এটা বোঝার পর থেকে মায়ের শিক্ষার উপর আমার
ভক্তি আরো বেড়ে গেল ৷ সব বাড়ির মতো আমাদের বাড়িতেও বিজয়া দশমীতে এ বাড়ি ও বাড়ি যাওয়ার রেওয়াজ ছিল ৷
ছোট চেনা জায়গায় এটা আরও বেশী করে হত ৷ বাবাকে একবার লোকজনরা বলে দিল,মাস্টারমশাই,সব বাড়িতে শুধু মিষ্টি খেতে খেতে একেবারে
অরুচী ধরে যায়,আপনার বাড়ির বিজয়াতে একটু অন্য কিছু করুন ৷ সেবার থেকে আমাদের বাড়িতে বিজয়ার দিন লুচি আর
মাংস হত ৷ এখন ভাবি মা কী করে এক হাতে একশো-দেড়শো জনের লুচি বানাতো ৷ আর মাংস অবশ্য একেবারে ছোট ছোট
টুকরো করা হত কীমার মতো ৷দুপুরের মধ্যে মাংস রান্না হয়ে যেত ৷ লুচিও ভাজার আগের
অবস্থায় রেডি থাকত৷ সেদিনও ছিল বিজয়া দশমী ৷ লোকজন অনেক আমাদের বাড়িতে ৷ আমরা মাঠে রোজকার মতো
খেলায় মও ৷ হঠাৎ দিদি এসে বলল মাঠে যতো ছেলে-মেয়ে আছে সবাইকে মা ডাকছে ৷ কেমন জানো লাগল ব্যাপারটা ৷ এই
সময় মায়ের ডাক ৷ বিশজন হয়নি প্রণাম,কোলাকুলি বাকি ৷ সবাই গেলাম দেখলাম উঠোনে দিয়ে কলাপাতা পাতা
৷ আমাদের বসতে বলা হল ৷ আমরা বসলাম ৷ বন্ধুরা সব উৎসাহ চেঁচামেচি করছে ৷ কিন্তু
আমার একটা খারাপ চিন্তা হচ্ছিল ৷ কিছু গোলমাল লাগছিল ৷ মা নিজে সবাইকে একটা করে
লুচি আর অনেকটা করে মাংস দিয়ে যাচ্ছে ৷ আমার সামনে অল্প মাংস দিয়ে বলল,খুব নীচু স্বরে বলল,এত লোভ,ছিঃ – ৷ সেজদা বসে ছিল আমাদের থেকে একটু তফাতে ৷ মা ওর সামনে গিয়ে
পুরো পাএটাই ওর সামনে রেখে বলল,খাও – ৷
সেজদা খেতে খেতেই বলল,অতটা খেতে পারব না,মা বলল,পারবে ৷ ঠিক পারবে খাও ৷ কোনো রকম খেয়ে উঠলাম ৷ বন্ধুরা
খাচ্ছে ৷ আমি গিয়ে ধরলাম দিদিকে ব্যাপারটা জানার জন্য ৷ দিদিও সবটা জানে না ৷ তবে
যে টুকরো স্বগোক্তি মায়ের মুখ থেকে বেরিয়েছে ;তাতে বোঝা গেছে যে আমাদের স্নানের ঘর আর রান্না ঘরের মাঝের
দেওয়ালে ছোট্ট একটা জানলার মতো ছিল ৷ মা বাথরুমে বসে একটা খুট করে আওয়াজ পেয়ে ঐ
জানলার ফুঁটো দিয়ে দেখে যে সেজদা উপুর হয়ে বসে মাংসের পাএ থেকে মাংস বের করে
খাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু নরম বলে পারছে না ৷ পাছে ব্যাপরটা বেশী জানাজানি হয়ে
যায় বা খেতে গিয়ে বিষম খায় তাই চুপ করে ছিল অনেকক্ষণ ৷ সেজদা দু-চারটে মাংসের টুকরো খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে
মা আমাদের ডেকে পাঠায় ৷ কারণ গেস্টদের এত মাংস দিতে পারবে না ৷
সেজদার অনেকগুণ ছিল ৷ কোনো ঝামেলায় থাকত না ৷
পড়াশোনা ছিল তার একমাএ ধ্যান-জ্ঞান ৷ পাড়ায় ওর কোনো বদনাম নেই ৷ বরং ভালো রেজাল্ট করার
জন্য ওকে সবাই একটু সন্মানের চোখে দেখত ৷ কিন্তু ঐ এক গুণ চুরি করে যাওয়া ৷ এটা যে
