সংশপ্তক: মানুষের সমাজ ও সভ্যতায় ট্রেন ও বিদ্যুৎ
শক্তির আবিষ্কারের মতোই এক যুগান্তকারী ঘটনা ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিকাশ। যার হাত
ধরে উত্থান সোশ্যাল মিডিয়ার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই নবতম উপহারের সাথে আপনার
পরিচয়ের সূত্রপাত সম্বন্ধে যদি একটু আলোকপাত করেন!
রঞ্জনা রায়:.... আমি একজন সাহিত্যসেবী মানুষ । আনুমানিক ২০০০ সাল থেকে আমি ইন্টারনেট পরিষেবার
সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ।e-mail এর মাধ্যমে বিভিন্ন
পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠানোর সুবিধা অনুভব করি । এছাড়া পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের
মানুষের কাছে নিজের ভাবনা ও মত ছড়িয়ে দেবার জন্য ফেসবুক/ হ্যোয়্যটস্ অ্যাপ খুবই উপযোগী মাধ্যম ।
সংশপ্তক: মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে
স্যোশাল মিডিয়ার মতোন এমন শক্তিশালী মাধ্যম আবিষ্কৃত হয় নি আগে। এই যে গোটা
পৃথিবীটাই প্রায় আপনার হাতের মুঠোয়; এই বিষয়টি আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
রঞ্জনা রায়: ইন্টারনেট পরিষেবার মাধ্যমে যে কোন
তথ্য যে কোন সময় মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে । মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বের পরিসর
ব্যাপ্ত হচ্ছে । স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কোন সময় যে কোন অনুভূতি মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেবার সুবিধা আছে । Google Chrome , Mozilla Firefox এইসব সার্চ ইঞ্জিন গুলি
মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছে , দুরকে কাছে নিয়ে আসছে । পৃথিবীর সব তথ্য এখন
হাতের মুঠোয় চলে এসেছে ।
সংশপ্তক: মানুষের সৃষ্টিশীলতা সৃজনশীলতার বিকাশের
ক্ষেত্রে এই সোশ্যাল মিডিয়া সম্পূ্র্ণ একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। যা এক কথায়
অভুতপূর্ব! আগে নির্দিষ্ট কিছু মাধ্যমের ছাড়পত্র না পেলে আপন প্রতিভা প্রকাশের কোন
উপায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন যে কেউ তার সৃষ্টিশীল সৃজনশীল শক্তিকে বিশ্বের
দরবারে নিজেই হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টি আপনি ঠিক কি ভাবে দেখছেন?
রঞ্জনা রায়: আগে যে কোন লেখক শিল্পীকে তার প্রতিভা
প্রকাশের জন্য বিভিন্ন পত্র পত্রিকা মঞ্চ / প্রেক্ষাগৃহের ওপর নির্ভর করতে হত
।সেখানে মনোনয়নের একটি মানদণ্ড ছিল । বর্তমানে ফেসবুক/ হ্যোয়্যটস্ অ্যাপ এর
মাধ্যমে যে কোন লেখক, কবি ,শিল্পী,
চিত্রপরিচালক তাদের সৃষ্টিকে সবার সামনে তুলে ধরতে পারেন । সৃষ্টি কর্মের গ্রহণ
যোগ্যতা নির্ধারিত হয় স্যোশাল মিডিয়ার
দরবারে ।
সংশপ্তক: এই প্রসঙ্গেই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
আমাদের বিচলিত করে। আগে প্রতিভা বিকাশের কোন না কোন একটি মাপকাঠি ছিল। কিন্তু আজকে
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে কেউ নিজেকে কবি সাহিত্যিক সংগীতশিল্পী বলে প্রচার করতেই
পারেন। এবং বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের প্রশংসায় এই ভাবে মধ্যমেধার বাড়বারন্ত
শিল্পসংস্কৃতির পক্ষে কতটা স্বাস্থ্যপ্রদ বলে আপনার মনে হয়?
