পানসি চলল বেলঘরিয়া,আমি
চললাম আসানসোল ৷ আগে একবার সবার সঙ্গে আসানসোল গিয়েছিলাম ৷ কাজেই আমি খুব কনফিডেন্ট ৷ একটা টিনের পুরানো সুটকেস আর একটা হোল্ড অল নিয়ে
বেরিয়ে পড়লাম বর্ধমানের পথে৷ রেলের কর্মচারী হিসেবে আমরা সেকেন্ড ক্লাসের পাস পেতাম
৷ ট্রেনে উঠে পড়লাম ৷ শিলিগুড়ি,পর্যন্ত চেনা পথ ৷ শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং
মেলেও উঠতে কোনো ঝামেলা নেই ৷ খেজুরিয়া ঘাটে নেমে বালিয়ারি পেরিয়ে স্টীমার না চড়ে
তাড়াতাড়ি হবে ভেবে লঞ্চে করে পৌঁছে গেলাম ফারাক্কা স্টেশন ৷ আর এখানেই শুরু হল
গোলমাল ৷ ওভার কনফিডেন্সের ফল ৷ তখনও অন্যান্য প্যাসেঞ্জাররা বেশী এসে পৌঁছায়নি ৷
এতবার যাতায়াত করেছি কোলকাতায় সবার সঙ্গে,আমি জানতাম ৷ ফারাক্কায় একটা ট্রেনই দাঁড়িয়ে
থাকে –দার্জিলিং
মেল ৷ দেখলাম একটা নয় দুটো ট্রেন ৷ কোনটায় উঠব ৷ ট্রেন দুটোই খালি ৷ আমি একজনকে
জিজ্ঞেস করলাম কোলকাতায় যাবার ট্রেন কোনটা ৷ ও বলল দুটোই যাবে,তবে
ঐ ট্রেনটায় ভীড় বেশী হবে আর এটায় ভীড় কম হবে ৷ আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম কোনটায় উঠি ৷ লোকজনের
ভীড় ক্রমেই বাড়ছে ৷ তাই বেশী চিন্তা না করে ট্রেনে উঠে পড়লাম ৷
নিশ্চিন্ত মনে একটা ভালো সিটে বসে আছি ৷
ট্রেন চলছে ৷ বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হল,ট্রেনটা তুলনায় একটু বেশী স্টেশনে থামছে ৷
দার্জিলিং মেল তো ফারাক্কার পরে একেবারে রামপুরহাটে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়ায় ৷ একটু
চিন্তায় পড়লাম ৷ বয়স চৌদ্দ ৷ দুনিয়ার কিছুই জানি না ৷ যেন একটা বাঘকে,না
বাঘ-সিংহ-হাতি
নয়,শিয়াল-শুয়োরও
নয়,একটা
বনে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ানো হরিণকে জঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে তুলে এনে কেউ
শো চলাকালীন সার্কাসের আঙিনায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ৷ দিশাহীন হরিণ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে
কাঁপছে ৷ আমার দশা বোধহয় বসে থাকা লোকটা বুঝতে পারল ৷ বলল,কোথায়
যাবে তুমি,খোকা ?
-কোলকাতা
৷
-তবে
এতো চিন্তা করছ কেন ? এই ট্রেনও তো কোলকাতায়ই যাচ্ছে ৷
-কিন্তু
আমি স্টেশনগুলো চিনতে পারছি না ৷
-তা
আবার হয় নাকি ? স্টেশন কি লাফিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে বেড়ায় ৷ সব
ঠিকঠাকই আছে ৷ আমি তো প্রায়ই যাই ৷ চুপ করে বসে থাক ৷ দেখবে একসময় হাওড়া পৌঁছে
যাবে ৷
-হাওড়া
? হাওড়া
কেন ?
-আরে
বার হাওড়া প্যাসেঞ্জার হাওড়া যাবে না তো কি দিল্লি যাবে ৷ তুমি তো বেশ মজা করতে
পারো ৷
-মানে
এই ট্রেনটার নাম বার-হাওড়া প্যাসেঞ্জার ? দার্জিলিং
মেল নয় ?
-দার্জিলিং
মেল তো ফারাক্কা থেকে ছেড়ে এতক্ষণে নলহাটি বোধহয় পৌঁছে গেছে ৷
-মানে
?
-আচ্ছা
খোকা,ঠিক
করে বলো তো,তুমি কোথায় যাবে ?
-কোলকাতা
৷
-তো
এটাও তো কোলকাতাতেই যাবে ৷ তবে চিন্তা করছ কেন ?
-হাওড়া
আবার কোলকাতা হবে কেন ? ওটাতো হাওড়া,গঙ্গার উপরে হাওড়া ব্রিজ ৷
-দেখছো
ওসব ? গেছ
কোনোদিন ?
-না
বইতে পড়েছি,ছবি দেখেছি ৷
-আরে
বাবা হাওড়া নেমে গঙ্গা পেরোলেই তো কোলকাতা ৷
-কিন্তু
আমি তো শুধু শিয়ালদা স্টেশনই চিনি ৷ কোলকাতায় আর কিছু চিনি না ৷
-পরিষ্কার
করে বলো তো তুমি কোথায় যাবে –মানে কোলকাতায় নেমে তুমি কোথায় যাবে ?
-আসলে
আমি আসানসোল যাব ৷
-আসানসোল
? তবে
তো দার্জিলিং মেলে গিয়ে বর্ধমান থেকে ট্রেন ধরে চলে যেতে এ ট্রেনে উঠলে কেন ?
