>

ফুল্লরা নাগ

SongSoptok | 1/10/2015 |



দিনগুলি মোর........   শেষ পর্ব

বসেছিলাম বেড়ে ওঠার দিনগুলি কথা লিখবার জন্য... কিন্তু, লিখতে বসে দেখছি, স্মৃতিগুলি যেন বড়ই আবছা, বড়ই এলোমেলো... সেগুলি দিয়ে কোন কথামালা গাঁথা যায় না... হ্যাঁ, সামঞ্জস্যহীন কতগুলি খণ্ড চিত্র হয় বা আঁকা যায়... কিন্তু তা দিয়ে হবেটা কি? তাই তুলি কলম এক রকম গুটিয়েই ফেলেছিলাম...আবার ভাবলাম, চেষ্টা করে দেখাই যাক না কেন, সেই খণ্ড চিত্র কোন গল্প করলেও করতে পারে!

স্কুল জীবনটা যে একেবারে সাদামাটা ছিল তা নয়...সেখানেও কিছু বৈচিত্র ছিল বৈকি... বিশেষ করে যখন থেকে বাবা হাওড়া আর হুগলী জেলার আধিকারিক পদ পেলেন...ফুলেশ্বরের নাম বোধহয় তোমরা অনেকেই শুনেছ... গঙ্গার ধারে বিশাল জায়গা নিয়ে সেচ দপ্তরের বিশাল বাংলো...আর ছিল হুগলী জেলার আমতা...তবে, উত্তর বঙ্গের স্মৃতি তখনও জাগরুক মনে, তাই এই জায়গাগুলোর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে সময় লেগেছিল বৈকি।

তবুও দুধের স্বাদ খানিকটা ঘোলে মিটত চিড়িয়াখানায় গিয়ে...সারা বছরই যাওয়া হত সেখানে... শীতকাল হলে কথাই নেই। ভোর ছয়টায় যখন চিড়িয়াখানার দরজাটা খুলত, তার আগেই আমরা সেখালে হাজির হয়ে যেতাম...পাখীদের কোলাহল... বাঁদরগুলোর লম্ফঝম্প... বাঘসিংহের তর্জন গর্জন...সবারই যে খিদে পেয়েছে... দেরী আর তাই সইছে না!

আমরা প্রথমে বাঁ দিক দিয়ে শুরু করতাম... জিরাফ... বাঁদরদের খাঁচা... হরিণদের এনক্লোজার... হাতিদের পিলখানা... শজারু... সেই বিশাল কচ্ছপটা... বাঘ... সিংহ... হায়েনা... আরও কত কি...সরীসৃপ ভবনে গিয়ে সাপ আর কুমীরদের সঙ্গেও আলাপ করার চেষ্টা চলত...তক্ষক দেখে কিন্তু মনটা খারাপই হয়ে গিয়েছিল...রাজা পরীক্ষিতকে মেরেছিল এই জন্তুটা? এটা সাপই না... আর লেখা আছে, mildly poisonous… মানে এর বিষ এমন কিছু মারাত্মক নয়... তবে এর কামড়ে কি করে একটা মানুষ এভাবে মারা যেতে পারে? কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারতাম না।

তক্ষক নামক সরীসৃপটির সঙ্গে পরে অবশ্য সঙ্গে আরও ভালোভাবে আলাপ হয়েছিল। বাবা তখন আগরতলায় চাকরীরত... হাঁটতে হাঁটতে শহরের বাইরে চলে গিয়েছি... তেষ্টাও পেয়েছিল খুব...একটা ঝুপড়ী দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়লাম ভিতরে... বিনা নিমন্ত্রণেই... বললাম জল খাব... তারা আদর করে চৌকির ওপর বসতে দিল... যত্ন করে জল আনল আর সঙ্গে আরও কি যেন...জলের গ্লাসে সবে মুখ লাগিয়েছি... মাথার উপর টকটক শব্দ... ঝুপড়ির ছাদে তক্ষকের বাসা... মানুষ আর সরীসৃপের এমনই সহবস্থান...তাদের আর কষ্ট করে পরীক্ষিতের গল্পটা আর বললাম না...শুনলে কি বলত কে জানে?

