>

আলপনা ঘোষ

SongSoptok | 2/10/2015 |




গাড়িটা পাহাড় ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছিলো দেহরাদুন থেকে মুসৌরির পথে, সুধা পুরনো দিনের কথা মনে করছিলেন বিয়ের পরে পরেই শেখর ওনাকে নিয়ে মুসৌরি গিয়ে ছিলেন, কোনদিন সুধা পাহাড় দেখেননি, খুব ভালো লেগেছিলো তখনও মার্চ মাস ছিলো, পাহাড় লাল বুরাঁশ ফুলে ভরা ছিলোবড়ো বড়ো গাছের মাথায় থোকা থোকা টুকটুকে লাল ফুল ফুটে আছে পাহাড়ে যেন আগুন লেগে আছে  তখনও পাহাড়ী বাচ্চা মেয়েরা বুরাঁশ ফুলের গুচ্ছো নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো, কচি মুখ গুলো হাসিতে ভরিয়ে টুরিস্টদের আকর্ষণ করতো, আজও ছোটো ছোট স্কূল ড্রেস পরা বাচ্চা মেয়েরা তেমনি পথের ধারে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করছে

আজ শেখর আর ছোটী সঙ্গে রয়েছে ছোটি খুব উত্তেজিত, ও কোনো দিন পাহাড় দেখেনি প্রত্যেকটা মুহুর্ত উপভোগ করছেযতো উপরে উঠছে ততো ঠান্ডা বাড়ছে.শাল জড়িয়ে নিলেন সুধা ছোটী বলে উঠলো "মাম্মি দি এলো না, দি আসলে কী মজা হতো" বলেই ফোন লাগালো রিমিকে "দি কী সুন্দর জায়গা তুমি এলে কতো ভালো হতো" রিমি জবাব দিলো "যে কাজে যাচ্ছিস  সেটা ভালো করে কর" " হ্যাঁ দি কিন্তু ভয় করছে একটু " ভয় করলে তো চলবে না একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজে জয়েন করতে যাচ্ছিস মনে রাখিস" জানি দি কিন্তু তুমি সঙ্গে থাকলে....." “কিচ্ছু ভয় নেই আজ তোর সব স্বপ্ন পুরণ হচ্ছে” ছোটী ফোন সুধার হাতে দিল " মাম্মি দি র সঙ্গে একটু   কথা বল সুধা ফোন হাতে নিয়ে রিমির সঙ্গে একটু কথা বললেন শেখরও মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন    "আজ তুই থাকলে কতো ভালো হতো

আজ ছোটির বিশেষ দিন, ও আজ ইণ্ডিয়ান আডমিন্স্ট্রেটিব সার্ভিস একাডেমীতে জয়েন করতে যাচ্ছে সবাই খুবই খুশী। সুধা পুরনো দিনের স্মৃতিতে ডুবে গেলেন যখন ছোটি ওর মা লক্ষ্মীর সাথে প্রথম ওনাদের কোয়ার্টরে আসে তখন রিমি চার বছরের কাজের লোক খুঁজছিলেন সুধা, কলেজে চাকরী করেন বাড়িতে রিমিকে দেখাশোনা করার জন্য ভালো একজন লোক চাইছিলেন সেই সময় লক্ষ্মী এক বছরের ছোটিকে নিয়ে এলো ওনার পছন্দ ছিলনা যে ছোটো বাচ্চা নিয়ে কেউ বাড়িতে বাচ্চা দেখা শোনা করুক কিন্তু শেখর বললেন থাক না রিমির সঙ্গে খেলা টেলা করবে, ওর মন ভালো থাকবে সেই থেকে লক্ষ্মী আর ছোটি রয়ে গেলো বাড়িতেলক্ষ্মীর আসল নাম লছিযা,পাহাড়ী মেয়ে, ওর স্বামী অসুস্থ বলে ও  কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলো সুধার বাড়িতে এসে ও হয়ে গেলো লক্ষ্মী। একেবারে নিজের মতো করে বাড়ির সব কাজ করতো আর রিমিকে দেখাশোনা করতো সুধা নিশ্চিন্ত ছিলেন ধীরে ধীরে রিমি বড়ো হতে লাগলো, সুধা ও শেখরের বাড়িতে এসে লক্ষ্মীও একটা আশ্রয় পেয়েছিলো সেজন্য ও খুব কৃতজ্ঞও ছিলো এবং ভালো করে কাজ করতো, রিমিকে নিজের মেয়ের মতো দেখতো

