অষ্টম পর্ব
এবার আমার একটা কালো কাজের কথা বলি ৷ আংটি চুরির
কথা ৷ এটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে ৷ নামটা মনে নেই ঠিক ওখানে একজন সিনিয়ার ইঞ্জিন
ড্রাইভার থাকত ৷ তার বড় ছেলে আমাদের বয়সী ৷ ওদের কোয়াটার্সটা দূরে ৷ ওঠিক আমাদের
বন্ধু না,সৎ মায়ের ছেলে ৷ পরে আরও তিন-চারজন ভাই-বোনও আছে ৷ নিয়মিত আমাদের সঙ্গে
খেলতেও আসত না ৷ কখনও সখনও আসত ৷ বেশী কথা বলত না ৷ একদিন বিকালে ফুটবল খেলার সময়
ও এল ৷ এসেই সবাইকে নিজের হাতে পরা আংটিটা দেখাতে লাগল ৷ আমিও দেখলাম ৷ কিন্তু এত
খুশি হওয়ার কোনো কারণ দেখলাম না ৷ কেউ কেউ বলল সোনার আংটি ৷ আমার কাছে আংটি আংটিই ,
তা সেটা সোনার হোক, রুপোর ,লোহার কি পাথরের ৷ আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামালাম না ৷ তারপর ফুটবল খেলা শুরু
হয়ে গেল ৷ কেন জানি না ছেলেটি আমাকে বলল, তুই আজ খেলিস না ৷
আমার আংটিটা পরে বসে থাক ৷ খেলার পরে নিয়ে নেব ৷ যদি খেলতে গিয়ে পড়ে যায় তাই ৷ আমি
ওর কথা মতো না খেলে আংটিটা হাতে নিয়ে বসে বসে ওদের খেলা দেখলাম ৷ তারপর সন্ধে হল,
সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে গেল , আমিও বাড়ি
এলাম ৷ বাড়িতে ঢুকতেই মা বলল, একি তুই আংটি কোথায় পেলি ?
সোনার আংটি ৷ যা এক্ষুণি যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আয় ৷ অতদামী
জিনিস কেউ নেয় ৷ সাবধানে যাবি ৷
মায়ের কথায় এই প্রথম আমার চিন্তা শুরু হল ৷
ঘন্টা দুয়েক আমি আংটি পরেছি ৷ ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা ৷ মায়ের কথায় বুঝলাম
মারাত্মক ভুল কাজ করে ফেলেছ ৷ সঙ্গে সঙ্গে আমি বেরিয়ে গেলাম আংটি ফেরত দিতে ৷ আংটি
নিয়ে আমার চিন্তা ক্রমেই বাড়তে থাকল ৷ যতো তাড়াতাড়ি পারি ওটা ফেরত দিতে হবে ৷ আমি ওদের
বাড়ির দিকে রওনা হলাম ৷ আংটিটা এতক্ষণ আমার আঙুলেই ছিল ৷ সাবধান হওয়ার জন্য ওটা
খুলে দুহাতের তালুর মধ্যে চেপে ধরে রেখে আমি এগোতে লাগলাম ৷ ওদের বাড়ি গিয়ে শুনি
বন্ধুটি কী এক কাজে অন্য পাড়ায় গেছে ৷ শুনেই আমি ওর
উদ্দেশ্যে সেই পাড়ার দিকে রওনা দিলাম ৷ বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে ৷ আমি শক্ত করে
আংটিটি হাতের তালুর মধ্যে রেখে হাঁটছি ৷ একটু ভয় ভয়ও লাগছে ৷ পথে রেললাইন পেরোতে
হয় ৷ তিন-চারটা লাইন ৷ একজোড়া লাইন পেড়িয়ে পরের জোড়ায় যেতে গিয়ে একটু ছোট্ট হোঁচট
খেলাম ৷ আমার হাত ছিটকে আংটিটা পড়ে গেল ৷ কোথায় আর যাবে , এখানেই আছে ভেবে খোঁজা শুরু করলাম ৷ কিন্তু আংটিটা চোখে পড়ল না ৷ ক্রমে
খোঁজার জায়গাটা বাড়তে লাগল ৷ কোথায় গেল ? আমি দু হাত দিয়ে
রেললাইনের পাথরগুলো সরাতে লাগলাম ৷ কিন্তু আংটিটা কোথায় গেল ? আমার ভয় লাগতে লাগল ৷ মায়ের কথা মনে পড়ল ৷ সাবধানে যেতে বলেছিল আর আমি এটা
