>

শর্মিষ্ঠা ঘোষ





সংশপ্তক:  আপনার লেখালেখির সূত্রপাত সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন। সময়ের পরিধিতে এবং পরিবেশের প্রেক্ষাপটে। জীবনের বিভিন্ন পর্বে কোন কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আপনার জীবনদর্শনের গড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন?

শর্মিষ্ঠা ঘোষ: তখন বছর এগার... হাতে এলো প্রথম ডায়েরি ... লিখতে শুরু করলাম নিজেকে ... বরাবরই বড্ড চুপচাপ ... বইএর পোকা, উচ্ছল সঙ্গীদের মাঝে একটু ভাবুক গোছের, বড্ড অভিমানী, যে কোন জমায়েতে মিশতে পারি না, দূর থেকে বরং অবজারভ করি, তারপর বিশ্লেষণ ... এইসব ভালোলাগা মন্দলাগা বলবো কাকে? সুতরাং আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির মত সেই ডায়েরিই আমার প্রথম বুজুম ফ্রেন্ড ... আর আমাকে নাড়া দিয়ে যাওয়া সেসবই ভরিয়ে তুলতে লাগলো পাতার পর পাতা... এই করতে করতে একদিন লিখে ফেলা প্রথম কবিতা আমার প্রথম দুরন্ত ক্রাশ কে নিয়ে, তারপর একে একে অগুন্তি পায়ের ছাপ এই সমুদ্রবেলায়, আর গুনতে চাই না, শুধু দেখে যাই, বুকে রাখি ... কোনদিন বলা হল না সেসব কথা, তারা রয়ে গেল লেখাতেই। পরে বড় হয়ে পুড়িয়ে ফেলেছি সমস্ত ডায়েরি, চলে গেছে বহু লেখা, আফসোস নেই, তারা আমার জীবন ভিতের এক একটা ইট, আমি আজানু স্বীকার করি সেই ঋণ ... করবো আজীবন ...ক্লাস সিক্স , হাতে এলো পরিচয়পত্রিকা,’আনন্দমেলা, ‘কিশোর ভারতী, ‘কিশোর মন’, ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’, ‘দেশএর পাশাপাশি সেই প্রথম সিরিয়াস সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি ... জ্যেঠু ইন্সটিটিউট লাইব্রেরির মেম্বার, হাতে করে আনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সন্তোষ ঘোষ , সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় , অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় , শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর পাশাপাশি এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’, ‘লা নুই বেঙ্গলি’, ‘মৃচ্ছকটিক’... আম্মার ( ঠাকুমা) বইএর ভাণ্ডারে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, কালিদাসের পাশাপাশি নবকল্লোল’, সত্যজিত রায় ... ক্লাস এইট, তুমুল বন্ধুত্ব ঋতচেতার সাথে, ওর বাবা বাংলার শিক্ষক, বাড়ি তে পুরো গান কবিতা উড়ে বেড়ায়, ওর প্রভাবে পড়তে শুরু করা রাশিয়ান সাহিত্য, আধুনিক বঙ্গ সাহিত্যের পাশাপাশি ... পড়তে শুরু করা ষাট সত্তর দশকের কবিতার দিকপালদের... তার আগে কবি বলতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল , জীবনানন্দ, সুকান্ত, সত্যেন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, সুকুমার, দীনেশ দাশ দের বুঝতাম ... বাবার মাসতুতো ভাই, সাহিত্যিক তপন কিরণ রায়,  বাবার কলিগ কবি নীরদ রায় ... এদের দেখছি, জানছি, প্রভাবিত হচ্ছি ... 

আমার ছাত্রজীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেলসন ম্যানডেলার মুক্তি, সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, পেরেস্ত্রইকার খোলা হাওয়া, তিএন আন মেনের ছাত্র নিধন, ফরাসী বিপ্লবের তিনশো বছর পূর্তি, সাহিত্যে তার ব্যাপক প্রভাব ...পড়ছি, আলোচনা শুনছি, অল্প কিছু বুঝি, নাড়া খাই, আমিও ক্রমে প্রেমে পড়ে যাই সমাজতন্ত্রের ... এভাবেই আমার ফর্মেটিভ ইয়ার্স ভরে উঠেছে অনেকের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ছোঁয়ায় ... আজও আমি শিক্ষানবিশ, সবার আমি ছাত্র ... আক্ষরিক...অর্থেই... 


