অর্দ্ধসমাপ্ত (প্রথম পর্ব)
দক্ষিনের বারান্দায় রোদে
পিঠ দিয়ে বসার কথা হতেই আবার আমার মাথার পোকাটা নড়ে উঠল। শীতের মিঠে রোদে
চার বোনে বসা; আড় চোখে বড়দি,মেজদি,সেজদি কে দেখে
নিলাম। ওরা যে যার নিজের
জগতে; বড়দি তার বিশাল
চুলের রাশি রোদে দিয়ে শুকোচ্ছে আর একটা জনপ্রিয় মেয়েদের ম্যাগাজীন পড়ছে একমনে।
মেজদি এতো বছর পরে এলো তাই সেই ছোটোবেলার মতো পা ছড়িয়ে চক্ষুবুজে তেঁতুলের আচার
চাটছে তাড়িয়ে তাড়িয়ে। সেজদি স্বভাবসিদ্ধ দ্রুতহাতে উল বুনছে। কেউ
খেয়াল করেনি আমি রোদে আসার সময়ে খাতাটা নিয়ে এসেছি; যাতে আমার সেই
অর্দ্ধসমাপ্ত লেখা।
বড়দি--- আমাদের
চার বোনের মধ্যে সব থেকে রূপসী, আর তাই বিয়েও হয়েছে খুব অল্প বয়েসে। বড়দিকে
দেখলে মনেহয় মা লক্ষ্মী আসন ছেড়ে নেমে এসেছেন। শুধু একটু লম্বা এইযা।
জামাইবাবুদের জামা কাপড়ের ব্যাবসা। গড়িয়াহাটে, ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে আরোও কোথায়
কোথায় জানি বিশাল বিশাল দোকান। বড়দি বিয়ে হয়ে যাবার পর পরই নাকি ওনাদের
বিজনেসের প্রচুর সুনাম এবং লাভ হয়, আর তাই তখন থেকে বড়দির শ্বশুড়মশাই বড়দিকে
রীতিমতো মা লক্ষ্মী মানেন। পড়াশোনা শেষ করিয়েছেন, ঘরের কুটোটি অবধি নাড়তে হয়না। যদিও বাড়ীর ছোটো বউ, বড়দিকে ঝি চাকর
থেকে ঘরের লোক অবধি সবাই সমীহ করে। হাঁপিয়ে ওঠেনা বড়দি? প্রশ্নটা মনে এসেও
কোনোদিন জিজ্ঞেস করার সাহস
হয়নি। সকলের মতো আমিও ধরেই নিয়েছি বড়দি খুব সুখী, কারণ একটা ঠিক যে বড়দিকে কোনোদিন কোনো বিষয়ে অভিযোগ
অনুযোগ করতে শুনিনি। হতে পারে সেটাই ওর নেচার, হতে পারে সেটাই ওর
সুখী থাকার পাসওয়ার্ড।
মেজদি--- প্রচুর
পড়াশোনা করা, বিদেশে সেট্ল্ড।
বড়দির মতো না হলেও মেজদিও যথেষ্ট রূপসী। তবে মেজদির রূপ হোলো জ্বলন্ত ধরনের, স্নিগ্ধ না। আর
মেজদি সযত্নে সেটাকে কাজে লাগাতো। যেখানে দরকার বেশ ফ্লার্ট
টার্ট করে কাজ হাসিল করতো। জামাইবাবু ওদেশীয় ছিলেন, দুই বাচ্চা হবার
পরেও মেজদি মানিয়ে গুছিয়ে থাকেনি, ডাইভোর্স হয়েই যায়। একা হাতে ছেলেমেয়েদের বড়
করেছে, তাই মেজদির দেশে
আসা খুব কমই হোতো, মা বাবা থাকা
কালীন তাও কর্তব্যের খাতিরে আসত। এতোদিনে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা নিয়ে নিজের নিজের জগতে
ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় মেজদি ঝাড়া হাত পা একা এসেছে এ যাত্রায়।