আমি চুপ করে থাকি ৷
পাশের একজন বলে উঠল,কেন
আজ রাতে না হয় হাওড়া স্টেশনে থেকে গেলে৷ কাল সকালে ব্লাক ডায়মন্ড বা কোলফিল্ড ধরে
চলে যাবে ৷ সমস্যা কোথায় ? ট্রেন চলছে ৷ আমি চিন্তা নিয়ে সঙ্গে চলছি ৷
দিশাহীন লোক বোধহয় একেই বলে ৷ হঠাৎ পাশের ভদ্রলোক বলে উঠল,তুমি
কাটোয়ায় নেমে যাও না কেন ? ওখান থেকে একেঁবেঁকে ধরে বর্ধমান চলে যেতে
পারবে ৷
আমি ভূগোলের ম্যাপ জানি কাটোয়াকে চিহ্নিত
করতে পারব ৷ কাটোয়ার ডাঁটা খুব বিখ্যাত এটাও জানা ৷ কিন্তু কাটোয়া স্টেশন বা ঐ
অদ্ভূত নাম একেঁবেঁকে রেলওয়ে? ওটা কি ? একেঁবেঁকে তো সব ট্রেনেই যায় ৷ তবে কি এই
ট্রেন বেশী বেঁকতে বেঁকতে যায় ৷ আমার ভয় আরো বেড়ে গেল ৷ হাওড়া গেলে হারিয়ে সব
নির্ঘাৎ আর একেঁবেঁকে গেলেও জানিনা ৷
-ভাবছি
কি খোকা আর একটু পরেই কাটোয়া ৷রেডি হয়ে নাও ৷ নামব,কি নামব না ভাবতে ভাবতে কাটোয়ায় নেমেই পড়লাম
৷ জিজ্ঞেস করে প্লাটফর্মের একধারে একটু আলাদা করে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটাকে দেখলাম ৷ একটু
যেন জাতের দিক থেকে নিম্নশ্রেণীর ৷ সাইজে তো ছোটই ৷ মানে ন্যারো গেজ ৷ দার্জিলিং-এর
পাহাড়ে ওটা ট্রয়ট্রেনের মতো ৷ উঠে বসলাম ট্রেনে ৷ একটা আমাকে বর্ধমানে পৌঁছে দেবে
৷ ট্রেনের প্য্যাসেঞ্জার শুরুতে ছিল না ৷ আমার চোখ আমার উল্টোদিকে বসা একটা লোকের
দিকে ৷ গরমের মধ্যেও মাথা মুখ সব মোটা চাদরে জড়ানো ৷ কেবল চোখ দুটো চকচক করছে ৷ আর
চোখদুটোর দৃষ্টি সোজা আমার মুখের উপর ৷ তার আগেই শোনা হয়ে গিয়েছিল যে
এখানে প্রচুর ডাকাতি হয় ৷
হঠাৎ দেখলাম চলন্ত ট্রেনেই একদল লোক উঠল বস্তা,ঝুড়ি
ইত্যাদি নিয়ে ৷ এরা হাট ফেরতা ৷ এখন কামরা একেবারে ঠাসা ৷ কিন্তু তারমধ্য্য থেকেই
মাথাটা হেলিয়ে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ আমার অবস্থা কি সেটা আমি নিজেই বলতে
পারব না ৷ তখন বোধহয় আমার নামও আমি ভুলে গিয়েছিলাম ৷ কিছুক্ষণ পরে
হাটুড়ে লোকগুলো নেমে খেতে সোজা সেই জোড়া দৃষ্টির আক্রমণ ৷
কতক্ষণে লেগেছিল জানি না ৷ হট করে আলো ঝলমলে
বর্ধমান স্টেশন ৷ পরে জেনেছি যে রেললাইনের ট্রেন আমাকে উদ্ধার
করল,তার
আসল A.K-B.K Rly অর্থাৎ Ahmedpure to
Burdwan এবং
Burdwan to Katoa . ব্যাস,অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা
প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে আসানসোল ৷ তারপর আধচেনা শহর পেরিয়ে মাসির বাড়ি পৌঁছালাম ৷
এক ধাক্কায় আসানসোলে এসে পড়াতে আমার মধ্যে
অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল ৷ আমি বুঝতে পারছিলাম এ জায়গা আমার জন্য নয় ৷ শহরের একটা
নিজস্ব রীতিনীতি থাকে,সেটা রপ্ত করা খুব কঠিন না ৷ কিন্তু আসানসোল
তো শুধু শহর নয় –শিল্পাঞ্চল ৷ এদের কায়দা-কানুন
এক্কেবারে ভিন্ন ৷ এখানে আমার পদে পদে সমস্যা হতে লাগল ৷ যাইহোক পরের দিন মাসির বড়
ছেলে মানে রঞ্জিতদা আমাকে নিয়ে গিয়ে ওখানকার বি.বি
কলেজে ভর্তি করে দিয়ে এল ৷ এটা ছিল বর্ধমান ইউনিভারসিটির অধীনে ৷ কলকাতা ইউনিভারসিটিতে
এই কোর্সটা পড়ানো হত Pre-University নামে ৷ বর্ধমান ইউনিভারসিটিতে এই একই কোর্সের
নাম ছিল University Entrance . শুধুমাত্র ছেলেদের কলেজ ৷বইপত্র জোগাড় হল ৷ অন্যকিছুতে মন
না দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম ৷ দু-একদিন যেতে মাসির বাড়িতে বলাবলি শুরু হল,এতো
জোরে চিৎকার করে পড়ে কেন ? পাড়ার লোকজন কী ভাববে ? এটা
কানে আসতেই আমি আওয়াজ না করে পড়ার অভ্যাস শুরু করলাম ৷ রপ্তও হয়ে গেল ৷
(ক্রমশ)
[কমলেন্দু চক্রবর্তী]