সংশপ্তক:  বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব এবং আপনার জীবন  ও সাহিত্যসাধনার যাত্রাপথে বিশ্বকবির ভূমিকা ঠিক কি রকম?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ:  দেখুন, বাংলা কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব একটা জানাশোনা বিষয়, সেই নামকে বাদ দিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করা যায় না, আর এ নিয়ে বলতে গিয়ে সকলেই একটা থিসিস নামিয়ে দিতে পারবেন। আমি আকাডেমিক লাইনে হাঁটতে চাই না, বরং বলি তাঁর সাথে আমার আত্মীয়তার কথা। তখন বছর পাঁচ ছয় বয়স আমার। সহজপাঠএর দুই খণ্ডে তাঁর সাথে আলাপ সম্পন্ন। মা তাঁর গান গুনগুন করে। রেডিও চালিয়ে শোনে কণিকা, সুচিত্রা, সাগর সেন, জর্জ বিশ্বাস, ঋতু গুহ, সুবিনয় রায় দের রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমায় গানের কাকুর কাছে শিখতে দিল তাঁর গান। কাকু একটা করে গান শেখায়, অর্থ বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করে পুচকেটাকে যথাসম্ভব, তা না হলে ভাব আসবে না, গানে দরদ আসবে না, প্রাণ আসবে না ... এই করে একটু একটু করে তাঁর দর্শনের সাথে পরিচয়। প্রকৃতি, প্রেম  পূজা, বিচিত্র, স্বদেশ, আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গানে ঝুলি ভরতে থাকে, প্রেম আর পূজা সেখানে একাকার, ক্রমশ ভানু সিংহের পদাবলী এলো, কাকুর কাছেই প্রথম শেখা সঞ্চয়িতাথেকে তাঁর কবিতার আবৃত্তি, বাবার সকাল শুরু হয় গীতাঞ্জলী’, ‘নৈবেদ্য’, ‘সঞ্চয়িতারকবিতা আবৃত্তি করে, আমি ও তাঁকে করে ফেলতে থাকি প্রাণের আরাম, আত্মার আনন্দ, মনের শান্তি ... আর সে বন্ধন ঘুচল না ...

কবিতা লিখতে গিয়ে তাঁর প্রভাব টের পাই এখনো যখন জীবন দর্শন কিম্বা পরমাত্মার প্রতি প্রিয়র প্রতি ভরসা সমর্পণ বিশ্বাসের কথা আসে ... এখনো প্রেমের কবিতা লিখতে গেলে সামনে এসে দাঁড়ায় আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী’, অথবা, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে’...তখন সচেতন ভাবে তাঁকে সাইড করতে হয়, সবই যে বলে গেছেন, আর কি বাকি আছে এই নিদারুণ ফিলিং আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, মাঝে মাঝে বড্ড অসহায় বোধ করি, তারপর নিজেকে ভাঙতে বসি, গড়তে থাকি মানডেন শব্দের তাসের ঘর ...

সংশপ্তক:  রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’; একজন সাহিত্যিকের প্রত্যয়ে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখাটা কতটা জরুরী বলে আপনার মনে হয়? আর বিশ্বাসভঙ্গেরর দহন তার প্রতিভাকে কি ভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে? বা আদৌ পারে কি?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ: হুম, আমি বিশ্বাস করি এই কথা আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ... মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ ... মানুষ মানুষকে সাময়িক আঘাত দিতে পারে তার ব্যাবহারে , তবু দিনের শেষে আমিও তো দাঁড়াই আমার জীবন দেবতার মুখোমুখি, ধন্যবাদ জানাই আমার সমস্ত প্রাপ্তির জন্য, যা পাই নি, যা পেয়ে হারিয়েছি, তার জন্য মানুষকে দোষারোপ করি না, ভাবি, সেসব আমার পাওনা নয় ... মানুষের এত কি সাধ্য আছে সে কাউকে কিছু দেবে বা কেড়ে নেবে ... ভবিতব্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, যার যেটুকু প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি তার দায় মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা, আকাঙ্ক্ষা, সততার পাশাপাশি তার ওপর ও শেষমেশ বর্তায় তো।
বিশ্বাসভঙ্গ মানে যন্ত্রণা, অভিজ্ঞতা, কষ্টের সাঁকো পেরিয়ে সত্যে পৌঁছনো, আলোতে উত্তরণ ... এসব মানুষকে শেষমেশ ঋদ্ধ করে , প্রকৃত মানুষ করে ... লেখায় সেই ছাপ পরোক্ষে পড়তে বাধ্য ... যে ইনফারনোর আগুনে সে পোড়ে তার কিছু ফুলকি তো ছিটবেই এদিক ওদিক , কিছু তো ঝলকাবেই তার দেখার ধরণে , আত্তীকরণের মাধ্যমে যে ব্যাথার অলঙ্কার পরেছে সে, তার কিছু..দ্যুতি..তো..থাকবেই..তার..প্রকাশ..ভঙ্গিমায়...