কি করলাম ৷ ক্রমে একজন দুজন করে লোক জড়ো হতে লাগল ৷ আংটি হারিয়েছে শুনে তারাও
খুঁজতে শুরু করল ৷ রেললাইন ভীর কেন দেখতে স্টেশনমাস্টার হিসাবে বাবা এসে পড়ল ৷
খোঁজা তখন জোর কদমে চলছে ৷ এমন সময় কে একজন বলে উঠল, হারিয়েছে
না ঘন্টা ৷ দেখুন, নিজের পকেটে লুকিয়ে বলছে হারিয়ে গেছে ৷
আজকালকার ছেলে, লোভ সামলাতে পারে ৷ সোনার আংটি বলে কথা ৷
বাবা ঘটনার কিছুই জানে না ৷ শুধু জানে আমি ওখানে আংটি হারিয়ে ফেলে খুঁজছি ৷ ঐ
লোকটার কথা শুনে আর বোধ হয় ধৈর্য রাখতে পারল না ৷ জুতো পায়ে আমার হাঁটুর কাছে জোরে
একটা লাথি মারল ৷ ব্যথা লাগল কিনা জানি না ৷ বাবা কোনোদিন আমাদের গায়ে হাত দিত না
৷ আজ কতটা কষ্ট পেয়েছে, কতটা অপমানিত হয়েছে, সেটা ভেবেই আমার লজ্জায় একে বারে মাথা নীচু হয়ে গেল ৷ শেষ পর্যন্ত আমাকে
চুরির অপবাদ ৷ আরও কিছুক্ষণ খোঁজার পর অন্ধকারে যে যার মতো চলে গেল ৷ বাবও আর
ওখানে দাঁড়াল না ৷ আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলেই ৷ আমি আস্তে আস্তে স্টেশনে গিয়ে
একেবারে শেষের দিকের একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম ৷ দাদারা আমাকে কয়েকবার ডাকার জন্য
এসেছিল ৷ কিন্তু যাইনি ৷ অনেক রাত পর্যন্ত একা বেঞ্চে বসে ছিলাম ৷ একটাই কথা ,
সবাই আমার সম্বন্ধে কী ভাবছে ? আমি আংটি চুরি
করেছি ? সবাই কী ভাবছে সে নিয়ে যতটা চিন্তা হচ্ছে তার চাইতেও
বেশী কষ্ট হচ্ছে মা কী ভাবছে সেটা ভেবে ৷ আচ্ছা ওরকম একটা সোনার আংটি কত দাম
পঞ্চাশ টাকা একশো টাকা ? কিন্তু অত টাকা কোথায় পাব ? টাকা থাকলে এক্ষুণি কিনে দিতাম ৷
অনেক রাত হয়েছে ৷ আমি একভাবেই বসে আছি ৷ মেজদা
এল ৷ বলল, মা বলেছে খেয়ে আসতে নইলে মা খেতে বসতে পারছে না ৷ তারপর ইচ্ছে হলে আবার
রাতে এসে বসিস ৷ মা খায়নি ? আমি আস্তে আস্তে উঠে বাড়ির দিকে
রওনা দিলাম ৷ কোনো রকম একটু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লাম ৷
বাড়ির কেউ এ ব্যাপারে কোনো কথা কোনো দিন বলেনি ৷
শুধু শুনেছিলাম
বাবা নাকি ছেলেটির বাবা ঐ ড্রাইভারকে একটা আংটি বানিয়ে দিতে চেয়েছিল ৷ কিন্তু
ড্রাইভার রাজী হয়নি ৷ বলেছিল বাচ্চারা হারিয়ে ফেলেছে ৷ এতে মাথা ঘামানোর কিছু নেই
৷ সব মিটে গেল কিন্তু মিটল না ৷ দুটো জিনিস মিটল না ৷ এক, আমাকে ঐ ছেলেটার বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে যেতে হত ৷ আর আমার যাতায়াতের
পথে ড্রাইভার কাকুর কয়েকটা ছোট ছোট মেয়ে কিচির মিচির করে বলেই যেত, আংটি চোর, আংটি চোর , আংটি চোর
………..’ ৷ আমি চুপচাপ ওখানটা পেরিয়ে যেতাম ৷ দুই নম্বর যেটা
মিটল না সেটা হল আমার প্রতিজ্ঞা, জীবনে কোনো দিন আংটি পরব
না- সোনার আংটি তো নয় ৷ মাকে এটা বলেছিলাম এবং এখনও সেই প্রতিজ্ঞা কেউ ভাঙেনি বা
