অর্ধসমাপ্ত পর্ব ৪
মন্দ এগোচ্ছেনা গল্পটা। নিজেই নিজের তারিফ করলাম
মনে মনে। কিন্তু এখনও অবধি সন্তরনের কিছুই পেলুমনি। যাক গে পড়ে দেখি যদি মনে করতে
পারি। আর না হলে কি, বদলে দেবো নাম। পুরোটাই তো আমার হাতে। দুপুরে
ঠাকুরের ভোগ, সে নাকি সোনামন রান্না করে। যদিও কুমারি মেয়ে,
তবু ওর মতো
কেউ পারেনা তাই। কোন একবার নাকি মায়ের শরীর
ভালো ছিলোনা, বৌরা মোটামুটি
দায়িত্ব এড়াতেই ওকে দিয়ে করায়,
কিন্তু মেয়েটা বাজিমাৎ করে দেয়। তারপর থেকে এটাই চলছে, সাথে পরিপাটি করে নৈবেদ্য সাজায়। স্বাভাবিক
ভাবেই আজকেও সোনামনই করছে সব। যথারীতি ক্যামেরা গলায় শমী হাজির;
সবাই ছেঁকে ধরেছে নিজের নিজের ভালো ফটো তোলানোর জন্য। শমীর মতো ফটোগ্রাফার
পেয়ে সদ্ব্যবহার আরকি। শমী হুল্লোড় করছে, ভাইপো ভাইঝি বোনপো বোনঝিদের আব্দার রাখছে,
বৌদিদের পিছে
লাগছে সবই ঠিক কিন্তু চোখ যেন কাকে খুঁজছে।
হঠাৎ "বড়মা আপনাকে
ডাকছেন" শুনে পিছন ফিরে হাঁ করে চেয়ে রইল,
শাড়ী পরে মেয়েটা যেন কতোটা বড় হয়ে গেলো একবেলার মধ্যে। সোনামন বুঝেছে শমী ধরতে
পারেনি সে কি বলেছে তাই আরেকবার রিপিট করল। সম্বিত ফিরল শমীন্দ্রর চুপ চাপ পিছু নিলো।
দুপুরের
পর্ব মিটতে মিটতে প্রায় বিকেল,
শমী নিজের ঘরে ঠিকই,
কিন্তু মন পড়ে আছে
ঠাকুর দালানে। খানিকক্ষন শুয়ে এপাশ ওপাশ করে
ক্যামেরা থেকে ফটো ডাউনলোড করতে বসল। দুপুরে মোট ১০৮ খানা ছবি তুলেছে। বাকিদের গুলো
নিয়ে মাথাব্যথা নেই, আসল ছবি গুলোর জন্যই তো বসা। খেয়াল হোলো দরজা খোলা,
বন্ধ করে নিলো। যে
কেউ হানা দিতে পারে;
তখনই ছবি দেখার জন্য ঝুলোঝুলি করছিলো,
এখন যদি টের
পায় শমী ফটো ডাউনলোড করে দেখছে তো সব এসে
জুটবে আর ছোটোবৌ কে তো এড়িয়ে চলাই ভালো। শেষের দিকের বারো পনেরটা ছবি সোনামনের। মেয়েটাকে দেখে
ইস্তক মনে হচ্ছে ওর নাম পাঁপড়ি,
কেন শমী জানেনা। তবে মন দিয়ে দেখতে থাকে ওর
ছবি গুলো। একটু পরেই দরজায় নক্ শুনে বাস্তবে ফিরলো শমী।
বুঝছে না এক বেলার মধ্যে কি হোলো ওর। তড়িঘড়ি সব বন্ধ করে দরজা খুলল,
ধরা না পড়ে যায়!!
