>

বিপ্লব রহমান





সংশপ্তকঃ মানুষের সমাজ ও সভ্যতায় প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি পরিচয়ের পরতে ও পরিসরে, কোনো না কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মের ছাপ থাকেই।  এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে দেখেন?

বিপ্লব রহমান: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটি বেশ খানিকটা সত্যি। আমাদের স্কুল-কলেছের ধর্ম শিক্ষার বইয়ে, ধর্ম শিক্ষার ক্লাসে এবং শুক্রবার জুম্মার নামাজের খুতবায় ইসলাম ধর্মকে মহিয়ান করে তুলতে হিন্দু ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিস্তর বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। এভাবে অজান্তেই শিশু মনে তো বটেই, বয়স্কদের মনেও গেঁথে দেওয়া হয় অন্য ধর্মকে হেয় করে দেখার সংস্কৃতি। এভাবে ঘরে ঘরে বপন করা হয় সম্প্রদায়ীকতার বীজ।  এটি উপযুক্ত আলো-বাতাসে ডালাপালা ছড়াবে না, এমনটি বলতে পারি না। অথচ এই সব পুস্তক লেখক, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও মোল্লারা ভুলে যান, ইসলাম ধর্মেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে সকল ধর্মের সমান অধিকার। এটি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া সম্ভব নয়। আর চাই মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞান মনস্ক মানসিকতার চাষাবাদ। তবেই সমাজ থেকে সব ধরণের সাম্রদায়িকতার আগাছা নাশ সম্ভব। কাজটি কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।

সংশপ্তকঃ সাধারণ জনজীবনে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস কতটা সাম্প্রদায়িক আবেগ প্রসূত, আর কতটাই বা আধ্যাত্মিক চেতনা সম্ভূত?

বিপ্লব রহমান: সাধারণ মানুষ অবশ্য ধর্ম নিয়ে খুব ভাবিত নন। গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব অল্পই উদয়-অস্ত হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পর পাঁচ ওয়াক্ত নামজ পড়েন। তারা মনে মনে আল্লাহ-রসুলকে ভক্তি করেন, শুক্রবার জুম্মার নামাজে কেউ কেউ যান, রোজার সময় অনেকেই রোজা রাখেন, দুই ঈদের নামজ পড়েন, সাধ্যমত কোরবানী দেন, ঈদ উপলক্ষে ছেলেমেয়েদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দেন -- ধর্মকর্ম বলতে এইটুকু। খুব কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন এখনো গ্রামে-গঞ্জে তেমন মেনে চলা হয় না। তাই সাধারণের মনে সাম্প্রাদায়িকতার বোধই নেই। মৌলবাদ, তথা সাম্প্রদায়িকতার শেকড় হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা নামক আসমানী কিতাব নির্ভর শিক্ষা, যার সঙ্গে বাংলার হাজার বছরের অসাম্প্রায়ীক চেতনা, রীতিনীতি, সংস্কৃতি, দেশপ্রেম ইত্যাদির সর্ম্পকই নেইমাদ্রাসাগুলোতে সাম্প্রদায়ীক ধ্যান-ধ্যারণায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা হয় তো বটেই, সেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, তোলা হয় না জাতীয় পতাকা। একজন মাদ্রাসার ছাত্র মক্কা-মদীনার ইতিহাস যতোটা নিবিড়ভাবে পাঠ করেন, বাংলাদেশের ইতিহাস সেভাবে পাঠ করেন না। স্বাভাবিকভাবেই উটের দুধ, দুম্বার মাংস, খোরমা-খেজুর, জমজমের পানি তথা আরবের সংস্কৃতি নিয়ে তারা ফ্যান্টাসিতে ভোগে। বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস, ২১ ফেব্রয়ারি-আন্তর্জািতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর-বিজয় দিবস, তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এসব শিক্ষার্থীর কাছে কোনো অর্থবহন করে না। তৈরি হয় হাজারে হাজারে দেশ, বিজ্ঞান ও বাস্তব বিচ্ছিন্ন মৌলবাদী মানুষ। তারাই আবার সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটান। রাতারাতি অবৈজ্ঞানিক মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়তো কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে দরকার এই শিক্ষা ব্যবস্থাটির আমূল সংস্কার। 

সংশপ্তকঃ এখন প্রশ্ন হলো, কোনো একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ধর্মীয় ধ্যান ধ্যারণার সাথে একাত্মতাই কি মৌলবাদ বলে গণ্য হতে পারে?