ভাঙার চেষ্টা করেনি ৷ শুধু বিয়ের মায়ের অনুরোধে একবার মায়ের সোনার আংটিটা আঙুলে
স্পর্শ করেছিলাম ৷ বিয়ের নিয়ম বলে ৷ ব্যাস্, আমি আর কোনোদিন
আংটি পরিনি ৷
হঠাৎ কানে কানে প্রচার হয়ে গেল যে তিস্তাবুড়ি
এসেছে ৷ সাবধান ৷ এবার একটু তিস্তার কথা লিখি ৷ তিস্তা মানে তিস্তা নদী ৷ আমাদের
বাড়ি থেকে আধমাইল হাঁটলে তিস্তার পাড় ৷ তবে কোনো পথ নেই ৷ প্রথমে একটু শুরু লোহার
পাটাতনের উপর দিয়ে রেলের একটা চওড়া খাল পেরোনো ৷ একটু ব্যালান্সের খেলা ৷ ওটা
পেরোলে একটা কাঁটা তারের বেড়া ৷ সেটার ফাঁক দিয়ে শুরু শরীরটাকে পার করানো ৷ তারপর
হালকা গাছপালার ভিতর দিয়ে এবড়ো খেবড়ো পথে অনেকটা হাঁটা ৷ পায়ে দু-চারটা কাঁটা
অবশ্য ফোটানো ৷ তারপর বেশ কিছুটা বড় বড় বোল্ডার মানে গোলাকার পাথর ৷ সেই পাথর বেয়ে
উঠলেই তিস্তা ৷ তিস্তার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই ৷ তখন যা দেখেছি, তার যতোটুকুও মনে আছে সেটা লেখার ফাঁক কিছুটা থাকবে ৷ আমরা প্রথম প্রথম
মেজদার নেতৃত্ব অনেকে মিলে তিস্তায় যেতাম ৷ কেন যেতাম ৷ না, তিস্তাকে
দেখতে নয় ৷ মাছ ধরতে ৷ তিস্তার দুধারে সারে করে বোল্ডার দেওয়া যাতে তিস্তার জল
খেঁপে গিয়ে পার ছাপিয়ে না দেয় ৷ সেই বোল্ডারের উপরে বসলে বেশ প্রায় দুজন মানুষ
সমান নীচুতে থাকত তিস্তার জল ৷ সারাবছর যা জল থাকত তাতে হেঁটেই পেরিয়ে যাওয়া যেত ৷
কিন্তু ঠিক মাঝখানটা ছিল জলের তোড় ৷ আমরা কোনোদিন তিস্তা পেরোনোর চেষ্টা করিনি ৷
আমরা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম ৷ বাঁশের কঞ্চির ছিপের মাথায় শক্ত সুতো বেঁধে তাতে বড়শি
বাঁধতাম ৷ তখন বাচ্চাদের নানামাপের বড়শি পাওয়া যেত ৷ একেক ধরনের মাছের জন্য একেক
ধরনের বড়শি ৷ এক্কেবারে হাতে ধরা যায় না এমন বড়শিও পাওয়া যেত ৷ বড়শিতে লাগাতাম
কেঁচো ৷ আমার কেঁচোতে খুব ঘেন্না ৷ কিন্তু মাছ ধরার উৎসাহে কেঁচো ঘাটতে আমার কোনো
আপত্তি ছিল না ৷ একটু মাটি খুঁড়লেই কেঁচো দেখা যেত ৷ সেগুলো হাত দিয়ে ধরে কৌটোয়
ভরতাম ৷ তারপর মাছ ধরার অভিযান ৷ বড়শিতে কেঁচো ঢুকিয়ে বেশি থাকা কেঁচোর শরীরটা নখ
দিয়ে কেটে আবার রেখে দিতাম ৷ তিস্তার সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য যে হালকা জলের তলাতেই
বড় বড় বোল্ডার দেখা যেত ৷ আমরা দুটো বোল্ডারের বড়শিটা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ফাঁকে
করতাম ৷ কারণ বেশীরভাগ মাছই পাথরের তলায় থাকত ৷ বড়শি ফেলে বেশী বসে থাকতে হত না ৷
কারণ ভ্যাদা মাছ ৷ এই মাছের অন্য কি নাম আছে, আমি জানি না ৷
একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলে হয়তো পরিষ্কার বুঝতে পারবেন কোন মাছের কথা বলা হচ্ছে ৷
শরীরটা অনেকটা কই বা তেলাপিয়া মাছের মতো ৷ কিন্তু মুখটা বন্ধ থাকলে একরকম ,
