>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • মৌ দাশগুপ্তা





    *সংশপ্তক:* অধিকাংশ বাঙালিরই রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচয় সহজপাঠের পাতায়! তারপর সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁর সাথে প্রথম আলাপ যার যার নিজস্ব পরিসরে এক এক রকম ভাবে গড়ে ওঠে আপনার ক্ষেত্রে সেই প্রথম আলাপ গড়ে ওঠার গল্পটা যদি একটু বলেন আমাদের!
    মৌ: আর পাঁচটা গড়পড়তা বাঙালীর মত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় অতিশৈশবেই, সেই মায়ের মুখে শুনে, মায়ের হাত ধরেইকিন্তু সে সময়টা ছিল নিছকই অ আ ক খ কে ছন্দবদ্ধ উপায়ে আত্মস্থ করার প্রয়াসমাত্র। ভালো লাগা ব্যাপারটা নয় কিংবা তার মধ্যে দিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথকে পাইনি, বরঞ নিয়ম করে পড়তে বসার উপকরন হিসাবে সেই ক্ষুদে বাচ্চাবেলায় সহজপাঠ বইটার ওপর বেশ রাগই হতসুতরাং ‘সহজপাঠ’ আমার স্মৃতিতে নিছক একটা প্রাইমারই রয়ে গেছে।  প্রথম সন্তান, তার ওপর অতিরিক্তমাত্রায় দুরন্ত আর খেলাপ্রিয় ছিলাম বলে মা আমার পড়াশুনোর ওপর বেশী নজরই দিতেন,স্কুল যাবার আগেই তাই ‘বর্ণপরিচয়’ ছাড়াও বাড়ীতে  সহপাঠ প্রথম, দ্বিতীয়ভাগ পড়া হয়ে গেছিল।তারপর স্কুলে ভরতি হয়ে সেই একই পড়ার চর্বিতচর্বনের সময় বরঞ্চ ভালোলাগাটা শুরু হয়ছড়াগুলো বুঝতে অসুবিধে হত না। সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রশ্নোত্তর লিখতে হত না। শুধু  মুখস্ত বলতে ও লিখতে হত। তাই বেশ লাগত।  সাদা কালোয় আঁকা ছবি সাথে দুটি করে অক্ষর নিয়ে অন্তমিলের ছড়া প্রাইমারী স্কুলের ঠাকুমার মত ভীষণ ফরসাসাদাকালো চুলে চওড়া সিঁদুরের টান, চওড়া লালপাড় সাদাশাড়ীপড়া, পান খাওয়া লাল টুকটুকে ঠোঁটের  পারুল দিদিমনি সুর করে পড়তেন আর বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের আমরা ক্লাশ ওয়ানের ৪১টি বাচ্চা দুলে দুলে সহজপাঠ খুলে সুর করে ধুয়ো তুলতাম

    -  ছোট খোকা বলে অ আ
    -  শেখেনি সে কথা কওয়া
    কি
    -  ডাক পাড়ে ও ঔ
    -  ভাত আনো বড় বউ
    -   
    (চল্লিশোত্তীর্ণ বয়সে স্মৃতি বিশ্বাসঘাকতা করতেই পারে, তার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে রাখছি) এই একটা সুর করে পড়া, বাড়ীতে এভাবে শিখিনি খুব মজা পেতাম ভালোলাগাটা তখন থেকে শুরুঅপ্রাসঙ্গিক তবু একটা কথা বলে নিই আমাদের বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের  প্রার্থনাসঙ্গীত হতআগুনর পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে”, কিআনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর”, (আর মনে নেই,)তারপরজনগনমন অধিনায়ক জয় হে”…দিয়ে গান গাওয়া শেষ করে লাইন করে ক্লাশরুমে ফিরতাম প্রথম যেদিন পারুল দিদিমনি বলেছিলেন ঐ গানদুটোর লেখক আর সহজপাঠের লেখক একজনই, রবি ঠাকুর,স্কুলে দিদিমনিদের বসার ঘরে যার চন্দন পড়ানো ছবি টাঙানো আছে সেদিন কি আশ্চর্য্যই না হয়েছিলাম, আজ এই বয়সে কেউ যদি এসে আমায় বলেন,যেআমি বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়েছি তাতেও বোধহয় আমি অতটা আশ্চর্য্য হবনা

    সব দিক থেকে ছাত্রজীবনে ‘সহজপাঠ’ আমার সুখস্মৃতিই। সহজপাঠ মানে আমার চীনে পুতুলের মত হাত পা নাড়া ছোট্টবোনটাকে কোলে নেওয়া ভীষণ বাচ্চা বাচ্চা ঝকঝকে চেহারার  মা, সহজপাঠ মানে আমার স্কুলের বন্ধুরা, জয়িতা,ইন্দ্রানী, দোলা, সোনালী,বেবী,চিন্ময়, প্রদ্যোত,কার্তিক, গনেশ,তুষার, বুদ্ধু, যাদের সিংহভাগের সাথে এজীবনে হয়ত আর দেখা হবে না সহজপাঠ মানে ছবি হয়ে যাওয়া  পারুলদি,ছায়াদি,বড়দি,রেখামাসী, সহজপাঠ মানে মাস্টামশাই, অনিমাদি,বকুলদি, সহজপাঠ মানে  আমাদের লাল টালির স্কুল,খেলার ছোট্ট মাঠ,সহজপাঠ মানে আমার না ফুরানো, ভীষণ দুরন্ত ভীষণ বকবকানো এক মেয়েবেলা, সুদূর প্রবাসে আমার দুইমেয়েকেও ঐ সহজপাঠ দিয়েই বাংলা পড়তে লিখতে শিখিয়েছি, নিখিলভারত বঙ্গ সম্মেলনের বাংলা পরীক্ষা দেওয়া করিয়েছিছেলেবেলার অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে, কিন্তু সহজপাঠের ওই চারটি ভাগ তাদের ভাজা-ভাজা, খাজা-খাজা, হয়ে যাওয়া শীর্ণ শরীর নিয়ে আজও আমার বইয়ের তাক আলো করে আছেআজও ওদের মায়া কাটাতে পারিনি।  