বিপ্লব রহমান: অবশ্যই। মৌলবাদী দর্শনের বাহ্য রূপ বা প্রয়োগিক বিদ্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, আর জঙ্গীবাদ। উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠিটি যেমন চেতনায় জন্মান্ধ, তেমনি নেতার প্রতিও অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করে। পরমত সহিষ্ণুতা এদের অভিধানে নেই। আবার ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে মন্দির, হিন্দু বা আদিবাসীর ঘরবাড়ি ধংস করার পর দেখা যাবে দেশান্তরিত অসহায় মানুষজনের জমি-জিরেত, পাহাড়-টিলা, ভিটেমাটি ভোগ দখল করছে। অথাৎ নেহাত পরলৌকিক পুন্য বা সোয়াব কামানো বাদেও ইহলৌকিক স্বার্থও আছে। আবার ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলে রাজনৈতিক পাণ্ডারা সিদ্ধহস্ত। তারাই বিভিন্ন ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন করে, পরে করে সম্পত্তি দখল। মৌলবাদী গোষ্ঠি এখানে ব্যবহৃত হয়।

সংশপ্তকঃ তবুও মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মৌলবাদের সম্পর্ক কতটুকু? অর্থাৎ নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মচর্চার মধ্যেই কি মৌলবাদের বীজ সুপ্ত থাকে না? যেমন আমার ঈশ্বরই স্বর্বশ্রেষ্ঠ, আমার ধর্মগ্রন্থই অভ্রান্ত, আমার ধর্মেই মানুষের সব প্রশ্নের শেষ উত্তর
দেওয়া আছে।


বিপ্লব রহমান: ‌"ধর্মচর্চার মধ্যেই মৌলবাদের বীজ" একটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ ধর্ম কতোগুলো শুভ বুদ্ধির মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি ব্যক্তি মনের বিশ্বাস মাত্র। যেমন, সকল ধর্মই পিতা-মাতাকে ভক্তি করতে বলে। বলে খুন-জখম, ধর্ষন, ব্যাভিচার, লুন্ঠনের বিরুদ্ধে। সত্য কথা ও সত্যবাদীতা প্রতিষ্ঠার কথা বলে ধর্ম। মানুষে মানুষে ভাতৃবোধ, সর্বজীবে প্রেমের কথাও বলে ধর্ম। আর ঈশ্বরের নিবিড় আরাধনার পন্থা হচ্ছে ধর্মের মূল। তো এখানে সাম্প্রদায়িকতার অবস্থান কোথায়? ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেন কিছু অর্ধশিক্ষত মোল্লা ও রাজনীতিবিদরা, যা আগেই বলা হয়েছে। এটি নিছক জেহাদী জোশ বা পূন্যপ্রাপ্তি নয়, বস্তুগত প্রাপ্তিযোগও কম নয়। এ কথা আগেই বলা হয়েছে। "পৌত্তলিকতা হারাম" বোঝাতে গিয়ে ৫৭০ খ্রিষ্টা্ব্দ সময়কার আরব দেশের পৌত্তলিকতা না বুঝিয়ে কাঠমোল্লা যদি গ্রামের গনি মিয়াকে যদু মাস্টারের দুর্গাভক্তিকে বোঝান, তাহলেই বিপদ।

 


সংশপ্তকঃ দেশ কাল পাত্র নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে পুঁজি করেই তো আবহমান কাল ব্যাপি একশ্রেণীর মানুষের ধর্মব্যাবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং সেই ব্যবসাই যাদের পেশা, তারা তো মৌলবাদকেই পরিপুষ্ট করে তুলতে চাইবে ব্যবসারই স্বার্থে।  তাই মৌলবাদের বিরোধীতা করতে হলে, সেই বিরোধিতার অন্তর্লীন অভিমুখটাই কি সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগের বিরোধীতার দিকেই ঘুরে যায় না? এই বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাইছি। যদি একটু বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বলেন।