ধীরে ধীরে রিমি বড়ো হতে লাগলো, স্কূলে যেতে শুরু করলো.স্কুল থেকে ফিরে রিমি ছোটিকে টিচার সেজে পড়াতো, টিচারের মতো করে এ বি সী ডী বোর্ডে লিখে শেখাতো, ছোটি বাধ্য ছাত্রীর মত বসে থাকতো  ছোটি যখন পাঁচ বছরের হলো তখন শেখরই বললেন  ওকেও স্কুলে দিলে হয় ছোটির তখন একটা ভালো নাম চাই, রিমিই নাম ঠিক করলো- রুনি, রুনি থাপাছোটি কাছেই একটা স্কূলে যেতে আরম্ভ করলো, স্কূলে ওকে রুনি থাপা বলে জানে, কিন্তু পাড়ায় সকলে সুধার ছোটো মেয়ে বলে রিমিই ওর পড়াশোনা হোম ওয়ার্ক করানোর ভার নিলো দুজনের বেশ ভাব ছিলোসময় কেটে যেতে লাগলো ছোটি পড়ার সাথে সাথে ঘরের কাজও সুন্দর শিখে গেলো বাড়িতে পার্টি ইত্যাদি হলে লক্ষ্মী, ছোটি আর সঙ্গে রিমি মিলে সব কিছু নিখুঁত করে রেডি করে দিতো সুধাকে কিছুই প্রায় দেখতে হতো না

রিমি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো ভালো রেজাল্ট করে ক্লাস টেন পাস করে উচ্চমাধ্যমিক সাইন্স নিয়ে পড়া শুরু করলো, ছোটিও নিজের ক্লাসে ভালই রেজাল্ট করছিলো রিমির দেখা শোনায় শেখর, সুধা আনন্দে ছিলেন পাসের কোয়ার্টারে ডাক্তার বীথি ছিলো সেও মাঝে মধ্যে ওদের সাহায্য করে দিতো বায়োলোজি পড়ায়বারো ক্লাসেও রিমি ভালো রেজাল্ট করে আইআইটিতে পড়তে চলে গেলো তখন ছোটি ক্লাস সেভেনে ওর প্রাণের দি দূরে চলে যাওয়ায় ওর মন খুব খারাপ হলো রিমি ওকে সাহস দিয়ে বল্লো  “তোর যা জিজ্ঞেস করার আমি সব ফোনেই বলে দেবো তা ছাড়া বাবা, মাম্মি তো আছেই প্রায় বছর দুই পরে রিমি গরমের ছুটিতে বাড়ি এলো সঙ্গে বন্ধু আকাশ রিমির সঙ্গেই পড়ে দুজনে মেলামেশা করছে আকাশের বাবা চা বাগানের মালিক ওদের বিশাল চা এস্টেট আকাশ একমাত্র ছেলে দুই বাড়ির বাবা মা জানে এবং ঠিক আছে পড়া শেষ হলে দুজনে বিয়ে করে বিদেশে পড়তে যাবে আকাশ বেশ মিশুকে ছেলেবাড়িতে আনন্দের হাট, সারাক্ষ্ণন গল্প, খাওয়া দাওয়া, বিকেলে বাগানে ব্যাডমিন্টন খেলা, রাত্রে ডিনারে ছোটির নানারকম পদ বানিয়ে তার দি কে আর আকাশকে অবাক করে দেওয়া, বেশ চলছিলো একদিন রিমি ওর স্কূলে টিচারদের সঙ্গে দেখা করতে গেলো শেখর ওকে স্কূলে নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে গেলেন, সুধাও কলেজে গেলেন ছোটির ওপর দায়িত্ব রইলো আকাশকে দেখাশোনা করার লক্ষ্মী সেসময় তার অসুস্থ স্বামীকে দেখতে দেশে গিয়েছিলোআকাশ খুশি হয়ে বল্লো "আমার অনেক প্রজেক্ট বাকি আছে সেগুলো করে ফেলবো, কিরে ছোটি মাঝে মাঝে কফি খাওয়াবি তো?” ছোটি রাজী রিমি চলে গেলো স্কূলে বিকেলে ফিরে দেখে আকাশ মনোযোগ দিয়ে নিজের প্রজেক্ট করছে কম্পুটারে আর ছোটি নিজের ঘরে শুয়ে আছে রিমি জিজ্ঞেসা করলো কী হয়েছে রে ছোটি শুয়ে কেনো?  আকাশকে কফি করে দিয়েছিস তো?”  ছোটি উঠে পড়লো মুখটা গম্ভীর, কালি মাখা, বল্লো "হ্যাঁ দি দিয়েছি, একটু মাথা ধরেছে তাই"রিমি উত্তর দিলো  ও কে দেন; ঠিক আছে তাহলে মাম্মি আসলে আজ আমরা শুধু গল্প করবো, আজ আর খেলা হবে নাসন্ধ্যে বেলায় সকলে মিলে ডাইনিং টেবিলে বসে অনেক গল্প হলো শেখর ওদের ভাবী প্ল্যানের কথা জানতে চাইলেন- আকাশ পাস করে বিদেশে যাবার জন্য এখন থেকেই চেষ্টা করছে, রিমি এখনো ঠিক করতে পারছে না কী করবে বিদেশে তো সবাই যায় দেশে থেকে ভালো কিছু করা যায় কিনা দেখছে, ছোটি নিজের ঘরে শুয়ে থাকলো শরীর খারাপ বলে

