মাছের অন্য কি নাম আছে, আমি জানি না ৷ একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলে হয়তো পরিষ্কার বুঝতে পারবেন কোন মাছের কথা বলা হচ্ছে ৷ শরীরটা অনেকটা কই বা তেলাপিয়া মাছের মতো ৷ কিন্তু মুখটা বন্ধ থাকলে একরকম , খুললে মনে হবে শরীরের চাইতেও বড় মুখের হা টা ৷ পুরোটা খুললে দেখতে একেবারে চৌকো বাক্সের মতো লাগে ৷ এরা খুব লোভী আর  বোকা ৷ সেই যাওয়ার কিছু পেল, বোঝাবুঝির আগেই ঝপ করে গিলে ফেলল ৷ কাজেই বরশিতে ভ্যাদা মাছ ধরা খুব সহজ ৷ আরও নানা ধরনের মাছ থাকত ৷ সব মাছের নাম জানতাম না ৷ এখনো জানি না ৷ আরো একটা সমস্যা আছে, আমাদের উওরবঙ্গে বাংলার সঙ্গে কোলকাতার ভাষায় অনেক ফারাক ৷ ওখানকার ভাষাটা স্থানীয় ভাষার মিশেল দেওয়া বাংলার ভাষার মতো ৷ কাজেই আমরা যাকে চ্যাং মাছ বলতাম, এখানে এসে শুনলাম ওকে এখানে বলে ল্যাটা মাছ ৷ আমাদের বাড়িতে চ্যাং মাছ চলত ৷ চ্যাং মাছ অনেক ধরা পড়ত ৷ ট্যাংরাও ধরতাম ৷ বেলে মাছ ইত্যাদিও ধরা পড়ত ৷ 
আমি এমনভাবে লিখছি যা আমি যেন প্রচুর মাছ ধরে বাড়িতে আনতাম ৷ আসলে আমি ছিলাম তুনুকে বাচ্চা ৷ শুধু মাছ ধরা নয় দাদাদের সব কাজেই আমি ছিলাম তুনুকে ৷ একটা ছাগলের তিন-চারটে করে বাচ্চা হয় ৷ কিন্তু মা ছাগলের দুটো মাএ বোঁটা ৷ বড় দুটো মনের আনন্দে মায়ের দুধ খায় , আর ছোটগুলো তিড়িং তিড়িং করে নাচে আর বলে , কী মজা ,কী মজা দাদারা দুধ খাচ্ছে ৷ মাছ ধরায়ও আমি ছিলাম তুনুকে ৷ খাপ খেলাতেও আমি ছিলাম তুনুকে ৷ একটা বোধহয় প্রখর ছিল ৷ নিজের মতো করে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা ৷ আমি দাদাদের সঙ্গে থাকলেও সব কাজে সমর্থন করতাম না ৷ যেমন শুনু আর ভগিরথের ব্যাপারটা ৷ যাকগে আমাক মাছ ধরার কথা ৷ সেজদা মোটামুটি ভালোই মাছ ধরত ৷ সেজদাও পারত ৷ কিন্তু আমি ছিপ ফেলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ৷ মাসে মাসে এক-আধটা ধরেও ফেলতাম ৷ যারা জানে তারা জানে যে জলের মধ্যে থাকাকালীন মাছের গায়ে প্রচন্ড জোর থাকে ৷ কাজেই একটা ছোট মাছ বড়শিতে বিঁধলেও জলের মধ্যে দিয়ে টানলে বিশাল ভারি আর বড় মনে হয় ৷ বড় মাছ ফেঁসেছে ভেবে আমি প্রাণপণ টান মারতাম আর মাছের মুখ ঠোঁট ছিড়ে খালি বড়শি আমার হাতে ফিরে আসত ৷ মেজদা অনেকবার শিখানোর চেষ্টা করে, কি করে ছোট একটা হ্যাঁচকা টান দিতে হয় ৷ মাছ বড়শি মুখে দিলে একটু অপেক্ষা করতে হয় ৷ মনে হয় না ওর শিক্ষা আমি খুব একটা গ্রহণ করতে পেরেছিলাম ৷

গ্রীষ্মকাল পড়লেই আমাদের তোরজোর শুরু হয়ে যেত ৷ সকালে নম নম করে বই ছুইয়েই আমরা ছুটতাম তিস্তায় ৷ চলত দুপুর পর্যন্ত ৷ টুকটাক মাছ ধরতাম যতোটা আনন্দ আর নেশাটা ছিল তার চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশী ৷