খুললে মনে হবে শরীরের চাইতেও বড় মুখের হা টা ৷ পুরোটা খুললে দেখতে
একেবারে চৌকো বাক্সের মতো লাগে ৷ এরা খুব লোভী আর বোকা
৷ সেই যাওয়ার কিছু পেল, বোঝাবুঝির আগেই ঝপ করে গিলে
ফেলল ৷ কাজেই বরশিতে ভ্যাদা মাছ ধরা খুব সহজ ৷ আরও নানা ধরনের মাছ থাকত ৷ সব মাছের
নাম জানতাম না ৷ এখনো জানি না ৷ আরো একটা সমস্যা আছে, আমাদের
উওরবঙ্গে বাংলার সঙ্গে কোলকাতার ভাষায় অনেক ফারাক ৷ ওখানকার ভাষাটা স্থানীয় ভাষার
মিশেল দেওয়া বাংলার ভাষার মতো ৷ কাজেই আমরা যাকে চ্যাং মাছ বলতাম, এখানে এসে শুনলাম ওকে এখানে বলে ল্যাটা মাছ ৷ আমাদের বাড়িতে চ্যাং মাছ চলত
৷ চ্যাং মাছ অনেক ধরা পড়ত ৷ ট্যাংরাও ধরতাম ৷ বেলে মাছ ইত্যাদিও ধরা পড়ত ৷
আমি এমনভাবে লিখছি যা আমি যেন প্রচুর মাছ ধরে
বাড়িতে আনতাম ৷ আসলে আমি ছিলাম তুনুকে বাচ্চা ৷ শুধু মাছ ধরা নয় দাদাদের সব কাজেই
আমি ছিলাম তুনুকে ৷ একটা ছাগলের তিন-চারটে করে বাচ্চা হয় ৷ কিন্তু মা ছাগলের দুটো
মাএ বোঁটা ৷ বড় দুটো মনের আনন্দে মায়ের দুধ খায় , আর ছোটগুলো তিড়িং তিড়িং করে
নাচে আর বলে , কী মজা ,কী মজা দাদারা
দুধ খাচ্ছে ৷ মাছ ধরায়ও আমি ছিলাম তুনুকে ৷ খাপ খেলাতেও আমি ছিলাম তুনুকে ৷ একটা
বোধহয় প্রখর ছিল ৷ নিজের মতো করে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা ৷ আমি দাদাদের সঙ্গে
থাকলেও সব কাজে সমর্থন করতাম না ৷ যেমন শুনু আর ভগিরথের ব্যাপারটা ৷ যাকগে আমাক
মাছ ধরার কথা ৷ সেজদা মোটামুটি ভালোই মাছ ধরত ৷ সেজদাও পারত ৷ কিন্তু আমি ছিপ ফেলে
হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ৷ মাসে মাসে এক-আধটা ধরেও ফেলতাম ৷ যারা জানে তারা জানে যে
জলের মধ্যে থাকাকালীন মাছের গায়ে প্রচন্ড জোর থাকে ৷ কাজেই একটা ছোট মাছ বড়শিতে
বিঁধলেও জলের মধ্যে দিয়ে টানলে বিশাল ভারি আর বড় মনে হয় ৷ বড় মাছ ফেঁসেছে ভেবে আমি
প্রাণপণ টান মারতাম আর মাছের মুখ ঠোঁট ছিড়ে খালি বড়শি আমার হাতে ফিরে আসত ৷ মেজদা
অনেকবার শিখানোর চেষ্টা করে, কি করে ছোট একটা হ্যাঁচকা টান
দিতে হয় ৷ মাছ বড়শি মুখে দিলে একটু অপেক্ষা করতে হয় ৷ মনে হয় না ওর শিক্ষা আমি খুব
একটা গ্রহণ করতে পেরেছিলাম ৷
গ্রীষ্মকাল পড়লেই আমাদের তোরজোর শুরু হয়ে যেত ৷
সকালে নম নম করে বই ছুইয়েই আমরা ছুটতাম তিস্তায় ৷ চলত দুপুর পর্যন্ত ৷ টুকটাক মাছ
ধরতাম যতোটা আনন্দ আর নেশাটা ছিল তার চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশী ৷
মাঝে মাঝে বোল্ডার খাঁচে বড়শি আটকে যেত ৷ জলে
নেমে ওটা হাত দিয়ে বের করতে হত ৷ এ কাজটা আমি ভালো পারতাম ৷ যদিও মাঝে মাঝে
ট্যাংরা মাছের কাঁটা বিধত আর ছিল সাপের ভয় ৷ কিন্তু ওসব নিয়ে তখন চিন্তা ছিল না ৷
মাঝে মাঝে দুষ্ট মাছ বড়শি শুদ্ধ সুতো কেটে নিয়ে পালাত ৷ অথবা টেনে নিয়ে পাথরের