পরের দিন সকালে আকাশ ঘোষণা করলো তার অনেক প্রজেক্ট বাকি আছে তাই চলে যাবে রিমির   যাবার এক সপ্তাহ আগেই চলে গেলো যাবার   সময় ছোটি খুব কান্নাকাটি করে নিজের ঘরে লুকিয়ে রইলো, রিমি অনেক ডাকাডাকি করে ও সাড়া পেলো না সুধাও অবাক হয়ে গেলেন ও তো কোনদিন এরকম করে না রিমিরা চলে গেছে প্রায় মাস চার হবে, একদিন সুধা কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসে পেপার পড়ছিলেন এমন সময় রিক্সায় করে ছোটি সঙ্গে একজন টিচার এসে গেটের কাছে নামলোসুধা অবাক হয়ে গেলেন ছোটি তো হেঁটেই আসে আজ কী হলো?সঙ্গে টিচার ও এসেছে সুধা তাডাতাডি গেটের কাছে গেলেনছোটির মুখ শুকনো, হাত পা কাঁপছে, টিচার রিক্সো থেকে নেমে বললেন ওকে ঘরে নিয়ে চলুন তারপর বলছি ছোটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইযে দিলেন সুধা, টিচারকে জিজ্ঞেসা করলেন কী হয়েছে ছোটির?” টিচার বলেন ওর প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে তাই ওকে বাড়ি নিয়ে এসেছি আপনি  এখন ওকে  কোনো ডাক্তার দেখান” . টিচারকে গেট অবধি পৌঁছে দিয়ে দৌড়ে পাসের কোয়ার্টরে বীথিকে ডাকতে গেলেনডাক্তার বীথি এলেন ছোটিকে দেখতে। ওকে পরীক্ষা করে একটু গম্ভীর হয়ে বল্লেন ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসো সুধা,  সুধা নার্ভাস হয়ে জিজ্ঞেসা করলেন "কিছু সিরিয়াস নাকি?" বীথি কেবল বললেন ওকে নিয়ে এসো আমি হাসপাতাল যাচ্ছি সুধা ছোটিকে গাড়িতে নিয়ে হাসপাতাল গেলেন অনেকক্ষণ পরীক্ষা করার পর বীথি সুধাকে ভিতরে ডাকলেন আর যা বললেন তাতে সুধার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, একি কথা!! বীথি সুধার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন  হ্যাঁ ওর এবরসন হয়েছে প্রায় তিন মাস সুধা ধপ্ করে বসে পড়লেন মাথায় হাত দিয়ে ছোটি মুখ লুকিয়ে কাদঁছে। সুধা কী করবেন বুঝতে পারছেন না অবিশ্বাস্য! বীথি কী ঠিক বলছে? আবার বীথিকে জিজ্ঞেসা করলেন "তুমি ঠিক করে দেখেছো তো?” “হ্যাঁ সুধা আমি ডাক্তার, সব সময় এই কাজই করছি হ্যাভ পেসেন্স বাড়ি নিয়ে যাও, ওকে রেস্ট দাও এখন ও মানসিক ভাবে খুবই কষ্টতে আছে সুধা আর থাকতে পারছেন না, শেখর কে ফোন করে শীঘ্র বাড়ি আসতে বললেন বাড়িতে আসতে আসতে ছোটিকে কোনো প্রশ্ন করলেন না, কিন্তু বাড়িতে এসে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না লজ্জায় ঘেন্নায় সুধা নিজেকে নিয়ে কী করবেন বুঝতে পাচ্ছেন না, ছোটিকে বার বার জিজ্ঞেসা করতে লাগলেন কার সঙ্গে এই কাজ করেছিস?” রাগে ওর ওপর হাত উঠিয়ে ছিলেন, এমন সময় শেখর এসে ওনার হাত ধরে ফেললেন সব কিছু শুনে শেখরও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ছোটি বিছানায় মুখ লুকিয়ে রয়েছে, দুচোখে জলের ধারা 