রঞ্জনা রায়: বর্তমানে
স্যোশাল মিডিয়ায় যে কোন মানুষ নিজেকে গায়ক , সাহিত্যিক , নৃত্যশিল্পী ,
চিত্রপরিচালক , চিত্রকর রূপে তুলে ধরতে
পারেন এবং তাদের পরিচিত জনেরা তাদের সমর্থন ও করতে পারেন ; কিন্তু তারা যদি সত্য
সত্যই প্রতিভাধর না হন তবে তাদের সেই প্রয়াস চিরস্থায়ী হবে না , তা কেবল ধুমকেতুর
মত তাৎক্ষনিক আনন্দের খোরাক হবে । তাই আমার মনে হয় এই ধরনের প্রবণতা শিল্প
সাহিত্যের সুস্বাস্থ্যের কিছুটা ক্ষতি করলেও তার চিরস্থায়ী প্রভাব শূন্য ।
সংশপ্তক: আবিশ্ব বিভিন্ন সংস্কৃতিকে পরস্পরের আরও
কাছে নিয়ে আসতে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুমিকা কতটা শক্তিশালী হতে পারে?
রঞ্জনা রায়:..... সমগ্র
বিশ্বের শিল্প সাহিত্যকে পরস্পরের কাছে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট একটি
শক্তিশালী মাধ্যম । এই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের শিল্পী ,
লেখক বা কবিরা পরস্পরের মাধ্যমে যোগাযোগ
গড়ে তুলতে পারেন । ফেসবুক এক্ষেত্রে খুবই উপযোগী স্যোশাল মিডিয়া ।
সংশপ্তক: এই যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের
লোকসংস্কৃতির সাথে সহজ আদান প্রদানের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে
ব্যবহার করার ক্ষেত্রটি: সেই সম্বন্ধে আমাদের বাঙালিদের সচেতনতা কতখানি ঘটেছে বলে
মনে হয় আপনার?
রঞ্জনা রায়:... আমার মনে হয় স্যোশাল মিডিয়ার
মাধ্যমে আজকাল বাঙালী লেখক , কবি , গায়ক , চিত্রশিল্পী , চিত্রপরিচালকরা বা
সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যুক্ত যে কোন মানুষ তাদের সৃষ্টিকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিশেষত পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা
বাঙালীদের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারছেন ।তারা ই- মেইল ,
ফেসবুক,টুইটার,ব্লগের মাধ্যমে তাদের
বক্তব্য পৌঁছে দিচ্ছেন বিশ্বের দরবারে ।
সংশপ্তক: সোশ্যাল মিডিয়া স্বভাবতঃই সমাজ দর্পনের
ভুমিকায় একটি কার্যকরী মাধ্যম। আমাদের বাঙালি সমাজের প্রেক্ষিতে এই দর্পনের
বর্তমান প্রতিচ্ছবিটি কতটা আশাব্যঞ্জক আপনার কাছে?
রঞ্জনা রায়:...স্যোশাল
মিডিয়ার প্রতি নির্ভরশীলতা ক্রমশ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বাঙালী মহলে বাড়ছে ।শুধু
মাত্র শহরে নয় বর্তমান সরকার গ্রামাঞ্চলেও ইন্টারনেট পরিষেবা ছড়িয়ে দিতে চাইছেন
।মোবাইলের মাধ্যমে অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও স্যোশাল মিডিয়ার সুবিধা পাওয়া যায় ।
সংশপ্তক: একথা আমরা সকলেই জানি, ইংরেজী ও হিন্দীর
দূর্দমনীয় প্রভাবে আমাদের দৈন্দিন জীবনচর্চায় ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাসঙ্গিকতা দ্রুতহারে
ক্রমহ্রাসমান। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ার অভূত্থানে বাংলা ভাষার পুনরুজ্জীবনে কি
কোন আশার আলো চোখে পড়ছে আপনার?