খাঁজে আটকে দিত ৷ ওরা খুব বুদ্ধিমান মাছ ছিল মনে হয় ৷ আর একটা মাছের কথা না লিখলেই
নয়, বানমাছ ৷ সেটার কথা পরে লিখছি ৷
আমি অনেক চেষ্টা করে প্রথম একটা ইঞ্চি দুয়েকের
মাছ ধরেছিলাম ৷ ব্যাস্ কি যে হল, আমার নেশা ধরে গেল ৷ গ্রীষ্মের
ছুটি ৷ সকাল হলেই মনে হত কখন মাছ ধরতে যাব ৷ কিছুদিন মাছ ধরতে যাওয়ার পর দাদারা
বন্ধ করে দিল ৷ কিন্তু আমার যে নেশা চেপে গেছে ৷ একাই বেরিয়ে পড়লাম ৷ রাস্তাটা বেশ
ভয়ের ৷ দাদাদের সঙ্গে যাওয়ার সময় বুঝতে পারিনি ৷ কিন্তু একা বেরিয়ে কিছুটা যেতেই
ভয় পেতে শুরু করল ৷ ভয় বাড়তে বাড়তে এমন হল যে আমি দৌঁড়াতে শুরু করলাম ৷ আমাকে
দৌঁড়তে দেখে কেন জানি না একটা কুকুর আমার পিছনে পিছনে দৌঁড়াতে শুরু করল ৷ আমি ভয়ে
আরো জোরে দৌঁড়াতে লাগলাম ৷ কুকুরটাও চিৎকার করতে করতে আরও জোরে আমার পিছনে আসতে
লাগল ৷ একবার সামনের দিকে, একবার পিছনের কুকুরটার দিকে
তাকাতে গিয়ে আমি একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেলাম ৷ আর কিছু করার নেই ৷ চুপ করে
আশঙ্কাকে সত্য হতে দেখব বলে বসে রইলাম ৷ ও আসবে, কামড়াবে,ঘেউ করবে একবার, তারপর চলে যাবে ৷ কিন্তু আমার কি
হবে ? এই পথে তো লোকজন ও বেশী আসে না ৷ আমি কি কুকুরের কামড়
খেয়ে এখানেই পড়ে থাকব ? ও কি খুব জোরে কামড়াবে ৷ আমার ভারি
অসুখ হবে ? আমি কি এখানেই মরে পড়ে থাকব ? চোখ বন্ধ করে বসেই রইলাম ৷
কপালটার কাছে ভিজে ভিজে কি যেন লাগল ৷ নরম নরম ৷
চোখ খোলার সাহস নেই, ও বোধ হয় যাওয়ার আগে চেখে দেখছে
৷ এবার স্পস্ট বুঝলাম আমার কপালে কেউ জিভ দিয়ে চাটছে ৷ গরম লালাতে, আমার কপাল ভিজে যাচ্ছে ৷ তারপর পর কিউ করে একটা আওয়াজ হতেই চমকে তাকালাম ৷
দেখি কুকুরটা আমার সামনে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ নিশ্চয়ই প্লান করছে, কী ভাবে কামড়াবে ৷ দুজন দুজনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছি ৷ কী করব
মাথায় আসছে না ৷ হঠাৎ দেখি ও আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের পা চাটতে লাগল ৷ আমার
মনে হল এই সুযোগ ৷ উঠে দৌঁড় লাগালাম তিস্তার দিকে মুখ করে ৷ সর্বনাশ ওটাও
দৌঁড়াতে লাগল আমার পিছে পিছে ৷ ভয় পেয়ে আমি যা হবার হোক ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লাম ৷ ও
এসে দাঁড়াল আমার পাশে ৷ আমার কেন যেন মনে হল ও আমাকে কামড়াবে না ৷ আমি হাঁটতে শুরু
করলাম ও আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল ৷ যদিও আমার ভয় তখনও কাটেনি, বুকের ভিতর এখনও ধক ধক করছে, তবে একটু স্বস্তি পেতে
লাগলাম ৷ আমি তিস্তার পায়ে পৌঁছালাম ৷ নিজের রোজকার জায়গাতে বসলাম ৷ কিন্তু মাছ
ধরতে ইচ্ছে করল না, বসেই রইলাম অনেকক্ষণ ৷ যেন সদ্য প্রাণ
