পরগাছা পর্ব- ৯
কিন্তু একথা এখন থাক। আরও আগে, যখন আমার জন্ম হয়নি, আমার মা-বাবার বিয়ে হয়নি, আমার ঠাকুর্দা গোপালপুর স্কুলে পড়াতে পড়াতে আমার দস্যি, গেছো মা-কে দেখে তার ভাবী পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করে ফেলেননি, তারও অনেক আগে, ১৯৪১ সালের ১১-ই মার্চ, অবিভক্ত বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমার অন্তর্গত সালধ নামের অজ-গাঁয়, যখন আমার বাবা পৃথিবীর হাওয়ার মধ্যে মুণ্ডুটি বের করে চারদিকে এত আলো, এত অদ্ভুত দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কেঁদে উঠছে, সদ্যজাতর কান্না শুনে হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসছে পাড়া-পড়শিরা, তখনই কি শুরু হয়ে যায়নি এই লেখার গৌরচন্দ্রিকা? আজ হয়তো আমি লিখছি, আমার আগে কি বাবা পারত না, তার আগে কি ঠাকুর্দা পারতেন না এসব লিখতে? আসলে আমি তেমন কিছুই করছি না, ঘটনা ঘটনার মতোই ঘটে গেছে, আমি শুধু যেমন দেখেছি, যেমন শুনেছি, অনেকটা সেভাবেই, যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করে সাদা পাতায় নামিয়ে আনছি তাদের। যেসব কথা সেভাবে মনে পড়ছে না, তার ওপর রং চড়াচ্ছি সাধ্যমতো। যাতে মিথ্যেটাকেও মিথ্যে বলে ধরতে না পারেন পাঠক, আর ঘটনার সাক্ষীরাও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে যান।
সালধর যে বাড়িতে বাবা জন্মেছিল, সেই বাড়িতে থাকতেন বাবার জ্যাঠামশাইরা। মহেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা, সম্ভবত তিনিই সালধর এই বাড়িটা কিনেছিলেন চার-পাঁচ বিঘে জমিসমেত, মোট্টে দুটাকায়। ভাবা যায়! রাধাকৃষ্ণের মন্দির ছিল বাড়িতে। বাবার কাছে শুনেছি, ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে ভয়ংকর সাইক্লোন বয়ে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম, এমনকী সালধর বাড়ির বাগানের একটা গাছও আস্ত ছিল না, অথচ অদ্ভুতভাবে বেঁচে যায় সেই রাধাকৃষ্ণের মন্দির। আপাদমস্তক গাছপালায় ঘেরা থাকলেও, একটা গাছও সেই মন্দিরের ওপর পড়েনি।
বংশের সবাই রাধাকৃষ্ণের সেবাইত হলেও, আমার ঠাকুর্দা ছিলেন কালীভক্ত। গোপালপুরে বাবাদের বাড়িতে কালীপুজো হত। ঠাকুর্দাই পুজো করতেন। পুজো বলতে, সারারাত জেগে কালীর গান গাওয়া। নিজের লেখা, নিজের সুরে কালীর গান। যখন নিজেকে ঘোরতর নাস্তিক ভাবার চেষ্টা করতাম, মূর্তিপুজোকে আমাদের হিন্দুদের ন্যাকামি আর পয়সার শ্রাদ্ধ বলে মনে হতোৎ, তখন এইসব কথা শুনলে বিরক্তিতে নাক কোঁচকাতাম। তারপর একদিন, সেটা ছিল পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের রাত। ছাদে চেয়ার পেতে বসে আছি। তখনও গ্রহণ লাগেনি, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। হঠাৎ একটা গান এল, "তুমি আসবে তাই সন্ধ্যা হবে যামিনী / তুমি দরজা খুলবে আর সব ভাসিয়ে দেবে তাই / সাজানো সকালগুলো ওলটপালট করে যাই"। আমি গাইতে লাগলাম ওই কটা লাইন, একবার, দুবার, তিনবার, বার বার। হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন শুনছে গানটা। হয়তো পাশের বাড়ির কেউ। হয়তো রাস্তায় হেঁটে যাওয়া দুএকজন মানুষ। হয়তো ছাদের পাশের সুপুরিগাছটা। হয়তো হাওয়া। হয়তো চাঁদকে গিলতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যাওয়া পৃথিবীর ছায়া। হয়তো লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, সূর্যের মতো একটা তারার পৃথিবীর মতোই জ্যান্ত একটা গ্রহে, অনেক উঁচু বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে, আমার মতোই একটা মেয়ে তাদের চাঁদের গ্রহণ দেখছে। যদি কোনও মহাজাগতিক ছিদ্রপথে তার কাছে গিয়ে পৌঁছোয় আমার গান? কী ভাববে সে? অবাক হয়ে যাবে কি খুব? গুন গুন করবে কি আমার গানের ওই কটা লাইন? মনে হল, এই সবকিছুর নাম যদি 'ঈশ্বর' দিই, তাহলে আমার গান ছোট্ট একটা সেতু। সামান্য একটা যোগাযোগ। যা আমাকে এই মহাবিশ্বের সুরের সঙ্গে এক স্কেলে বেঁধে দিচ্ছে। তাহলে মা কালীকে যদি অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার ভাবি, সেক্ষেত্রে আমার ঠাকুর্দার কালীর গানও কি সেই একই উদ্দেশ্যে গাওয়া হত না? আজ আমি চোখ বুজলেও দেখতে পাই, রাত্রির থেকে অন্ধকার, ছোট্ট একটি কালীমূর্তি, টিমটিম করে জ্বলছে মাটির প্রদীপ, দুচারজন আধোঘুমন্ত শ্রোতা ঢলে পড়েছে এ ওর গায়ের ওপর, আর প্রতিমার সামনে তন্ময় হয়ে গান গেয়ে চলেছেন আমার ঠাকুর্দা। রাত্রি ক্রমশ নিজের শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছে তাকে। গান গাইতে গাইতে, মহাকালী অন্ধকারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যাচ্ছেন তিনি।
(ক্রমশ)
[মিতুল দত্ত]