বিপ্লব রহমান: ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসে দেশকালের কি এমন লাভক্ষতি হয়? সমস্যাটি তৈরি হয় তখনই, যখন ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে রাজনীতির মিশেল ঘটে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিবিদরা যেমন ভোটে জিততে চান, তেমনি ফুলে ফেপে উঠতে ধর্মীয় নেতারা ব্যবহার করেন আবার ধর্মকেই। তারা উস্কে দেন না কুসংস্কার, এমনকি সাম্প্রদায়িকতাও। আর মৌলবাদীরা ধর্মীয় অনুশাসনে দেশ চালানোর খোয়াব দেখতে শুরু করে আমদানী করেছে জঙ্গীবাদ। এরাই বিএনপি আমলে পুলিশী প্রহরায় বায়তুল মোকাররমে সমাবেশ করে প্রকাশ্যে শ্লোগান দিয়েছে, "আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান"। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার যখন সংবিধান সংশোধন করে এতে "বিসমিল্লাহ" যোগ করে, ঘোষণা করে "রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম", তখন দলিলীভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, দেশটি প্রধানত ইসলাম ধর্মের অনুসারিদেরই, অন্য ধর্মের লোকজনের এখানে খুব একটা সুবিধা হবে না। সরকারি এই আস্কারাটিও মৌলবাদী গোষ্ঠিকে সাহস যোগায়। আর সাম্প্রদায়কতার নেপথ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বহুমাত্রিক হিসাব-কিতাব। এ কারণে দেখা যাবে, বাংলাদেশে হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দিরে কথায় কথায় হামলা চালানো হলেও মৌলবাদীরা গির্জায় হামলা করার সাহস পায় না। কারণ গির্জার নেপথ্যে রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার অনুদান। এগুলোতে আচড় পড়লেও ওসি ওয়ার্ল্ড ছেড়ে কথা বলবে না। আগেই বলেছি, মৌলবাদীতার হাত ধরে আসে জঙ্গীবাদ। এরা পরমত সহিষ্ণু নয় বলেই অবিশ্বাসের দর্শনটি নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে। এরাই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে ফেরার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করে মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। এরাই এর আগে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে খুন করেছে। একই কায়দায় খুন করেছে ব্লগার রাজিবকে। আরেক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকেও তারা ধারলো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করার চেষ্টা করেছে। ধর্মীয় লেবাসের নীচে এমনই নৃশংস এদের নগ্ন রূপ।


সংশপ্তকঃ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভরাডুবির পর বিশ্বব্যাপি সমাজতন্ত্রের পতনের পরপরই যেন মৌলবাদ সুনামির মতো আছড়ে পড়েছে আমাদের চারপাশে। এই দুইটি ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে বলে কি মনে হয় আপনার? থাকলে তার রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন আমাদের।

বিপ্লব রহমান: মৌলবাদ একটি সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণা। সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মে পুজিবাদের অগ্রযাত্রায় সামন্তবাদের পিছু হটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে পুজিবাদই সামন্ত দর্শন মৌলবাদকে লালন করেছে, তাকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। আর এখন এই ফ্রাঙ্কেস্টাইন এখন হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। যেমনটি আমরা দেখেছি আফগানিস্তানে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, তথা নাস্তিক কমিউনিস্টদের দমন করতে গিয়ে সেখানে মার্কিনীরা তালেবান গোষ্ঠিকে অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে, এমনকি পপির ক্ষেত গড়ে তুলেও সাহায্য করেছে। সোভিয়েতের পতনের পর আফগান তালেবানরা যখন বন্দুক আমেরিকার দিকেই ঘুরিয়ে ধরেছে, তখন এই ফ্রাঙ্কেস্টাইনকে বিনাশ করাটা তাদের জন্য জরুরী হয়ে পড়ে। ৯/১১ এর পর প্রকাশ্য হয়ে পড়ে যে এই জঙ্গীবাদী গোষ্ঠি ততোদিনে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা দেশে। সে জন্যই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে আফগানিস্তানে আমেরিকাকে রীতিমত সৈন্য পাঠিয়ে তালেবান নাশ করতে হয়েছে। এমনকি সব আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে সরাসরি পাকিস্তানে ঢুকে লাদেনকে খুন করতেও তারা বাধ্য হয়।
অন্যদিকে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের সব জেলায় এক সঙ্গে বোমা ফাটিয়ে জঙ্গীরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। ২০০৮ সালের ২৮ নভেম্বর মুম্বাই বোমা হামলা করে জঙ্গীরা। পুলিশী তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, শীর্ষ জঙ্গী নেতা বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান, আজমল কাসাব -- সকলেই আফগান ফেরত, তালেবানী অস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত  এই প্রেক্ষাপটেই
'বিশ্বব্যাপি সমাজতন্ত্রের পতনের পরপরই যেন মৌলবাদ সুনামি' দেখা যাচ্ছে। আর তালেবান তথা জেহাদী গোষ্ঠির পালনকর্তা পশ্চিমা বিশ্বর মুখোশ লুকাতে প্রয়োজন পড়ে মালালা'র মতো একটি নিস্পাপ মুখকে প্রচারণার কেন্দ্রে নিয়ে আসার।