মাঝে মাঝে বোল্ডার খাঁচে বড়শি আটকে যেত ৷ জলে নেমে ওটা হাত দিয়ে বের করতে হত ৷ এ কাজটা আমি ভালো পারতাম ৷ যদিও মাঝে মাঝে ট্যাংরা মাছের কাঁটা বিধত আর ছিল সাপের ভয় ৷ কিন্তু ওসব নিয়ে তখন চিন্তা ছিল না ৷ মাঝে মাঝে দুষ্ট মাছ বড়শি শুদ্ধ সুতো কেটে নিয়ে পালাত ৷ অথবা টেনে নিয়ে পাথরের খাঁজে আটকে দিত ৷ ওরা খুব বুদ্ধিমান মাছ ছিল মনে হয় ৷ আর একটা মাছের কথা না লিখলেই নয়, বানমাছ ৷ সেটার কথা পরে লিখছি ৷ 

আমি অনেক চেষ্টা করে প্রথম একটা ইঞ্চি দুয়েকের মাছ ধরেছিলাম ৷ ব্যাস্ কি  যে হল, আমার নেশা ধরে গেল ৷ গ্রীষ্মের ছুটি ৷ সকাল হলেই মনে হত কখন মাছ ধরতে যাব ৷ কিছুদিন মাছ ধরতে যাওয়ার পর দাদারা বন্ধ করে দিল ৷ কিন্তু আমার যে নেশা চেপে গেছে ৷ একাই বেরিয়ে পড়লাম ৷ রাস্তাটা বেশ ভয়ের ৷ দাদাদের সঙ্গে যাওয়ার সময় বুঝতে পারিনি ৷ কিন্তু একা বেরিয়ে কিছুটা যেতেই ভয় পেতে শুরু করল ৷ ভয় বাড়তে বাড়তে এমন হল যে আমি দৌঁড়াতে শুরু করলাম ৷ আমাকে দৌঁড়তে দেখে কেন জানি না একটা কুকুর আমার পিছনে পিছনে দৌঁড়াতে শুরু করল ৷ আমি ভয়ে আরো জোরে দৌঁড়াতে লাগলাম ৷ কুকুরটাও চিৎকার করতে করতে আরও জোরে আমার পিছনে আসতে লাগল ৷ একবার সামনের দিকে, একবার পিছনের কুকুরটার দিকে তাকাতে গিয়ে আমি একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেলাম ৷ আর কিছু করার নেই ৷ চুপ করে আশঙ্কাকে সত্য হতে দেখব বলে বসে রইলাম ৷ ও আসবে, কামড়াবে,ঘেউ করবে একবার, তারপর চলে যাবে ৷ কিন্তু আমার কি হবে ? এই পথে তো লোকজন ও বেশী আসে না ৷ আমি কি কুকুরের কামড় খেয়ে এখানেই পড়ে থাকব ? ও কি খুব জোরে কামড়াবে ৷ আমার ভারি অসুখ হবে ? আমি কি এখানেই মরে পড়ে থাকব ? চোখ বন্ধ করে বসেই রইলাম ৷

কপালটার কাছে ভিজে ভিজে কি যেন লাগল ৷ নরম নরম ৷ চোখ খোলার সাহস নেই, ও বোধ হয় যাওয়ার আগে চেখে দেখছে ৷ এবার স্পস্ট বুঝলাম আমার কপালে কেউ জিভ দিয়ে চাটছে ৷ গরম লালাতে, আমার কপাল ভিজে যাচ্ছে ৷ তারপর পর কিউ করে একটা আওয়াজ হতেই চমকে তাকালাম ৷ দেখি কুকুরটা আমার সামনে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ নিশ্চয়ই প্লান করছে, কী ভাবে কামড়াবে ৷ দুজন দুজনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছি ৷ কী করব মাথায় আসছে না ৷ হঠাৎ দেখি ও আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের পা চাটতে লাগল ৷ আমার মনে হল এই সুযোগ ৷ উঠে দৌঁড় লাগালাম তিস্তার দিকে মুখ করে ৷ সর্বনাশ ওটাও দৌঁড়াতে লাগল আমার পিছে পিছে ৷ ভয় পেয়ে আমি যা হবার হোক ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লাম ৷ ও এসে দাঁড়াল আমার পাশে ৷ আমার কেন যেন মনে হল ও আমাকে কামড়াবে না ৷ আমি হাঁটতে শুরু করলাম ও আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল ৷ যদিও আমার ভয় তখনও কাটেনি, বুকের ভিতর এখনও ধক ধক করছে, তবে একটু স্বস্তি পেতে লাগলাম ৷ আমি তিস্তার পায়ে পৌঁছালাম ৷ নিজের রোজকার জায়গাতে