(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -৯
এন্টিডোট
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়
ডাঃ গৌতমের সর্বশেষ আবিষ্কার অর্থাৎ ৮ম
একান্ত ব্যক্তিগত অর্থাৎ খাদ্যভান্ডারকে নিয়ে শুধু সারা দেশ নয় এখন তোলপাড় হচ্ছে
সারা বিশ্ব। কেননা খাদ্যে স্বয়ংভর হবার বাসনা কার না হয়? বিশেষত এই গাছে যেহেতু জমি, জল,
সার, পোকানাশক এমন কি যত্ন পর্যন্ত বেশী লাগে না, গাছ বড় হতেও লাগে মাত্র তিনমাসের
মত সময় আর একটি গাছেই সব ফল, ফসল আর মশলাপাতি। আর কি চাই। কিন্তু সে অন্য কথা। কিন্তু এই আবিস্কারের গোড়ায়
যে ঘটনা ছিল অর্থাৎ দস্যুদের দ্বারা ডাঃ গৌতমের অপহরণের বিষয় এবার আমাদের সেটা
নিয়েই পড়তে হবে। যদিও তিনি নিজের বাড়িতে বেশ সুরক্ষিতই। তাঁর জন্যে সরকার থেকে একটি
রক্ষী পরিবৃত বুলেট প্রুফ গাড়ী বরাদ্দ হলেও ডাঃ গৌতম তেমন কোথাও যাচ্ছেন না। বয়স
হয়েছে যথেষ্ট আবার নিজের আবিষ্কার নিয়েই তিনি এখন পরিতৃপ্ত। এমন কি ভারতরত্ন পেলেন
কি না পেলেন সে নিয়েও ভাবিত নন। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন আমার দেশ আর মানুষকে আমি
কিছু দিতে পেরেছি এর থেকে বড় কিছু আর হয় না। ভারতের এই মানুষরাই আমার কাছে এক একটা
রত্ন-স্বরূপ। এক প্রতিষ্ঠান একবার তাঁকে
ডক্টরেট দিতে চাইল। প্রথমে তিনি অরাজী হলেও পরে তাদের জোরাজুরিতে রাজী হতেই হল।
ওরা একদিন সাংবাদিক বৈঠকও করল যেদিন সেই সম্মান দেওয়া হবে। তবে এই সাংবাদিক বৈঠক
হল তাঁর বাড়িতে তাঁকে সভায় নিয়ে যাবার প্রাক্কালে।অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধি
তাঁর হাতে একটি ছোট্ট সোনার তাগা বেঁধে দিয়ে বললেন, এটি একটি ছোট্ট সূচনা মাত্র।
সভায় অপেক্ষা করছে আরও বড় কৌতূহলের ঝাঁপি। ডাঃ গৌতম এবার যাবার জন্য প্রস্তুত
হবেন। সেজন্য তিনি নিজের ঘরে একান্তে কয়েক মিনিট একটু সময় চান। তাঁর অনুরোধে ঘর
থেকে বেরিয়ে গেল সবাই এমন কি ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরাও। ভেতরে নির্জনে একটু চিন্তা
করছেন যাবেন কি না তাই এমন সময় মোবাইল বাজল।
- হ্যাল্লো, কে বলছেন?
- যা বলছি চুপ করে শোন। তোর হাতে যে তাগা বেঁধে
দিয়েছি সেটা আসলে একটা ব্যোম। উঁহু উঁহু। তাড়াহুড়ো করে আবার টান মেরে খুলতে বা ছিঁড়তে
যাবি না যেন। তাহলেই দুম ফটাস। একেবারে বাড়ি সমেত এই কয়েকশ লোক ভোগে যাবে। তার
চেয়ে অনেক সহজ হবে যেটা বলছি সেটাই কর।
মিনিট কয়েক পরে খুলল ডাঃ গৌতমের ঘর। হাসিমুখে
এগিয়ে এলেন প্রতিষ্ঠানের সেই প্রতিনিধি। নিজের বুলেট প্রুফ গাড়িতে নয়, প্রতিনিধির
আনা গাড়িতে করে সেখানে যাবেন ডাঃ গৌতম। আর কোনও ব্যক্তিগত দেহরক্ষীও যাবেন না
সেখানে। সবাই একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠল বিশেষ রক্ষীরা। এর জন্যে সরকারকে তাদের
কৈফিয়ত দিতে হবে। বুঝিয়ে বললেন ডাঃ গৌতম। কোনও ভয় নেই। সরকারকে তিনি জানিয়ে দেবেন
স্বয়ং নিজের ইচ্ছেতে তিনি যাচ্ছেন। কেউ দায়ী নয় এ জন্যে। সেই সভায় কিন্তু ঘোষণা
করা হল, অনিবার্য কারণ বশত ডাঃ গৌতম সভায় আসতে না পারায় সভা আজকের জন্যে মুলতুবি
করে দেওয়া হল। পরে কবে হবে সে ডাঃ গৌতমের সঙ্গে আলোচনা করে পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে
ডাঃ গৌতম কোথায় গেলেন?