ছোটোরা টানতে
টানতে নিয়ে গেলো ফুচকাওলা এসেছে,
ওরা সব কম্পিটিশন দিয়ে খাবে,
শমীকে ওরা
দলে চায়। এটা এ বাড়ীতে খুব চলে,
মাঝেমাঝেই ফুচকাওলা শুধু এই বাড়ীর জন্যই আসে। এখন শমী আসায় মোটামুটি সবাই ই মেতেছে
হুল্লোরে। যদিও শমী এককালের চ্যাম্পিয়ান ছিলো, তাকে কেউ হারাতে পারতো না। তবে এতো বছরের গ্যাপ পড়ায় শমী একটু এড়িয়েই যাচ্ছিলো;
শুধু ফটো তুলে ক্ষান্ত থাকতে চেয়েছিলো।
কিন্তু ছোটোরা এতো গল্প শুনেছে সাথে দাদা দিদি
বৌদিরাও সেই চিরাচরিত "আরে খা,
এককালে কতো খেতিস,
একদিন খেলে কিসু্য হবে না"
করে জোরজার করে খাওয়ালো। যখন শমী খেতে গেছে ছোটোদের একজন "ছোট্কা, ক্যামেরাটা না সোনামনদি বলল অন্য
কাউকে দিয়ে নিতে,
একটু তেঁতুল জলটল পড়লে খারাপ হয়ে যাবে"
ঠিকই তো বলেছে
মেয়েটা; কিন্তু তাকে দেখতে পেলোনা শমী। ক্যামেরা দিতেই সেটা কোথায়
জানি অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার ঠিক যখন শমী সবার ছবি
তুলবে ভাবছে একবার চাইতেই এসে গেল ক্যামেরাটা। ঠাকুর দালানে সন্ধ্যারতির জন্য অপেক্ষা
করার সময়ে শমী বসে বসে এলসিডি প্যানেলে দেখতে লাগলো ছবি গুলো।
বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে, একা বসে
সময় কাটাতে শমী দেখছে ছবি। কি অবাক কান্ড
শমীর ফুচকা খাবার ছবিও নিখুঁত ভাবে তোলা। কে তুলল? মউলি নাকি __ অন্য কেউ? ভাবতে ভাবতে মউলি হাজির "কি বস্ লুকিয়ে লুকিয়ে কার ছবি দেখছেন?"
খি্রক খ্রিক হাসির সাথে উঁকি দিয়ে দেখে শমীর নিজের ফটো "ওকিরে? তোর ফটো তুললি কখন?"
"আমি তুলবো কিকরে? আমি তো ফুচকা খাচ্ছিলাম,
বুঝতে পারছিনা কে তুলল। আমি তো ভাবলাম তুই নাকি। আচ্ছা আমি যখন ফুচকা খেতে
গেলাম কেউ একজন বলল যে পাঁপড়ি আই মিন তোদের সোনামন নাকি ক্যামেরাটা দিয়ে নিতে বলছে,
ক্যামেরার ওপর কিছু
পড়লে নষ্ট হবে। আমি দিলাম ঠিকই কিন্তু কার
হাতে গেলো ক্যামেরাটা সেটা আর টের পাইনি হুল্লোড়ের চোটে" গলাটা একটু ঝেড়ে মউলি হাসি লুকিয়ে সিরিয়াস
মুখ করার চেষ্টা করে বলল
"এক বেলাতেই এতোদূর?
নাম অবধি দেওয়া হয়ে গেলো?