সেজদি--- অতি
বড় ঘরনী না পায় ঘর; আক্ষরিক অর্থে সেজদির জন্য প্রযোজ্য। দেখতে খুব রূপসী সুন্দরী না
হলেও আলগা একটা শ্রী ছিলো যা অনেকেরই চোখ টানত, মন কাড়ত। কাজে কর্ম্মে দশভূজা বললেও বোধহয় কম বলাহয়। কি
পারেনা সেজদি; পড়াশোনার পাশাপাশি রকমারি
রান্না, সেলাই ফোঁড়াই, উল বোনা, বড়ি আচার, বাচ্চা ভোলানো, ছবি আঁকা, কনে সাজানো, তত্ত্ব সাজানো কতো
বলবো? আর প্রতিটা কাজ
নিখুঁত। কিন্তু মা বাবা
চাইলেন যে বড়মেয়ে মেজমেয়ের এতো ভালো ভালো বিয়ে হয়েছে অতএব সেজর ও তেমন বর
চাই, মেয়ে ডবল
মাস্টার্স অতএব মানানসই কোয়ালিফিকেশনের ছেলে চাই, মেয়ে সর্বগুন
সম্পন্না শুধু নাচ গানটাই যা পারেনা অতএব ছেলের সেই দিকটা থাকতে হবে, এতো সব চাহিদা
মেলাতে মেলাতে শেষ মেশ বিয়েটাই হোলোনা সেজদির। মা বাবাও এক এক করে গত হলেন ব্যস্, এখন অবশ্য সেজদি
নিজেই আর চায়না বিয়ে করতে।
আমি-রাগেশ্রী---যদিও সবার ছোটো কিন্তু
সকলের নয়নেরমণি কোনোদিনই ছিলামনা। বরং চতুর্থ মেয়ে হয়ে মা বাবাকে আরোও
যন্ত্রনায় ফেলেছিলাম। ছেলের আশায় একটু বেশী বয়সেই গর্ভধারন করেন মা। তারওপর
আমি দিদিদের সমতুল নই কোনো বিষয়েই, বলতে গেলে এক কথায় মিডিওকার। কি
দেখার দিকে, কি কাজে কর্ম্মে, কি পড়াশোনায়। তবু
কিভাবে জানিনা অনিরুদ্ধর সাথে আমার প্রেম হয়, আর বিয়েও হয়।
কিন্তু বিয়ে হয়ে যতক্ষন না চব্বিশ ঘন্টা একই ছাদের নীচে থাকা হয় ততোক্ষন
বুঝি আন্দাজও করা যায়না পরস্পরের ভালো না লাগার দিকটা। আমাদের ক্ষেত্রেও
এর ব্যতিক্রম হোলোনা। কিছুমাসের মধ্যে অসহ্য হয়ে উঠল একসাথে থাকা।
আমিও ত্যাড়া ঘেঁটি কিছুতেই মেনে নিতে পারলামনা। আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত
নিলাম। কি জানি দুজনেরই মনের কোনো এক গোপন কোনায় বুঝি আজও এক হবার আশা মিট্
মিট্ করে তাই কিছুতেই ডাইভোর্সের কথা কেউ মুখেও আনিনা কেউই।
আজ কতো যুগ পর যেন
চার বোনে একসাথে দুপুরে খেলাম। সেজদি কি দারুন দারুন সব পদ বানিয়েছিলো।
চেটেপুটে খেলাম সবাই আর কতো জমানো কথা মন খুলে বলে গেলো দিদিরা। আমি কেন
জানিনা কিছুতেই সহজ হতে পারলামনা। অংশগ্রহন করেও গুটিয়ে থাকলাম ভেতরে
ভেতরে। হয়ত দিদিরাও সবাই ঠিক ঠিক মন খুলল না, এক সেজদি ছাড়া ওর তো লোকানোর মতো
কিছুই নেই। আসলে আমার একটা রূপ বড়দি মেজদির অজানা ছিলো, যেটা নিয়ে