    *সংশপ্তক:*  একটু গভীর ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের যার যার জীবনে শৈশবের রবীন্দ্রনাথ কৈশোরের রবীন্দ্রনাথ যৌবনের রবীন্দ্রনাথ আসলেই ক্রমশ প্রকাশ্য রবীন্দ্রনাথের একটা ধারাবাহিক পর্বই! আমরা যার জন্যে ঠিক প্রস্তুত থাকি না, অথচ এই ধারাবাহিক ভাবেই কবি যেন আমাদেরকেই প্রস্তুত করে তোলেন আমাদের জীবনের পূর্ণ উদ্বোধনের জন্যেই! আপনার ব্যক্তি জীবনের গড়ে ওঠার পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সেই গল্পটা যদি বলেন
    মৌ: খুব টিপিক্যাল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। দেখুন সেভাবে বলতে গেলে ‘সহজপাঠ’ বাদ দিলে গড় বাঙালির প্রথম রবীন্দ্রপরিচিতি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে,কানে শুনে,নিজে গেয়েআমার বেলায় সে নিয়ম খাটেনি। রবীন্দ্রনাথকে আমি গানের মধ্যে দিয়ে চিনিনি। পরবর্তীকালে তাঁকে চিনতে চিনতেই তাঁর গানের মধ্যে এসেছিলাম, সেএক অন্য গল্প বরঞ্চ কবিতায়বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিনতে শুরু করি তার অনেক আগে থেকে আমার ছোটবলায় মা ঘুমপাড়নী ছড়ার থেকে রবিঠাকুরের ছড়া, কবিতা, বেশী শোনাতেন শুনতাম,কখনও বুঝতাম, কখনো বুঝতাম না কিন্তু কান থেকে প্রাণে শিকড়গাথার শুরু ছিল সেটাইএরপর রবীন্দ্রনাথের সাথে আলাপ রেকটু বাড়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরকারি শিশুপাঠ্য বাংলা বই ‘কিশলয়’ মোটামুটি দাড়িওয়ালা কবিটিকে তখন থেকেই খুব একটা মন্দ লাগেনি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে সংকলিতা প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ পড়েছি সহায়িকা বই হিসেবে।  এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সিরিয়াস কবিতায় উপনীত হয়েছিলাম।  পাড়ার ফাংশানে,স্কুলের অনুষ্ঠানে আমার বাঁধাধরা আশ্রয়ের খড়কুটো ছিলেন রবিঠাকুর স্বীকার করতে লজ্জা নেই, বই পড়ে নয়, মায়ের মুখে শুনে হুবহু সেই উচ্চারণ, সেইকমাতে অল্প বিরতি, ‘দাঁড়িতে দীর্ঘ বিরতি, সেই কণ্ঠস্বরের ওঠানামায় উগড়ে দিয়ে আসতাম, “অন্ধকারে সিন্ধুতীরে একলাটি ঐ মেয়ে”,”মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে,মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দুরে…” “আঘাত সংঘাত মাঝে দাঁড়াইনু আসি”, “দে দোল দোল,দে দোল দোল,এ মহাসাগরে তুফান তোল”,”নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার…” বয়স বাড়ার সাথে কবিতার বিষয় বদল,পছন্দ বদলশুধু রবিঠাকুরের কোন বদল নেইপাঁচ বছরের জন্মদিন থেকেই অন্য উপহারর সাথে বাঁধাধরা বিশ্বভারতীর বিস্কিট কালারের পেপারব্যাক একটি করে বই আজও আমার বইয়ের আলমারির তাকে সযত্নে রয়ে গেছে সেই রত্নভান্ডারছেলেবেলা, মুকুট, শিশু, বলাকা, পূরবী, শ্যামলী, মহুয়া, মালঞ্চ, রাজর্ষি, গোরা, সঞ্চয়িতা,গল্পগুচ্ছ (অখন্ড),গীতবিতান ইত্যাদি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের গদ্যের সঙ্গেও প্রথম আমার পরিচয় ‘পেটে ও পিঠে’। তখন আমি বেণী ঝোলনো স্কুলপড়ুয়া। সবে হাইস্কুলে, পঞ্চম শ্রেণি। এবং এই রচনাটিরও সৌজন্য ‘কিশলয়’। তারপর ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোটোগল্পটি। সে অবশ্য আরও একটু বড়ো হয়ে; ছবি বিশ্বাস টিঙ্কু ঠাকুর অভিনীত তপন সিনহা নির্দেশিত সিনেমাটি দেখার পরপরই। ওই সময়েই প্রথম উপন্যাস পড়েছিলাম মুকুট, তারপর  ‘রাজর্ষি’। এরপর পড়েছিলাম ‘বউঠাকুরাণীর হাট’। সাথে‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’। সেটি অবশ্য পড়ি ‘চিরকুমার সভা’-র অনুষঙ্গে। গল্পগুচ্ছের খণ্ড সংস্করণটিও তখন শেষ। তাতেও মুগ্ধতা। ফলত, আমার জীবনে গদ্যশিল্পী রবীন্দ্রনাথ জাঁকিয়ে বসেছিলেন। একটু এঁচড়েপাকা পেকে আবার রবীন্দ্রনাথগোরা দিয়ে শুরু করে মালঞ্চ ঘুরে চারুলতার সাথে স্ত্রীর পত্র পড়ে নিয়ে  শেষমেষ চোখের বালি মাধ্যমিকের আগেই এই সফরের পরিণতি। সেই সঙ্গে এল গান। আমার মায়ের ঘুমপাড়ানি ছড়ার মত গুনগুনানি গানও রবি ঠাকুরের গান আমার মায়ের মত ঘোরতর রবীন্দ্রপ্রেমী, এরকম বিস্ময়কর রবীন্দ্রপ্রেম আমি আর কারো ভেতরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কত গান আর কবিতা যে তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল এবং আছে সেটা এখন ভাবলেও অবাক লাগে। ছোটবেলা থেকে সে সবই কানে শুনে বড় হয়েছি সেই শোনাটাই অবচেতনে বোধহয় আমাকে টেনে এনেছিল রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি – দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পড়া কোন ছায়ায়….” গায়ে কাঁটা দিতরবীন্দ্রনাথ এমন এক শিল্পী যিনি একটা গান কিংবা কবিতার ভেতরে হাজারটা অর্থ ধরে রেখেছেন, যা ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে আমার কাছে ধরা দেয়।
    আমার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এমনভাবে মিশে আছেন যে, তাঁকে ছাড়া আমার চলেই না।  কোনকিছুতেই যখন স্বস্তি মেলে না, কোনো কিছুই আমাকে শান্তি দেয় না, সব মিলিয়ে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা ভর করে,কিছু ভালো না লাগার সেই বিভীষিকাময় সময়েও আমার রবিঠাকুরই ভরসা। কিছু না ভেবেই আমি  তখন রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতরে ঢুকে পড়ি। প্রেম বা প্রার্থনা, স্বস্তি, শান্তি, আনন্দ বা আশ্রয় সবই মেলে তাঁর কাছে। ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে”, “চরণ ধরিতে দিও গো আমারে…”,তোরা যে যা বলিস ভাই…”, “মায়াবন বিহারিনী”… তাঁর এ ধরনের গান যখন শুনি, মনটা শান্ত হয়ে আসে; স্থির হয়ে আসে। আর তাই, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া দিনযাপন - এক অসম্ভব ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে। রবীন্দ্রনাথের গানকে শিশুকাল থেকেই বাংলার ধানক্ষেত, আকাশ, নদী, সমুদ্র, অরণ্যের মধ্যে পেয়েছি। তাই রবীন্দ্রসদন-কলামন্দির আমাকে কোনোকালেই টানে না। আমার ঘুমপাড়ানিয়া গান থেকে আপন মনে গুনগুনানি, বাথরুম সং থেকে ঘরোয়া আড্ডায় গলাবাজি সর্বত্র রবিঠাকুর আর এভাবেই আমার বেড়ে ওঠা। বড় হয়ে ওঠা।