খাওয়ার জন্য যাওয়া নয়-নেশার জন্য যাওয়া ৷ তখন ফ্রীজ বলে কোনো বস্তু ছিল কিনা জানা নেই
৷ তবে মীটকেস বা মীটসেফ ছিল ৷আজকার দেখা কল্পনা ৷ মীটসেফ কাঠের তৈরী আলমারীর
অর্ধেকের মতো উঁচু হত ৷ দুটো পাল্লা দেওয়া দরজা থাকত ৷ তালা দেওয়ার ও ব্যবস্থা
থাকত ৷ যেটার বিশেষত্ব ছিল সেটা হচ্ছে কাঠের বদলে চারিধারে সরু তারের জাল থাকত ৷
এমনকি পাল্লাদুটোও কপার ফ্রেমে জাল লাগানো থাকত ৷ এতে খাবারটা যেমন হাওয়া পায়,টাটকা থাকে একই সঙ্গে সুরক্ষিত থাকে ৷ মায়ের
একটু এটোর উপর বাছবিচার ছিল ৷ ফলে ওখানে ভাত-ডাল বা অন্য রান্নার কিছু থাকত না ৷ থাকত নাড়ুর বয়েম,আচারের শিশি ৷ হাতে ভাজা কুঁচো নিমকি,
তালের বড়া – এই সব ৷ সেজদা যে সেখানে কী করে চলত সেটা মায়ের কোনো ধারণাই ছিল না
৷ সামনের নেট সব ঠিক আছে-কিন্তু দেওয়াল ঘেষা পিছনের নেট অনেকদিন টেনে
খুলে ফেলেছে সেজদা ৷ আর মাঝে মাঝেই নাড়ুটা,আচারটা সরিয়ে খাওয়া চালাত৷
একদিন মা আমাদের কিছু বন্ধুদের পরীক্ষার
রেজাল্টে খুশি হয়ে মীটসেফ খুলে দেখে একটা নাড়ুর বয়েম প্রায় ফাঁকা আরেকটা মুখটা
আলগা করা ৷ কিছু বোঝার আগেই মা বারান্দার মেঝেটা ঝাট দিয়ে জায়গাটা জল ন্যাকরা দিয়ে
মুছল ৷ তারপর হাত ধুয়ে এসে বলল,আজ হাতে হাতে দেব না ৷ নাড়ুর হরির লুট হবে ৷ যেমন পারো
কুড়িয়ে নাও,বলেই বয়েম দুটো মেঝেতে ফেলে দিল ৷ কাঁচা ভাঙা
আর নাড়ুতে মেঝেতে ছএাকার আমরা খেলা ভেবে কাঁচ বেছে বেছে নাড়ু কুড়ানো খেলায় মাতলাম
৷ শুধু সেজদা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল ৷ চুরি করে কিছু একটা খেতেই হবে এবং অবশ্য চুরি করে
৷ আগেই লিখেছি সন্ধ্যা থেকে আটটা পর্যন্ত আমাদের পড়াশুনোর সময় ৷ তারপর মায়ের
মহাভারত বা রামায়ণ শোনা ৷ মা শুধু পড়ত না,বুঝিয়েও দিত ৷ আমি ক্লাশ এইটের ভালো ছাএ হয়েও যা বুঝতে
পারতাম না,মা সেটা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত ৷ এতে আমরা
অবাক হতাম না ৷ কারণ আমার ধারণা ছিল সব মায়েরাই সব কিছু জানে ৷
মায়ের মহাভারত পড়া চলছে ৷ সেজদা আমাকে হাত
দিয়ে খোঁচা মারছে ৷ অনেকক্ষণ খোঁচা মারার পর ওর সঙ্গে আসর ছেড়ে খাট থেকে নেমে পড়তে
হত ৷ কারণ রাতে তো সেজদার সঙ্গেই আমার শুতে হবে ৷ আমরা দুজন রান্নাঘরে যেতাম ৷
ভাজা-টাজা ধরণের ছোট্ট খাবার তুলে নিয়ে সেজদা নিজে
একটা খেত আর আমাকেও একটা দিত ৷ আমাকে খেতেই হত ৷ সেজদার আমাকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্য
ছিল আমার একটু ভালো স্বভাব বলে নাম ছিল ৷ কাজেই আমি খেয়েছি মানে ওর দোষ কম হবে ৷