সংশপ্তকঃ বিশ্বরাজনীতির দিকে নিবিড় ভাবে লক্ষ্য রাখলেই দেখা যায়, আধুনিক বিশ্বের মানচিত্রে যে যে অঞ্চলেই মৌলবাদ বিশেষভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, পরবর্তীতে সেই সেই অঞ্চলেই ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তান যার সফলতম উদাহরণতাই মৌলবাদ কি ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারকেই সাহায্য করছে না?


বিপ্লব রহমান: " আধুনিক বিশ্বের মানচিত্রে যে যে অঞ্চলেই মৌলবাদ বিশেষভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, পরবর্তীতে সেই সেই অঞ্চলেই ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে" -- এটি হতেই হবে। কারণ সমাজ বিকাশের নিয়মেই সামন্তবাদের অবসান এবং পুঁজিবাদের বিকাশ হবে। মার্কিন রাজনীতি বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক বলে তারাই একে নানা রূপ দেয়। কখনো মৌলবাদকে বিকশিত করতে সাহায্য করে, কখনো তা নিয়ন্ত্রণ করে, আবার কখনো আগ্রাসী রূপ নেয়। এর নেপথ্যে উপমহাদেশে ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি তেল-গ্যাস দখলের রাজনীতিও আছে। আফগানিস্তানে আমেরিকা সেটাই করেছে, যা এরই মধ্যে বলেছি। তবু খুব সংক্ষেপে, প্রথমত, আমেরিকা আফগান তালেবান গোষ্ঠি তৈরি করে, সোভিয়েত দমনে তাদের ব্যবহার করে [র‌্যাম্বো-৩ সিনেমাতে প্রচ্ছন্নভাবে এর অনেকটাই ধরা পড়েছে], দ্বিতীয়ত, জঙ্গীবাদীতা বিকশিত রূপ নিলে আমেরিকার তালেবান ধ্বংস করার প্রয়োজন পড়ে, তৃতীয়ত, আফগানিস্তানে দুর্বল নতজানু সরকার গঠনে সেখানের তেল-গ্যাসের ওপর মার্কিন আধিপত্য বহাল থাকে। চতুর্থত, আফগানিস্তানে সেনা ঘাটিঁ প্রতিষ্ঠায় ভারত, পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশ থাকে  মার্কিন দূর পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্রের এবং সমর বিমানের পাল্লার ভেতর।

 
এই সমীকরণটি খেযাল করলে "মৌলবাদ আসলে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারকেই সাহায্য করছে" এমন সরলীকরণ করা যায় না। বরং বেড়ালের লেজ ধরে মাথাটি উল্টে নীচের দিকে ধরে বলতে হয়, সাম্রজ্যবাদই মৌলবাদের বিস্তারকে সাহায্য করছে।

  
সংশপ্তকঃ আর তখনই প্রশ্ন ওঠে মৌলবাদের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কেই। মৌলবাদের সাথে ধর্মের যোগ তবে কতটুকু? ধর্মীয় মৌলবাদ বলে যা প্রচলিত, সেইটি কি আসলে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদেরই ডান হাত নয়?


বিপ্লব রহমান: আমার মনে হয়, ধর্ম, রাজনীতি, মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যোগসূত্র -- ইত্যাদি প্রসঙ্গ এরই মধ্যে ব্যাখ্যা করেছি। আর ধর্মীয় মৌলবাদকে "সাম্রাজ্যবাদের ডান হাত" না বলে "সাম্রজ্যবাদের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন" বললে মনে অনেকটাই বলা হয়।

সংশপ্তকঃ এই যে ধর্মীয় মৌলবাদকেই ঢাল করে বিশ্বায়নের মুখোশ পড়া ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন এর বিরুদ্ধে কি ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে মানুষ?