ফিরে পাওয়া একটা মানুষ ৷ আর সেই কুকুরটাও আমার পাশে চুপ করে আমার পাশে বসে থাকল ৷
আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম ৷ ফেরার পথেও বন্ধু আমার সঙ্গেই ফিরল ৷ সে দিনের পর থেকে
আমার তিস্তায় যাওয়ার নেশা আরও বেড়ে গেল ৷ সারাদিন তো যাই যাই মনে হতই রাতেও শুয়ে
শুয়ে মনে হত যাই একবার তিস্তার পারে ৷ মাছ ধরাটা গৌণ, তিস্তাকে
দেখব বসে বসে আর সঙ্গে থাকবে আমার বন্ধু ৷ এবার একটু বান মাছ ধরার কথা বলি ৷
স্থানীয় লোকেরা বলে বাইন মাছ ৷ আমরাও বলতাম বাইন মাছ ৷ সাপ মাছও বলত কেউ কেউ ৷
লম্বা সাপের মতোই দেখতে৷ তবে মুখটা শরীরটা থেকে সুঁচালো ৷ ছোট ঠোঁট ৷ সাপের মতো
শরীরটা নরম নয়, একেবারে মাংসালো solid . পাঁচ ইঞ্চি থেকে মানুষ সমান হয় এদের লম্বা দেই ৷ বান মাছ ধরা যায়, তবে বেশীরভাগই ছোট ৷ বড় বান মাছ ধরার একটা পুরো সেশন আমি আর আমার বন্ধু
ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দেখেছিলাম ৷ একজন স্থানীয় লোক নদীতে নামল পরণের কাপড়টা
একেবারে পাছা পর্যন্ত ওটানো ৷ ওখানে পুরুষ মানুষরা তখনও লেটিংর মতো
একটা পোষাক পরে দিব্যি সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতো ৷ যাই হোক লোকটা
নদীতে নামল ৷ কোমরে দড়ি বাঁধা তিনটে জিনিস ৷ একটা বেশ শক্তপোক্ত কয়েক
হাত লম্বা লাঠি ৷ বড়শি বাঁধা একটা মোটা সুতো আর এই ধরনেরই আরো একটা সুতো ৷ লোকটা
নদীর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঝ বরাবর গেল ৷ তারপর একটা বড়শিতে কেঁচো গেঁথে সেটা
জলে ফেলল ৷ তারপর পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে বড়শিটাকে যতোটা সম্ভব
পাথরের তলার দিকে ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ৷ ওর বড়শি লাগানো সুতোটা ধরে রাখত ৷ সুতোটা
কিন্তু কোমড়েই বাঁধা থাকত ৷ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়ে আছে একেবারে স্থির হয়ে ৷
হঠাৎ লোকটা নড়ে উঠল ৷ বড়শিতে মাছ ধরছে ৷ লোকটা তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে সুতো
টানতে লাগল ৷ বেরিয়ে এল সরু ঠোঁটে বড়শি বাঁধানো মুখ ৷ বান মাছের মুখ ৷ লোকটা জল
থেকে মাছটাকে তোলার চেষ্টা করছে ৷ শুনে ছিলাম বড় বান জলে থাকা অবস্থায় এক
শক্তপোক্ত লোকের পক্ষে তোলা সম্ভব না ৷ উল্টে লোকটারই জলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা ৷
মুখটা বেরোতেই শুরু করলেই কোমরে বাঁধা লাঠিটা নিয়ে মার ৷ মাছটাকে এক হাতে ধরে
তুলছে আর অন্য হাতের লাঠি দিয়ে মারতে থাকা ৷ বান মাছ প্রায় লোকটার সমান লম্বা ৷
প্রাণপণ যুদ্ধ চালাচ্ছে সেও ৷ তার নড়াচড়ার ধাক্কা লোকটাও সামলাতে পারছে না ৷ মনে
হচ্ছে এক্ষুণি লোকটা বড় বোল্ডার থেকে পড়ে যাবে আর বান মাছটা তাকে টেনে নিয়ে যাবে ৷