বসলাম ৷ কিন্তু মাছ ধরতে ইচ্ছে করল না, বসেই রইলাম অনেকক্ষণ ৷ যেন সদ্য প্রাণ ফিরে পাওয়া একটা মানুষ ৷ আর সেই কুকুরটাও আমার পাশে চুপ করে আমার পাশে বসে থাকল ৷ আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম ৷ ফেরার পথেও বন্ধু আমার সঙ্গেই ফিরল ৷ সে দিনের পর থেকে আমার তিস্তায় যাওয়ার নেশা আরও বেড়ে গেল ৷ সারাদিন তো যাই যাই মনে হতই রাতেও শুয়ে শুয়ে মনে হত যাই একবার তিস্তার পারে ৷ মাছ ধরাটা গৌণ, তিস্তাকে দেখব বসে বসে আর সঙ্গে থাকবে আমার বন্ধু ৷ এবার একটু বান মাছ ধরার কথা বলি ৷ স্থানীয় লোকেরা বলে বাইন মাছ ৷ আমরাও বলতাম বাইন মাছ ৷ সাপ মাছও বলত কেউ কেউ ৷ লম্বা সাপের মতোই দেখতে৷ তবে মুখটা শরীরটা থেকে সুঁচালো ৷ ছোট ঠোঁট ৷ সাপের মতো শরীরটা নরম নয়, একেবারে মাংসালো solid . পাঁচ ইঞ্চি থেকে মানুষ সমান হয় এদের লম্বা দেই ৷ বান মাছ ধরা যায়, তবে বেশীরভাগই ছোট ৷ বড় বান মাছ ধরার একটা পুরো সেশন আমি আর আমার বন্ধু ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দেখেছিলাম ৷ একজন স্থানীয় লোক নদীতে নামল পরণের কাপড়টা একেবারে পাছা পর্যন্ত  ওটানো ৷ ওখানে পুরুষ মানুষরা তখনও লেটিংর মতো একটা পোষাক পরে  দিব্যি সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতো ৷ যাই হোক লোকটা নদীতে নামল ৷ কোমরে দড়ি বাঁধা তিনটে জিনিস ৷ একটা বেশ শক্তপোক্ত  কয়েক হাত লম্বা লাঠি ৷ বড়শি বাঁধা একটা মোটা সুতো আর এই ধরনেরই আরো একটা সুতো ৷ লোকটা নদীর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঝ বরাবর গেল ৷ তারপর একটা বড়শিতে কেঁচো গেঁথে সেটা জলে ফেলল ৷  তারপর পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে বড়শিটাকে যতোটা সম্ভব পাথরের তলার দিকে ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ৷ ওর বড়শি লাগানো সুতোটা ধরে রাখত ৷ সুতোটা কিন্তু কোমড়েই বাঁধা থাকত ৷ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়ে আছে একেবারে স্থির হয়ে ৷ হঠাৎ লোকটা নড়ে উঠল ৷ বড়শিতে মাছ ধরছে ৷ লোকটা তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে সুতো টানতে লাগল ৷ বেরিয়ে এল সরু ঠোঁটে বড়শি বাঁধানো মুখ ৷ বান মাছের মুখ ৷ লোকটা জল থেকে মাছটাকে তোলার চেষ্টা করছে ৷ শুনে ছিলাম বড় বান জলে থাকা অবস্থায় এক শক্তপোক্ত লোকের পক্ষে তোলা সম্ভব না ৷ উল্টে লোকটারই জলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা ৷ মুখটা বেরোতেই শুরু করলেই কোমরে বাঁধা লাঠিটা নিয়ে মার ৷ মাছটাকে এক হাতে ধরে তুলছে আর অন্য হাতের লাঠি দিয়ে মারতে থাকা ৷ বান মাছ প্রায় লোকটার সমান লম্বা ৷ প্রাণপণ যুদ্ধ চালাচ্ছে সেও ৷ তার নড়াচড়ার ধাক্কা লোকটাও সামলাতে পারছে না ৷ মনে হচ্ছে এক্ষুণি লোকটা বড় বোল্ডার থেকে পড়ে যাবে আর বান মাছটা তাকে টেনে নিয়ে যাবে ৷ কিন্তু ক্রমাগত লাঠির ঘায়ে সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল ৷ তারপর কোমড়ের বড়শি বাঁধা অন্য সুতোতে মাছের মুখটা ঢুকিয়ে দিল ৷ মানে একটা মাছ জমা পড়ল ৷ সেই অন্য একটা ধরার তোড়জোর শুরু হল ৷ 