রাত কী ভাবে কেটে গেলো বাড়ির কেউই বুঝতে পারলেন নাঅজস্র চিন্তায় ডুবে রইলেন কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না সকাল আটটার সময় রিমিকে ফোন করে সব বললেন, এও বললেন ওনারা দুজনেই কোনো সল্যুসন খুঁজে পাচ্ছেন না রিমি বল্লো  "মাম্মি ওকে কিছু বলো না এখন, আমি পরশু আসছি ওর সঙ্গে কথা বলবো"  সুধা, শেখর কেউই নিজের কাজে গেলেন না ছোটি সেই মুখ গুঁজে শুয়ে রইলোপরদিন সুধা ছোটির স্কূলে গিয়ে জানতে চেষ্টা করলেন ওর কোনো ছেলে বন্ধু স্কূলের আসে পাসে ঘুরে বেড়ায় কিনা, ওর বন্ধুদের জিজ্ঞেসা করলেন তারা কিছু জানে কিনা, সকলে একই কথা বল্লো ছোটি খুবই শান্ত ভালো মেয়ে মাথা নিচু করে স্কূলে আসে কোনো ছেলে বন্ধু নেইতারা সবাই ওকে অত্যন্ত ভালো মেয়ে বলে জানে সুধা আরও মুস্কিলে পড়লেন কোনো সূত্র পাওয়া গেলো না পাড়ায় আসেপাসে কোয়ার্টরে গিয়ে একই প্রশ্ন করলেন, তারাও সকলে একই কথা বল্লো ছোটি অত্যন্ত ভালো মেয়ে, কোনো ছেলেন ছেলে বন্ধু কেউ দেখেনি.

