দারিদ্র।
তখন আমি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পনেরো
পয়সার টিকিট কেটে ঢাকুরিয়া থেকে ৫ অথবা ৯ নম্বর বাসে চড়ে হাজরায় ক্লাস করতে যাই।
বাবা কলেজের মায়না দিয়ে দিলেওছাত্রী পড়িয়ে বাস ভাড়া, কলেজ ক্যান্টিনের চা-টিফিন আর বন্ধুদের সঙ্গে নাটক, সিনেমার পয়সার ব্যাবস্থা হয়। প্রথম প্রেম পর্ব-ও চলছে তখন। ধরা যাক উজান তার নাম, এদিকে ওদিকে চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে- একটা কিছু লেগেই যাবে আর আমাদেরও হিল্লে হবে। অন্তত
ভ্যাগাবন্ডের মতো ঢাকুরিয়া লেকের মাঠে বা বেঞ্চিতে বসে ভাড়ের
চা খেয়ে প্রেম না করে একটু ভদ্রস্থ কোনো রেস্তোরাঁয় বসে কফি-কাটলেট নিয়ে প্রেমালাপে সভ্য-ভদ্র হব আমরা। এরকম সময়কার এক বিকেলের ঘটনা। লেক ফ্রেডস
সুইমিং পুলের লাগোয়া মাঠে, ওই ক্লাবের দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘাসের ওপরে
বসেছি আমি আর উজান। কাছাকাছি ছেলেদের জটলা। আমাদের মতো আরও কিছু যুবক যুবতী(যারা দিবা স্বপ্ন দেখে, মনে করে জীবন মানেই প্রেম; বাকি সব আনুষাঙ্গিক বা অপ্রয়োজনীয়)ফিসফিস করে কথা বলছে –কখনো হাহা হাসি কখনো একটু উত্তেজিত কন্ঠস্বর, ‘ কী মনে করেছ, তুমি লম্বা চুল রেখে ঝুটি বাঁধ আর গিটার
বাজাও বলে মেয়েরা তোমার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে?’ অথবা এই একই ধরণেরই কথা- অন্য পক্ষের। শেষ দুপুরেই এসেছি, ঘাসের ওপর রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে, চোখ ছুটে বেড়াচ্ছে রোদের লুকোচুরির সঙ্গে। আমার খুড়তুতো
দাদা কাতু এক দল ছেলের সঙ্গে সামনের রাস্তা দিয়ে চলে গেলো একবারই আঁড় চোখে আমাদের
দিকে চেয়ে, না দেখার ভান করে। আমাদের ডান দিকে বসে একজন
দিনমজুর ধরণের লোক বিড়ি খাচ্ছিল; ফাটা সার্টের কলার, জীর্ণ পুরনো প্যান্ট-পাশে রাখা সস্তা সাইড ব্যাগ এর ভাঙ্গা চেন, ভিতরের সার্ট বা পাঞ্জাবি উঁকি মারছে। ব্যাগ হাতরে একটা
গামছা বার করে ঘাসের ওপর বিছিয়ে লোকটা শুতে যাবে, এমন সময়ে আর একজন সিগারেট হাতে নিয়ে ‘একটু আগুন হবে?’ বলে তার দিকে এগিয়ে গেল। প্রথম জনের পকেট থেকে দেশলাই বেরলো, বিড়ি তো আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। দেখলাম একজনের পাশে বসে আর একজন সিগারেট ধরিয়ে দেশলাই ফেরত
দিল। এর পোশাক বা চেহারাতেও দারিদ্রের ছাপ। আমাদের কাছে চা-আলা এসেছে, চায়ের ভাড়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ চলে যাচ্ছিল ওদের দিকে। কথাবার্তা অস্পষ্ট
কানে আসছে, অপরিচিত দুই ব্যক্তির ভদ্রতা গোছের আলাপের দু- এক টুকরো। চা-আলা আমাদের থেকে পয়সা নিয়ে ওদের কাছে গেল।
সিগারেট শেষ করে একজন চা নিলেও অন্যজন হাই তুলে মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে গামছার
ওপর টানটান হল। আমরা আবার নিজেদের কথায় মশগুল। আধ ঘন্টার মত
কেটে গেছে, ওদিকে আর মন দিই নি। রোদ মিলিয়ে যাচ্ছে, এবার উঠে লেকের পাড় দিয়ে হাঁটব। হঠাৎ অস্ফুট বিলাপের শব্দে
আমরা চমকে উঠলাম। প্রথম লোকটা একা, অন্যজন কখন চলে গেছে টের পাই নি। সে ধড়মড় করে
উঠে বসে বোকার মতো হাঁ করে চারিদিকে কী যেন খুঁজছে। উজান জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে’? সে হতভম্বের মতো উলটে আমাদের জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার সঙ্গে একটা ব্যাগ ছিল দেখেছেন?’ ‘হ্যাঁ, ছিল তো, দেখেছি। কেন, নেই?’ নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। নেই। আমরা দুজনেই
হাহাকার করে উঠলাম, ‘যাঃ তুলে নিয়েছে কেউ!’ লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গামছা ভাজ করে জুতোজোড়া পরল—সে দুটো ছিল। ‘ট্রেন ধরে কাজে যাব, রাতে থাকার জামাকাপর, টুকিটাকি, চটি,
রাতের খাবার...’ বলতে বলতে কেমন অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘পয়সার ব্যাগ?’ ‘আছে’। পকেটে হাত দিয়ে আমাদেরই যেন আশ্বস্ত করল সে। ওর ধীর, অপ্রস্তুত, ইতস্তত পদক্ষেপের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে
রইলাম।
‘ভাবা যায়? ওই অন্য লোকটা নির্ঘাত নিয়ে গেছে! ঈশ! আমাদের চোখের ওপর দিয়ে! কেন যে দেখলামই না!’ উজান বলল, ‘আশ্চর্য! এত গরীব মানুষেরও চুরি যায়?’ খানিক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘আসলে অন্যজন তস্য গরীব, পাশে বসে আগুন নিল, গল্প করল! ওই ধান্দাতেই এসেহিল আসলে। এই কাজে অভ্যস্ত! কী জান মিঠুন, মনুষত্ব বিবেক টিবেক বেঁচেবর্তে টিকে থাকার
অনেক বাইরের ব্যাপার, অনেক দূরের- সৌখিন, অর্থহীন জিনিষ! আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি না, বলয়টার ভিতরের নিরাপদ উষ্ণতায় থাকি কি না!’ আমরাও উঠলাম। কেমন আচ্ছন্নের মতো। সেই দিন তো বটেই, আমার এখনও লোকটির বিস্মিত, দুঃখকাতর মুখটার কথা মনে পড়ে। সে কি শুধু পুরনো
জামাকাপর ব্যাগ চুরি যাবার রাগ আর শোক? কোনো একটা লজ্জা, অসহয়তা বোধ ও কি ছিল তার? দারিদ্র একটা জাতীয় অপরাধ এবং কলঙ্ক! কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে যে নিজে এই দুর্দশা
অতিক্রম করতে না পারে; জীবনের ন্যুনতম সুন্দর জায়গায়, মনুষত্ব, মানবিকতার গৌরবে পৌছতে পারে না সে। এ এক করুণ দুরাবস্থা!
মিত্রা ঘোষ