শীতকালে আরো আমাদের বিশাল ইট আর মাটি দিয়ে বানানো উনোনের উপর উঠে বসতাম ৷ এতে শরীর
গরমও হত আবার চুরি করে খাওয়াও যেত ৷
পরের দিকে মা ইচ্ছে করে কিছু খাবার বানিয়ে
আলাদা করে পাএে রেখে দিত ৷ সেজদার চুরি করার জন্য ৷ এখন ভাবলে হাসি পায় ৷ এমন কি
সেজদা যখন মাসির বাড়িতে কলেজে পড়ার জন্য গেল,তখন মা মাসিকে বলে দিয়েছিল একটু চুরি করে খাওয়ার ব্যবস্থা
করে দিতে ৷ আর এতেই সেজদার চুরি করে খাওয়ার স্বভাবটা বন্ধ হয়ে গেল ৷
দোমহনীর এত ঘটনার পরেও টুকটাক আরো ঘটনা ঘটে
ছিল ৷ যেমন নাটক করা ৷ কার মাথায় এল নাটক করতে হবে ৷ বাড়ির সামনের মাঠে মায়েদের
শ্রীরামকৃষ্ঞ নাটক হবে ৷ কে কী সাজবে ৷ মেজদা বলল,রামকৃঞ্ষ কমল আর ভানু গিরিশ ঘোষ ৷ আমাদের মধ্যে যে আড়ি চলছে
সেটা মেটানোর জন্যই মেজদা এটা বলেছিল ৷ কারণ মূলত এই দুজনকে নিয়ে নাটকটা ৷ কিন্তু
ভানু বাদ সাধল ৷ এক,আমার সঙ্গে নাটক করবে না ৷ দুই,রামকৃঞ্ষ ও নিজে হবে ৷ পরে অবশ্য সব মিটমাট
হয়ে গেল ৷ ভানু গিরিশ ঘোষই সাজল ৷ আমি গানের গ জানি না আমাকে দিয়ে গায়ানো হল-“ডুব ডুব রূপ সাগরে আমার মন ৷”
বড়রা সবাই কিন্তু নাটক দেখতে এসেছিল ৷ এরপর
হল সুকুমার রায়ের ‘লক্ষণের শক্তিশেল’
এখানেও মেজদা আমাকে রাম বানালো ৷ এর মানে এই
নয় যে আমি রামের মতো দেখতে বা আমি ভালো অভিনয় করি ৷ এটা পরিষ্কার আমার প্রতি
মেজদার দুর্বলতা ৷ এবার ঝামেলা শুরু করল সেজদা ৷ ঔ হনুমান সাজবে না ৷ নাটকে মহরা
চলছে ৷ সেজদা বসে আছে ৷ কিন্তু রিহার্সাল দিচ্ছে না ৷ ও হনুমান সাজবে না ৷ হাসির
নাটক হনুমানের অনেক বড়পাট ৷ কিন্তু হনুমান ও সাজবে না ৷ নাটকের দিন এসে গেল ৷ শেষ
মুহুর্তেও সেজদা গো ধরে বসে আছে হনুমান কখনই না ৷
নাটক শুরু হয়ে গেল ঠিক দিনে ঠিক সময় ৷ মেজদা
বলল,তোর সেজদা ঠিক আসবে,
আর না আসলে আমিই করব ৷ হনুমান আমার সময় হয়ে
গেল দেখি একটা ব্যডমিন্টনেও নেট গায়ে জড়িয়ে সেজদা স্টেজে ঢুকছে এবং সবাইকে মজা
দিয়ে দাপটে পার্ট করছিল ৷
দোমহনীর শেষ বড় ঘটনাটা বলি ৷ বাড়ির সবাই
জল্পেশ্বর মন্দির দেখতে যাবে ৷ কিন্তু বাড়ি পাহাড়ার তো একটা লোক চাই ৷ আমি রাজী
হয়ে গেলাম বাড়ি পাহাড়ায় ৷ দিনের বেলায় আমি একা একা শুয়ে বসে বই পড়ে কাটিয়ে দিলাম ৷
কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই সমস্যা শুরু হল ৷ ভূত ৷ আমার বিশাল ভূতের ছিল ৷ প্রচন্ড
প্রস্রাব পেয়েছে যেতেই হবে ৷ কিন্তু খাটের তলায় যদি ভূত থাকে ৷ নামলে যদি লম্বা
হাত বাড়িয়ে আমার পা টা টেনে ধরে ? যদি খাটের তলার অন্ধকারে আমাকে নিয়ে গিয়ে গলা চেপে ধরে ?