যাক সে কথা... বলছিলাম চিড়িয়াখানার কথা...সেখানে তখন পশু ছিল নানা রকম..আর পাখীও...এদের মধ্যে কিছু আবার বিদেশী... কাকাতুয়া, মাকাও, এমু, অস্ট্রিচ... কাকাতুয়া যে সুদূর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সে চিড়িয়াখানাতেই এসে জানলাম... না এলে হয় শিক্ষাটা অপূর্ণই থেকে যেতো। পরে যে ornithology নিয়ে নাড়াচাড়া করা শুরু করেছিলাম, তার সুত্রপাতও বোধহয় এই ছিঁড়িয়াখানাতেই...

শীতকাল হলে অবশ্য খাঁচার পাখীদের দিকে তাকাবার অবকাশ থাকত না... একটা ঝিল ছিল না? আর তার ওপর সাঁকো? সেইখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা... তাকিয়ে থাকতাম সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা হাঁসেদের দিকে... চেয়ে চেয়ে দেখতাম তাদের জলে ভাসা, ডানা ঝাপট মেরে আকাশে ওড়া...আবার জলে নামা, আবার ওড়া...দেখতাম আর ভাবতাম... সেই বুড়ো আংলার কথা... চখাচখীদের কথা... আরও কত কথা!

মনে পড়ে যেত, আদিকবি বাল্মিকীর কণ্ঠ থেকে যে প্রথম শ্লোক উচ্চারিত হয়েছিল সে একটি চখার মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই... এদের নিয়ে যুগযুগ ধরে কবিরা কাব্য রচনা করে এসেছেন... কি আশ্চর্য, এরা তাহলে আমাদের দেশীয় পাখি নয়? বিদেশী পাখী... সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা? ভাবতে অবাক লাগত, যুগযুগ ধরে এরা আমদের দেশকেই বেছে নিয়েছে নিশ্চিন্তে শীতের দিনগুলি কাটিয়ে দেবে বলে!

হে ভারতভূমি, তুমি যে শুধু শকহূন দলকেই আশ্রয় দিয়েছ তা নয়... নিজের করে নাওনি শুধু পাঠান মোগলদেরই...সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা ক্রৌঞ্চমিথুনও স্থান পেয়েছে তোমার সাহিত্যে... তোমার সংস্কৃতির অন্দরমহলে...এই ল্যাজ নাড়ানো খঞ্জনা... সেও যে বিদেশী সেই বা জানে কয়জন? আমিও হয় জানতাম না...তবুও জেনেছি; নিজের তাগিদেই জেনেছি!

এই প্রাতঃ ভ্রমণগুলো আমার মনের দরজা কখন যে চুপিসারে এসে খুলে দিয়েছিল কেই বা তা জানে...আর সেই খোলা দরজা দিয়ে এসে প্রকৃতি দেবীর স্নেহমাখা স্পর্শ কখন যে আমাকে আদ্যপ্রান্ত বদলে দিল সেও আমার জানা নেই... আমি যে আজ আমি, তার অনেকটা কৃতিত্বই চিড়িয়াখানার প্রাপ্য!     


যাক সে কথা...চিড়িয়াখানায় গেলে শুধু মাত্র যে পশুপাখীদের সঙ্গেই আলাপ হত তা নয়... অন্য স্বাদও একটু আধটু পেয়েছি বটে...বুড়ীর চুল খেয়েছ কোনদিন? ইংরেজীতে যাকে candy floss বলে? হোক না সে চিনির ড্যালা... খেতে কিন্তু দারুণ...এই চিড়িয়াখানাতেই প্রথম সেটা খেয়েছি...আর যেদিন মা আমাদের ম্যাগনোলিয়া রেস্তুরান্তে খাওয়াতেন, সেদিন হাতে স্বর্গই পেতাম... কিন্তু সেটা ভাগ্যে কম দিনই জুটত...  আজ চল এখানেই!

[ফুল্লরা নাগ]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.