পরগাছা:পর্ব-আট
কুমুদবাবুর কাছে বসিরহাটের অনেক গল্পই শুনেছিলাম। তার
বেশিরভাগই আজ আর মনে নেই। শুধু মনে আছে ওঁর মায়ের গলার সাতনরী হারের কথা। রত্নখচিত
সেই হারের প্রত্যেকটা রত্নের পেছনে নাকি ছোট ছোট টুনিবাল্ব লাগানো ছিল। টুনিগুলো
জ্বলে উঠলে ঝলমল করে উঠত সেই হার আর সেইসঙ্গে মায়ের মুখটিও। মায়ের কথা খুব বলতেন
কুমুদবাবু। অপূর্ব সুন্দরী নাকি ছিলেন তিনি। কুমুদবাবুও খুব সুন্দর ছিলেন
বয়েসকালে। আমি যখন দেখেছি, বয়েস হয়ে গেছে, তখনও দিব্যি লাল-টুকটুকে মিষ্টি একটা বুড়ো। সারাক্ষণ গান গাইছেন, হাসছেন, বকবক করছেন, উৎসাহে ফেটে পড়ছেন, আবার অভিমানে গাল
ফোলাচ্ছেন। গড়িয়াহাট বাণীচক্রে গান শিখতে যেতাম যখন, পৌঁছোতাম সবার শেষে। আমার শেখা হয়ে গেলে সবাই মিলে বেরিয়ে
পড়তাম ক্লাস থেকে। রাস্তায় নেমেই কুমুদবাবু তারস্বরে শেষ শেখানো রাগের বন্দিশ
ধরতেন। আমাদেরও গলা মেলাতে হত ওঁর সঙ্গে। সে এক দেখা এবং শোনার মতো ব্যাপার ছিল।
আশেপাশের লোকজন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত। যাদের অভ্যেস ছিল, তারা অবিশ্যি হাসি চেপে পাশ কাটিয়ে যেত। ওঁকে বাসে তুলে
দিয়ে আমি আর বাবা উল্টোদিক থেকে হাওড়ার বাস ধরতাম। তারপর সেদিনের শেখা রাগটা, যাতে ভুলে না যাই সেই
জন্য, সারা রাস্তা গুনগুন করতে
করতে বাড়ি ফিরতাম।
আজও আমি ভাবতে পারি না, ওইরকম জীবনীশক্তি ছিল যে মানুষটার, তাঁর জীবনের শেষ বছরটা
কী ভয়ংকর মৃত্যু-আক্রান্ত হয়ে কেটেছে।
সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল। ডানদিকটা পড়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমি আর মা
দেখতে গিয়েছিলাম ওঁকে, গিয়ে দেখি চেয়ারে বসে আছেন ন্যালাখ্যাপার মতো। লক্ষীদি, ওঁর ছোটমেয়ে, একটা থালায় ভাত চটকে
গোটা দশ-বারো গোল্লা পাকিয়ে
টেবিলে রেখে দিয়ে গেছে আর উনি প্রায় অকেজো ডানহাতটা দিয়ে অপরিসীম চেষ্টা করছেন সেই
ভাতটা খাওয়ার। কথা বন্ধ একেবারে, শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছে শরীর, মাথাটা অনেকখানি ঝুঁকিয়ে ডানহাত কব্জি থেকে উল্টে ভাতের দলা
ধরে মুখে পোরার চেষ্টা করছেন, নালেঝোলে একসা হয়ে যাচ্ছে মুখ। মা গেল রান্নাঘরে জেঠিমার
সঙ্গে গল্প করতে। আমি একটু একটু করে ভাতটা খাওয়াতে লাগলাম ওঁকে। আমার দিকে
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। হঠাৎ একটু সবল বাঁ-হাতটা চেপে ধরলেন আমার বুকে। চোখ বন্ধ করে কী যেন বিড়বিড়
করলেন কয়েক সেকেণ্ড। আমার সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। মনে হল একটা সুরের
প্রবাহ যেন ঢুকে যাচ্ছে আমার শরীরে। বুঝলাম, মৃত্যুর আগে উনি ওঁর সবকিছু আমাকে দিয়ে গেলেন। এরপর উনি আর
বেশিদিন বাঁচেননি।
সেদিনের কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয় আমার। আমি পারিনি ওঁর
আশীর্বাদের যোগ্য হয়ে উঠতে। ছড়িয়ে গেছি। সুরও আমাকে ছেড়ে গেছে ক্রমশঃ। আজ একটু
সুরের জন্য মাথা খুঁড়ে মরি। ফেরে না সে। কুহকিনীর মতো তার অদ্ভুত মায়াবী পালক আমার
মুখে বুলিয়ে কোথায় চলে যায়। পর্দার ওপার থেকে আমাকে সারাজীবন আচ্ছন্ন করে রাখে।
আমি সেই পর্দা সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাই। পারি না। আমার আর সুরের মাঝখানে
ওড়নার মতো স্বচ্ছ একটা পর্দা দুলতে থাকে। দুলতে থাকে আমাদের ব্যবধান, আমাদের না-পাওয়া।
আবার হঠাৎ হঠাৎ সুর যে কোথা থেকে এসে আমার ঘাড়ে চাপে। কেউ
কেউ জিজ্ঞেস করে, "এই যে গান লেখো, সুর দাও, কীভাবে হয় এইসব? আগে কথা, না আগে সুর? আগে খাতা, না আগে হারমোনিয়াম?" আমি কোনওরকমে আমতা আমতা
করে বলি, "ওই হয়ে যায় আর কী।" কীভাবে যে হয়, তা আমি নিজেও জানি না।
শুধু এইটুকু বুঝতে পারি, কিছুই আমি নিজে করিনি। মহাশূন্যের কোনও একটা স্তরে ভেসে
যাচ্ছিল একটা গান, কথা-সুর সমেত, ভাসতে ভাসতে হঠাৎ আমার
বাথরুমে চলে এল। আমি হয়তো তখন চান করছি। আমার সারা গা ভিজে। আমার ভিজে গায়ে লেপ্টে
গেল গানটা। আমার পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়িতে হয়তো কেউ চান করছিল না তখন। তাই গানটাকে
তারা ধরতে পারেনি। আমি সেই গান গলায় পরে নিই আর সারাক্ষণ গাইতে থাকি। তারপর আমার
খাতা, হারমোনিয়াম, অথবা টেপরেকর্ডারের
দরকার পড়ে, গানটার সংরক্ষণের জন্য।
কিন্তু এসব কথা কাউকে বলা যায় না। বললেই সে মনে মনে আমার
বাথরুমে উঁকি মারবে। আমার স্নান করার রোম্যান্সটুকু নষ্ট হয়ে যাবে। আর চান করা মানে
তো নিজেকে ভালোবাসা। নিজের শরীর আরও মসৃণ, আরও সজল করে তোলা। নিজের গায়ের গন্ধ নেওয়া। নিজেকে আদর করা।
বাথরুমের ভিজে দেয়ালে ঠোঁট চেপে ধরা। সাবানের ফেনা বুকের কালোয় মাখিয়ে মিথ্যে
দুধের কুহক তৈরি করা। স্নান করা মানে নিজের শরীর নিয়ে যাবতীয় ইচ্ছেপূরণ। আর প্রতিশোধ
মানে, নিজেকে ধর্ষণ। নিজের
যোনি নখ দিয়ে ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করে তোলা। আর ধর্ষণ মানে নিরুমাস্টার। ধর্ষণ মানে
একটা স্যাঁতসেঁতে, ঘুপচি স্কুলবাড়ি।
(চলবে)
[মিতুল দত্ত]