অনিরুদ্ধর সাথে অশান্তি। আমি লিখি; বেনামে অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে।
বড়দি পড়েছেন কিন্তু ভুলেও ভাবেননি ওটা আমার লেখা; মেজদির পড়ার প্রশ্ন নেই। সেজদি শুধু বরাবর এক ভাবে
সাপোর্ট করেছে। আমার সান্মানিক গুলো সেজদির এক বন্ধুর ঠিকানায় আসত, যাতে বাড়ীতে ধরা
না পরি। আজ কতোদিন পর আবার যেন খাতাটা ডাক দিলো আমায়। কিজানি কেমন মনে
হচ্ছে দিদিদের কাছে ধরা দিতেই চাইছি হয়ত, আমি চলে আসায় বড়দির শ্বশুড় বাড়ীতে বুঝি কিছু
অপ্রীতিকর কথা হয়েছিল, জানিনা মেজদির বেলায় কি হয়েছিল। তবে আজ যদি বড়দি
জানতে পারেন আমি কে তাহলে হয়ত গর্বিত হবেন, বড় মুখ করে বলতে
পারবেন সবাইকে। মেজদিরও অখুসী হবার কারন নেই; আর আমার চলে আসার
আসল কারনটাও ওদের কাছে পরিস্কার হবে।
আমার হাত দিয়ে শুধুই
রোম্যান্টিক গল্প বেরোয়, আর সে ও আবার এমন রোম্যান্স যে পড়ে পাঠক রীতিমতো
আবিষ্ট হয়, শিহরিত হয়। আমার
কিছু ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়ে অনির হাতে আর ধরা পড়ে যাই আমি, যে আমিই
সন্ধ্যারাগ ছদ্মনামে লিখি। আমার লেখা নিয়ে ওর কোনো সমস্যা ছিলোনা সমস্যা হোলো
রোম্যান্টিক গল্পে। ওর মতে এগুলো রগরগে আদিরসাত্মক বটতলা মার্কা লেখা। আমায়
অন্য ধরনের গল্প লিখতে বলে। সে আমার মাথায় না এলে আমি কি করবো? কাজেই লেখা নিয়ে
নিত্য ঝগড়া, ঘরের কোনো কাজে ভুল
হলেই শুরু হোতো। ওগুলো ছাইপাঁশ ও লেখার চেয়ে না লেখা ভালো, ওগুলো লিখে নাকি
আমি সমাজের ক্ষতি করছি, আমি নাকি আমার অবদমিত ইচ্ছাকে এইভাবে প্রকাশ করে
স্যাটিফায়েড হচ্ছি। শেষে পাত্তারি গুটিয়ে যখন চলে এলাম এবাড়ী কাউকে কেন
জানি খুলে বলতে পারিনি আসল কথাটা, সেজদি ছাড়া। সেজদি অবশ্য মা পাখীর মতো আড়াল
দিয়ে ছিলো। কোনোদিন জোর করেনি ফিরে যাবার জন্য। বছর খানেকের মধ্যে একে
একে মা বাবা গত হলেন, দুইবোন রইলাম। সেজদি দু'হাতে টিউশনি করে আর আমি? বড় সড় একটা
অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে আরোও বিপদ বাড়িয়ে রেখেছি সবার। মা বাবা থাকতেই দেখে গেছেন আমি
শয্যাশায়ী। এই সবে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করেছি, তাও একটা খাঁচার মতো ওয়াকার মেজদি এনেছে তাই।
কাজেই লেখা পত্তর মাথায় উঠেছিলো। কিন্তু আজ হাঁটতে পেরেই
মনে হচ্ছে আবার কনফিডেন্স পাচ্ছি।
(চলবে)
[মৈত্রেয়ী
চক্রবর্তী]