    *সংশপ্তক:*  রবীন্দ্র-প্রতিভার ঠিক কোন দিকটি, আপনার যৌবনের পর্বে বেশি মাত্রায় আন্দোলিত করেছিল আপনাকে?
    মৌ: যৌবনের পর্বে কথাটার মানেটা বেশ বুঝলাম। এখন কথা হল, আমার রবি ঠাকুর তো সেই বিরল প্রতিভা যিনি প্রেম ও প্রার্থনাকে অবলীলায় একাকার করে ফেলেছেন; দুটো বিষয়কে তিনি আলাদা করে তো দেখেন-ই নি, বরং সমার্থক করে তুলেছেন। তিনি তো সেই অসামান্য শিল্পী যাঁর গান বা কবিতার উদ্ধৃতি ছাড়া বাংলায় প্রেমপত্রই লেখা হয় না। পাড়ার ফাংশানে রবিঠাকুর ছাড়া কিভাবে পছন্দের পাড়ার হিরোটিকে মনের গোপন কথাটি বলব? “গোপন কথাটি রবে না গোপনে..”  ‘দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা হৃদয় আকাশে’, যে ছিল আমার স্বপনচারিনী”, “যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে “ ,”আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে”, “তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা, ভালোবাসা, সখী ভালোবাসা কারে কয়, সেকি কেবলই যাতনাময়”… মিলন থেকে বিরহ, আজকের ভাষায় প্রেমে পড়া’, থেকে হাফ সোল’, ‘ফুল সোলএমনকি ব্রেকেজঅবধি রবিঠাকুরের অবাধ গতি। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার বয়স, সেই দুষ্টুমিষ্টি কৈশোর সান্ধিকাল থেকে আজকের পরিণত বয়স অবধি এ গানগুলো আমার রক্তকনিকায় মিশে আছে, জড়িয়ে আছে।
    আমার ও পরান ও যাহা চায়
    তুমি তাই , তুমি তাই গো
    আমার ও পরান ও যাহা চায়
    তোমা ছাড়া আর এ জগতে
    মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
    আমার ও পরান ও যাহা চায়
    তুমি সুখ ও যদি নাহি পাও
    যাও সুখের ও সন্ধানে যাও …