পরদিন সকালে বীথি এসে সান্ত্বনা দিলো সুধাকে,  ছোটিকে ওর ঘরে গিয়ে দেখে এলো। চা করে শেখর আর সুধাকে জোর করে খাওয়ালো সুধা ছোটির দিকে তাকতেও ঘেন্না বোধ করছেন যাকে নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করে তুলছিলেন একি কাজ করলো? উনি ঠিক করলেন লক্ষিকে ডেকে পাঠাবেন আর ওর সঙ্গে ওকে দেশে পাঠিয়ে দেবেন, এরকম মেয়েকে ঘরে রাখবেন না আকাশ পাতাল ভেবেও কোনো কুল কিনারা পাচ্ছেন নাদুদিন ওই ভাবেই কেটে গেলোতৃতীয় দিন সকালে  রিমি এলো, সুধা প্রচন্ড রাগ দুঃখে ফেটে পড়ে রিমিকে সব ঘটনা জানালেন রিমি চুপ করে শুনে একটু অবাক হয়ে গেলো সে তার ছোটিকে ভালো ভাবে চেনে, সে কী করে এই কাজ করলো? রিমি মাকে শান্ত করে বল্লো "আমি দেখছি মা" বলে ছোটির ঘরে গিয়ে ছোটির বিছানায় বসলো রিমিকে দেখে প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ছোটিরিমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, কোনো কথা নেই, অনেকক্ষন চুপ করে বসে রইল রিমিও ভাবনায় পড়ে গেলো কী করে এমনটা হলো? রাতেও রিমি ছোটির ঘরেই থাকলো রাতে একবার সুধা দেখলেন দুজনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে পরদিন সকালে রিমি বল্লো "মা আমার কাজ আছে আমি আজকেই যাব" সে কি! তবে যে বললি তোর সেমেস্টার ছুটি পনেরো দিন, আজকেই যাবি কেনো?” সুধা অবাক হয়ে বলে উঠলেন রিমির মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর, মুখটাতে যেন  কেউ কালি  মাখিয়ে দিয়েছেসুধা কিছুই বুঝতে পারছেন নাবললেন “তুই ছোটির ব্যাপারে কিছুই করলি না আর তুই চলে যাবি ?”  মা আমাকে যেতেই হবে কাজ আছে, রাতের ট্রেনে রিমি চলে গেলো পরের দিন রিমির কোনো ফোন এলো না সুধা আরও চিন্তায় পড়ে গেলেন শেখরের কাছে নিজের চিন্তা ব্যক্ত করতেও দিধা বোধ করছেন কিন্তু শেখরই রিমিকে ফোন করে জানলেন সে ভালো ভাবে পৌঁছে গেছে রিমির এরকম ব্যাবহার সুধার কাছে অস্বাভিক মনে হলো কারণ রিমি ফোনের ব্যাপারে খুবই পার্টিক্যুলর 