কিন্তু ক্রমাগত লাঠির ঘায়ে সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল ৷ তারপর কোমড়ের বড়শি
বাঁধা অন্য সুতোতে মাছের মুখটা ঢুকিয়ে দিল ৷ মানে একটা মাছ জমা পড়ল ৷ সেই অন্য
একটা ধরার তোড়জোর শুরু হল ৷
আমার বাবা কিন্তু খুব ভালো মাছ ধরত ৷ বছরে একবার
মাছ ধরতে যেত ৷ বাবা পুকুরে মাছ ধরত ৷ লোকজনের কাছে খবর পেত কোথায় ভালো মাছ ধরার
পুকুর আছে ৷ একটা কথা বোধহয় বলে রাখা ভালো যে আমাদের ওদিকে পুকুর কিন্তু এদিকের
তুলনায় কম ছিল ৷ আর এর ফলে আমাদের সাঁতার শেখা হয়নি ৷ কোনোরকম যতটুকু শিখেছি সেটা
অনেক বড় হয়ে ৷ বাবার মাছ ধরতে যাওয়ার থেকে মাছ ধরার তোড়জোর শুরু হয়ে যেত ৷ মাছের
খাদ্য বানানো হত যা মাছ ধরার আগে জলে ছড়িয়ে দেওয়া হত ৷ বড়শিতে লাগানো খাবারও বাবা
নিজের হাতে বানাত ৷ বাবা মাছ ধরত হুইল (wheel) ছিপ দিয়ে ৷ সুন্দর একটা
কাঠের বা বেতের ছিপ, গোড়ার দিক মানে যে দিকটা ধরা হবে সেখানে
একটা চাকা লাগানো থাকে ৷ চাকাটা লোহা না পিতলের জানি না তবে শক্তপোক্ত আর দেখতে
সুন্দর ৷ চাকার গায়ে একটা ছোট্ট হ্যান্ডেল লাগনো থাকত ৷ সেটা হাত দিয়ে ধরে
চাকাটাকে ঘোরানো যায় ৷ চাকার গায়ে গোটানো বিশাল লম্বা শক্ত এক ধরনের সুতো লাগানো
থাকত ৷ সেই সুতোটা ছিপের গায়ে লাগানো ছোট ছোট লোহার আংটার মধ্যে দিয়ে বার করে
ছিপের মাথায় দিয়ে বাইরে বেরিয়ে থাকে ৷ সুতোর মাথায় বাঁধা থাকে বড়শি ৷
বাবার মাছ ধরা একদিন দেখেছি ৷ বাবার বড়শিতে একটা
বড়সর মাছ আটকেছে, বাবার মনে কোনো উওেজনা নেই ৷ মাছটার মুখে বড়শি গাঁথা ৷ ওটা পাগলের মতো
জলের তলা দিয়ে পুকুরের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে আর বাবা শুধু হুইল
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুতো ঢিলে দিয়ে যাচ্ছে ৷ মাছটা সারা পুকুরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৷ আর
বাবা শান্ত হয়ে সুতো ঢিলে দিয়ে যাচ্ছে, আমার শুধু মনে হচ্ছে
বাবা কেন মাছটা টেনে পাড়ে তুলছে না ৷ আমি ছটফট করছি দেখে বাবা বলল, শোনো, যখন কোনো লোক বাড়িবাড়ি ছটফট করে তখন তার সঙ্গে
বিরোধিতা না করে শান্ত হয়ে থাকবে ৷ দুজন ছোটফট করবে শুধু ঝামেলাই হবে ৷ দেখনা ছটফট
করতে করতেও কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে ৷ সত্যি আস্তে আস্তে মাছটা ক্লান্ত হয়ে দৌঁড়াদৌড়ি
কমে এল ৷ আস্তে আস্তে বাবা মাছটাকে পাড়ের সামনে নিয়ে এল হুইলের চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
সুতো ছোট করতে করতে ৷ কিন্তু মাছটার তেজ তখনও শেষ হয়নি ৷ এত বড় মাছ কিছুতে জল থেকে
উঠবে না ৷ তখন বাবা আমাদের দুই ভাইকে বলল যে জলে নেমে হাত দিয়ে মাছটা জল থেকে টেনে
তুলতে, বাবা একটা ক্লান্ত মাছকে জল থেকে তুলতে এত কষ্ট ৷ দুই