আমার বাবা কিন্তু খুব ভালো মাছ ধরত ৷ বছরে একবার মাছ ধরতে যেত ৷ বাবা পুকুরে মাছ ধরত ৷ লোকজনের কাছে খবর পেত কোথায় ভালো মাছ ধরার পুকুর আছে ৷ একটা কথা বোধহয় বলে রাখা ভালো যে আমাদের ওদিকে পুকুর কিন্তু এদিকের তুলনায় কম ছিল ৷ আর এর ফলে আমাদের সাঁতার শেখা হয়নি ৷ কোনোরকম যতটুকু শিখেছি সেটা অনেক বড় হয়ে ৷ বাবার মাছ ধরতে যাওয়ার থেকে মাছ ধরার তোড়জোর শুরু হয়ে যেত ৷ মাছের খাদ্য বানানো হত যা মাছ ধরার আগে জলে ছড়িয়ে দেওয়া হত ৷ বড়শিতে লাগানো খাবারও বাবা নিজের হাতে বানাত ৷ বাবা মাছ ধরত হুইল (wheel) ছিপ দিয়ে ৷ সুন্দর একটা কাঠের বা বেতের ছিপ, গোড়ার দিক মানে যে দিকটা ধরা হবে সেখানে একটা চাকা লাগানো থাকে ৷ চাকাটা লোহা না পিতলের জানি না তবে শক্তপোক্ত আর দেখতে সুন্দর ৷ চাকার গায়ে একটা ছোট্ট হ্যান্ডেল লাগনো থাকত ৷ সেটা হাত দিয়ে ধরে চাকাটাকে ঘোরানো যায় ৷ চাকার গায়ে গোটানো বিশাল লম্বা শক্ত এক ধরনের সুতো লাগানো থাকত ৷ সেই সুতোটা ছিপের গায়ে লাগানো ছোট ছোট লোহার আংটার মধ্যে দিয়ে বার করে ছিপের মাথায় দিয়ে বাইরে বেরিয়ে থাকে ৷ সুতোর মাথায় বাঁধা থাকে বড়শি ৷
বাবার মাছ ধরা একদিন দেখেছি ৷ বাবার বড়শিতে একটা বড়সর মাছ আটকেছে, বাবার মনে কোনো উওেজনা নেই ৷ মাছটার মুখে বড়শি গাঁথা ৷ ওটা পাগলের মতো জলের তলা দিয়ে পুকুরের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে আর বাবা শুধু হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুতো ঢিলে দিয়ে যাচ্ছে ৷ মাছটা সারা পুকুরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৷ আর বাবা শান্ত হয়ে সুতো ঢিলে দিয়ে যাচ্ছে, আমার শুধু মনে হচ্ছে বাবা কেন মাছটা টেনে পাড়ে তুলছে না ৷ আমি ছটফট করছি দেখে বাবা বলল, শোনো, যখন কোনো লোক বাড়িবাড়ি ছটফট করে তখন তার সঙ্গে বিরোধিতা না করে শান্ত হয়ে থাকবে ৷ দুজন ছোটফট করবে শুধু ঝামেলাই হবে ৷ দেখনা ছটফট করতে করতেও কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে ৷ সত্যি আস্তে আস্তে মাছটা ক্লান্ত হয়ে দৌঁড়াদৌড়ি কমে এল ৷ আস্তে আস্তে বাবা মাছটাকে পাড়ের সামনে নিয়ে এল হুইলের চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুতো ছোট করতে করতে ৷ কিন্তু মাছটার তেজ তখনও শেষ হয়নি ৷ এত বড় মাছ কিছুতে জল থেকে উঠবে না ৷ তখন বাবা আমাদের দুই ভাইকে বলল যে জলে নেমে হাত দিয়ে মাছটা জল থেকে টেনে তুলতে, বাবা একটা ক্লান্ত মাছকে জল থেকে তুলতে এত কষ্ট ৷ দুই ভাই কোনোরকমে যুদ্ধ করে মাছটাকে তোলা হল ৷ জলের মধ্যে যেমন বড় মনে হচ্ছিল, ঠিক ততটা বড় না হলেও বেশ বড় ৷ বাবা নিজের ছিপটিপগুলো নিজের হাতে গুছিয়ে নিয়ে বলল, ধৈর্য আর ধৈর্য ৷ শত্রু যতো বড়ই হোক বুদ্ধি দিয়ে কাবু করতে হয়, শুধু গায়ের জোরে নয় ৷ বাবা কার উদ্দেশ্যে এক কথা বলল, জানি না ৷ কিন্তু যা শেখার শিখে গেলাম ৷ 