সংশপ্তক:  রবীন্দ্রনাথের যুগের পর আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি! জীবন ও সাহিত্যের ভিতর ও বাইরে ঘটে গিয়েছে বিপুল পরিবর্ত্তন! আজকের দিনে  সাহিত্যে আধুনিকতা বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে কোথাও কি একটা আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করেন আপনি? নাকি বাংলাসাহিত্য আরও বেগবান হয়ে আধুনিকাতার পরিসরটিরই আরও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে বলে মনে হয় আপনার?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ: না, না, থেমে থাকার কোন সিন ই নেই ... এটা একটা ধারা ... যার উপনদী শাখানদী আছে, সে একাধারে গ্রহণ করে, বিকশিত করে নিজেকে তেমনি অন্যকে প্রভাবিতও করে ... সাহিত্যে যুগ পরিবর্তন খুব স্পষ্ট ভাবে দেখি আমরা ভাষা, ছন্দ , ইমেজারি, সিম্বল, গঠন, বিষয় বৈচিত্র্য, পোস্ট মডার্নিস্ট নানারকম ইজম এর ব্যাবহারে ... জীবনযাত্রা যত বিজ্ঞানে সমর্পিত হয়, তার ভাবনা সেই অনুযায়ী আবর্তিত হয় ... বেসিক ইন্সটিঙ্কট ঠিকই থাকে, আর সব প্রকাশের রাস্তায় বাঁক আসে নতুন নতুন ... পরীক্ষা নিরীক্ষা সবসময় স্বাগত, আই কিউ আর ই কিউ মিশিয়ে প্রাণের মননের মগজের যে কবিতা লেখা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত কাল বলবে কে থাকবে আর কে হারাবে ...

সংশপ্তক:  সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যেকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এবং এই সমাজসচেতনতার প্রসঙ্গে সাহিত্যিকের দেশপ্রেম রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ: সাহিত্যিক সমাজের অঙ্গ হিসেবে তার দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। আর যে কোন সামাজিক জীবেরই স্বাজাত্য বোধ, রাজনৈতিক অবস্থান থাকবেই। নিরপেক্ষতা বলে অবশ্য একটা ব্যাপার থাকে, যা সাহিত্যিকরা অনেকসময় সঙ্কীর্ণ স্বার্থে প্রয়োগ করে থাকেন ... কিন্তু আমি হয় এদিকে নয় ওদিকে, সেটা আমার বিবেক বলে দেবে, বোধ বলে দেবে, চেতনা বলে দেবে, সার্বিক মঙ্গলাকাঙ্খা বলে দেবে, কিন্তু আমি চোখ কান বুজে মাঝ রাস্তা বরাবর হাঁটতে পারি..না..দুর্ঘটনা..এড়িয়ে..খুব..বেশি..সময়...

সংশপ্তক:  সাহিত্যসাধনা বা কাব্যচর্চার প্রসঙ্গে কবি  জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।  তাই এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি, এবং কেন?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ: শুধু জীবনানন্দ নন, আমাদের রবীন্দ্রনাথ কিম্বা ওদেশের টি এস এলিয়ট ও তাঁদের প্রবন্ধে একই কথা বলে গেছেন। এলিয়ট তাঁর ‘Tradition and Individual Talent’, প্রবন্ধে বলেছেন, সুস্পষ্ট ইতিহাস চেতনা কতটা জরুরি আধুনিকতাকে ঠিকঠাক ধরতে গেলে। তিনি বলছেন, ‘Tradition is a matter of much wider significance. It cannot be inherited, and if you want it you must obtain it by great labour. It involves, in the first place, the historical sense, which we may call nearly indispensable to anyone who would continue to be a poet beyond his twenty-fifth year; and the historical sense involves a perception, not only of the pastiness of the past, but of its presence; the historical sense compels a man to write not merely with his own generation in his bones, but with a feeling that the whole of the literature of Europe from Homer and within it the whole of the literature of his own country has a simultaneous existence and composes a simultaneous order. This historical sense, which is a sense of the timeless as well as of the temporal and of the timeless and of the temporal together, is what makes a writer traditional. And it is at the same time what makes a writer most acutely conscious of his place in time, of his contemporaneity.