বিপ্লব রহমান: এটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদ বিরোধী যুগপদ লড়াই চাই। সরাসরি মাঠ পর্যায়ের লড়াইটি বিশ্বের দেশে দেশে গড়ে তুলতে চাই সত্যিকারের দেশপ্রেমী রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন দেশপ্রেমী দলের খুবই অভাব। অল্প যে কয়টি ছোট বামপন্থী দল আছে, তারা সাধ্যমত চেষ্টা করছে স্রোতের বিপরীতে শক্তি সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়ানোর। এর বাইরে সামাজিক আন্দোলনেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন হতে পারে। দেশের তেল-গ্যাস রক্ষার দাবিতে সব ক'টি বাম দল একাট্টা হয়ে এরই মধ্যে জাতীয় কমিটির ব্যনারে গড়ে তুলেছে সামাজিক আন্দোলন। অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদের নেতৃত্বাধীন এই জাতীয় কমিটি সুন্দরবন রক্ষায় দীর্ঘ লং মার্চসহ একাধিক সফল লং মার্চ করে দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছে, সারাদেশে জনমত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।  অন্যদিকে, মৌলবাদ বিরোধী মনোস্তাত্বিক লড়াইটি অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ গণবিস্ফোরণ যুদ্ধাপরাধীদের ফাসিঁর দাবি নিয়ে গড়ে উঠলেও এই মঞ্চ থেকেই দাবি করা হয়েছিল, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। মুক্তমনা ব্লগাররা এই আন্দোলন গড়ে তুললেও শিগগিরই ছাত্র, শিক্ষক, জনতা এতে যোগ দেন। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। আর এতেই মৌলবাদের লেজ ধরে টান দেওয়া হয়। তাই হেফাজতে ইসলাম একই বছর ৫ মে "নাস্তিক ব্লগারদের ফাসিঁ" দাবি করে পাল্টা শো ডাউন করে। শাহবাগ গণবিস্ফোরণ নিভে গেছে, মুক্তমনা অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন, কিন্তু প্রজন্মের চেতনার লড়াইটি শাহবাগ থেকে ছড়িয়ে গেছে এখন সবখানে। সাইবার যুদ্ধ এখন ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে। যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদ গোষ্ঠি, সাম্প্রদায়ীকতা ও সাম্রাজ্যবাদ -- এই লড়াইয়ের টার্গেট। লক্ষ্য মুক্তমনা- বিজ্ঞান মনস্ক গণতান্ত্রিক দেশ গড়া। 

সংশপ্তকঃ সাধারণভাবে দেখা যায় যে যে অঞ্চলের জনজীবনে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানমুখী শিক্ষার প্রসার যত কম, দারিদ্র্য যত  বেশি  কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিধেগুলি যত কম, সেই সেই অঞ্চলেই ধর্মীয় মৌলবাদ  তত বেশি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই মৌলবাদ বিরোধী যুদ্ধে শিক্ষার বিস্তার কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার?

বিপ্লব রহমান: আপনার পর্যবেক্ষণটি যথার্থই। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তার "রানওয়ে" বাংলা ছবিটিতে এ বিষয়টি খুব চমৎকার ও সরাসরি উপস্থাপন করেছেন। অভাবী মাদ্রাসায় পড়া যুবকরাই ধর্ম ব্যবসা, তথা মৌলবাদী চর্চা এমনকি জঙ্গীবাদীকে শুধু মিশন নয়, অর্থ উপর্জানের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তানসহ নানান দেশের কোটি কোটি টাকা অনুদান আছে এইসব কর্মকাণ্ডে। আর অভাবী ঘরের মাদ্রাসায় পড়া ছেলেটি পুলিশের গুলিতে মরার আশংকা জেনেও টাকার লোভে জঙ্গীবাদীতায় ঝাপিয়েঁ পড়ে। মাদ্রাসা শিক্ষা তাকে এই কাজে উস্কানি দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র অভিভাবকরা শিশুটিকে মাদ্রাসায় দেন দুবেলা খাবারের নিশ্চয়তা প্রাপ্তির আশায়। এছাড়া ছেলে মওলানা হলে গ্রামে সন্মান বৃদ্ধি পাবে, মিলাদ, বিয়ে, মুসলমানী, জানাজা ইত্যাদি পড়িয়ে ছেলে দু পয়সা আয় করবে, এমন সুপ্ত বাসনাও থাকে। মৌলবাদীরা তাই চেবানোর জন্য মাদ্রাসা শিক্ষায় সহজেই বিস্তার কচিমাথা পেয়ে যায়।

সংশপ্তকঃ মানুষের ধর্মবোধ মূলত তার নিজ সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় বিধি বিধানের প্রতি অন্ধ আনুগত্য। এই অন্ধ আনুগত্যই জন্ম দেয় ধর্মীয় ভাবাবেগের। যাকে
পুঁজি করে পুষ্ট হয়ে ওঠে ধর্মীয় মৌলবাদ। যে মৌলবাদকেই হাতিয়ার করে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ- তার রাজনৈতিক স্বার্থে।  এই যে অশুভ শৃঙ্খল, এর বেষ্টনি ভাঙতে নাস্তিকতার আলো কতটা ফলদায়ক বলে আপনার ধারণা? বা আদৌ কি তা ফলদায়ক হয়ে উঠতে সক্ষম বলে মনে করেন? নাকি এই নাস্তিকতাও বস্তুত মৌলবাদেরই ভিন্ন প্রকরণ?