তিস্তার কথা শুরু করেছিলাম তিস্তা বুড়ি দিয়ে ৷ তিস্তা বুড়ির আবির্ভাব হয়েছে ৷ তিস্তার উপর দিয়ে যারা পাড়াপাড় করে, তাদের বাড়ি থেকে যদি পূজো না দেওয়া হয়,তবে সেই বাড়ির এক ছেলেকে তিস্তা বুড়ি খেয়ে ফেলবে ৷ এসব নিয়ে আমার বিশ্বাস প্রথম থেকেই কম ৷ কিন্তু মেজদা তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে মাঝে মধ্যে বাড়ি আসে তিস্তার উপর দিয়ে ৷ কাজেই মায়ের চিন্তা শুরু হল ৷ মা ঠিক করল তিস্তা বুড়ির পূজো দেবে ৷ দোমহনি থেকে জলপাইগুড়ি শহরে যাওয়ার ব্যাপারটা তখন বেশ ইনটারেস্টিং ছিল ৷ আমি মাএ দু-একবার মেজদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় জলপাইগুড়ি শহরে গিয়েছিলাম ৷ কাজেই সবটা ঠিক মনে নেই ৷ দোমহনিতে তিস্তার কোনো ঘাট ছিল না ৷ পাশের রেলস্টেশন ময়নাগুড়ি যেতে হত ট্রেনে ৷ সেখান থেকে তিস্তার ঘাট ৷ ছোট ছোট লঞ্চে বা বড় নৌকায় তিস্তা পেরিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের দিকে একটা ঘাটে নামতে হয় ৷ লিখেছিলাম দোমহনি থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়া বেশ ইনটারেস্টিং ৷ এই জলপাইগুড়ির দিকের ঘাট থেকে সেই ইনটারেস্টিং ব্যাপারটা শুরু ৷ মূল শহরে পৌঁছাতে গেলে মাইলের মতো বালির বিশাল নদীর চর পেরোতে হয় ৷ হয় কষ্ট করে ঐ বালির চর হেঁটে পেরোও, নয় তো পয়সা দিয়ে গাড়িতে আরামে পেরিয়ে যাও ৷ দ্বিতীয়টা কথাই বলতে চাইছিলাম দুনিয়ার এমন কোনো গাড়ি আর কোথায় আছে আমার তখনও জানা ছিল না এখনও জানা নেই ৷ আমরা বলতাম মটরগাড়ি ৷ এখন যাকে বলে car ৷ মনে হয় যেখানে যত মোটর গাড়ি আছে সব জলপাইগুড়ির তিস্তার ঘাটে জমা করা হয়েছে ৷ কোনোটার ছাদ নেই বলে মাথায় বস্তার ছাদ , পিছনের দিকটা নেই বলে টিন কেটে দড়ি দিয়ে বাঁধা ৷ দরজা নেই তো কী আছে কাঠ আর দড়ি তো আছে ৷ বলতে গেলে  গাড়িগুলোর কিছুই নেই কিন্তু একটা ইঞ্জিন আছে এবং সেটা কাজ করে ৷ যতোদূর মনে হয় তখন একটাকা করে মাথা পিছু নেওয়া হত আর গাদিয়ে লোক তোলা হত ৷  গতি অবশ্য শামুখের সঙ্গে তুলনা করলে ওদের প্রেস্টিজে লাগবে ৷ রাস্তায় এটা ওটা খুলে পড়লেও যাএীরা পৌঁছে অবশ্যই যাবে এটা গ্যারান্টেড ৷ এখন আর সে অযোধ্যাও নেই, সেই রামও নেই ৷ এখন সব পাল্টে গেছে ৷ মেজদা তিস্তা পেরিয়ে যাতায়াত করত ৷ কাজেই তিস্তা বুড়ির কোপ ওর উপর পড়তেই পারে ৷ তাই একদিন মা আমাকে নিয়ে ময়নাগুড়ির ঘাটে পূজো দিয়ে এল ৷ সব ঠিকঠাক মিটে গেল ৷ 
(ক্রমশ)


[কমলেন্দু চক্রবর্তী]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.