পর্ব – দশ
সালধর বাড়ি
ছিল বাবার জ্যাঠামশাইদের। আর ঠাকুরদা থাকতেন
ঢাকার শ্রীনগরে। শ্রীনগর বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। যে কোনও ছোটখাটো শহরের মতোই,
সেখানে ব্যাঙ্ক,
পোস্টঅফিস, থানা, স্কুল– সবকিছুই ছিল। আর ছিল মঠ, অনন্তদেবের মন্দির, আর জমিদারবাড়ি। জমিদারবাড়িতে দুর্গাপুজো হত। বাবারা যে বাড়িতে থাকত,
তার উল্টোদিকে একটা দোতলা বাড়ি ছিল,
যেখানে কোনও লোক থাকত না। তার দোতলার ঘরে, পুতুল দিয়ে সাজানো একটা কাঠের আলমারি ছিল।
রায়টের সময় শ্রীনগরে মুসলমান আক্রমণ ঠেকাবে বলে, হিন্দুরা সেই বাড়ির দোতলায় প্রচুর ইট,
পাথর আর তলোয়ার মজুত করে রেখেছিল। মুসলমানদের ভয়ে সেই সময় অনেকের
বাড়িতেই তলোয়ার রাখা হত। সেবার অবশ্য শেষ অব্দি
আর আক্রমণ হয়নি। জানি না,
পুতুলগুলো প্রেতের মতো জেগে উঠে পাহারা দিত
কিনা সেই বাড়ি, ঘুমন্ত মানুষগুলোর সন্ত্রস্ত মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
যেত কিনা তাদের ছায়া। তাদের অনিশ্চিত, অনির্দিষ্ট বেঁচে থাকার দৈর্ঘ্য,
স্বপ্নের মধ্যে নতুন পাতার মতো বেড়ে উঠত
কিনা।
আমার ঠাকুরদা
শ্রীনগরে বেঙ্গল ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার
ছিলেন। দেশভাগের সময় একের পর এক ব্যাঙ্ক ফেল করতে শুরু করে। শ্রীনগরের ব্যাঙ্কও ফেল
করে, ঠাকুরদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই ব্যাঙ্কেরই লৌহজং ব্রাঞ্চে। সেখানকার ব্যাঙ্কও কিছুদিনের
মধ্যেই ফেল করে আর ঠাকুরদার ট্রান্সফার হয়ে যায় বেঙ্গল ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কলকাতা
ব্রাঞ্চে। বউ-বাচ্চা, বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে লৌহজং থেকে স্টিমারে চেপে রাত দশটা নাগাদ গোয়ালন্দ,
পরের দিন গোয়ালন্দ থেকে রাত বারোটার ট্রেন, আর তার পরের দিন সকালে শিয়ালদা স্টেশন।
সেই সময়
হিন্দুরা দলে দলে ও-বাংলা ছেড়ে এ-বাংলায় চলে আসছে। স্টেশনে তিলধারণের জায়গা
নেই। পাছে পরে আর জায়গা না পাওয়া যায়,
সেই ভয়ে ঠাকুরদা রাত বারোটার ট্রেন বেলা
বারোটায় ইয়ার্ডে থাকতে থাকতেই, চড়ে বসলেন গোটা ফ্যামিলি নিয়ে। সন্ধের মধ্যে
সেই ট্রেনে আর মাছি গলারও জায়গা থাকল না। এদিকে বাবার দাদু,
তিনিও যাচ্ছিলেন কলকাতায়,
সন্ধেবেলা তার পেচ্ছাব
পায়। ট্রেনের বাথরুমে ঢোকা অসম্ভব দেখে তিনি
স্টেশনে নেমে পড়েন। বাবাও নেমে পড়ে দাদুর পেছন পেছন আর ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় কোথায়।
তখন বাবার সাত-আট বছর বয়েস। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে যখন পাওয়া গেল,
সে বেচারা ভয়ে, খিদেয়, একেবারে এলিয়ে পড়েছে। আজ ভাবি,
সত্যিই
বাবা যদি সেদিন হারিয়ে যেত। তাহলে তো বাবা-মায়ের বিয়েই হত না আর আমিও হতাম না। অথবা হয়তো হতাম অন্য কোনও বাড়িতে,
অন্য কোনও মায়ের পেটে,
আর হয়তো বা এমনি করেই একদিন সেই বংশের গপ্পো ফেঁদে বসতাম।
কলকাতা
পৌঁছে বাবারা এসে ওঠে দমদমের কাছে দত্তবাগানে,
ঠাকুমার মেজোমামার বাড়িতে। বাবার নিজের মামারবাড়িও ছিল দত্তবাগানে। কিছুদিনের মধ্যে
সেখানেই একুশ নম্বর বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ভারতবর্ষে প্রথম সংসার পাতেন ঠাকুরদা।
ইতিমধ্যে কলকাতার বেঙ্গল ইউনিয়ন ব্যাঙ্কও ফেল করে। এবারে ‘অস্তিত্বসংকট’ শব্দটা আক্ষরিক অর্থেই তৈরি হয়। অগত্যা,
কাগজের ঠোঙা
তৈরি করে দোকানে দোকানে সাপ্লাই। সে সময়
আধসের ওজনের একশো ঠোঙার দাম ছিল তিন পয়সা। যুগান্তর আর বসুমতী,
এই দুটো কাগজ দিয়ে বানানো হত ঠোঙা।
আনন্দবাজার বোধ হয় তখন ঠোঙার উপযুক্ত ছিল না। দেশভাগের তোড়ে ভেসে আসা মানুষগুলোর অনেকেরই
এই ঠোঙা বানানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর মধ্যে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দুনিয়ার ঠগ,
জালিয়াত, চোরচামার। এইরকমই এক ফেরেব্বাজের পাল্লায় পড়েন ঠাকুরদা। রেলে
চাকরি দেবার নাম করে সেই মহাপ্রাণ, ঠাকুরদা আর বাবার মেজোমামার কাছ থেকে তিনশো টাকা নিয়ে হাওয়া। এই
ধাক্কাও সামলে উঠলেন ঠাকুরদা, যখন পাতিপুকুরে মাছের পুরনো বাজারে,
নিজেরই শালার মাছের আড়তে একটা কাজ জুটে গেল।
আর তারপর, যাকিছু জমানো টাকা, তা দিয়ে বেলগাছিয়া বাজারে ছোট একটা মুদিখানা খুললেন। সেই দোকানটা এখনও আছে,
আশ্চর্য!
(ক্রমশ)
[মিতুল দত্ত]