    যা কিছু প্রেম তা-ই প্রার্থনার যোগ্য, যা কিছু প্রার্থনা তা-ই প্রেমের যোগ্য। এরকম উদাহরণ আপনি আর কোথায় পাবেন, বলুন?


    *সংশপ্তক:* এই যে জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিত্য নতুন নানা ভাবে আবিষ্কার করি, এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে ব্যাখা করবেন? আমাদের এই ধারাবাহিক ভাবে রবীন্দ্রমানস আবিস্কার আসলেই রবীন্দ্রনাথেরই সাথে পথ চলা নয় কি? না কি এই আবিস্কারের সাথে আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আত্মিক যোগ ততটা নেই যতটা মেধা বুদ্ধিবৃত্তির যোগ আছে?
    মৌ: ছোটবেলায় 'শিশু'; 'শিশু ভোলানাথ'; 'খাপছাড়া' পড়ার সময় থেকে মনে হত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন  তাঁর রচনার মধ্যে তাঁর নিজের শৈশব-কৈশোরের অবদমিত ইচ্ছে-স্বপ্ন-কল্পনাগুলোকে মেলে ধরেছেন। তিনি যে কথাই বলেন, তা যেন আমারও মনের কথা হয়ে ওঠে।ছোটবেলা তো একরকম, কিন্তু যৌবন থাকে উদ্দামতায় ভরা। ওই বয়সেও আমার হাত কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছাড়েন নি।  যদিও মানছি সে সময়ে আমার মানসিক খিদে মেটানো শুধু একা রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে চলে না। কিন্তু চার দেওয়ালের সুরক্ষিত নীরব ঘরে ফিরে এসে, গভীর রাতে, যখন একা, তখন কবিতা বলতে , গান বলতে সেই রবীন্দ্রনাথ। আনন্দে রোমাঞ্চে, রাগে অভিমানে, ভালোবাসায় বিতৃষ্ণায়, আবেগে- সমর্পণে, আমাকে কেন জানি না রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার ফিরতেই হতো।

    আসলে রবি ঠাকুর এমনই এক শিল্পী যে, একেকসময় একেকভাবে আমাকে ধরা দেন। একটি গান এক বয়সে এক ধরনের অর্থ নিয়ে ধরা দেয়, পরে সেটিই আবার আলাদা অর্থ নিয়ে হাজির হয়। একটা উদাহরণ দিই।"আমার মন মানে না দিন রজনী।/ আমি কী কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি।/ ওগো কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি/ ওগো সজনি।।"প্রেম যদি চোখের জলে ভিজে না ওঠে তাহলে সেটি প্রেম নয়। আমার জীবনে অনেক ভাল লাগা এসেছে। হয়তো প্রেমও এসেছে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। কেন? কারণ সেই প্রেম আসায় মন   ভিজে ওঠেনি। ওই সময় গানটি আমার কাছে নারী-পুরুষের প্রেম অর্থেই ধরা দিয়েছিল। কিন্তু এর কয়েক বছর পর আমার কাছে গানটির অর্থই বদলে গেলএ সজনির অর্থ তখন জীবনের ফেলে আসা ক্ষণযা আনন্দে আবেগে, শোকে, দুঃখে, শোকে, চোখে জল তো আনে কিন্তু নিজে আর ফিরে আসে না এরকম এক আধটা নয়, একাধিক উদাহরন দিতে পারি তাঁর এসব কাব্যের ভাবে ও ভাষায় রয়েছে নির্মল আনন্দ রসের ধারা, কল্পনার মায়াজাল, নিবেদিত প্রাণের বিনম্রতা, প্রেমময় চিত্তের আকুতি। তবে পারসোন্যালি আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথকে নিত্যনতুন নানা ভাবে আবিষ্কার করার মধ্যে মেধা বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষ প্রয়োজন বা ভূমিকা কোনটাই নেই যা দরকার সেটা হল একটা সংবেদনশীল মন, এক একান্ত আত্মপোলব্ধি আর আমার সাথে আমার রবিঠাকুরের এক আত্মিক যোগ


    *সংশপ্তক:*  রবীন্দ্রপ্রতিভার কোন দিকটি আপনাকে বেশি করে টানে কেন?
    মৌ: গীতাঞ্জলি থেকে  একটু বলি-

    “যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু,
    এবার এ জীবনে
    তবে তোমায় আমি পাই নি যেন
    সে কথা রয় মনে।
    যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
    শয়নে স্বপনে।
    এ সংসারের হাটে
    আমার যতই দিবস কাটে,
    আমার যতই দু'হাত ভরে উঠে ধনে,
    তবু কিছুই আমি পাইনি যেন
    সে কথা রয় মনে।
    যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
    শয়নে স্বপনে।‍’’...

