>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • শাকিলা তুবা

    SongSoptok | 8/15/2015 |





    বিজন বনের দিকে
    নেই হবার জন্যে বিকেলের শরীর থেকে রোদটুকু আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে হাজী সাহেবের তিনতলা বাড়ীর ছাদের দিকে। নীচে এইখানে আমাদের একতলা বাড়ীর উঠানে আমরা এতগুলো ছেলেমেয়ে হই হই করে গোল্লাছুট খেলছি। ঘামে ভিজে একেকজন জুবজুবে। মুখের উপর, নাকের নীচে চিকমিক করছে তারই ছিটেফোঁটা কুঁচিজল। সেমাইওয়ালার ছেলে হানিফকে ওরা ধরে ফেলেছে, সে আর নিঃশ্বাস আটকে রাখতে পারছিল না। সমস্বরে তখনো আমাদের সবার উল্লাস, ‘হানিফ মরেছে, হানিফ মরেছে।হানিফ মরে আমাদেরকে জিতিয়ে দিয়েছে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির বিকেলগুলো আমাদের এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। নিত্যনতুন প্ল্যান আর বাদরামীতে বড়রা তখন প্রায় অতিষ্ঠ। বিকেল শেষ হয়ে রাত নেমে এলেই যে যার বাসায় গিয়ে টিভি দেখো, গল্প শোনো। বারণ কে করেছে! এমনই এক সন্ধ্যায় দেখলাম আমাদের বারান্দায় চেয়ারে বসা মাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা। এই জটলার মানে হল সালিশ টাইপের কিছু। কি না, রশিদ মামাকে আর আমাদের বাসায় থাকতে দেয়া চলবে না, মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে চাঁন মিয়া চাচার আর্জি নিয়ে মার কাছে এসেছে ওবাড়ীর মেয়েরা। সময়টা ঊনিশ শ সাতাত্তর/আটত্তর হবে হয়তো।

    বিধবা শামসুন বুজি কি জানি কবে থেকে দুই ছেলেমেয়ে রানী-নাদিম এবং সাথে মা আর ভাই রশিদ মিয়াকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসে উঠেছিল জানিনা। আমার মায়ের ছিল দয়া নামের রোগ। মারই প্রশ্রয়ে ওরা আমাদের উঠানের শেষপ্রান্তে যেখানে জঙ্গল সেখানকার খানিকটা জায়গা সাফসুতরো করে বেড়ার একটা ঘর তুলে থাকা আরম্ভ করেছিল। শামসুন বুজি আমাদের ঘরের কাজকর্ম করত, বিনিময়ে কিছু পারিশ্রমিকও পেত। এখানে থাকতে থাকতেই রশিদ মামাকে তার মা বিয়েও করিয়েছিল। রশিদ মামার ছোট্ট ছেলে রমজান তখন আমাদের চোখের মনি। এই রশিদ মামাকে সবাই চলে যেতে বলছে? কেন? হয়েছে কি, রশিদ মামার নিঃসন্তান ডিভোর্সড খালাতো বোন জানু বুজিও তখন এদের সাথে এসে একসাথে থাকা শুরু করেছিল। মুলতঃ জানু এর ওর বাড়ীতে ছুটা কাজ করে এসে রাত্তিরে ওদের বাসায় ঘুমাত। জীবনে দেখা প্রথম পরকীয়ার জুটি ছিল এরাই। জানু বুজি ছিল চরম হাসিখুশী একটা মেয়ে। মিশমিশে কালো গায়ের রঙ আর ছিপছিপে শরীরি গড়ন নিয়ে সে যে কত রকমের নাটক, সিনেমার ডায়ালগ শুনিয়ে, মুখভঙ্গি দেখিয়ে আমাদেরকে তাক লাগিয়ে দিত সেটা বলেও বোঝানো যাবেনা। অপরদিকে রশিদ মামার বউ মানে রমজানের মা ছিল প্রবল ফর্সা আর স্থুল শরীরের এক গোমড়ামুখি মানুষ। জানু যখন গোসল করিয়ে, খাইয়ে দাইয়ে রমজানটাকে কোলে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরুত তখন আমাদেরও মনে হত, আহা রশিদ মামার বউ যদি এই জানু মেয়েটি হতো কেমন নন্দনীয়ই না হতো বিষয়টা! আমরাও দেখতাম রশিদ মামাকে দেখলেই জানু বুজির মুখের সেই চাপা হাসি, মুখ ধোবার ছলে এল্যুমিনিয়ামের লোটা থেকে দুই এক আঁজলা পানি জানু বুজির মুখে ছিটিয়ে দিয়ে রশিদ মামার অদৃশ্য হওয়ার দৃশ্যাবলী। তখনো এতই ছোট ছিলাম যে ওগুলোকে নিছক মজা হিসেবেই ধরে নিতাম। একদিন রমজানের মাকে বিড়বিড় করে বলতে শুনেছিলাম, ‘এই জানুর লাইগ্যাই আমার ঘর পুড়বসেদিন কি রাগ লেগেছিল আমার। কেন যে মহিলাটা জানু বুজিকে এত অপছন্দ করে! আমার বরং এই মহিলাটিকেই দারুন বিরক্তিকর মনে হত। মুখে হাসি নেই, সারাদিন কাজ আর কাজ। আজ এত বছর পর এই মহিলার জন্যেই আমার মন কেমন করে ওঠে। গ্রাম থেকে পরিবার পরিজন ফেলে আসা এই মেয়েটি মনে কত কষ্ট নিয়েই না পার করছিল তার একেকটি দিন। এর মুখ গোমড়া হবে না তো কি আমার মুখ গোমড়া হবে?