গতবারে এরা তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। দিনের পর
দিন তাঁকে না খাইয়ে রেখেছিল। বারো ঘন্টা পর পর জল বা খাবার দিয়েছিল তাও একসঙ্গে
নয়। জল দিলে খাবার নয়, আবার খাবার দিলে জল নয়। এবারে ঠিক তার উল্টো। রেখেছে বিরাট আলোহাওয়া ভরা
ঘরে। দামী টেলিভিশন, সোফা, খাট টেবিল সব সব কিছু। ঘন্টায় ঘন্টায় আসছে নানান
সুখাদ্য, কফি, নয় ফলের রস, দুধ হরলিক্স এসব। মেঝেতে দামী কার্পেট পাতা। বিছানায়
দামী ভিডিয়ো গেম। সেটা নিয়ে খেলতে খেলতে ডাঃ গৌতম শুধু ভাবছিলেন এরা কারা? তাঁকে
এমন চালাকির সঙ্গে ধরে এনে এত রাজভোগে রেখেছে কেন? বেশী ভাবতে হল না। এলেন এক
সুদৃশ্য ভদ্রলোক। মুখে মুখোস নেই বরং রয়েছে একমুখ মিষ্টি হাসি। নমস্কার করে বললেন, সুপ্রভাত ডাঃ
গৌতম। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়েছিল তো? ভাল স্বপ্ন দেখেছিলেন তো?
বিস্ময়ে হতবাক ডাঃ গৌতম কোনও রকমে ঘাড় নেড়ে
সম্মতি দিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক বসলেন একটা সোফায়। বললেন, ভাবছেন আমরা কে? আবার ভাবছেন
চালাকি খাটিয়ে ধরেই যখন আনলাম তখন আবার জামাই আদর কেন। ডাঃ গৌতম কথা বললেন না।
- আমরা আর নতূন কেউ নয় সেই আগের বারে যারা
আপনাকে এনেছিল তারাই।
- কিন্তু-
-ঘাবড়াচ্ছেন কেন মশাই সব বলছি। সেই লোকটি বলল, আসলে সেবার
আমরা বড় ভুল করেছিলাম আপনাকে না খাইয়ে রেখে। আর আমাদের সেই ভুলেই আপনি দেশকে উপহার
দিলেন আপনার আর একটা চমৎকার আবিষ্কার। নিজে কিছুদিন না খেয়ে সারা বিশ্বকে দিলেন
একটা গাছেই সারা বছরের খাবার। হ্যাঁ, মাত্র একটা গাছেই। আর তা দিয়েই দেশে বিদেশে
একেবারে হীরো হয়ে গেলেন। এবার আর আমরা
আপনাকে সে সুযোগ দিচ্ছি না মশাই। অত্যাচার করে নয় মশাই, বরং ভালবেসে ভিক্ষে চাইছি
প্লিজ আপনার ঐ সাক্ষীগোপাল যন্ত্রটাকে বিগড়ে দেবার মত কিছু তো একটা করুন। ভাবুন
স্যর প্লিজ। মিথ্যে সাক্ষীগুলো একেবারে সব না খেয়ে আছে। করলে টাকা দিয়ে একেবারে
মুড়িয়ে রাখব মশাই। সুইশ ব্যাংকে আপনার কত টাকা জমবে কল্পনাই করতে পারবেন না। আপনার
টাকা এত কালো হয়ে যাবে যে কোনও আলোই সেখানে পড়বে না। কালোর পাহাড়ে আলো হয়ে আপনি
বিরাজ করবেন।
ভদ্রলোক চলে গেছেন। একা একা বিছানায় আপেল আর
আঙ্গুর খেতে খেতে আর ভিডিও গেম খেলতে খেলতে ভাবছেন কি করা যায়। এরা তাঁর নিজের
মোবাইল তাঁর কাছেই দিয়ে গেছে। বিছানায় পড়ে আছে সেটা। যেথা ইচ্ছে সেথাই ফোন করতে
পারেন তিনি। কোনও বাধা নেই। বাধা কি সত্যি নেই? তাঁর বিজ্ঞানী মন বলল অন্য কথা। একবার