এতো স্পিডে যাচ্ছিস দেখিস ডিরেলড্ হোসনা। ক্যামেরাটা তোর পাঁপড়ির কাছেই
ছিলো, আমি দেখেছিলাম। কিন্তু
ফটো ও ই তুলেছে কিনা দেখিনি,
তবে বললাম না ও পারেনা হ্যানো কাজ নেই। ডেকে দেবো? জিজ্ঞেস করবি? ওনাঃ, তোর তো আবার কি জানি হয়।"
হাসতে থাকে মউলি, কথা হতে হতে ওদিকে আরতি শুরু হওয়ায় শমীর
উত্তর করা হোলোনা। আরতি দেখতে দেখতে শমী কেমন অস্বস্তি বোধ করতে
লাগলো। সারা শরীর ঘামছে, কি কষ্ট কোথায় কষ্ট নিজেও ধরতে পারছেনা। মা
আরতির আশিস দিতে এসে ওর মুখ দেখে বুঝতে পেরে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। শমী এতো বছর বাদে
অস্বাস্থ্যকর ভাবে পরিবেশিত ফুচকা খেয়ে সামলাতে পারেনি, অসুস্থ হয়ে পড়ল। দিন দুত্তিন জ্বর,
স্যালাইন, জলপট্টি, বেডপ্যান এই সব চলল। শমী পুরো ঘোরের মধ্যে কাটালো। মাঝে
মাঝে বুঝতে পারে তার মা ছাড়া আরোও একজন কেউ আসে
তার সেবা শুস্রূষা করতে, তার পছন্দের সুগন্ধী ফুল দিয়ে যায় সে। জ্বর ছাড়ল
দিন তিনেক পর কিন্তু এই কয়দিনেই যেন বিছানার সাথে মিশে গেছে শমী। সেদিন খুব ভোরে,
ভোর না বলে রাত
শেষে বলা ভালো, যখন একটা দুটো কাকের ডাক শোনা যায় তেমন সময়ে
আধো তন্দ্রায় শমী টের পেলো, খুট্ আওয়াজেএকটা ছায়া মূর্তি ঢুকলো তার ঘরে।
যতোটা সম্ভব কম শব্দে বেডসাইড টেবিলে সুগন্ধী কিছু ফুল রাখল।
তারপর মশারীর ভেতর সন্তর্পনে হাত ভরে শমীর কপালে, হাতের পিঠ দিয়ে ওর গলায়, জ্বরের তাপ আছে কিনা দেখল; কিন্তু বেচারা হাত সরিয়ে নিতে পারলোনা। তার
আগেই খপ্ করে ধরল শমী ডাক দিলো গাঢ় স্বরে গলা নীচু করে "আয়, কাছে প্লিজ"
"তুম্ আপ্ জেগে?" অপ্রত্যাশিত হাতের টানে কেঁপে গেল স্বর,
গুলিয়ে গেলো কি বলা
উচিত, তবে মশারীর ভেতর যেতে বাধ্য হোলো "না জেগে থাকলে তোকে ধরব কিকরে?
আমি ঘুমিয়ে থাকলে তবে তুই আসিস কেনরে?"
ক্লান্ত অভিমানী আওয়াজ শমীর। দেখল অভিমান জমেছে অপর পক্ষেও,
শমী ধরতেই পারেনি
"জেগে থাকলে কিকরে আসব?
ছোটোবৌদি যে বললেন আমায় দেখলে নাকি কি হয়,
আমি যেনে শুনে
কষ্ট দিতে পারি?"
বুকের ওপর হাত চেপে ধরে শমী,
আলতো করে হাত বোলায় পাঁপড়ির হাতে
"হ্যাঁ হয় তো, তোকে দেখলে আমার গলা শুকিয়ে যায়,
বুকের ভেতর ধুপ ধুপ করে,
কিন্তু
তোকে না দেখলে যে আরোও বেশী কষ্ট হয়,
সেটা বুঝলিনা? মেয়েরা নাকি ছেলেদের
চেখের ভাষা পড়তে পারে,
তুই পারিস না এটা বিশ্বাস করতে বলিস?"
"পারিই তো,
তাইতো অসুস্থ হয়ে পড়ায় এসেছি। কিন্তু আর আসব
না" অভিমনীনির
মুখটা বিশাল হাতের পাতায় ভরে, নিজের দিকে ঘোরায় আলতো হাতে শমী
"দেখ অভিমান দেখানোর এটা সময়না,
আমায় আগে সুস্থ করে নে,
তারপর যতো খুশী অভিমান
করিস আমি ভাঙ্গাবো,
তুই না আসলে সুস্থই হতে পারবোনা রে"
"কেন তোমার ওই কে পাঁপড়ি না কি তাকে ডেকে নাও না,
অসুখের সময় যার নাম ধরে আমার হাত টেনে ধরে কি কি সব করছিলে,
বড়মার সামনে" ব্যাঙ্গ করে পাঁপড়ি
"কিঃ?
কি করেছিলাম?" আনন্দের ছোঁওয়া শমীর গলায়,
আস্তে করে আরোও কাছে টানে আড়ষ্ট পাঁপড়ি কে।
"জানিনা কি করেছ,
বড়মা কে জিজ্ঞোস কোরো। ওনার সামনে ইস্,
যা তা করেছ"
"হাত টেনে ধরেছিলাম শুধু?
