মাংস (নয়) :
পাথরে মাথা ঠুকে কাঁদতে-কাঁদতে কখন যে ঘুমে দু'চোখ জড়িয়ে এসেছিল,
বুঝতে পারেনি গিরিজা..
আশেপাশে অনেকেই ছিল,
উঠে গেছে নিঃশব্দে।
ঢাক-ঢোল-শিঙার প্রচন্ড শব্দে কান-মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়,
মানুষের এই বাঁধ-ভাঙা উল্লাস-উৎসব, সব কিছুই যে আজ তাকে ঘিরে - এ কথাটা মনে হতেই অসম্ভব এক আতঙ্কে শিউরে ওঠে
গিরি, আজ ওরা তাকে 'পুণ্য সতী' বানাবে...রাজস্থানের সিকার জেলার ছোট্টো গ্রাম 'বীদাসর', নওয়ালগড় রেলস্টেশন থেকেও প্রায় সাত কিলোমিটার
দূর...
বছর খানেক আগে দুই পরিবারের মিলিত সম্মতিতেই,
হাসি-আনন্দে সুখের সংসার পেতেছিল গিরিজা আর উদয়। গিরি তখন সবে
উনিশ, আর উদয় সদ্য তরুণ বিশ-বাইশের যুবা...ঢাকের শব্দটা ক্রমশঃ যেন কাছে এগিয়ে আসছে,
ঘোর ভাঙে গিরিজার,
চমকে উঠে ঘরের এদিক-ওদিক তাকায়; দরজা-জানালা সব বাইরে থেকে বন্ধ, যাওয়ার সময় লোহার শিকলে তালা ঝুলিয়ে গেছে ওরা,
পালাবার পথ নেই।
অস্বাভাবিক ভয়ে শরীর-মন অবশ হয়ে আসে,
মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে যায় গিরি...সবাই মিলে বিয়ের দিনের মতো যত্ন করে গিরিকে,
ইঁদারা থেকে জল তুলে স্নান করিয়ে দেয়। নকশা
করা ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে খুঁজেপেতে বের করে আনে বিয়ের লাল-জোড়া, সঙ্গে আনে কাজললতা, কুমকুম, চুলের কাঁটা। গিরিজার 'তীজ' উৎসবের কথা মনে পড়ে,
বিয়ের পর তার প্রথম এবং শেষ 'তীজ' পরব.. সেদিনও তো
এমনিভাবেই সেজেছিল গিরি, পার্বতীমা-মহাদেবের উপাসনায় স্বামীর মঙ্গলকামনায়
সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর পরেছিল.. আর দূর থেকে উদয়ের চোখে ধরা পড়েছিল শুধুই অপার মুগ্ধতা...তিন দিনের জ্বরে সব কিছু শেষ হয়ে গেল?
তিল-তিল করে মনের ভিতর জমিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো,
ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল মুহূর্তে?
না না, এ হতে পারে না.. কান্নায় ভেঙে পড়ে গিরি,
তার শ্রান্ত দু'চোখ মা কে খোঁজে,
কিন্তু মাও তো আজ...দূরে কোথাও উদয়কে শুইয়ে রেখেছে ওরা,
গিরিজার খুব ইচ্ছে করে-
একবার ছুটে যায়,
জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে,
কান পেতে ধুকপুকানি শুনে চিৎকার করে বলে-
"উও আভি জিন্দা হে,
উসে ছোড় দো..."
কিন্তু পারে না,
মনে-মনে তাপ লাগে শরীরে.. মানুষ যে বড় স্বার্থপর,
নিজেকেই বেশি ভালোবেসে ফেলে...
গিরি জানে আজ তাকে মরতেই হবে,
সতী না হলেও কেশরীকাকার লোকেরা ওকে খুন করবে
নিশ্চয়.. উদয়ের চাষজমি-সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণীকে তো এত
সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না, অতএব পথের কাঁটা সরিয়ে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করো...মেয়েরা নিয়ম মেনে সকল রীতি পালন করে,
কেউ কাঁদে, কেউ ভাবে গিরিজা ভাগ্যবতী,
সতী হওয়ার সৌভাগ্য সকলের হয় না..
ভক্তিভরে প্রণাম করে যায়...শেষ চেষ্টা করে গিরি,
কোনোমতে এক মুহূর্তের একাকীত্বে উপায় খোঁজে
নিজেকে বাঁচাবার, আজ প্রথম তার নিজের জন্য বড় মায়া হয়...কিন্তু হায়...!!
যে চরম ধর্মান্ধতার সুযোগে,
সুপরিকল্পিত-চক্রান্ত তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে,
তার থেকে এ জনমে বুঝি আর মুক্তি মিলবে না। পাগলের মতো কাঁদতে থাকে গিরি,
দম যেন বন্ধ হয়ে আসে..দরজার বাইরে অগণিত মানুষের উচ্ছ্বাস-কোলাহল শোনা যায়,
ওরা এখনই নিয়ে যাবে তাকে,
নৃশংস-দৃষ্টিসুখে পুণ্য অর্জন করার লোভে...এক গ্লাস দুধে আফিম মিশিয়ে সামনে রাখে,
গিরিও আর প্রতিবাদ করে না..
যেখানে সমগ্র পুলিশ-প্রশাসন কেবল প্রহসন মাত্র,
যেখানে ধর্মের নামে নিজের মা-বোন সবাই অন্ধ, সেখানে আর কিসের প্রতিবাদ?
কিসের আশায় বেঁচে থাকা?
ধীরে-ধীরে ঘুম নেমে আসে দু'চোখে, নেশার ঘোরে উদয়ের সাথে শান্তির পথে চলে গিরিজা,
চারিপাশে জয়ধ্বনি ওঠে –"সতীমাঈকি জয়, বোলো গিরিজাসতীমাঈকি জয়..."
[গল্পে বর্ণিত স্থানগুলির ভৌগোলিক-অবস্থান সত্য হলেও,
বাস্তবের সাথে কিন্তু এর কোনো যোগসূত্র নেই। 'সতীদাহপ্রথা'-কে ভিত্তি করে, এটি একটি সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত গল্প মাত্র...]
সহেলী ভট্টাচার্য্য