বিপ্লব রহমান: আপনি বলছেন, "মানুষের ধর্মবোধ মূলত তার নিজ সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় বিধি বিধানের প্রতি অন্ধ আনুগত্য। এই অন্ধ আনুগত্যই জন্ম দেয় ধর্মীয় ভাবাবেগের। যাকে
পুঁজি করে পুষ্ট হয়ে ওঠে ধর্মীয় মৌলবাদ। যে মৌলবাদকেই হাতিয়ার করে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ- তার রাজনৈতিক স্বার্থে।" এ পর্যন্ত তো ঠিকই আছে। আমরা ওপরে এতোক্ষণ এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এর বিপরীতে শুধু নাস্তিক্যবাদ কোনো অর্থ বহন করে না। ধর্মীয় অন্ধত্ব, মৌলবাদ, সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে চাই সামাজিক আন্দোলন, মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল সংস্কার। এটি একটি সুবিশাল দক্ষযক্ষ আয়োজন। এতে হাজার হাজার মানুষের সতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চাই। আর মুক্তমনার নাস্তিক্যবাদ যুক্তি নির্ভর, বিজ্ঞানমনস্ক। যুক্তিতর্কে ধর্মীয় অন্ধত্ব দূর করাই তার কাজ। তার যুদ্ধ ক্ষেত্র হচ্ছে, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে চেতনার লড়াই। কিছুদিন আগে খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায় জীবন দিয়ে মুক্তমনার এই আন্দোলনে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। 


সংশপ্তকঃ মৌলবাদকে পরস্ত করতে তাই যে, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাচেতনা, যুক্তিবাদী মেধা ও অসাম্প্রদায়িক সহৃদয় মননশীলতার ত্রিবেণীসঙ্গম-এর প্রয়েজন, বর্তমানের ইন্টারনেট বিপ্লব সেই প্রয়োজনের পক্ষে কতটা সহায়ক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন আপনি?


বিপ্লব রহমান: মৌলবাদ বিরোধী চেতনার সংগ্রামটিকে অনলাইন অনেক শানিত করেছে। এখন খুব সহজেই একটি ছোট্ট ফেসবুক নোট বা ব্লগ লিখে লাখ লাখ কোটি কোটি পাঠকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। একটি মূদ্রিত লেখায় খুব বেশী সংখ্যক পাঠকের কাছে এতো দ্রুত পৌঁছানো যায় না। নব প্রজন্ম তাই চেতনার সংগ্রামে অনলাইনে লেখালেখিটিকেই বেছে নিয়েছে,  মৌলবাদের বিরুদ্ধ ঘোষণা করেছে সাইবার যুদ্ধ। শাহবাগ গণবিস্ফোরণ অনলাইন লেখার, তথা বাংলা ব্লগের অমিত শক্তি সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
এই মাধ্যমটি শক্তিশালী বলেই ব্লগার রাজিব হায়দার ও অভিজিৎ রায়কে খুন হতে হয়েছে। মৌলবাদীদের চাপাতির কোপ নিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন। মৌলবাদীরা খুন করে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে তাদের। লেখার জন্য জীবন দেওয়া এখন আর খুব দূরের অতীত নয় কিন্তু মৌলবাদ জানে না, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গলা কাটা যায়, কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা যায় না। অভিজিৎ চেতনার মৃত্যূ নেই। তবে মৌলবাদ বিরোধী মূল সংগ্রামটি অনলাইনের নয়, অফলাইনের, অথাৎ রাজপথের। সে সংগ্রামটি দীর্ঘতর, সমাজব্যাপী, এ কথা আগেই বলেছি। অনলাইন এখানে সহায়ক শক্তিমাত্র।


[Biplob Rahman, Senior Reporter, Kaler-Kantho|
biplobcht.blogspot.com/
Twitter: @biplobCHT
Skype: biplobcht]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.