সুধা লক্ষ্মীকে ডেকে পাঠিয়েছেন জরুরী তলব দিয়ে নিশ্চিত করে নিয়েছেন ছোটিকে ওদের দেশে পাঠিয়ে দেবেন কয়েক দিনের মধ্যেই লক্ষ্মী চলে আসবে ততোদিনও যেন সুধা স্থির থাকতে পারছেন না ওর দিকে তাকিয়ে দেখতেও ঘেন্না বোধ করছেনবীথি মাঝে মাঝে এসে ওদের সান্ত্বনা দেয় বাড়িতে যেন পিন ফেললেও শোনা যাবে এমন নিঃশব্দতা কদিন কেটে গেছে, হঠাৎ রিমির ফোন "মা আমি আসছি" আবার সুধা অবাক! এই তো কাজ আছে বলে একবারে তাড়াতাড়ি চলে গেলো, আবার এখন আসছে? কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছেন না ইতিমধ্যে লক্ষ্মী এসে গেলো. সব শুনে লক্ষ্মীও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর ছোটিকে ঘরে গিয়ে মারধর করতে লাগলো শেখর অনেক কষ্টে থামালেনলক্ষ্মী কেবল সুধার পা ধরে বলতে লাগলো আমার মেয়ে আপনাদের লজ্জিত করেছে, আপনি ওকে মেয়ের মতো দেখেন আর ও কিনা এই রকম পাপ করলো একবার আপনাদের কথা ভাবলো না? আপনারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন ও তার মান রাখতে পারলো না? হায় ভগবান! বলে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলোবাড়িতে বিশ্রী অবস্থা সেই সময় রিমি এসে পৌঁছলো রিমি এসে শুনলো ছোটি ওর মায়ের সঙ্গে চলে যাবে হঠাৎ অস্বাভিক জোরে চিৎকার করে বল্লো "না ছোটি কোথাও যাবে না" শেখর অন্য ঘরে ছিলেন, ছুটে এলেন কী হয়েছে জানতে চাইলেনরিমি আবার অস্বাভিক গলায় বল্লো  ও কোথাও যাবে নাসবাই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে, ছোটির চোখে অনুনয় সুধা বলে উঠলেন "কে নেবে ওর দায়িত্ব?" কখন কী করবে কে দেখবে? রিমি জোর গলায় বলে উঠলো "আমি, আমি নেবো ওর সব দায়িত্ব আজ থেকে আমি ওর গার্জেন, ও আমার রেস্পোনসিবিলিটি সকলে অবাক, সুধা বললেন "কি বলছিস তুই ভেবে দেখেছিস?" রিমির উত্তর "হ্যাঁ মা অনেক ভেবে আমি বলছি" সকলে চুপ যে যার ঘরে চলে গেলেন, নিশ্চুপ অবস্থায় রাতের খাওয়া হলো ছোটি আর রিমি একঘরে, সুধা বেডরুমে লক্ষ্মী পায়ের কাছে বসে শেখর বাইরের বারান্দায় অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন প্রায় মাঝ রাতে রিমি বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, শেখর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন আয় মা বস, বড়ো ধকল গেছে যাওয়া আসা তাই না?” বলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন অনেকক্ষন চুপ করে বসে থেকে রিমি আস্তে করে বল্লো  "বাবা আকাশের সঙ্গে আমার ব্রেক আপ হয়ে গেছে" শেখর চমকে উঠলেন  "সেকি! আমি আর তোর মা যে বিয়ের প্লানিং করতে শুরু করে দিয়েছি কী এমন হলো বল তো? রিমি চুপ ইতিমধ্যে সুধা ওদের কথাবার্তা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, জিগ্য়েস করলেন কী হয়েছে? সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেনআমার বাড়িতে কার নজর পড়লো? চারিদিক থেকে কেবল খারাপ খবর, একি হলো ভগবান!”  রিমিকে একটু রাগত স্বরে জিগ্য়েস করলেন তোমাদের মধ্যে আবার এর মধ্যে কী হলো একেবারে ব্রেক আপ? এই কিছুদিন আগে আকাশের মায়ের সাথে বিয়ে নিয়ে কথা হলো, উনিও তো খুশি ছিলেন এর মাঝে এই নিউজ, তোমরা অল্প বয়সে কোনো ডিসিসন খুব তাড়াতাড়ি না ভেবে, না জিজ্ঞাসা করেই নিয়ে নাও, আমাদের কথা ভেবে দেখেছো?” রিমির গলায় এক আর্ত্ চিৎকার "মা" বলেই বাবার কোলে রিমি মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলোসুধা বা শেখর কিছুই বুঝতে পারছেন না কী এমন হলো মেয়ের, শেখর কিছু না বলে শুধু মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন কখন রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটলো কেউ বুঝতে পারলেন না লক্ষ্মী চা করে আনলে চায়ে চুমুক দিয়ে শেখর রিমিকে আস্তে করে বললেনকারণ বলতে তোমার যদি আপত্তি না থাকে,তাহলে  বলতে পারো রিমি উঠে চলে গেলো সুধা অত্যন্ত দু:খী হয়ে বসে থাকলেন

