মধুচন্দ্রিমা (৩য় পর্ব)
আগে যা ঘটেছে::: সুভদ্র তার বাসের গাইড সুভদ্রার পরিচয় পেল।
আগের রাতের পিৎজা বিভ্রাট সমাধান। এখন একবার কথা বলতে চায় সুভদ্রার সাথে।
সুভদ্রা বাসে ওঠে, পিছে পিছে প্রায় সব যাত্রীরাই চড়ল বাসে, পরবর্তী ও আজকের শেষ আকর্ষণ ক্যাপিটল বিল্ডিং। ঋজু টের পায়
সুভদ্রার গলার আওয়াজে বিষন্নতা। হতে পারে দিনের শুরুতে যে উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু
করা হয় দিনের বড় একটা অংশ অতিক্রম করে সেই উৎসাহে ভাঁটা পড়ে বৈকি। আবার ওই
ছেলেটির সাথে মনোমালিন্যর জের তাও হতে পারে। বাসে এখন মোটামুটি সব যাত্রীরাই
ঝিমোচ্ছে, খাবার পেটে পড়তেই চোখ বুজে আসাটা বোধহয় একা
বাঙালিদের বদ্অভ্যাস নয়। বাসে গেলে হোয়াইট হাউস থেকে ক্যাপিটল বিল্ডিংএর দূরত্ব
তেমন নয়, ঋজু সহ প্রায় সব যাত্রীদেরই মনোভাব 'এঃ এখনি আবার নামতে হবে?' কাজেই সিগন্যালের লাল আলোর সঙ্কেতে দাঁড়াতে হলে স্বস্তিই পাচ্ছে সকলে।
সুভদ্রা নিজের কাজে ব্যস্ত, কেউ শুনুক না শুনুক ক্লান্ত গলায় বলে চলেছে
ক্যাপিটল বিল্ডিং সম্পর্কে "ক্যাপিটল হিল হিস্টরিক ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত
এই বাড়িটি ১৮০০ সাল থেকে ক্যাপিটল বিল্ডিং নামে পরিচিত, এটি ইউনাইটেড স্টেটস্ এর কংগ্রেসের বাড়ি এবং ক্যাপিটল হিল
ও আশেপাশে বসবাসকারীদের কাজের জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস
জেফারসন এই বাড়িটির নামকরণ করেন। বিখ্যাত টেম্পল অফ জুপিটার অপ্টিমাস ম্যাক্সিমাস
এর সাথে সামঞ্জস্য পেয়ে উনি এই নাম দেন ল্যাটিন ভাষায় জুপিটারের মন্দিরকে Aedes lovis
Optimi Maximi Capitolini বলা হয়, সেই থেকেই এই নাম। কংগ্রেসের অধিবেশন হয় এখানে তবে প্রায় প্রথম দিকে চার্চের
কাজও হত এখান থেকে। বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের সৌজন্যে বাড়িটির এক্সটেনশন হয়।
বাড়িটির মূল আকর্ষন এর রোটান্ডা এবং তাতে বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের
কাজের নমুনা। রোটান্ডা থেকে নর্থের দিকের ঘর গুলোকে S অর্থাৎ সেনেট আর সাউথের দিকের ঘর গুলো H অর্থাৎ হাউস হিসাবে নামকরন করা হয়। মূল অধিবেশন কক্ষটি কেও
দেখা যায় ভেতরে গেলে। তবে আজ আমরা বাইরে থেকেই দেখে নেব কারন, ভেতরে ঢুকতে আলাদা করে টিকিট করে লাইন দিয়ে ঢুকতে হয়। যদি
কোনো যাত্রী চান তবে তাঁরা এখানে যাত্রা শেষ করে পরবর্তীতে নিজেদের ফেরবার
ব্যবস্থা নিজেরা করে নিতে পারেন।" বাস মোটামুটি আধ ঘন্টা খানেক দাঁড়াবে, আর ক্যাপিটল বিল্ডিং সম্পর্কে আরোও তথ্য জানাতে থাকে
সুভদ্রা। বেশ ঘুম পাড়ানি গানের মতো কাজ করে ওর কথা গুলো। কাজেই ক্যাপিটল বিল্ডিংএ
পৌঁছে একটু অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেমে ছবি তুলল ঋজু। বাড়িটার সাথে কোলকাতার
ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালের কি মিল। স্লথ গতিতে দেখা শেষ করে যাত্রীরা আবার ফেরত এলে
বাস যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেখানেই এসে শেষ করল। কিছু যাত্রী অবশ্য
ক্যাপিটল বিল্ডিংএর ভিতরটা দেখবে বলে রয়ে গেল।
ঋজু আগে ভেবেছিল আরোও খানিকক্ষণ ঘুরবে, এতো এতো মিউজিয়াম এবং মজার কথা প্রায় সব গুলোই ফ্রি, প্রবেশ মূল্য লাগে না। সুযোগ বুঝে সুভদ্রার সাথেই পরামর্শ
করবে যে কোন মিউজিয়াম আগে দেখা উচিত; সে তো গাইড অতএব তার ভালো ধারনা থাকবেই।
কিন্তু বাস থেকে নামার পর মেয়েটা কেমন যেন উবে গেল, দেখতেই পেল না ঋজু আর। কি আর করে, সারাদিন ঘুরে ক্লান্তও লাগছে ক্ষিধে ক্ষিধেও
পাচ্ছে সাথে কেমন মনটাও দমে গেল; সব মিলিয়ে মোটেলে ফিরে যাওয়াই ঠিক মনেহল।
আজ অবশ্য একেবারে রাতের খাবার সাথে তখনের জন্য কফি আবার সকালে খেতে পারে এমন শুকনো
খাবার সব গুছিয়ে কিনে মোটেলের ঘরে ফিরল। একা থাকলে যা হয় চিন্তার সূত্র কোথার
থেকে যে কোথায় পৌঁছয় নিজেরই হিসেব থাকে না। ভাবনা শুরু হল পরের দিনকে কোনটা
কোনটা দেখবে তাই দিয়ে। এতো রকমের মিউজিয়াম সব দেখতে গেলে বোধহয় ছুটি বাড়িয়ে
নিতে হবে। আর আছে ন্যাশনাল মল থেকে কিছুটা দূরে পেন্টাগন হাউস অর্থাৎ
হেডকোয়ার্টারস অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস্ ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স কিম্বা
অ্যামেরিকার প্রাচীন চিড়িয়াখানা গুলির একটি সেগুলিও দেখতে মন্দ লাগবে না। এইসব
দিয়ে ভাবনা শুরু হলেও কখন যেন ঘুরতে ঘুরতে সুভদ্রা এসে পড়েছে ভাবনায়। ঋজু ভাবে, গতকাল ও এই মোটেলে ছিল বলেই আজও যে রাত কাটাতে আসবেই সে
গ্যারান্টি কোথায়? মেয়েটার সাথে কথা বলার সুযোগ পেলে প্রথমেই
পিৎজার জন্য দুঃখ প্রকাশ করত। যদিও ঋজুর কিছু তেমন করার ছিল না, তা ও। ঋজু তো খুঁজে বেরও করেনি যে কে অর্ডার করেছিল, হয়ত সুভদ্রার খুব অসুবিধে হয়েছে। ঋজু অবশ্য পে করেই
ডেলিভারি নিয়েছিল, তা ও কেমন অপরাধ বোধ রয়েছে ওর, সুভদ্রাকে কোনো বাহানায় একটিবার খাওয়াতে পারলে স্বস্তি
হত। কফির গেলাস হাতে বাইরে এলো টুকরো টুকরো চিন্তা নিয়ে, বাইরে তখনও পুরো অন্ধকার নামেনি যেন। একটা সুবিধে আছে এ
দেশে,
মশার উৎপাত কম। বাইরে বসলেই পোঁওও করে ছেঁকে
ধরে না সবখানে। গাছপালা জঙ্গলওলা জায়গায় অবশ্য বেশ টের পাওয়া যায় তাদের
উপস্থিতি। একতলা মোটেলটার লম্বা টানা বারান্দা আর পরপর একই চেহারার ঘর, মানুষজন আছে নেই টেরই পাওয়া যায়না। একা দাঁড়িয়ে
সূযর্াস্তের আভায় লাল হওয়া আকাশ দেখতে দেখতে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল, এমন সময়ে টের পেল খুট্ শব্দ করে ওর পাশের কোনো একটা ঘর
থেকে কেউ বেরল। মাথা ঘুরিয়ে না তাকানোই দস্তুর; কিন্তু বাধ সাধল সিগারেটের গন্ধ। যে নিজে স্মোক করেনা তার কাছে এই গন্ধটা
মোটেও সুখকর নয়, আর এদেশের কড়া তামাকের গন্ধ আরোই কষ্ট দেয়
ঋজুকে। ঘরে চলে যেতে গিয়ে ঘুরতেই দেখতে পেল আধা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে স্মোক করছে
সুভদ্রা। ঘটনাটা একটা স্পার্কের মতো কাজ করল, ঋজু চট করে ভেবে নিল এই সুযোগটা সে কাজে লাগাবে।
পরিচিত আধা পরিচিত তো বটেই এমনকি অপরিচিতদের মুখোমুখি
পড়লেও "হাই" বলা বা যেকোনো রকম উইশ করা এদেশের রীতি। সে
গুডমর্নিংই হোক, হ্যাভ আ নাইসডে, হ্যাভ আ নাইস রেস্ট অফ দ্য ডে, হ্যাভ আ গুড নাইট, হ্যাভ আ নাইস উইকএন্ড যে কোনো রকমের শুভেচ্ছা
বিনিময় করা যায়। কাজেই সকালে
দেখা একটি মানুষকে যদি ঋজু গিয়ে 'হাই' বলে সেটা মোটেও বিসদৃশ হবেনা। সাথে যদি দুটো
কথা বলার সুযোগ পায় তবে ওর স্মোক করা বন্ধ করতে
পারবে আর ঋজুর তরফের পিৎজা কাহনটা শোনাতেও পারবে। যদিও কেমন একটা বুক ঢিপ ঢিপ
করছিল,
যদি শীতল ব্যবহার পায় ভেবে। পায়ে পায়ে
এগিয়ে যায় কারণ সিগারেটের তীব্র গন্ধে কষ্ট হতে শুরু করেছে আর দেরী নয়।
"হাই" শুনে মাথা ঘোরায় সুভদ্রা, একটা তিতকুটে হাসি দিয়ে প্রত্যুত্তর দেয়
"হাই"
"বসতে পারি?" ভণিতা বিহীন বাংলা কথায় একটু চমকাল সুভদ্রা।
একটু বিরক্তির অভিব্যক্তি ফুটল মুখে
"স্যুর" হাত বাড়িয়ে দেখাল আর জোরে জোরে কটা টান দিল
সিগারেটে। বসেই সময় নষ্ট না করে হাত বাড়াল "আমি সকালে ডিসি ঘুরছিলাম, আপনাদের বাসে; আমার নাম সুভদ্র" এবারের চমকটা চোখে পড়বার মত হল "কি নাম বললেন? সুভদ্র?" নিজের নামের সাথে মিল পেয়ে হেসে ফেলল
সুভদ্রা
"হুঁ, ঠিকই শুনেছেন, আপনাকে একটা সরি বলার ছিল, যদিও আমার কোনো হাত ছিল না, ইট ওয়াজ আ কোয়েন্সিডেন্ট"
"বুঝলাম না"
"বলছি, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, সিগারেট টা নিভিয়ে দেবেন? অ্যাস আই ডোন্ট স্মোক একটু অসুবিধে___"
"ওঃ সরি, নেভাচ্ছি"
"দেখুন কাল রাত্রে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে, কাল আপনি পেপরনি পিজা অর্ডার করেছিলেন, রাইট?"
"হ্যাঁ, সেটা আপনি কি করে?___"
"ডেলিভারি দিতে এসে ঘরের নম্বর ভুল করে, কিন্তু ইংরেজীতে আমাদের নামের বানান এক হওয়াতে সব গোলমাল, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে,আমি অর্ডার না করা সত্ত্বেও কি করে আমার নাম লেখা রিসিট
নিয়ে হাজির। আজ সকালে ডিসিতে আপনার নামটা জানবার পর পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল।
তবে আমার না একটু গিল্টি লাগছে"
"কেন? নিজেকে দোষী ভাবছেন কেন? আপনার কী করার?" ঘটনাটা শুনে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে
সুভদ্রা।
"না, মানে, আমি তো ট্রাই করিনি কার অর্ডার সেটা খুঁজে
বের করতে, দিব্যি খেয়ে নিলাম।"
"তো? আমি তো দোকানে ফোন করে ওদের খুব একচোট বকলাম, ওরা খালি বলে এই তো ডেলিভারি দিয়ে এসেছে, আর আমি ততো চেঁচাই যে, তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছি? আর আপনি কেন লজ্জা পাচ্ছেন? আপনি তো নিজে পে করেছেন, আমার টাকায় তো খাননি।"
"মে বি ইউ আর রাইট, তবু, ওই খারাপ ওয়েদারে, আবার করে অর্ডার করা।"
"ওঃ ওটা কোনো ব্যাপার নয়"
"আচ্ছা আপনার কাছে অ্যাস অ্যান এক্সপার্ট জানতে চাইছি, কাল কি কি দেখা উচিত? আই মিন এগ্জ্যাক্টলি কোন মিউজিয়ম গুলো বা
ধরুন পেন্টাগন হাউস এগুলো কি একদিনে কভার করা পসিবল্?"