কিন্তু যেতে তো হবেই ৷ হিসাব করলাম ভূতের ভয়
আর শরীরের চাপ-কোনটা বেশী কষ্টকর ৷ শেষে কিছু চিন্তা না করে
এক লাফ দিয়ে খাটের থেকে একটু দূরে ল্যান্ড করলাম ৷ দৌড়ে গেলাম বাথরুমে ৷ বাথরুম
করা আর শেষ হয় না ৷ যতো দেরী হচ্ছে ততবেশী মনে হচ্ছে ভূতেরা এগিয়ে আসছে ৷ পুরোতল
পেটটা বোধহয় খালি হয়নি ৷ প্যান্টে –একটু-আধটু-পড়ছে,আর অপেক্ষা নয় বলে দৌড় খাটে উঠতে গেলাম ৷ আমার ধারণা ভূত সব
খাটের তলায়তেই থাকে ৷ তাই বেশ কিছুটা দূর থেকে লাফ মেরে খাটে উঠতে গেলাম ৷ কিন্তু
দূরত্ব আর লাফের সমতা হল না ৷ হুমরি খেয়ে পড়লাম খাটের মোটা কাঠের উপর ৷ প্রচন্ড
লাগল পায়ের উপরের দিকে ৷ কোনো রকম ঘষটে খাটে উঠলাম ৷ ব্যথা বেশ ভালোই লাগছে ৷ চুপ
করে শুয়ে থাকলাম৷ কিছুক্ষণ পরে অবশ্য সবাই ফিরে এল ৷ মা জিজ্ঞেস করল,কিরে ভয় পেয়েছিস?
আমি কোনো উওর দিলাম না ৷
ঘটনাটা এখানে শেষ নয়,শুরু বলা যায় ৷ আমাকে একা বাড়িতে রেখে যাওয়ার
জন্য মায়ের মনটা খারাপ হয়েছিল ৷ তাই যাওয়ার আগে বলেছিল তোমার কি চাই ৷ আমি বলেছিলাম
সিরাজদৌলা যাএা এলে আমাকে দেখাবে ৷ তারপর অনেকদিন হয়ে গেছে ৷ যাএা দেখার কথা আমি ভুলেই গেছি ৷
কাল থেকে ক্লাশ এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষা ৷ প্রথম দিনই বাংলা ৷ কাজেই একটু পরীক্ষার চিন্তা আর একটু বই-পএ ঘাটাঘাটি করেই সময় যাচ্ছে ৷ হঠাৎ দুপুরে
মা আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে বলল,যাও আজ সিরাজদৌলা যাএা হবে ৷ তুমি বলেছিলে ছোট ফণীর সিরাজ
দেখবে ৷ এই নাও টিকিট ৷
-কিন্তু আমার তো কাল পরীক্ষা ৷
-দেখ,আমি কথা দিয়েছিলাম ৷ এখন টিকিট কেটে দিলাম ৷ এবার তোমার
ব্যাপার ৷
-কিন্তু –
-দেখ,যদি তোমার মনে হয় রাত জেগে রাএে যাএা দেখলে তোমার পরীক্ষা
খারাপ হবে – তুমি ঠিক করবে তুমি যাবে কিনা ৷ এনিয়ে আর কথা
নয় ৷
আমি তো মহা
ঝামেলায় পড়লাম ৷ পুরস্কার এমনও হয় ৷ অনেক ভাবলাম ৷ দাদাদের জিজ্ঞেস করলাম ওরা বলল
যেমন তোমার খুশি ৷ বাবা-মা বরাবর বলত সারাবছর ঠিক মতো পড়লে হয় না ৷
পরীক্ষার আগের দিন হালকা মনে থাকতে হয় ৷ সত্যি কথা পরবর্তী কালেও যতো পরীক্ষা
দিয়েছি পরীক্ষার আগে একদমই পড়তাম না ৷ বিকেলে ঠিক করলাম যাএা দেখতেই যাব ৷ রাত দশটায় তখন যাএা
শুরু হত ৷ শেষ হতে হতে প্রায় চারটা ৷
রাত জেগে শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল কিন্তু
পরীক্ষা যেমন হওয়ার তেমনি হয়েছিল ৷
সেবার আমি আর সেজদা এতগুলো বই প্রাইজ
পেয়েছিলাম যে মায়ের কোলে রাখার জায়গা হচ্ছিল না ৷ মাকে খুশি দেখে আমরাও খুব খুশি
হয়েছিলাম ৷
[কমলেন্দু
চক্রবর্তী]