দুপুর বেলায় রিমি নিজের ঘরে শুয়ে ছিলো চোখ খোলা সুধা পাশে গিয়ে বসলেন, আস্তে   করে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন সুধা বললেন  “মা আমি তোকে খুব রুড ভাবে বলেছি না? আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিস তো?” রিমি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো"মা আমি আর পারছি না, আর আমি পারছি না” “কী হয়েছে মা তুই আমাকে বলবিনা মা আমার?” মা আকাশ ......... “কী হয়েছে? আকাশ কী বলেছে?” “না মা আকাশই ছোটিকে ......”  কী বলছিস! না না এ ভুল কথা ছোটি মিথ্যা কথা বলছেনা মা আমি সেই জন্যই গিয়ে ছিলাম, ছোটি আমাকে কিছুতেই বলছিলো না যে কে ওর সঙ্গে এরকম করেছে শেষে তোমাদের দিব্যি দিয়ে ও বলেছে, ও তোমাদের ভগবানের মতো মনে করে তাই তোমাদের কথা বলেই ওর থেকে কথা বার করতে পেরেছি তারপর আমি গিয়ে জখন আকাশকে জিজ্ঞেস করলাম ও নির্বিকার ভাবে বল্লো তাতে কী হয়েছে ও তো তোমাদের চাকরানীর মেয়ে ও আই সি! ছোটি গট প্রেগন্যান্ট? গেট অবর্টেড দ্যাটস অল, এতে এতো এক্সাইট হবার কী আছে? আফটার অল সী ইজ এ মেইড ওনলি, হোয়াট ইজ দা বিগ ডিল?”  শুনে আমার সারা গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো আমি ওকে এক চড় মারতে হাত উঠিয়ে ছিলাম আমার হাত মুচড়ে দিয়েছে হাত এখনো কালসিটে পড়ে আছে, সুধা হাত দেখলেন সত্যি অনেকটা জায়গা কালচে হয়ে আছে, রিমি বলে গেলো মা তুমি ওর আসল চেহারা দেখলে ঘেন্না করবে, কথা বলার সময়  আকাশ একেবারে রিলাক্স ছিলো, কোনো টেনশন ওর চেহরায় ছিলো না যেন এটা একটা সাধারণ ঘটনা, আসলে ও মানুষের চেহরায় একটা দানবআমি নিজের ওপর ঘেন্না করছি কেন আমি ওর সঙ্গে মেলামেশা করলাম? কেনো আগে আমি বুঝতে পারলাম না ওকে? ট্রেনে বার বার মনে হয়েছে ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে জীবন দিয়ে দিই, শুধু তোমাদের কথা আর ওই সবে বড়ো হওয়া ছোটির জন্য পারিনি, মা আমি তোমাদের লজ্জায় ফেলেছি মা, তাই না মা? মা আজ ও আমাদের দায়িত্ব, ওকে আমি মানুষ করে তুলবো ও কেবল চাকরানীর মেয়ের পরিচয়ে বড়ো হবে না ও নিজের পায়ে দাঁড়াবে মা তুমি আমাকে সাহায্য করবে না মা?”  সুধা চোখের জলে ভেসে গিয়ে মাথা হেলিয়ে সন্মতি দিলেন কাতর গলায় এই কটা কথা বলে মাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো সুধাও ওকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ভেসে গেলেন বহুক্ষণ কেটে গেলো বীথি এসে ঘরে ঢুকল কিছু না বলেই বসে থাকলো লক্ষ্মী বীথিকে দেখে চা করে নিয়ে এলোসুধা নিজেকে সামলে উঠে বসলেন বীথির সঙ্গে কয়েকটা সাধারণ কথা হলো বীথি রিমিকে ধৈয্য ধরতে বললেন, ওকে সান্ত্বনা দিলেন আবার আসার কথা বলে বীথি হাসপাতালে ডীউটি করতে চলে গেলেন

সেই দিন থেকে রিমি ওকে কাউনসেলিং করতে শুরু করলো ওকে বল্লো "তোকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতেই হবে এবং ভালো রেজাল্ট করতেই হবে অনেক চেষ্টা করে ওকে রাজী করিয়ে রিমি ফিরে গেলো নিজের পড়ার জায়গায় আকাশ অনেকবার রিমির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে রিমি ফোন কেটে দিত অন্তরটা জ্বলে উঠতোশেষে আকাশ নিজের মাকে দিয়ে ফোন করাতো রিমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে উত্তর কাটিয়ে দিত 