চেষ্টা করে দেখতে লাগলেন। না, সংযোগ করা যাচ্ছে না কারোর সঙ্গেই। হয়ত কোনও জ্যামার রয়েছে এখানে মোবাইল অকেজো
হয়ে গেছে। কোনও মোবাইল সিগন্যাল যাতায়াত করতে পারছে
না। দুপুরে এল বিরিয়ানি, চিকেন, পোলাও, কোর্মা এরকম অন্তত দশ পনেরটা পদ। খেলেন বেশ
জমিয়ে। তারপর বিছানায় আধশোয়া হয়ে ভিডিয়ো গেম খেলতে খেলতে ভাবতে লাগলেন, অবস্থা যা
তাতে তো এবারে পালানো খুব মুশকিল। খুব আঁটসাঁট নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মোড়া। তাছাড়া
নিজে তো হাত পুড়িয়ে ডাল আলুভাতে দিয়ে ভাত খান। এই বুড়ো বয়েসে এত খাবার। তছাড়া এরা
এত জামাই আদর যখন করছে তখন কিছু তো দিতেই হয়। আর এমন একটা কিছু যা সারা জীবন এরা
মনে রাখবে। বললেন, আমি রাজি। ঠিক আছে তোমাদের সাক্ষীগোপালের এন্টিডোট তৈরি করে দেব
আর শর্ত –
- শর্ত?
- এটা করতে আমার ছ’মাস সময় লাগবে আর এর মধ্যে
আমাকে বিরক্ত করা যাবে না। আর দ্বিতীয় শর্ত হল আমাকে আমার বাড়ীর বটগাছতলায় রেখে
আসতে হবে আমার গবেষণার জন্য।
- প্রথম শর্ত মানা যাবে কিন্তু দ্বিতীয় শর্ত
মানা যাবে না। তোমাকে এখানে এই রাজভোগ খেতে খেতেই গবেষণা করতে হবে।
এতক্ষণে যেন রেগে উঠলেন ডাঃ গৌতম। বললেন,
রাজভোগ আমার দরকার নেই। কিন্তু দরকার রাজসুখ। আর আমার বাড়ীর নিজের বটগাছতলা না হলে
সে রাজসুখ হবে না। আমি গবেষণা করতে পারব না।
- সেটা সম্ভব নয়। লোকটাও রেগে গিয়ে বলল, তোমাকে
এখানেই গবেষণা করতে হবে। তুমি যা পপুলার লোক বাপু একবার ছেড়ে দিলে যা হৈ হৈ হবে
তোমার নিরাপত্তায় আবার যে বজ্রআঁটুনি আঁটবে তাতে আর তোমাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব
নয়।
আবার একটু ভেবে নিয়ে বলল, আচ্ছা তোমার
বটগাছতলা তো সিন্থেটিক। মানে এক জায়গা থেকে অনায়াসেই অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। ওটা
যদি আমরা এখানেই এনে দিই? তবে কথা দিচ্ছি তোমার গবেষণায় আমরা কেউ কখনও বাধা দেব
না। আর মনে রাখবে ছ’মাসের পরে কিন্তু আর একটি দিনও নয়।
কি আর করবেন ডাঃ গৌতম। ওদের কথা না শুনলে কি
হবে ওরা হয়ত মেরে ফেলবে। না খেতে দিয়ে নয়, হয়ত বিরাট বড় বড় রাজভোগ খাইয়েই মেরে
দেবে। একের পর এক কোপ্তা, কোর্মা, কাবাব খাইয়ে যাবে। পেট ফাটিয়ে দম বন্ধ করে মেরে
দেবে। ঠিক ছ’মাস মানে ১৮২ দিনে গবেষণা হয়ে গেল। আবিষ্কৃত হল তাঁর নবম আবিষ্কার
অর্থাৎ নবম একান্ত ব্যক্তিগত – ‘এন্টিডোট’। ছোটখাট পরীক্ষা হয়ে গেছে। ওরা নিশ্চিত যে এবার মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়া যাবে। দিলে আর সাক্ষীগোপাল কিছু করতে না পেরে চুপ