ভাই কোনোরকমে যুদ্ধ করে মাছটাকে তোলা হল ৷ জলের মধ্যে যেমন বড় মনে হচ্ছিল, ঠিক ততটা বড় না হলেও বেশ বড় ৷ বাবা নিজের ছিপটিপগুলো নিজের হাতে গুছিয়ে নিয়ে
বলল, ধৈর্য আর ধৈর্য ৷ শত্রু যতো বড়ই হোক বুদ্ধি দিয়ে কাবু করতে হয়, শুধু গায়ের জোরে নয় ৷ বাবা কার উদ্দেশ্যে এক কথা বলল, জানি না ৷ কিন্তু যা শেখার শিখে গেলাম ৷
তিস্তার কথা শুরু করেছিলাম তিস্তা বুড়ি দিয়ে ৷
তিস্তা বুড়ির আবির্ভাব হয়েছে ৷ তিস্তার উপর দিয়ে যারা পাড়াপাড় করে, তাদের বাড়ি থেকে যদি পূজো না দেওয়া হয়,তবে সেই বাড়ির
এক ছেলেকে তিস্তা বুড়ি খেয়ে ফেলবে ৷ এসব নিয়ে আমার বিশ্বাস প্রথম থেকেই কম ৷
কিন্তু মেজদা তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে মাঝে মধ্যে বাড়ি আসে তিস্তার উপর দিয়ে ৷ কাজেই
মায়ের চিন্তা শুরু হল ৷ মা ঠিক করল তিস্তা বুড়ির পূজো দেবে ৷ দোমহনি থেকে
জলপাইগুড়ি শহরে যাওয়ার ব্যাপারটা তখন বেশ ইনটারেস্টিং ছিল ৷ আমি মাএ দু-একবার
মেজদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় জলপাইগুড়ি শহরে গিয়েছিলাম ৷ কাজেই সবটা ঠিক মনে নেই
৷ দোমহনিতে তিস্তার কোনো ঘাট ছিল না ৷ পাশের রেলস্টেশন ময়নাগুড়ি যেতে হত ট্রেনে ৷
সেখান থেকে তিস্তার ঘাট ৷ ছোট ছোট লঞ্চে বা বড় নৌকায় তিস্তা পেরিয়ে জলপাইগুড়ি
শহরের দিকে একটা ঘাটে নামতে হয় ৷ লিখেছিলাম দোমহনি থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়া বেশ
ইনটারেস্টিং ৷ এই জলপাইগুড়ির দিকের ঘাট থেকে সেই ইনটারেস্টিং ব্যাপারটা শুরু ৷ মূল
শহরে পৌঁছাতে গেলে মাইলের মতো বালির বিশাল নদীর চর পেরোতে হয় ৷ হয় কষ্ট করে ঐ
বালির চর হেঁটে পেরোও, নয় তো পয়সা দিয়ে গাড়িতে আরামে পেরিয়ে
যাও ৷ দ্বিতীয়টা কথাই বলতে চাইছিলাম দুনিয়ার এমন কোনো গাড়ি আর কোথায় আছে আমার তখনও
জানা ছিল না এখনও জানা নেই ৷ আমরা বলতাম মটরগাড়ি ৷ এখন যাকে বলে car ৷ মনে হয় যেখানে যত মোটর গাড়ি আছে সব জলপাইগুড়ির তিস্তার ঘাটে জমা করা
হয়েছে ৷ কোনোটার ছাদ নেই বলে মাথায় বস্তার ছাদ , পিছনের
দিকটা নেই বলে টিন কেটে দড়ি দিয়ে বাঁধা ৷ দরজা নেই তো কী আছে কাঠ আর দড়ি তো আছে ৷
বলতে গেলে গাড়িগুলোর কিছুই নেই কিন্তু একটা ইঞ্জিন আছে এবং
সেটা কাজ করে ৷ যতোদূর মনে হয় তখন একটাকা করে মাথা পিছু নেওয়া হত আর গাদিয়ে লোক
তোলা হত ৷ গতি অবশ্য শামুখের সঙ্গে তুলনা করলে ওদের
প্রেস্টিজে লাগবে ৷ রাস্তায় এটা ওটা খুলে পড়লেও যাএীরা পৌঁছে অবশ্যই যাবে – এটা গ্যারান্টেড ৷ এখন আর সে অযোধ্যাও নেই, সেই রামও
নেই ৷ এখন সব পাল্টে গেছে ৷ মেজদা তিস্তা পেরিয়ে যাতায়াত করত ৷ কাজেই তিস্তা বুড়ির
কোপ ওর উপর পড়তেই পারে ৷ তাই একদিন মা আমাকে নিয়ে ময়নাগুড়ির ঘাটে পূজো দিয়ে এল ৷
সব ঠিকঠাক মিটে গেল ৷
(ক্রমশ)
[কমলেন্দু চক্রবর্তী]