আরও একটু তাকে টেনে আনার লোভ সামলাতে পারছি না, যেখানে তিনি বলছেন, ‘No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appreciation is the appreciation of his relation to the dead poets and artists. You cannot value him alone; you must set him, for contrast and comparison, among the dead. I mean this as a principle of esthetics, not merely historical, criticism. The necessity that he shall conform, that he shall cohere, is not one-sided; what happens when a new work of art is created is something that happens simultaneously to all the works of art which preceded it.’

সংশপ্তক:   এই যে স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- নিজের চারপাশের প্রবাহমান সময়ের সাথে আত্মসংলগ্নতা এগুলি একজন সাহিত্যিককে কি আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে  সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ: কখনোই নয়, শেকড় বলে একটা জিনিস থাকে মানুষের, তার খোঁজেই সে উচাটন। সে বড় মর্মান্তিক, যদি কেউ সেই মূল থেকে উৎপাটিত হন। V.S.Naipal তার ‘A House for Mr. Biswas’, এ সেই খোঁজ দেখিয়েছেন। Nothing comes out of nothing. সুতরাং গ্লোবাল হতে গেলে আপনার কথায় স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- নিজের চারপাশের প্রবাহমান সময়ের সাথে আত্মসংলগ্নতা ইত্যাদি বিসর্জন দিতে হবে এমন নয়। আপনি তো ওয়াচ টাওয়ারে বসেও Bird’s Eye View পেতে পারেন, তাই..না?


সংশপ্তক:   আধুনিক জীবনেরর গতি সর্বস্বতা ভোগবাদী সংস্কৃতি সাহিত্যকে কি ক্রমেই কোণঠাসা করে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে বলে মনে করেন আপনি? গত এক দশকে, গোটা বিশ্বে ইনটারনেট বিপ্লবে আপনি বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতটা আশাবাদী?

শর্মিষ্ঠা ঘোষ: দেখুন, সাহিত্য সংস্কৃতি বরাবরই ব্যাক্তি কেন্দ্রিক, সমষ্টিগত উদ্যোগ কখনো কোন প্রচেষ্টাকে সার্থক করার জন্য গ্রহণ করা হলেও সকলের অবদান সমান নয়। যে কোন মানুষের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সে যে সময়ে বাস করছ, সেটাই আধুনিক। এই যেমন প্রত্যেক সন্তানই তার বাবা মা কে পুরনো দিনের মানুষ মনে করে। ভিক্টোরিয়ান যুগে যখন মানুষের বিবর্তন নিয়ে বাইবেলের তত্ব নাকচ হয়ে গেল, তখন ও বিজ্ঞান আর ধর্মের সংঘাতের মধ্যেও অবিস্মরণীয় সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। আবার ছাপাখানার আবিষ্কার বা শিল্পবিপ্লবেও সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। দৃষ্টিভঙ্গী বদলায়, ফর্ম বদলায়, বিষয় আসে নতুন নতুন, জটিলতা বাড়ে, সাইকো অ্যানালিটিকাল অ্যাপ্রোচ দ্যাখা যায় অধিক মাত্রায়, তাতে ক্ষতি কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘Modern Poetry’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘After flowing straight for a while, most rivers take a sudden turn. Likewise, literature does not always follow the straight path; when it takes a turn that turn must be called modern. We call it adhunik in Bengali. This modernity depends not upon time but upon temperament. The poetry to which I was introduced in my boyhood might have been classed as modern in those days. Poetry had taken a new turn, beginning from Robert Burns, and the same movement brought forth many other great poets, such as Wordsworth, Coleridge, Shelley, and Keats.’ 
কাজেই যুগধর্মে সাহিত্য কোণঠাসা হতে পারে, এ আমি মানি না।
আর গোটা বিশ্বে ইনটারনেট বিপ্লবে সাহিত্যের আখেরে লাভ বই ক্ষতি কিছু হয় নি। হবে না। সে আরও বরং পুষ্পে পল্লবে শোভিত হয়ে উঠবে। দুনিয়া যখন একটা মাউস ক্লিক ব্যাবধানে তখন আমরা আরও বেশি পৌঁছতে পারবো আগ্রহী পাঠকের কাছে, আরও বেশি নাগালে পাবো গোটা বিশ্বে কোন প্রান্তে বসে কে বঙ্গসাহিত্য চর্চা করছে, তার খবর। কোটি কোটি ব্লগ, ই বু , ই ম্যাগ আরও প্রসার ঘটাবে ... সঙ্কুচিত করবে না কোনমতেই।