    রবীন্দ্রনাথের এই সমর্পনমূলক আত্মোপলব্ধি আমার বড় প্রিয় এটাই আমায় বেশি করে টানে



    *সংশপ্তক:*  বর্তমানে আপনার ব্যক্তিগত জীবন যাপন সংস্কৃতি চর্চার পরিসরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির চিত্রটির স্বরূপ বিকাশ সম্বন্ধে যদি কিছুবলেন
    মৌ: রবি ঠাকুরের কাছে আমার অনন্ত জিজ্ঞাসা, রবি ঠাকুরই আমার সব সন্দেহ সব সংশয়ের ত্রাতা, সব প্রশ্নের উত্তর আমি কে? জীবনের প্রথম ক্রিটিক্যাল আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর আমার রবিঠাকুর 
    আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ ,
    চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।
    আমি চোখ মেললুম আকাশে ,
    জ্বলে উঠল আলো
    পুবে পশ্চিমে ।
    গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর' ,
    সুন্দর হল সে ।
    তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা ,
    এ কবির বাণী নয় ।
    আমি বলব, এ সত্য ,
    তাই এ কাব্য ।
    এ আমার অহংকার ,
    অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে ।


    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও অনেকের মতোই আমারও ভাবনা, রুচি, নান্দনিকতার বোধ, জীবনযাপন, কর্তব্য নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। আমি নারী, এই বোধ আসার সাথে সাথে প্রথম যে কবিতাটি গুনগুনিয়ে পড়তাম তা হল  …“নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার।অথচ পরে বিভিন্ন সূত্রে পড়েছি রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনার দিকটি খুবই জটিল ।  'রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনায় অনেক স্তর ছিল, অনেক বাঁক ও ঘূর্ণি। তাঁর কোনো কোনো দিকের প্রগতিশীলতা আজও আমাদের স্তম্ভিত করে রাখে, আবার কোথাও কোথাও মনের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠে আপত্তি। ১৮৯৩ সালে সাধনা পত্রিকায় (চৈত্র, ১২৯৯ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত 'নরনারী' প্রবন্ধে সদ্য তিরিশ পেরোন রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, 'স্ত্রীলোকের প্রধান কার্য আনন্দ দান করা। তাহার সমস্ত অস্তিত্বকে সঙ্গীত ও কবিতার ন্যায় সম্পূর্ণ সৌন্দর্যময় করিয়া তুলিলে তবে তাহার জীবনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়।' 'গুপ্ত প্রেম' কবিতায় তিনি লিখেছেন : '
    তবে পরাণে ভালোবাসা কেন গো দিলে
    রূপ না দিলে যদি, বিধি হে
    পূজার তরে হিয়া ওঠে যে ব্যাকুলিয়া
    পূজিব তারে গিয়া কি দিয়ে।'

    তাহলে রূপ না থাকলে কি নারীর ভালোবাসার কোনো অধিকার নেই! পুরুষ কি কেবল শরীরী রূপকেই ভালোবাসে? বা ভালোবাসবে? কিংবা 'মেয়েদের সুন্দর হওয়া চাই' কিন্তু কোথায় নারী সুন্দর হবে, দেহে না মনে? দেহে হলে তো সমাজে নারীর ভোগ্যপণ্য অবস্থানই আরও জোরালো হয়। এখানে রবীন্দ্রভাবনার সাথে আমার ভাবনা মেলে না কিন্তু মনে মনেই তাঁর যুক্তির বিরোধিতায়, আমার অনুভব, আমার বাচনশক্তি, যুক্তিতর্কের গন্ডী ছাড়িয়ে আমার নারীত্ব শক্তিকে আমার অলঙ্কার, আমার অহঙ্কার, করে তোলে। রবীন্দ্রবিরোধিতায় এই প্রথম আমি আমার ভিতরের আমিকে অন্যভাবে খুঁজে পাই, ‘সবলার মত। আসলে নারীর প্রকৃত অবস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেও সংশয়ে ছিলেন। নাহলে আবার এই রবীন্দ্রনাথই তাঁর কোনো কোনো কবিতায় নারী জীবনের বাস্তবতাকে গ্রহণ করবেন কেন? 'রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা / বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা' …আসলে 'রবীন্দ্র-ভুবনে নারীর অবস্থান, রবীন্দ্র-মানসে নারীভাবনা এক দ্রুত পরিবর্তনশীল কালপর্বের মধ্যে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে। সেই গতিমুখ পিছনের দিকে নয়, সামনের দিকেই। রবীন্দ্র-মানসের প্রগতিমুখীন চলিষ্ণুতা এর মধ্য দিয়েই অনুভব করা যায়।' রবীন্দ্রনাথ আমার ব্যক্তিগত জীবনে জড়িয়ে আছেন সাহিত্য থেকে জীবনাদর্শের নানান স্হূল সুক্ষ্ম বিচারে, জড়িয়ে আছেন আমার বিজ্ঞানচেতনায়, অথবা  লোকায়ত জীবনের নিজস্ব অনুভূতিতে । আগেও বলেছি আবার বলছি। আমার রক্তে আমার চিন্তায় আমার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ আমার মায়ের দেওয়া উত্তরাধিকার। আমার বারোমেসে আটপৌরে জীবনের ঝোলে ঝালে অম্বলে রবীন্দ্রনাথ। আমার কাছে বাংলা মানে রবিঠাকুর,বাঙালিয়ানা মানে রবিঠাকুর, গান মানে রবিঠাকুর, আমার কাছে উনি কবিগুরু বা বিশ্বকবি নন,নন রাশভারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও, উনি আমার কাছে শুধুই রবিঠাকুর ,আমার বড় আদরের রবিঠাকুর।

    *সংশপ্তক:*  আরও একটি বিষয়কে কবি দ্ব্যর্থহীন ভাবে তুলে ধরেছিলেন, সে হল শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব! তিনি খুব সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন বারো বছর বয়স অব্দি শিশুদের শুধুমাত্র মাতৃভাষাতেই শিক্ষা দেওয়া উচিৎ অথচ আজকের দুই বাংলায় নার্সারি থেকেই স্বছ্বল পরিবারের শিশুদের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই ভর্ত্তি করার জন্যে অভিভাবকরা আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লাগেন এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
    মৌ: রবীন্দ্রনাথের অনুচিন্তনে প্রোথিত বিষয়াবলির মধ্যে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিলো বাংলাভাষা৷ মাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে ছিলো তাঁর আজন্ম সংগ্রাম৷ ‘ভারতী' পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, ‘‘ইংরাজিতে যাহা শিখিয়াছ তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলা সাহিত্য উন্নতি লাভ করুক ও অবশেষে বাংলা বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক৷''মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে বাংলাদেশে সকল প্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিরজীবন উদ্বিগ্ন ছিলেন৷ ‘‘কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়৷'' সরকারী ফরমান পড়ে আমরা সবাই জানি যে, ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমানএখন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা তো আমাদের ছোটবেলা থেকে বিতর্কের চটপটা বিষয়, এ নিয়ে স্বপক্ষে বা বিপক্ষে বেশী কি বলব। তবে রবিঠাকুরের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনো না করেও ইংরাজী ভাষায় যা বুৎপত্তি বা বিশ্বের সাহিত্য জগতে, বইয়ের পাতায় যতটা পরিচিতি তাতে করে আজকের দুই বাংলায় নার্সারি থেকেই স্বছ্বল পরিবারের শিশুদের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই ভর্ত্তি করার জন্যে অভিভাবকরা আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লাগার বিষয়টি তাত্বিকভাবে সমর্থন যোগ্য না হলেও আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার যুগে, সমাজ সংস্কৃতির বিশ্বায়নের নিরিখে ফেলনাও বলতে পারছি নাএর সাথে রবীন্দ্রভাবনাকে মেলানোতো মুশকিল


    *সংশপ্তক:* বর্তমান শতাব্দীতে বিশ্বায়ন নিয়ে আমরা সবাই বিপুল ভাবে উৎসাহিত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কোণে কোণে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ততটা উৎসাহ নেই বলেই মনে হয় এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি? কি ভাবে কারা এই বিষয়ে সঠিক দায়িত্ব নিতে পারে বলে মনে করেন আপনি?
    মৌ: এই তো কিছুদিন আগে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রাবন্ধিক অশোক মিত্র- একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম একটি সাহিত্য পত্রিকায় তিনি জানিয়েছেন: 'আমি কবিতা ছেড়ে দিলাম, রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস ছেড়ে দিলাম আমি বলব, অন্য কিছু নয় শুধু গীতবিতান নিয়ে সারাজীবন পড়ে থাকা যায় বাঙালি মধ্যবিত্ত, যাঁরা লেখাপড়া একটু শিখেছেন, তাঁরা হয়তো সহজভাবে রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে প্রবেশ করতে পারেন কিন্তু আমার ধারণা, যে মানুষটা এখনও সাক্ষর হওয়ার সুযোগ পায়নি, কিন্তু তাঁর মানবিক বৃত্তিগুলি বিকশিত হয়েছে আমাদের সমাজের এই দ্বান্দ্বিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, সেই মানুষটিও রবীন্দ্রনাথ থেকে শুধু শ্রবণের সাহায্যে জীবন সম্পর্কে প্রেরণা পেতে পারেন আর পড়াশোনা জানা মধ্যবিত্তের তো কথাই নেই ....... সুতরাং রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে কোথায় যাব? ...... হ্যাঁ, নিশ্চয় সময় পাল্টাবে, যুগের আদল অন্যরকম হবে, আমাদের চিন্তায় নতুন ভাবনার প্রলেপ পড়বে, কিন্তু নতুন ভাবনাকে যদি আরও গভীরে গিয়ে প্রকাশ করতে চাই, তার ব্যঞ্জনা অনুভব করতে চাই, তাহলে আমাদের রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফিরতে হবে

    আমারও মনের কথাবিশ্বায়ন হচ্ছে হবে যুগের সাথে পা মিলানোই যুগের ধর্ম সময়ের সাথে আপনি আমি, আমাদের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী প্রজন্ম সবাই এগোব তা বলে সে এগানো পুরানোকে বিসর্জন দিয়ে বা সমূলে উপড়ে ফেলে নিশ্চয়ই নয় আবার অন্ধের মত আঁকড়ে ধরেও নয়তাই রাবিন্দ্রিক ভাবনা বা চেতনারও বাংলায়নই শুধু নয়, বিশ্বায়নও হবে রবীন্দ্রসম্পদের চর্চা, মূল্যায়ন, বিস্তারীকরন সবই চলবে, তবে নিজের পথে, নিজের মত করে কখনো সামুহিকভাবে তো কখনো ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর এর দায়িত্ব ভার আপনার আমার মত সাধারন মানুষের ওপরই বর্তাবে তৃতীয়পক্ষের ওপর দায়ভার চাপিয়ে আমরা তো চোখ বুঁজে থেকে নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারব না


    *সংশপ্তক:* আমাদের বাঙালি সমাজের তরুণতর প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কি ক্রমহ্রাসমান? যদি তাই হয়, তবে তার মূলগত কারণ কি বলে আপনার মনে হয়?
    মৌ: প্রশ্নটি শুনতে নিদারুন, সত্যি উত্তর দেওয়ার প্রচেষ্টাও খুবই দুঃসাহসিক । আমি বরঞ্চ এক ঐতিহাসিক দলিলের কথাই প্রথমে বলি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সত্তরতম জন্মদিনে, রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি প্রশস্তিপত্র রচনা করেছিলেন এবং সেটি পাঠ করেছিলেন কবি কামিনী রায়। সেই প্রশস্তিপত্রটা অনেকটা এরকম

    কবিগুরু,
    তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই। তোমার সপ্ততিতম বর্ষশেষে একান্তমনে প্রার্থনা করি জীবনবিধাতা তোমাকে শতায়ু দান করুন; আজিকার এই জয়ন্তী উৎসবের স্মৃতি জাতির জীবনে অক্ষয় হউক। বাণীর দেউল আজি গগন স্পর্শ করিয়াছে। বঙ্গের কত কবি, কত শিল্পী, কত না সেবক ইহার নির্মাণকল্পে দ্রব্যসম্ভার বহন করিয়া আনিয়াছেন; তাঁহাদের স্বপ্ন ও সাধনার ধন, তাঁহাদের তপস্যা তোমার মধ্যে আজি সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। তোমার পূর্ববর্তী সকল সাহিত্যাচার্যগণকে তোমার অভিনন্দনের মাঝে অভিনন্দিত করি। আত্মার নিগূঢ় রস ও শোভা, কল্যাণ ও ঐশ্বর্য তোমার সাহিত্যে পূর্ণ বিকশিত হইয়া বিশ্বকে মুগ্ধ করিয়াছে। তোমার সৃষ্টির সেই বিচিত্র ও অপরূপ আলোকে স্বকীয়-চিত্তের গভীর ও সত্য পরিচয়ে কৃত-কৃতার্থ হইয়াছি। হাত পাতিয়া জগতের কাছে আমরা নিয়াছি অনেক কিন্তু তোমার হাত দিয়া দিয়াছিও অনেক। হে সার্ব্বভৌম কবি, এই শুভ দিনে তোমাকে শান্তমনে নমস্কার করি। তোমার মধ্যে সুন্দরের পরম প্রকাশকে আজি বারংবার নতশিরে নমস্কার করি।” (১১ই পৌষ ১৩৩৮)
    রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাঙালির এই আবেগ এখন কিন্তু আর স্বতঃস্ফূর্ত নেই লজ্জাষ্কর হলেও এটা সত্যি, যে, আমারা এখন একটা পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির নকলীকরনের জোয়ারে ভাসছি। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সবর্ত্র এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। খানিকটা হলেও এটা হয়ত বিশ্বায়নেরই ফল। বাইরে থেকে নিতে তো বাধা নেই তবে নিজস্বতাকে খুইয়ে ফেললে তো বিপদ। বাঙালী এমনতেই হুজুগে জাত। ফলে চিনেবাদামের খোলায় আমের শাঁস ঢোকাতে গেলে যা হয়। স্থানাভাবে বা চাপের চোটে মিষ্টি রসটা বরবাদ হয়ে ছিবড়েটুকুই হাতে থাকে। এখন মাঝখান থেকে কি হয়েছে  ,অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্টের মত অধিক প্রতিভার ভীড়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের ভালোবাসা মুগ্ধতা মোহ দরকচা মেরে সব একটা বিশেষ দিনে, বিশেষ ঋতুতে সংস্কৃতিমনস্ক হয়ে ওঠার এক মেকি প্রচেষ্টা ,এক লোকদেখানি আবেগের বহিঃপ্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই বিপ্রতীপধর্মী  আবেশেই  কবির বিস্মরণের কারণ, অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।

    *সংশপ্তক:* রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ছোট আমি থেকে বড়ো আমি হয়ে ওঠার গুরুত্বের কথা, *“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”*; তবু যেন আমরা ক্রমেই ছোট ছোট আমির দুর্ভেদ্য খোলসের মধ্যেই ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ এই বিষয়টি আপনাকে কতটা আহত করে বা বিচলিত করে?
    মৌ: খুব সত্যিকথা, যন্ত্র সভ্যতার যুগে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে আমরাও বুঝি ধীরেধীরে যন্ত্রমানুষই হয়ে যাচ্ছিআমি-তুমি, আমরা শব্দগুলো থেকে সযত্নেআমিকে সরিয়ে এনে টাকা-পয়সা, জ্ঞান-গরিমা, সামাজিক উঁচ-নীচের শক্ত বর্ম পরাচ্ছি আর এভাবেই এক দুই তিন করে আমরা ক্রমেই ছোট ছোট আমির দুর্ভেদ্য খোলসের মধ্যেই ঢুকে যাচ্ছি জানি এটা ঠিক না , মানি এটা চরম অন্যায় কিন্তু এড়াই কি করে? অতএব এখানেওআমিথেকে আবারআমরাহতে প্রতীক্ষার ক্ষণ দীর্ঘায়ত করি আবার সেই রবি ঠাকুরেরই শরণ নিই
    আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে-/ রাখিয়া জ্বালি আলো।/ তুমি তো ভালোবেসে আজি একাকী শুধু আমারে/ বসিতে হবে ভালো।/ আমার রাত্রি তোমার আর হবে না কভু সাজিতে/ তোমার লাগি আমি/ এখন হতে হৃদয় খানি সাজায়ে কুল রাজিতে/ রাখিব দিনযামী।

    *সংশপ্তক:* আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের বাংলায় রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু থাকবে বলে আপনি আশাবাদী?
    মৌ: আমার কাছে  রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতির অভিভাবকই শুধু ননতিনি আমার অন্তরেরও অভিভাবক। আমার নিজস্ব দৃষ্টভঙ্গিতে যা দেখেছি, বুঝেছি এবং অনুভব করেছি তাতে আমি দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি যে রবীন্দ্রনাথ আমায় 'ক্ষুদ্র ও সসীম' মানুষের ভেতরে 'বৃহৎ ও অসীম' ঈশ্বরের 'উপস্থিতি  দেখিয়েছেন, অনুভব করিয়েছেন ! ' শুধায়োনা কবে কোন গান / কাহারে করিয়াছিনু দান / পথের ধূলার পরে / পরে আছে তারি তরে / যে তাহারে দিতে পারে মান। তুমি কি শুনছো মোর বাণী / হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি? / জানি না তোমার নাম, / তোমারেই সঁপিলাম / আমার ধ্যানের ধনখানি। রবীন্দ্রনাথ যখন সাহিত্য রচনায় এসেছেন তখনও বাংলাভাষা তার নিজস্ব ভাব ও আকার নিয়ে নিজস্ব ছন্দ খুঁজে পায়নি। একদিকে তখন সংস্কৃত ঘেঁষা, তৎসম শব্দবহুল ভাষায় বাংলা ভাষা ছিল ভারাক্রান্ত। রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে পড়লেন। ভাষায় ছাঁটলেন সংস্কৃত ঘেঁষা শব্দ। তৎসম শব্দের বাহুল্যকে পরিত্যাগ করলেন। করে ভাষায় আনলেন বিপ্লব। বাংলাভাষা হয়ে উঠল বাঙালির মনের ভাষা। প্রাণের ভাষা। সে ভাষায় অতঃপর তিনি লিখলেন অনবদ্য সব ছোটোগল্প। বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা ছোটো গল্পের জন্ম হল। জন্ম নিল আবহমানকাল বাঙালির জীবনের গান। বাঙালির প্রাণের সংগীত। রচিত হল আধুনিক উপন্যাসের ধারা। লিখিত হল নতুন এক নাটক, যে নাটকের ভাষা হয়ে উঠল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। প্রকৃতি পরিবেশ ও লোকসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান ভোলার নয়। পরিবেশ সচেতনায় রবীন্দ্রনাথ যেমন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তেমনি লোকায়ত জীবন থেকে তার নিজস্ব অনুভূতিকে তুলে এনে লোকায়তসাহিত্য চর্চাকে তিনি মানুষেরই মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় তাঁর বিজ্ঞানচেতনা, তাঁর সমাজভাবনা, তাঁর দেশগঠনের চিন্তা ও সভ্যতার সংকটে তিনি কীভাবে মানবজাতিকে পথ দেখাতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর স্বদেশী ভাবনা, তাঁর সমবায়নীতি, বাংলার কৃষককুলের প্রতি তাঁর ভাবনা, তাঁর দেশ গঠনের চিন্তা ও সভ্যতার সংকটে তাঁর এগিয়ে আসার কথা কোনটাই ভোলার ত নয়ফলে রবীন্দ্রনাথের কাছে আজও আমাদের আশ্রয়। সব মিলিয়ে  দ্ব্যর্থহীনভাবে যে কথা বারবারই উঠে এসেছে, তা হল এই একুশের শতকে এসেও রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের জীবনে ভীষণরকমভাবে প্রাসঙ্গিক! আমাদের অগ্রজদের সময়ই বলুন, কি আমাদের সময়ে, রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতার বিশেষ হেরফের হয়নি। অতএব আমি আশাবাদী যে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের বাংলাতেও রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কমবেশী মোটামুটি একই থাকবে, থাকতে বাধ্য।।


    [মৌ দাশগুপ্তা কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক]

    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.