করে মুখ হাঁড়ি করে থাকবে। প্রচুর সম্মানের সঙ্গে ওরা পৌঁছে দিয়ে গেছে ডাঃ গৌতমকে
নিজের বাড়িতে। সবাই তো উদগ্রীব এতদিনের অন্তর্ধান রহস্য শোনার জন্য। সবাইকে বললেন,
কিছু না আমি একটু হিমালয়ে গিয়েছিলাম আমার যোগগুরুর সঙ্গে দেখা করতে।
আসলে ডাঃ গৌতম এখন এমন পপুলার হয়েছেন যে তাঁর
মুখের কথাই বেদবাক্য ধরে নিয়ে সবাই বিশ্বাস করে নেবে। কিন্তু মাত্র কয়েকজনকে বললেন
আসল কথাটা। সেই মাত্র কয়েকজনকে যারা কিছুতেই ফাঁস করবে না আসল জিনিসটা। বরং নেবে
কিঞ্চিৎ উপযুক্ত ব্যবস্থা। বিরাট বড় এক
ব্যবসায়ী খুন হয়েছে। সরকার পক্ষ একেবারে নিশ্চিন্ত যে কেস একেবারে নিখুঁত সাজানো
হয়েছে। কিন্তু একটা সাক্ষী সব গুবলেট করে দিচ্ছিল। আসলে এটা একটা মিথ্যে সাক্ষী।
সাক্ষী আর তার দালালরা খুব নিশ্চিন্ত। কারণ সাক্ষীর গায়ে কোনও এক গোপন জায়গায় আছে
ডাঃ গৌতমের নব্য আবিষ্কার ‘এন্টিডোট’। এর ফলে মিথ্যে সাক্ষী দিলেও সাক্ষীগোপাল
কিছুই করতে পারবে না আর। ঢ্যাঁড়স হয়ে চুপ করে থাকবে। সাক্ষীগোপাল কিছু বলল না বটে।
ঢ্যাঁড়স হয়ে চুপ করেই রইল। কিন্তু বললেন বিচারক স্বয়ং। পুলিশকে হুকুম দিলেন লোকটাকে
তল্লাসী করতে। হ্যাঁ পাওয়া গেল ডাঃ গৌতমের সেই এন্টিডোট। জাজ বললেন এই সাক্ষীকে
মিথ্যে সাক্ষী দেবার জন্যে পাঁচবছরের জন্যে জেলে ভরে দেওয়া হোক। আর কারা এর পেছনে
আছে তার তদন্ত করা হোক। আসলে সাক্ষীর যে এন্টিডোট বাঁধা আছে তা কারোর জানার কথা
নয়। ডাঃ গৌতম সে রকমই ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু আর যে একটা ব্যাবস্থা করেছেন সেটা
শিবের বাবারও জানার কথা নয়। কিন্তু জজসাহেব তো শিবের বাবা নয়। আইনের রক্ষাকর্তা। তাই
তাঁকে জানাবার ব্যবস্থা করেছেন আবার ডাঃ গৌতম নিজেই। জজ সাহেবের শরীরে রয়েছে এই
এন্টিডোটেরও আর একটা এন্টিডোট। মানে যাকে বলে বাবারও বাবা। যার ফলে কোনও সাক্ষীর
শরীরে এই এন্টিডোট বাঁধা আছে তা সাক্ষী কাঠগড়ায় উঠলেই জজসাহেব জেনে যাচ্ছেন। হ্যাঁ এটাই তো সরকারের গুটিকয় মাত্র লোককে
বলেছিলেন ডাঃ গৌতম। আর এই চালেই তো মাত। পেছনের সব রাঘব বোয়াল ধরা পড়ে এখন জেল
খাটছে। তাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে একশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড। ভারতীয় দন্ডবিধিতে
সংশোধন করে এখন গুরুতর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ একশ বছর সশ্রম কারাদন্ড করা
হয়েছে। ডাঃ গৌতমের মত দেশের এক খাঁটি সেবককে কিডন্যাপ করা? একবার নয় দু দুবার?
২৯শে জুন, ২০১৫
অরুণ
চট্টোপাধ্যায়