এহেঃ এখন হলে বেশ হোতো,
তাহলে আরোও কিছু করতাম। আমি বড়মার থেকে জানবো কেন?
যে রিপোর্ট করছে সে ই বলবে আমি এগ্জ্যাক্টলি
কি কি করেছি। আর যদি শুধু টেনে ধরেছিলাম তাহলে বাকি
টুকু এখন সেরে নেবো" দুষ্টুমি করে শমী, বুঝে নিয়েছে পাঁপড়ির তার প্রতি মনোভাব
"শুধু টেনেছ বললাম? আরোও করেছ। দুৎ আমি বলতে পারবোনা। ওই সব
করছিলে বলেই তো বড়মা বললেন 'যার নাম ধরেই ডাকুক,
ছুঁয়েছে তো ওকে,সজ্ঞানেই হোক কি অজ্ঞানে। কাজেই___'
"কাজেই?"
"ওঃ শোনেনা,
বলছিনা বড়মার থেকে শুনে নিও"
"নাঃ,
তোর থেকে শুনবো,
তুই বরং বড়মাকে বা ছোটোবৌকে জিজ্ঞেস করিস
পাঁপড়ি কে"
"কে?
বড়মা জানেন না বলেছেন তো"
পাঁপড়ির গালের পাশের স্প্রিং পাকানো চুলগুলো
আঙ্গুল দিয়ে সরায়,
"তুইরে,
আমি প্রথমদিন তোকে দেখে তোর বড়মাকে বলেছিলাম
এমন একটা মেয়ের বেশ একটা ফুলের মতো নাম দিতে, তোর নাম আমি দিয়েছি পাঁপড়ি, তুই আমার পাঁপড়ি। সোনামন পচা নাম।" বলে পাঁপড়ির দুই হাত ধরে গভীর চুমো দিল শমী,
বাধা পেলোনা দেখে
ক্রমে চুমো ছড়িয়ে পড়ল পাঁপড়ির ফুলের মতো নরম
গালে, কপালে, ঠোঁটে। আনন্দে খুশীতে লজ্জায় চোখ বন্ধ পাঁপড়ির,
বেশ খানিকটা সময় লাগলো কথা বলতে,
গলা দিয়ে
আওয়াজ বেরোতেই চায়না অতিকষ্টে বলে "তুমি বড়মার সামনে আমার হাতে___"
লজ্জায়
একহাতে মুখ ঢাকে। আরেক হাত শমীর দুহাতের
মধ্যে জমা "তাই?"
দুই হাতে
পাঁপড়ির মুখ ধরে শমী "সত্যি বলছিস? কি করবো, শরীর খারাপের সময় তোকে খুব
কাছে পেতে ইচ্ছে করছিলো;
আচ্ছা,
এবার বল এসব করেছি বলে মা কি ডিসিশন নিয়েছেন? বিয়ে দেবেন কি তোর সাথে? নাহলে এতোসব করা তো বৃথা, মায়ের সামনে
আমারও কি কিছুটা লজ্জা লাগেনি?"
বলে হাসছে শমী "মানে? তুমি জেনে শুনে করেছ? শরীর খারাপটা নাটক? ছাড়ো আমায় ছাড়ো, তোমার মতো লোককে বিয়ে করবো না আমি।
তুমি খুব খারাপ"
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে আর ধুপ ধুপ কিল
মারে শমীকে "মারিস না,
দুর্ব্বল মানুষকে মারতে নেই জানিসনা?
খারাপ বলেই তো প্রেমে
পড়লি, আমি গুডি গুডি হলে কি আর পাগল হতিস আমার জন্য?
তাহলে কি এভাবে লুকিয়ে আসতি আমার ঘরে?
আসলে শরীরটা খারাপ হয়েছিলো ঠিকই,
কিন্তু এমন অবস্থা
হয়নি যে ওই সময়ে যা খুশী করবো,
ওটা কিছুটা বানানো ছিলো"
(ক্রমশ)
[মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী]