শিশু রবীন্দ্রনাথ ও সহজ পাঠ
শিল্প ও সাহিত্য
সাধনার
ক্ষেত্রে
রবীন্দ্রনাথ
এক সার্বভৌম
ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য আলোচনা পর্বে যদি শিশু সাহিত্যের প্রসঙ্গ তোলা হয় তাহলে
এটা বলা প্রয়োজন
যে শিশু সাহিত্য
রবীন্দ্রনাথের
লেখনী জীবনে এক বিশেষ স্থান পেয়েছে। এর পিছনে অবশ্য একটি কারণ কাজ করেছে সবসময়। রবীন্দ্রনাথের
সঙ্গে শৈশবকালের
কোন রকম সম্পর্কটুকু
তো দূরে থাক, পরিচয়টুকু অবধি হয়ে ওঠেনি। তিনি শৈশবকে
একান্ত
করে উপভোগ করবার মতো পরিবেশ
পাননি। তিনি একান্তই
নিঃসঙ্গ
ছিলেন। নিজের মা’কেও কাছে পাননি সেই সময়। তাই অতীতচারণার
মাধ্যমে
সেই শৈশবকে
উপলব্ধি
করার জন্য কবির উৎকণ্ঠা
ছিলও নিবিড়, যার ফলস্বরূপ জন্ম নেয় তাঁর বিভিন্ন শিশুকাব্য, প্রবন্ধ, গল্প, নাটিকা। আমার মতে ‘সহজ পাঠ’ এমনই একটি দৃষ্টান্ত।
‘সহজ পাঠ’-এ যে রবীন্দ্র সাহিত্য প্রকাশ পেয়েছে সেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও জীবজগৎ - এই সমস্তই তাঁর বিচরণভূমি। কবি ছোট্ট শিশুদের
কাছে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ খুবই সহজ সরল ভাষায় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। নন্দলাল
বসুর আঁকা ছবি ও কবির অনবদ্য
ভাষা, শব্দ, ছন্দের ব্যবহার সাহায্য করেছে বাংলা অক্ষরগুলির ছবি আঁকতে। লেখা পংক্তিগুলি
বারবার
বলতে বলতে যেন ছোট শিশুদের
জীবজগৎ, প্রকৃতি ও মনুষ্যসমাজের সঙ্গে এক সুন্দর, নিবিড় সম্পর্ক তৈরী হয়ে ওঠে। যদি বলা হয় “ঘন মেঘ বলে ঋ / দিন বড়ো বিশ্রী”, কিংবা “ প ফ ব ভ যায় মাঠে / সারা দিন ধান কাটে”, কিংবা “হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ / ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ” তাহলে এখানে যে মেঘলা দিন, চাষীদের
কথা, কুকুরের কথা, বলা হয়েছে তা বুঝতে একজন ছোট বাচ্চার
কোন অসুবিধে
হয় না। তার উপর আবার এতো সহজে যে ঐ, ঔ প্রভৃতির ব্যবহার শেখানো যায় ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে তা কবির লেখা উপলব্ধি নয়া করলে বিশ্বাস করা যেত না। “ভালো ভৈষা দৈ আর কৈ মাছ। শৈল আজ খৈ দিয়ে দৈ মেখে খাবে”; “ওরে কৌলু, দৌড়ে যা। চৌকি আন। গৌর, হাতে ঐ কৌটো কেন?” – এই বাক্যগুলি
মজার ছন্দে পড়তে পড়তে কোথায় কিভাবে
ঐ-কার, ঔ-কার ব্যবহৃত হচ্ছে জানা হয়ে যায় মনে মনে।
শিশু মন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ
প্রকৃতিকে
যেভাবে
ব্যাখ্যা
করেছেন
সেখানে
প্রকৃতি
নবীন, চঞ্চল, সুন্দর ও পরিপূর্ণ। বর্ষার
চাপল্য, মত্ত অবস্থা, শরতের তারুণ্যসুন্দর রূপ তাঁকে যেন বেশী আকর্ষণ করতো।
“আষাঢ়ে বাদিল নামে নদী ভর ভর / মাতিয়া
ছুটিয়া
চলে ধারা খরতর” – আষাঢ়ের
বর্ষা এমন চঞ্চল যে আকাশ নদীকে মাতিয়ে
ছুটে বেড়ায়। এক সুন্দরী, প্রাণচঞ্চল তরুণীর সৌন্দর্য্য যেমন ব্যাখ্যা করা হয়, ঠিক তেমন ভাবেই কবি শরতের সৌন্দর্য্যের
ব্যাখ্যা
করেনঃ
“দিঘি ভরা জল করে ঢল ঢল
নানা ফুল ধারে ধারে
কচি ধান গাছে ক্ষেত ভরে আছে
হাওয়া দোলা দেয় তারে”
শিশু বলতে কবি শুধু মানবশিশুকে
বুঝিয়েছেন
তা নয়। বৃক্ষ, পশু, সমস্তই
তাঁর কাছে সমমর্যাদায়
স্থিত। এবং একেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথের
শৈশবচেতনার
স্বরূপ
বলা যায়। তা না হলে একপায়ে
দাঁড়ানো
তালগাছ
কিভাবে
সব গাছ ছাড়িয়ে
আকাশে উঁকি দেয়?
প্রকৃতির
স্বাভাবিক
নিয়মে রবীন্দ্রনাথের
জীবনে শৈশব এসেছিল; কিন্তু অন্যান্য শিশুদের মতো সে শৈশবকে একান্ত করে তিনি উপভোগ করতে পারেননি। শৈশবে বিভিন্ন
নিয়মের
নিগড়ে বাঁধা জীবনে তিনি খেলাধূলা, ঘুড়ি ওড়ানো, গাছে চড়ার মতো অকিঞ্চিৎকর কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারেননি। কবি শিশু বয়সে তথাকথিত
বিদ্যালয়ের
শিক্ষায়
শিক্ষিত
হয়েছিলেন
মাত্র কয়েকটি
বছর। সেই জন্য তাঁর বাড়ির মানুষজন – অর্থাৎ
ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নী, ভাইপো-ভাইঝি ও ভ্রাতৃবধূরা ছাড়া অন্য কোন সঙ্গী বা বন্ধু তাঁর ছিল না। “রবীন্দ্রনাথের
মনোধর্মের
যে একটি প্রধান
বৈশিষ্ট্য
অন্তর্মুখীনতা - সে বৈশিষ্ট্য তাঁর চার পাঁচ বছর বয়স থেকেই জাগতে শুরু করাছিল। সে জাগার পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল হয়েছিল দিনের বেলায় চাকরদের তাঁবেদারিতে থাকা।”
তিনি একান্ত
নিঃসঙ্গ
ছিলেন – সম্ভবতঃ
সেই কারণেই
তিনি হয়ে উঠেছিলেন
কল্পনাবিলাসী। তিনি ঘরে বসে বাইরের জগতটুকু দেখতেন এর কল্পনায় ভাসিয়ে দিতেন তাঁর প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাগুলি। তাঁর সেই অভিজ্ঞতায়
বিধৃত সকলেই – বাদ পড়েনি এমনকি পাড়ার বাসনওয়ালাও। “বাসন ওলা থালা বাজায় / সুর করে ঐ হাঁক দিয়ে যায়” কিংবা ……… “আতাওয়ালা নিয়ে ফলের ঝোড়া”। দিনের শেষে ছেলের দলের হৈ হৈ করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার দৃশ্যও তাঁর নজর এড়ায় নি।
“সাড়ে চারটে বেজে ওঠে / ছেলেরা
সব বাসায় ছোটে / হো হো করে উড়িয়ে দিয়ে ধূলো”। জানালা দিয়ে যে মাঠ দেখতে পেতেন তার শেষ কোথায় তিনি হয়ত বা বুঝতে পারতেন নয়া; তাই কল্পনার
সাহায্যে
মনে ভাবতেন “তেপান্তরের মাঠ বুঝি ওই / মনে ভাবি ঐখানেতেই / আছে রাজার বাড়ী”।
রবীন্দ্রনাথের
নিজের শৈশব কেন্দ্রিক
শিশু ভাবনাই
শিশুদের
জন্য রচিত সহজ পাঠের বিভিন্ন
কবিতায়, গল্পে, প্রবন্ধে রূপায়িত হয়েছে বারে বারে। এই ভাবনার
অনুসরণে
কবির স্মৃতিচারণায়
ফিরে গিয়ে তাঁর কথায় বলতে হয় – “আমরা ছিলাম চাকরদেরই
শাসনের
অধীনে। নিজেদের
কর্তব্যকে
সরল করিয়া লইবার জন্য তাহারা
আমাদের
নড়াচড়া
একপ্রকার
বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। সেদিকে বন্ধন যতই কঠিন থাক, অনাদর একটা মস্ত স্বাধীনতা – সেই স্বাধীনতায়
আমাদের
মন মুক্ত ছিল। খাওয়ানো-পরানো-সাজানো-গোছানোর দ্বারা আমাদের চিত্তকে চারিদিক হইতে একেবারে ঠাসিয়া ধরা হয় নাই”। অনাদরের
স্বাধীনতা
শিশুর কাছে অনেক সময়েই আকাঙ্ক্ষিত। অনাদরে লালিত স্বাধীন জীবনের জন্য অনেক সময়ে ব্যাকুলতা অনুভব করে শিশু। কল্পনার
জগতে বিরাজ করতে করতে এক সময়ে হয়তো শিশুমন
কেঁদে ওঠে অনেক দূর যাওয়ার
জন্য – একা, স্বাধীনভাবে।
- “ভোরের বেলা দেব নৌকা ছেড়ে / দেখতে দেখতে কোথায় যাব ভেসে”। কোন সময়ে ঘোড়া হয়ে দাপিয়ে বেড়াতে মনে ইচ্ছে জাগে, সাধ হয় মাছ হয়ে জলের বহু গভীরে চলে যেতে, আবার পাখি হয়ে খোলা আকাশে উড়তে চায় মন ………… “আমি ভাবি ঘোড়া হয়ে মাঠ হবো পার / কভু ভাবি মাছ হয়ে কাটিব সাঁতার / কভু ভাবি পাখি হয়ে উড়িব গগনে / কখনো হবে না সে কি ভাবি যাহা মনে”। ঘরের মধ্যকার বদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে সাধ জাগে, মন চায় অন্য কোন নতুন জায়গায় যেতে ………… “থাকি ঘরের কোণে / সাধ জাগে মোর মনে / অমনি করে যাই ভেসে ভাই / নতুন নগর বনে”।
শিশুকালে
মাতৃলালনের
অভাবে যে ক্ষোভ, যে বেদনা সঞ্চিত ছিল রবীন্দ্রনাথের মনে তা তিনি ভুলতে পারেননি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত। তাঁর সাহিত্য
সৃষ্টিতেও
অনিবার্যভাবে
তার প্রভাব
প্রতিফলিত
হয়েছে। যা তিনি পাননি, অথচ যা তিনি পেতে চেয়েছিলেন সে বেদনা নিহিত ছিল কবির অন্তরের গভীরে। তাঁর সৃষ্ট শিশু চরিত্রও
তাই তাঁরই মতো মাতৃব্যাকুল
ও অভিমানী ………… “ঐখানে মা পুকুর পাড়ে / জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে / হোথায় হব বনবাসী / কেউ কোত্থাও
নেই” ………… “শুকনো পাতা বিছিয়ে
ঘরে / থাকব দুজনেই”। এখানে মা-কে যেন একান্তে, একেবারে নিজের করে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ফুটে উঠেছে। তিনি প্রতি মূহুর্তে
মা-কে এইভাবে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন তাঁর শৈশবে। এই ‘মা’-কে পাওয়ার
আকাঙ্ক্ষা
তাঁর কাছে স্বপ্নের
মতো ছিল – যেন প্রতিদিনের
বাস্তব
ঘটনার আঘাতে প্রতিনিয়ত
সে স্বপ্ন
ভেঙ্গে
গিয়েছে। ‘পথহারা’ কবিতায় ভারি সুন্দরভাবে তিনি ব্যক্ত করেন শৈশবের এই মনোভাব ………… ‘বল দেখি তুই কেমন করে / ফিরে পেলাম মাকে / কেউ জানে না কেমন করে / কানে কানে বলব তোরে / যেমনি স্বপন ভেঙ্গে
গেল / সিঙ্গিমামার
ডাকে”।
মা-কে ঘিরে শিশুর রোমান্টিক কল্পনা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে ‘বাণী বিনিময়’, ‘অন্য মা’, ‘নৌকাযাত্রা’
প্রভৃতি
কবিতাতে। মা এবং শিশুর সম্পর্ক, যে দিক থেকেই দেখি না কেন, খুবই কাছের এবং খুবই নিবিড় ………… “মা যদি তুই আকাশ হতিস / আমি চাঁপার
গাছ / তোর সাথে মোর বিনি কথায় / হতো কথার নাচ”। আর সহজ পাঠের পাতায় পাতায়, ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে কবির নিপুণ হাতে আঁকা সেইসব কথাচিত্র, মা ও শিশু যেখানে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ, যেখানে নিতান্ত হাল্কা কথাও বয়ে নিয়ে আসে মর্মস্পর্শী ও গভীর মানবিক অনুভূতি। সেজন্যই
কি সহজ পাঠ শিশুদের
এতো প্রিয়, যেখানে সে খুঁজে পায় তারি মতো আর এক শিশুকে, যাকে সহজেই ছোঁয়া যায়, যার সঙ্গে বলা চলে অনেক না বলা মনের কথা?
অনুশ্রী সেনশর্মা