ছোটি দি র মান রাখতে আবার পড়াশোনা শুরু করলো এবং ভালো ফল করে ওর দি র মান রাখলো রিমি ওকে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে উৎসাহ দিলো ছোটি সাইন্স পড়তে চাইলো না, রিমি ওকে আর্টস্ নিয়েই পড়তে বল্লো ছোটি মন দিয়ে পড়াশুনা শুরু করে দিলোরিমি ওকে সব সময় ফোন করে পড়ার বিষয় উৎসাহ দিতো, আর সব সময় ওকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য তখন থেকেই তৈরি হতে বলতো ছোটি মন প্রাণ দিয়ে দিদির কথা রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলোসুধা এক আধবার রিমিকে বিয়ের জন্য অনুরোধ করেন কিন্তু রিমির এক কথা "আমাকে বিয়ের জন্য এক বারও বলবে না আমি কাউকে বিয়ে করবো নাছেলেদের প্রতি তার মনটা এমন বিষিয়ে গেছে যে বিয়ে করার কথা ভাবতেই আতঙ্ক হয় রিমির এখন একমাত্র লক্ষ ছোটিকে তৈরি করা সুধা মন মরা হয়ে থাকতেন, উনি ভেবে ছিলেন হয়তো কিছুদিন গেলে রিমি ভুলে যাবে কিন্তু রিমির কোমল মনের দাগ মেলনো কঠিন ছিলো শেখরও সুধাকে রিমিকে বিয়ের জন্য জোর করতে বারণ করতেন. শেখর ছোটিকে পড়াশোনায় যা কিছু প্রয়োজন সব জোগাড় করে দিতেন ছোটি তার মাম্মি বাবার মান রাখার জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করতে লাগলো ইতিমধ্যে রিমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে হায়দ্রাবাদ চলে গেছে চাকরী করতে কিন্তু ওর একমাত্র লক্ষ ছোটিকে পড়ানো ওর মাস মাইনের অর্ধেক পয়সা ছোটির বই ইত্যাদি কিনতে কিনতে খরচ করতো একদিন সকলের পরিশ্রমের ফল ফললো ছোটি সীভিল সার্ভিস পরীক্ষার দুই লেভেলই, প্রিলিমিনারি আর ফাইনাল, দুটোতেই সাফল্য লাভ করলো সেদিন রিমি ছুটি নিয়ে চলে এলো সুধা, শেখর ছোটি রিমি লক্ষ্মী সকলে মিলে বাড়িতে বড়ো পার্টির ব্যাবস্থা করলো তাতে বীথি মুখ্য অতিথি হলো লক্ষ্মী মেয়ের সাফল্য কতটা না বুঝলেও কিছুটা আন্দাজ করে বাড়িতে নারায়ণ পুজোর ব্যাবস্থা করলো, অনেক দিন পরে বাড়িতে আনন্দের হাট বসলো রিমি ওকে ইনটারভিউএর জন্য তৈরি করার দায়িত্ব নিলো কিছুদিন ছুটি নিয়ে রিমি ছোটিকে তৈরি করে দিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলো আজ ছোটি ইন্টারভিউ পাস করে চলেছে মুসৌরি ইণ্ডিয়ান সীভিল সার্ভিস একাডেমীতে জয়েন করতে রিমি যেন দুনিয়াকে দেখাতে চায় বাড়িতে কাজ করলেই তার সঙ্গে যেমন খুশি ব্যাবহার করে তাকে নরকে ঠেলে দিলে কেউ প্রতিবাদ করবে না এমনটা নয় রিমি তার জীবন যুদ্ধে জয় লাভ করলো চাকরানীর মেয়েকে একজন নিজের পায়ে দাঁড়ানো আই এ এস অফিসার করার পণ পূর্ণ করে নিজেকে গ্লানির হাত থেকে মুক্ত করলো সুধা তার মেয়েকে নিয়ে আজ গর্বিত সুধা স্মৃতির সমুদ্র থেকে উঠে এলেন, গাড়ি মুসৌরি ম্যাল এর কাছে দাঁড়ালোশেখর বললেন এখানে একটু চা খেয়ে তারপর একাডেমিতে যাওয়া যাক


[আলপনা ঘোষ]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.