সংশপ্তক:  আমাদের সমাজসংসারে নারীর অবস্থান আপনাকে কতটা ও কিভাবে বিচলিত করে? আপনার ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিন ছন্দে এর প্রতিফলনের সরূপ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত ভাবেই জানতে চাইছি।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ: সত্যি কথা বলতে কি, নারীদের অবস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে এর পক্ষে বিপক্ষে দুই ই বলতে হয়। মনু বাণী শিরোধার্য করে যখন বিধি নিষেধের বেড়াজালে তার ক্ষমতা, সামর্থ্য, যোগ্যতা বেঁধে ফেলার চেষ্টা হয়, বা শারীরিক গঠনগত ফারাকের কারণে সে যৌন লালসার শিকার হয় তখন যেমন রাগ হয়, একই রকম রাগ হয় নারী যখন নিজেকে অযোগ্য, অসহায়, পরনির্ভরশীল, অক্ষম ভাবে। ব্যাক্তিজীবনেও কিছু বৈষম্য ফেস করেছি , করতে হয় । কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী সেসব ট্যাকল করার ব্যাপারে । আমি পুরুষ বিদ্বেষী বা নারীবাদী এসব তকমা চাই না, আমার চাওয়া যোগ্যতার সমান স্বীকৃতি, সুযোগ, সম্মান ...


সংশপ্তক:  তথাকথিত একাডেমিক  নারীবাদের চর্চা আমাদের তৃতীয়বিশ্বের  এই আর্থসামাজিক পরিসরে কতটা ফলদায়ী ও আশাব্যঞ্জক বল  মনে করেন?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ: C.Weedon এর মতে, ‘Feminism is a politics. It is a politics directed at changing existing power relations between women and men in society. These power relations structure all areas of life, the family, education, and welfare, the worlds of work and politics, culture and leisure. They determine who does what and for whom, what we are and what we might become.’ এখন এই নারীবাদের চর্চা ততদিনই প্রাসঙ্গিক থাকবে যতদিন না আমাদের নারীকে ‘Second Sex’ ভাবার অভ্যাসটা যাচ্ছে। এ লড়াই নয়। এটা আমাদের সভ্য সমাজের প্রকৃত সভ্য হবার চ্যালেঞ্জ। এখানে প্রথম বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বে কোন ফারাক নেই।


সংশপ্তক:  আর ঠিক এই প্রসঙ্গেই জানতে ইচ্ছে করছে, বিশেষত একজন লেখিকার দৃষ্টিকোণ থেকে; আমাদের পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় একজন লেখিকার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয়? আপনার নিজের লেখালেখির সূত্র ধরেই যদি বলেন!
শর্মিষ্ঠা ঘোষ:  দেখুন, এটার একপেশে উত্তর দেওয়া যায়, নারীরা স্রেফ লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা পরিসংখ্যানে প্রমাণিত বলে। তবে আমি নিজে একটা বিষয়ে বিশ্বাস করি, সেটা আত্মশক্তিতে বিশ্বাস। বহু নারী স্রেফ নিজ জোরে প্রতিষ্ঠিত এমন উদাহরণও অসংখ্য। আমি পেছনে তাকাই না। আমি অন্ধকারের গল্প ভালোবাসি না। আমি জানি, মশলা ঠিকঠাক থাকলে রান্না ভালো হয় ... সাথে মুন্সিয়ানাও জরুরি। একজন লেখক আর লেখিকার ভুমিকা সেখানে আলাদা নয়। আমার লেখার ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। আমি বিষয় নিয়ে সিলেক্টিভ নই। প্রকাশ ভঙ্গির বা ভাষার পার্থক্যে বিশ্বাসী নই। আমার কাছে লেখার ম্যাস্কুলিন ফেমিনিন বলে কিছু..নেই...সবই..ইউনিসেক্স...

সংশপ্তক:   ভবিষ্যত প্রজন্মের সাহিত্যের কাছে আপনার প্রত্যশা ও দাবী কি?
শর্মিষ্ঠা ঘোষ:  যেমন ভাবে চলছে ভালোই তো ... আমি সাইড লাইনার ... বিস্ময়ে আর অনুরাগে আর আদরে পর্যবেক্ষণ করি নতুনদের, ওদের দেখেও তো শিখি ...




Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.