বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জীবনে বহুবারই প্রেম
এসেছিল, সে সব ঘটনার মালা গাঁথলে একটা আস্ত রোমান্টিক
কাহিনী হয়ে যাবে। কবির জীবনে এক মারাঠি কন্যা আন্না তরখরের প্রেম নিয়ে কবি একবার
তার অনুজ ভক্তদের গল্প করছিলেন। সে ছিল বঙ্কিম যুগ। সাহিত্যসম্রাটের গল্প উপন্যাসের
নায়ক নায়িকাদের তখন যুবসমাজে খুবই কদর। কবিও কপালকুন্ডলা বিষবৃক্ষ পড়ে কল্পনার
রাজ্যে পারি দিতেন নবকুমার নগেন্দ্র রূপে, আর পাঁচটি বঙ্গ যুবকের মতোই। সে কথাই তার ভক্তদের রসিকতার
ছলে শোনাচ্ছিলেন একদিন। সহাস্যেই বলছিলেন কবি, “কিন্তু স্বপ্নে যাই করি না কেন,
সত্যিকার রোমান্স যে আমার মতোন জনৈক নগন্য,
মুখচোরা, ভয়কাতুরে, অবজ্ঞাত কিশোরের বাস্তব জীবনে ঘটতে পারে এমনতরো স্পর্ধাকে
জাগ্রত অবস্থায় মনের ত্রিসীমানায় আসতেও দিই নি”। এমনই
ছিলেন আমদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈশোরে।
কিন্ত তাঁর ষোলো বছর বয়সে তাঁকে ইংরেজীতে
সরগর করে তুলবার জন্যে, পাঠানো হল বম্বেতে,
একটি মারাঠী পরিবারে। কবির কথায় সেই তাঁর
প্রথম বাড়ি ছেড়ে থাকা। আন্না তরখর, সেই পরিবারেরই কন্যা, তাঁরও তখন ষোলো, কবির ভাষায় ষোড়শী। এবং যেমন শিক্ষিতা তেমনি চালাকচতুর তেমনি
মিশুকে। পরবর্তী জীবনে কবি মেয়েদের যে গুণকে হ্লাদিনী শক্তি বলে প্রশংসা করতেন।
ইংরেজীতে যাকে বলে চার্মিং লেডী। সেই বয়সেই, বিলেত ফেরত আন্নার স্তাবক সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। সেকথাই
বলছিলেন কবি নিজেই সহাস্যে, “সে সময় মেয়েদের
বিলেত যাওয়া আজেকের মতন পাড়া বেড়ানো গোছের ছিল না, মনে রেখো। আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে
আসত। কত ছুতো করে যে ঘুরতো আমার আনাচে কানাচে! আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিত সান্ত্বনা,
প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে”। কবি বুঝতে পারতেন,
ঘটনা ঘটবার মতন কিছু একটা ঘটছে,
কিন্তু সরস দুঃখে অনুজ ভক্তদের বলছিলেন,
“কিন্তু হায় রে, সেটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল
কোনোরকম তৎপরতা না ছিল কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব”।
কবি গল্প করছিলেন,
এক সন্ধ্যাবেলার কথা,
বহুদিনের পুরানো স্মৃতি থেকে,
সেদিনটা ছিল জ্যোৎস্না রাতের মায়াময় এক
পরিবেশ। চারিদিকে অপরূপ আলো হাওয়ার মাতন, কিন্তু কিশোর কবির মন তখন বাড়ির জন্য উতলা। কবির ভাষায়
হোমসিকনেস, মন পড়ে আছে, বাড়ির জন্যে, বাংলাদেশের জন্যে;
“সে বলে বসলঃ আহা কী এত ভাবো আকাশপাতাল!”
বলছিলেন কবি, আন্নার ধরনধারণ জানা সত্বেও একটু যেন কেমন
কেমন লাগছিল তাঁর, আর বিশেষ করে, প্রশ্নের সাথে সাথেই সে যখন কবির খাটের উপরেই
বসে পড়ল। “কিন্তু কী করি- যা হোক হুঁ হাঁ করে কাজ সেরে দিই। সে কথবার্তায় বোধ হয় জুৎ পাচ্ছিলনা, হঠাৎ বললঃ ‘আচ্ছা আমার হাত ধরে টানো তো – টাগ-অফ-ওয়ারে দেখি কে যেতে?’
আমি সত্যিই ধরতে পারিনি,
কেন হঠাৎ তার এত রকম খেলা থাকতে টাগ-অফ-ওয়ারের কথাই মনে পড়ে গেল। এমনকি আমি এ শক্তি পরীক্ষায় সম্মত
হতে না হতে সে হঠাৎ শ্লথভাবে হারমানা সত্বেও আমার না হল পুলক-রোমাঞ্চ
না খুলল রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি। এতে সে নিশ্চয়ই
আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ রকম সন্দিহান হয়ে পড়েছিল”।
কিশোর কবির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আন্না তরখরের
মনে কতটা কি দুশ্চিন্তার উদয় হয়েছিল, সেটা পাঠকের কল্পনার উপর ছেড়ে দিলেও, একথা হয়ত বলাই যায় বিশ্বকবির রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি
পরবর্তীতে কিভাবে কতখানি যে খুলেছিল; সে কথা তাঁর ভক্তদের অজানা না থাকলেও,
আন্নার নিশ্চয়ই অজানাই থেকে গিয়েছিল আজীবন।
আর একদিনের ঘটনার উল্লেখ করে তাঁর আপন
কৈশোরের রোমান্টিসিজমের বাস্তবতার সরূপ বর্ণনা করে কবি বলছিলেন,
“শেষে একদিন বলল তেমনি আচমকাঃ ‘জানো, কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে
তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?’ বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল
নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সে চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করেনি”। কবির কথায় শ্রোতারা হেসে গড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু শ্রোতাদের সেই হাসি আনন্দের মাঝেও
পরিণত রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের সেই স্মৃতি রোমন্থনের মধ্যে কিশোরী আন্না তরখরের সদ্দোত্থিত নবযৌবনের সেই প্রেমের কিশোরসুলভ আবেগের
প্রতি ঝরে পড়ছিল সহমর্মীতার অনুরণন। বলছিলেন কবি, “কিন্তু সেই মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে
আকর্ষণকে কোনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনোদিন। আমার জীবনে তারপর নানান
অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে- বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন- কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করেঃ যে,
কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও
অবজ্ঞার চোখে দেখিনি- তা সে ভালোবাসা যে রকমই হোক না কেন। প্রতি
মেয়ের স্নেহ বলো, প্রীতি বলো, প্রেম বলো আমার মনে হয়েছে একটা প্রসাদ-
কারণ
আমি এটা বারবারই উপলব্ধি করেছি যে প্রতি মেয়ের ভালোবাসা তা সে যে রকমের ভালোবাসাই
হোক না কেন আমাদের মনের বনে কিছু না কিছু আফোটা ফুল ফুটিয়ে রেখে যায়-
সে ফুল হয়ত পরে ঝরে যায় কিন্তু তার গন্ধ যায়
না মিলিয়ে!” এমনই ছিলেন বিশ্বকবি, আজীবন নারীর ভালবাসাকে দেখে এসেছেন বিনম্র শ্রদ্ধায়।
[তথ্যসুত্র- দিলীপকুমার রায়]