রঞ্জনা রায়: আমি কলকাতায় থাকি । ফেসবুক , হ্যোয়াটস্ ওয়্যাপের
মাধ্যমে আমার লন্ডন , আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া , বাংলাদেশ এবং মিশরে বসবাসকারী অনেক
বাঙালীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ আছে ।দেখি তারা সুদূর বিদেশে বাংলা ভাষার , বাংলা গান ও সাহিত্যের চর্চা করে যাচ্ছেন , অনেক বিদেশীও তা তাদের দেখে বাংলা ভাষা
সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করছেন । এই ধরণের প্রয়াস মনে বাংলা ভাষা পুনরুজ্জীবনের আশা
জাগায় ।
সংশপ্তক: আমাদের এই দ্বিখন্ডিত বাংলায় কাঁটাতারের
দূরত্ব ঘুচিয়ে দুই পারের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও প্রীতির সম্পর্কের
উন্মেষ ঘটিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসার বিষয়ে সোশ্যাল
মিডিয়ার ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে আপনার মনে হয়।
রঞ্জনা রায়: ...এক্ষেত্রে
স্যোশাল মিডিয়ার গুরুত্ব খুবই বেশী । আমার মনে হয় স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমার
ওপার বাংলায় যেসব বন্ধু আছেন তারা খুবই আন্তরিক ও উষ্ণ সম্পর্কের অনুভব মনে জাগায়
। সেক্ষেত্রে কাঁটাতার কোন বাঁধা নয় ।
তাদের প্রতি আমার বা আমার প্রতি তাদের প্রীতি শুভেচ্ছা ও ভালবাসার উষ্ণতা প্রতি
মুহূর্তে পারস্পারিক অনুভবে সমৃদ্ধ হয় ।
সংশপ্তক: মানুষের ইতিহাস জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ,
সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দাঙ্গা, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘর্ষের ইতিহাস। সোশ্যাল
মিডিয়ার এই উত্থান কি সেই ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আবিশ্ব মানুষকে জাতি ধর্ম
সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে একটা মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয়
আপনার?
রঞ্জনা রায়:....আমার মনে হয় স্যোশাল মিডিয়ার যে অপরিসীম ক্ষমতা তাকে যদি যথাযথ ভাবে কাজে
লাগানো যায় তবে তা মানুষের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠবে এবং মানুষের মধ্যে জাতি , ধর্ম ও
সম্প্রদায়গত বিভেদ মুছে ফেলার সহায়ক হবে । কারন সেক্ষেত্রে মানুষের বন্ধুত্বই হবে
মুখ্য আর সব কিছু গৌণ ।
সংশপ্তক: আমাদের সমাজ ও সভ্যতায় দৈনন্দিন জীবনের
পরিসরে অন্যায় অত্যাচার, শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের হাতিয়ার
হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুমিকা কতটা কার্যকরী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
রঞ্জনা রায়: ..স্যোশাল
মিডিয়ার মাধ্যমে যে কোন বিষয়ে যে কোন বক্তব্যকে খুব দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছে
দেওয়া যায় । মানুষের ভাবরাজ্যে এর বলিষ্ঠ প্রভাব আছে । নানা ধরণের সামাজিক অন্যায়
ও অবক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ এটিকে যদি ব্যবহার করা যায় তাহলে সেটি খুব-ই
ফলপ্রসূ হবে বলে আমার মনে হয় ।
সংশপ্তক: সংশপ্তকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি আমাদের
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে এই সাক্ষাৎকার শেষ করবো একটি কথাই জানতে চেয়ে:
সোশ্যাল মিডিয়ার এই হঠাৎ উত্থান আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে,
তার প্রকৃতি ও বিকাশ সম্বন্ধে একটু যদি আলোকপাত করেন!
রঞ্জনা রায়:... প্রথমেই
বলেছি আমি একজন কবি সাহিত্যসেবী মানুষ ।আমার সৃষ্টিকে আমি এই মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক
পাঠক ও বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি । বাংলাদেশ , ইংল্যান্ড ,আমেরিকায় অনেকেই আছেন যারা আমার লেখার অনুরাগী
। সেইসব অনুরাগী পাঠকের কাছে আমার সৃষ্টিকে তুলে ধরার মাধ্যম ফেসবুক , হোয়্যাটস্
অ্যাপ , ব্লগ , ই- মেইল । এইভাবে আমার সৃষ্টিকে অনেক মানুষের কাছে
সমাদৃত হতে দেখে আমি প্রেরনা লাভ করি ।
রঞ্জনা রায়: কবি সাহিত্যিক সমাজসেবী