    মা ছিলেন বিচক্ষন মানুষ। তিনি চাননি রশিদ মামাকে তাড়িয়ে দিতে। বলেছিলেন, ‘আমার হাত থেকে বের হয়ে গেলেই ও জানুকে বিয়ে করে ফেলবে, আমাকে আরেকটু সময় দিন ওকে শাসন করবার। আমি বরং জানুকেই চলে যেতে বলি।ওরা মাকে সেই সুযোগ দেয়নি। একুশ বছর বয়সী রশিদ মামার নতুন সংসার শুরু হয়েছিল জল্লায়, বস্তির এক ঘরে, তাও তিনমাসেরতিন মাস পরে রমজানের মা চলে গিয়েছিল গ্রামে আর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল জানু বুজি। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পরবর্তী জানু বুজির মুখটাও রমজানের মায়ের মতই গোমড়া হয়ে উঠেছিল ক্রমশঃ। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম শিক্ষা যে কারো কবরের উপর সুখের ঘর তোলা যায় না। এক অর্থে রমজানের মা তো ছিল মৃতই।

    রশিদ মামা চলে যাবার দুই বছরের মধ্যে শামসুন বুজির সংসারটাও আস্তে আস্তে বিলোপ হয়েছিল তবে এই বিলুপ্তিটা ছিল সুন্দর। তার আগ পর্যন্ত আমাদের সেই ছিল হৈচৈ, এক্কাদোক্কা আর গোল্লাছুটের দিন। জমজমাট থাকত উঠানটা সব সময়। আমার পিঠাপিঠি বড় ভাই হাসানকে মাঝে মাঝে বাসায় দেখা গেলেও আমার দেখা কদাচিৎ পাওয়া যেত। আমি তখন মজবুত করে গুলতি বাঁধি, কোপ খাওয়া লাট্টুগুলো আলাদা করে রাখি আর আরো যত রাজ্যের সব কাজে ব্যস্ত থাকি। এরই মধ্যে আমার সেজফুপ্পা ব্যংকের উচ্চপদস্থ অফিসার হওয়ায় অফিস থেকেই মিন্টোরোডে সরকারীভাবে তাকে দেয়া হল আলীশান এক বাড়ী। সেই বাড়িতে লাগবে কাজের লোক। রান্নাবান্নার, ঘর সাফ সুতরোর আরো অনেক রকমের। ফুপ্পির বাসায় রান্নার কাজে মা শামসুন বুজিকে পাঠালেন। শামসুন বুজির মা আর দুই ছেলেমেয়ে রয়ে গেল সেই ছোট্ট ঘরটাতেই।

    স্কুল ছুটির অর্ধেকটা সময় আমার আর হাসানের কাটত সেজফুপ্পির বাসায়। কেননা ফুপ্পির সাথে আমার আরো তিনটে ভাইবোনও থাকত। ওদেরকে দেখবার জন্যে আমরা মুখিয়ে থাকতাম। ছোট্ট থেকেই দেখে আসছি, আমাদের বাবা নেই। এগারোটা ছেলেমেয়ে নিয়ে মা নিশ্চই খুব বিপাকে পড়েছিলেন এক সময়ে নইলে আমরা বাকী ভাইবোনেরা মার সাথেই তো ছিলাম চিরকাল। ছিল না শুধু ওরা, আমার তিনটি ভাইবোন। ওরা ফুপ্পি-ফুপ্পার কাছে অনেক আদরেই ছিল, তবু আজো কোথায় যেন বুকের ভেতরটা আমার পুড়ে পুড়ে ওঠে। আমরা কক্ষনো বিচ্ছিন্ন হইনি। এখনো এই তিন ভাইবোন যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, এখনো আমরা সবগুলো ভাইবোন একসাথে হলে খুশীর বন্যা বিস্তৃত হয় মনের ভেতর তুমুল, তবু আমার বিশ্বাস আমাদের সাথে একসাথে থাকতে না পারার বেদনা ওরাও মনে মনে বয়ে বেড়ায়, এখনো। তো, ফুপ্পির বাসায় গেলেই দেখতাম শামসুন বুজিকে। অনেক হাসিখুশী। বলা হয়নি, শামসুন বুজি ছিল অসম্ভব রূপবতী এক মহিলা। আমাকে আকৃষ্ট করত তার কন্ঠস্বর। মেয়েদের কন্ঠ যেমন সরু হয় তেমন নয় মোটেই, আবার পুরুষালীও নয়। মেয়েদের কণ্ঠ বেইজে থাকলে যেমন তেমন আর কি! অনেকটা খবর পাঠিকাদের মতন ভরাট আর স্পষ্ট। এই শামসুন বুজি ছিল মারাত্মক শুভ্র এক মানুষ। গতানুগতিক কাজের মেয়ের মত নয়। চমৎকার ছিল তার বোধবুদ্ধি, পুরুষদেরকে এড়িয়ে চলত ঠিকই তা বলে কারো সাথে কথা বলত না এমনও নয়। মোটের উপর সেই রকম এক ব্যাক্তিত্বের মহিলা।

    সেবারের ছুটিতে মিন্টো রোডের বাসায় গিয়ে শুনলাম শামসুন বুজি বিয়ে করবে ঐ বাসারই মালিকে। যদিও মালির আগের ঘরে রয়েছে বউ-ছেলেমেয়ে। তবু মালি শামসুন বুজি ছাড়া কিচ্ছু বোঝে নাএ রকম একটা পরিস্থিতিতে শামসুন বুজি প্রথমে রাজী হয়নি পরে রাজী হয়েছিল শুধু লোকটা তার তিনটে বাড়ী থেকে একটা বাড়ী তাকে লিখে দেবে এই শর্তে। তখনই পেয়েছি জীবনের আরেক পাঠ। শামসুন বুজি মাকে বলেছিল, ‘মামানি আবার যদি বিয়া করতেই হয় তাইলে বাড়ী না নিয়া করমু ক্যান? এইটা তো আর আমার পছন্দের বিয়া না। জীবনে ভাল থাকতে হইলে, আমার বাচ্চাগো ভালা রাখতে হইলে এইটাই তো ভালা, কি কন মামানি? তবে আপনি যদি মানা করেন তাইলে এইটাও থাক।মা সম্মতি দিয়েছিল কেননা ফুপ্পির কাছে মালীর আগের পক্ষের বউ এসে অনুরোধ করে গিয়েছিল যেন শামসুন বুজির সাথে তার স্বামীর বিয়েটা দিয়ে দেয়া হয়, নইলে তার স্বামী আর বাঁচবে না এবং তার স্বামী নাকি চরম চরিত্রবান এক লোক কিনতু হঠাৎ করে এই প্রেমে পড়ায় লোকটা আর টাল সামলাতে পারছে না তাই স্বামীর এই প্রেমকে সে অবজ্ঞা করে কি করে! হায়রে নারী!! কত রকম তাদের মন!!!

    বিয়েটা হয়েছিলখুব সুখেই ছিল শামসুন বুজি পরবর্তী জীবনে। তারা দুই সতীনে মিলেমিশে নাকি লোকটার সম্পত্তি আরো বাড়িয়েছিল, সুখে রেখেছিল ওরা পরস্পর পরস্পরকে সারা জীবন। শামসুন বুজির কাছ থেকে এটাই তো কাম্য ছিল। কি মিষ্টি একটা মেয়ে যে ছিল সে। মুখে সব সময় লাজুক এক ফালি হাসি আর মাথায় একটু টেনে ঘোমটা দেয়া আগুনের মত রূপবতী এই নারী আমাকেও দিয়েছিল মাতৃস্নেহ, ভুলি কি করে!

    আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন তার বিয়ে হয়ে গেছে। রানী আর নাদিমকে নিয়ে সে গিয়ে উঠে গেছে রামপুরায় স্বামীর দেয়া তার নিজের তিনতলা বাড়ীটাতে। আমাদের উঠানের উৎসব এতে বন্ধ হয়ে যায়নিকো তা বলে। শামসুন বুজির ঘরটা ওভাবেই পড়েছিল অনেকদিন। আবারো আরেক দুঃখি লোক মন্নাফ ভাই আর ভাবী এল ওটাতে থাকতে। এরা ছিল হতদরিদ্রের চেয়েও দরিদ্র। কেননা মন্নাফ ভাই ছিল পাগল অর্থাৎ ছিটগ্রস্ত, কোনো কাজ করত না। লোকে ওকে ডাকত পাগলা মন্নাফ। বিশাল দশাসই এই লোকের আকৃতি, দেখতেও ভালই শুধু কপালের দুইপাশে কাটা দাগ দুটো ছাড়া। শুনেছি একসময় মন্নাফ ভাই ট্রাক চালাত। ঘরে ছিল তার রূপবতী বউ। সেই বউ আবার সিনেমায় একস্ট্রা হিসেবে কাজ করত। সেই বউকে আমি কখনো দেখিনি তবে তার রূপের কিছুটা দেখা পেয়েছিলাম তার রেখে যাওয়া মেয়ে নুরজাহানের ভেতরলোকে বলত সে ছিল মেয়ে নুরজাহানের চেয়েও বেশী সুন্দরী। সত্যি বলছি, এই মেয়েটার অত রূপ কিভাবে, কোত্থেকে এসেছিল এটা ভেবে আজো আমি পেরেশান হই। এ যাবতকাল আমার দেখা সেরা সুন্দরী মুখটা হল ওই নুরজাহানেরই। ছিল বটে সে রূপসী কিনতু এমন অসভ্য আর মুখরা মেয়েও আমি দেখিনি। নুরজাহান যখন ছোট তখন মন্নাফ ভাই একবার ট্রাক এক্সিডেন্ট করে কোমায় ছিল দুইদিন। কেউ নাকি ভাবেনি লোকটা বাঁচবে। আর সেই অবসরে তার ফিল্মি বউ হয়েছিল লাপাত্তা। ফেরত এসে মন্নাফ ভাই হয়ে গিয়েছিল পাগলা মন্নাফ। তার পরবর্তী বউকে নিয়েই সে আমাদের বাসায় এসেছিল থাকতে। এই বউটাও মানুষের বাসায় কাজ করত। এই বউয়েরও ছিল একটা পুতুলের মত মেয়ে, নাম লিপি। বউটি ছিল ছোটখাটো হালকা গড়নের মিষ্টি একটা মেয়ে। আমরা তখন ভাবী বলতে অজ্ঞান। জীবনের প্রথম ভাবী ডাক, তাই মনের সুখে যখন তখন তাকে ডাকতাম। সেও ছিল তেমনি। সর্বদা নরম আর খুশী বিলানো চেহারা। অথচ এই ভাবীর জানটা ঝালাপালা করে রেখেছিল নুরজাহান। তের বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ওর আর পনর বছর বয়সেই স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে এসেছিল নতুন মায়ের হাড় জ্বালাতে। ভাবী একে নিয়ে হিমশিম খেত। সারাক্ষন ঘরের দরজার সামনে বসে থেকে মাকে সে নিত্য ফরমাস দিয়ে যেত। মন্নাফ ভাই কিছুই বলত না কারন জানো তো সেও নাকি ছিল এই মেয়েটির প্রতি মারাত্মক দুর্বল।

    ভাবীর মাথায় ছিল অদ্ভুত কিছু জটা। অনেক লম্বা আর আকর্ষনীয়। ভাবী বলত, ‘বুঝলা বইন এইগুলা আমি হপ্নে পাইছি, এইগুলারে তাই অনেক পাক পবিত্র রাখতে হয়আমি এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতাম না। তবে সময় অসময়ে ওগুলো দেখতে চাইতাম এটা ঠিক। এত ভাল বউ পেয়েও মন্নাফ ভাই কিছুদিন পর পর বউকে পেটাত। কি যে দুঃখ হত তখন আমাদের। সমস্ত ঝগড়ার উৎপত্তি হত নুরজাহানের কাছ থেকে। তাই যতই সুন্দরী হোক না সে, তাকে কেউই দেখতে পারত না। এটা নিয়ে খুব যে একটা মাথাব্যথা ছিল ওর তাও না। সমগ্র পৃথিবীর প্রতি ওর এক ধরনের তাচ্ছিল্য ছিল যা আমাকে এই বয়সেও বেশ ভাবায়। অমন ছোট বয়সেই এই মেয়ে কি করে এত সাহসী হয়েছিল এটা নিয়ে এখনো ভাবি। যা হোক, এক সকালে দেখলাম ভাবী কাঁদতে কাঁদতে মাকে নালিশ জানাল, ‘হাসান ভাই কাইল বিকালে ছাদে খাড়াইয়া পেচ্ছাব করসে, ঐ পেচ্ছাব লাগসে আমার মাথার জটায় এখন মাথা ব্যথায় আম্মা আর তো বাঁচি না। আমার সর্বনাশ হইল গো আম্মা, জটাগুলি বোধহয় আর থাকব না আর জটা না থাকলে আমার সংসারে শনি ঢুকব।জানিনা কেন, কথাটা সত্যি হয়েছিল।

    সত্যিই ভাবীর মাথার সব জটা খুলে খুলে পড়ে গেল। আর এর তিনমাসের মাথায়ই নুরজাহান হল অদৃশ্য আর মন্নাফ ভাইয়ের পাগলামিও বেড়ে হল চূড়ান্ত। ভাবীকে দেখেছি এমন স্বামীকেও কেমন দেবতাজ্ঞানে সেবা করে যেতে। এই ভাবী, এই ছোটখাটো পাতলা বউ বউ রকমের ভাবীটার জন্যেও আমার মন আজো কেমন করে, জানতে ইচ্ছে করে তার ছোট্ট মেয়ে লিপিটাকে নিয়ে সে এখন কেমন আছে, কোথায় আছে।

    দিন কেটেই যাচ্ছিল। এরই মধ্যে এক সকালে নুরজাহানকে দেখা গেল আমাদের বাড়ির গেটের সামনে পা ছড়িয়ে বসে থাকতে। এতদিন কোথায় ছিল এসবের কোনো উওরই নেই তা বলে এতটুকু নমনীয়ও সে নয়। প্রত্যেকের কথার ঝাঁজাল সব উত্তর। অনেক সাজগোঁজ করেছিল সে। অথচ গলার নীচের ভাঁজে চিকন হারের মত ময়লা জমে ছিল তার যা কিনা ঘামের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ওর ব্লাউজের গলায়। সে নির্বিকার ভাবে কেবল গায়ের ঘামাচি খুঁটছিল। বেলা উঠতে উঠতেই আবারো সালিশ। কি না, এই নুরজাহানকে এখানে রাখা যাবে না। পারুলীর মা পাক্কা খবর এনেছে, ও নাকি পাড়ায় নাম লিখিয়েছে। পাড়া কি, কেন ওরা এসব বলছে তখনো এসব বিষয়ে আমরা ছিলাম দারুন মুর্খ। ওই দিনটাতেই তাকে দেখেছিলাম। পরেরদিন বাসাটা ফাঁকা। এইবার মন্নাফ ভাই মেয়ে আর বউ নিয়ে আমাদের মহল্লা ছেড়েছে কাউকে না জানিয়েই। এমন স্নেহশীল পিতা এ জগতে আর কয়জনা আছে?

    অনেক বছর কেটে গেছে এরপর। আমি তখন মিউজিক কলেজে পড়ি। একজনের কাছে খবর পেলাম রামপুরায় যে বাসায় আমি স্যারের কাছে গান শিখতে যাই তারই খুব কাছেই নাকি শামসুন বুজিরও বাসা। বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠল, আরেকবার এই স্নেহময়ী নারীকে দেখবার বাসনায়। সত্যি সত্যিই একদিন ঠিকানা যোগাড় করে চলেও গেলাম সেখানে। এত বছর পরে একটা মানুষ ঠিক ওই একই রকম থাকে কি করে এটা খুবই আশ্চর্যের। শামসুন বুজি আমাকে দেখে খুশীতে যেন একেবারে পাগলপারা। কোথায় বসতে দেবে, কি খাওয়াবে তার নেই ঠিক। যতক্ষন ছিলাম সারাটাক্ষন আমার গায়ে হাত বুলিয়েছে। আর কত যে জিজ্ঞাসা, এ কেমন আছে, সে কত বড় হয়েছে ইত্যাদি। দেখলাম, কি সুন্দর গোছানো তার সংসার। টিভি, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবল সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার। আমাদের বাসায়ও এত স্বাচ্ছন্দ্য নেই। অথচ লোকটা নাকি ছিল এক মালী। কি করে এই লোকের এত টাকা এসেছিল এটা জানিনা। কিনতু শামসুন বুজিকে রেখেছিল পটের বিবি করে। ওখানে তার সতীনকেও দেখলাম। সেও পাশের বাড়ীতেই থাকে। দুজন দুজনকে সম্বোধন করছিল, ‘অ বু, অ বুবলে। তার সতীনও আমাকে এত যত্ন করেছিল যে বলার না। শুনলাম, রানীর বিয়ে হয়ে গেছে আরো আগেই এখন রানী নিজেই শ্বাশুড়ী হবার মতন অবস্থায়। নাদিমও দুই মেয়ে আর বউ নিয়ে আলাদা থাকে, ব্যাবসাপাতি করে খায়। আশ্চর্য প্রশান্তিতে ভরে উঠল মন। বিদায় নেবার সময়ে শামসুন বুজির কান্না আমাকে আবারো মনে করিয়ে দিল, একদিন আমরা খুব কাছাকাছি ছিলাম।

    বাইরে বেরিয়ে যতই সামনের দিকে হাঁটছি পেছনে তাকালেই দেখছি তিনতলার বারান্দায় ঠায় দাঁড়ানো শামসুন বুজিকে। বুকের ভেতরটা আমারও কেমন এলোমেলো ঢেউয়ে তোলপাড় হচ্ছে। হঠাৎ অনেক, অনেককাল আগের মনে না থাকা একটা দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ঘটনাটার সময়ে আমি এতই ছোট যে ওটা আমার মনে থাকবারই কথা নয়, তবে মার মুখে অনেকবার শুনেছি। কে জানে এত বেশী শুনেছি বলেই কি-না ঘটনাটা আমি আবারো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দেখলাম, মা শামসুন বুজিকে ডেকে বলছে,

    - শামসুন তোকে আর রাখবার সামর্থ্য আমার নেই মা, তুই বরং হাজী সাহেবের বাসার কাজটা নিয়ে নে
    - মামানি আমি কি আপনের কাছে কিছু চাইছি কুনোদিন? আমি যামু না
    - ওরে আমাদেরই বাঁচবার উপায় নেই তোকে বাঁচাব কি করে? বেতনই বা দেব কোত্থেকে?
    - লাগব না আমার বেতন মামানি। আপনেরা যা খাইবেন তা খাইয়াই আমাগো দিনও কাটব।
    তখন মা কেঁদে ফেলে বলেছিল, ‘তোদেরকে খাওয়াবার সামর্থ্যও যে আমার নেইরে। তার চেয়ে তোরা এই বাসাতেই থাক কিনতু কাজ করে নিজেরা তো অন্ততঃ খেয়ে পরে বেঁচে থাক।অতঃপর শামসুন বুজি যোগদান করেছিল হাজী সাহেবের বাসার কাজে। সারাদিন খেটেপিটে রাত্তিরে সে ফিরত বাসায়। সময়টা ১৯৭৪/৭৫ সন। দেশে বেশুমার দুর্ভিক্ষ।

    আমার মনে নেই। মা বলেছিল, ওই সময়ে এই দেশের ঘরে ঘরে ছিল কান্নার রোল। মানুষ না খেয়ে মরে থাকত মাঠে ঘাটে। আমার বিধবা মা বড় কষ্টে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তখন এই দেশে ছিল রেশন কার্ডের চল। আমার মেজভাইয়া নাকি রেশন আনতে যেতেই চাইত না, ফিসফিস করে বলত, ‘খুব অপমান লাগে আম্মাতারপরও এই রেশন থেকেই আসত দুর্গন্ধযুক্ত লাল আটা। আমার প্রতিটা ভাইবোন সেই আটার রুটিই চিবাত অক্লেশে। শুধু নাকি আমি ভাত ছাড়া আর কিচ্ছুটি মুখে তুলতাম না। সারাদিন না খেয়ে থাকতাম আর ক্রমাগত কাঁদতাম। সেই না দেখা একটা দিনের দৃশ্যই যা মার কাছে শোনা তা আমি দেখে ফেললাম আজ। দেখলাম, রাত ঘণ হয়ে এসেছে। কারেন্ট চলে গেছে তাই ঘরে ঘরে হারিকেনের দু এক টুকরা আলো ফুটে উঠছে বটে তবে বাকী সবই অন্ধকার। ওই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা ছায়া যখন হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল আর আমরা ছুটে গেলাম তার কাছে, যেন কত প্রতীক্ষায় রেখেছিল সে আমাদেরকে। তার সারা শরীর শাড়ীতে ঢাকা, ছোট্ট একটা ঘোমটায় মুখের অর্ধকটাও ঢাকা। অতি দ্রুত সে রান্নাঘরে চলে গেল, পেছন পেছন আমরা মানে আমি, হাসান, রানী আর নাদিম। সে ঘরে ঢুকে আঁচলের নীচ থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে বের করে কুপির সামনে মেলে ধরল এক থালা ভাত। সারাদিন কাজ করে নিজে না খেয়ে হাজী সাহেবের বাসা থেকে এই এক থালা ভাত সে নিয়ে এসেছে আমাদের জন্যে। আমরা চারজন মাদুর পেতে বসেছি আর শামসুন বুজি তখন চার ভাগ করে ভাতগুলোকে চারটা প্লেটে তুলে এগিয়ে দিচ্ছে আমাদের দিকে। আমরা খাচ্ছি পাগলের মত আর পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে শামসুন বুজি এই দৃশ্য দেখছে আর নিজে চিবুচ্ছে বাসার সেই লাল আটার ধেবড়ানো বিশ্রী সব রুটি। আমার মা কিনতু তখন পাথরের মতন মুখ করে বসে আছে শোবার ঘরে। একবারো রান্নাঘরের দিকে আসছে না, এমনকি বড় ভাইবোনগুলোও তখন অদৃশ্য হয়ে আছে। আজ শামসুন বুজিকে রেখে চলে যেতে যেতে সেই দৃশ্যটাই স্পষ্ট চোখের সামনে দেখলাম। নিশ্চই এরপরে খেয়েদেয়ে আমরা ঘুমাতে যেতাম। আমাদের চোখের পাতায় নিশ্চই মিষ্টি সব স্বপ্ন খেলে খেলে যেত যার সবটুকুই ছিল শামসুন বুজির দান। সেদিনের সেই দানের কল্যানেই বুঝি আজ বিধাতা আমার চোখে উপরি কিছু আলো এনে জড়ো করেছিল। তাই তো না দেখা সেই দৃশ্যটা আবারো এক নিঃশ্বাসে দেখে ফেললাম আরো দেখলাম, দূরে তিনতলায় দাঁড়ানো শামসুন বুজির বিন্দু বিন্দু দুটো জলডোবা চোখ, যা এতদূর থেকে আদতে দেখতে পাওয়ারই কথা নয়।

    শাকিলা তুবা
    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.