"দেখুন, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি আর
ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়াম দুটি সব থেকে জনপ্রিয়। সেই দুটো দেখতে
প্রায় দুটো গোটা দিন লাগে, যদি ঠিক মতো দেখেন আর কি, আর নদী পেরিয়ে ভার্জিনিয়াতে পেন্টাগন হাউস দেখতে পারেন, ডিসি বেড়াতে এলে মানুষে ওটাও দেখেন। আপনার হাতে কেমন সময়
আছে তার ওপর নির্ভর করে"
"সময় আছে, ইনফ্যাক্ট আমি তো চেরীব্লসম দেখতে পাব
ভেবেছিলাম"
"দুঃখিত হবেন না, হাতে সময় যখন আছে, তখন কয়েকটা দিন থাকুন, তাপমাত্রা বাড়লেই দেখতে পাবেন"
"মে আই আস্ক ইউ সাম থিং?"
"কি?"
"আপনি কি সব সময় এমন শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন?"
"দেখুন, আমার বাবা বাঙালি ছিলেন, উনি শিখিয়েছিলেন কথার মধ্যে অদরকারে ইংরেজী বা স্প্যানিশ
শব্দ না ভরে দিতে। আমার মা মেক্সিকান, স্প্যানিশ বলার সময়ে তো আমরা তার মধ্যে বংলা
গুঁজে দেই না, ইংরেজীও কমই দেই। তাহলে বাংলার বেলায় কেন? আর এখন এই বাঙালি গাইড হওয়াতে আমার আরোই অভ্যাস হয়ে গেছে।
এটা কী ভুল?"
"না না ঠিক ভুল নয়, আমরা, আসলে আননেসেসারি হয়ত ইংলিশ ওয়ার্ডস ইউস করি, মানে উই আর ইউসটু উইথ দ্যাট, তাই হয়ত একটু কানে লাগছে।"
"ওঃ তাই বলুন, আমি ভাবলাম ভুল বলেছি"
"আপনার কি ডিনার হয়ে গেছে?"
"কেন বলুনতো?"
"না তাহলে একসাথে ডিনার করা যেতো, আমি নিয়ে এসেছি"
"ওঃ আয়াম সরি, আমি কাজ থেকে ফেরবার সময়ে ডিনার সেরে এসেছি, থ্যাঙ্কস্ ফর ইয়োর ইনভাইটেশন"
"যাঃ!! বেশ তাহলে অ্যাডভান্স বলে রাখছি, কাল কিন্তু একসাথে ডিনার করব, আপনার কাজ কটায় শেষ হয় মোটামুটি আন্দাজ পেলাম, আমি ধরুন ওই সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাব এন্ড পয়েন্টে, বাই দ্য ওয়ে, ক্যান আই হ্যাভ ইয়োর সেল নাম্বার?"
"কাল তো আমি কাজে যাচ্ছিনা, আমার সেল ফোন নেই আর কাল আমি এখান থেকেও চলে যাব"
"সে কি কেন? না মানে, আমায় বলতে অসুবিধে থাকলে বলবেন না"
"অসুবিধে? তা'নেই, তবে শুনতে আপনার ভালো লাগবে না, টু মাচ পার্সোনাল"
"না না আপনার বলতে খারাপ লাগলে থাক" বলে চুপ করে বসে থাকল দুজনেই। এখন গুডনাইট বলে চলে যাওয়া
উচিত নাকি অপেক্ষা করা উচিত সুভদ্রার কথাগুলো জানার জন্য ভাবতে থাকে ঋজু। এমনই
সময় দুপুরে দেখা সেই ছেলেটি হঠাৎ যেন কোত্থেকে এসে উপস্থিত।
(আগামী পর্বে)
©মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী