মাংস (দশ) :
রঘুবীরের বাড়িতে আজ ছোটোখাটো উৎসব, তাই রোজকার মোটা-মোটা বাজরা রুটির পরিবর্তে 'গাট্টে কি খিচড়ি, বেসন পুরলা, ডাল বাটি চুর্মা' প্রভৃতির মিষ্টি গন্ধে ভুরভুর করছে চারপাশ।
বাড়ির ছোটো-ছোটো বাচ্চাগুলোর তো আর সবুর সয় না, রসুইঘরের কালো ধোঁয়া অগ্রাহ্য করেও এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করছে আনন্দে, সেদিন আর কেউ কিছুতেই বাইরে খেলতে যাবে না...বড়ি-দাদী ভানুপ্রিয়া উঠানে পাতা খাটিয়ায় বসে হুঁকার নল মুখে দুই
ছেলের সাথে গভীর আলাপ-আলোচনায় মশগুল, আজ তাঁর বড় ছেলে রঘুর মজলি (মধ্যম) মেয়ে বিন্দিয়ার 'নথ্-উৎরাই', সংসারে আর একজন রোজগেরে-সংখ্যা বাড়লো, আনন্দ তো হবেই...পাগলের মতো কাঁদতে-কাঁদতে পায়ের কাছে এসে পড়লো বিন্দিয়া, বয়স তার সবে তেরো কি চৌদ্দ.. বড়ি-দাদীর কোলের ভিতর মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেবল একটাই কথা-
"দাদী, হাম ইয়ে গন্দা কাম নেই করেঙ্গে, মুঝে অওর পড়হনা হ্যায়, মুঝে যানে দো..."ইশারায় ছেলেদের সেখান থেকে উঠে যেতে বলেন ভানুপ্রিয়া, এককালে 'খুবসুরৎ নাচনি' নামে এ তল্লাটে সবাই তাঁকে এক ডাকে চিনতো.. বয়সের বলিরেখা, সূর্যের তেজ এখনও সে রূপ পুরোপুরি মুছে ফেলতে
পারেনি।
বিন্দিয়াকে আরও খানিকটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে
দু'হাতে চোখের জল মুছিয়ে দাদী বলেন-
"জ্যায়দা পড়হাই করনে সে কেয়া ফায়দা বিটিয়া? কাম তো তুঝে করনাই পড়েগা, ইয়েহি হামরা রোজি-রোটি সব কুছ, আচ্ছি তরহা সে সমঝ্ যা..."রাজস্থানের ভরতপুর জেলার প্রত্যন্তরে ছোট্টো
গ্রাম 'ঝিলমগড়'.. মাটির বাড়ি, বিজলিবাতি এখনও এসে পৌঁছয়নি, স্কুল-পাঠশালা তো দূরের কথা, জরুরীকালীন চিকিৎসাব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত নেই... আছে শুধু শত-শত বৎসরের পুরানো কিছু অমানবিক প্রথা, জীবিকা অর্জনের উপায়.. যা নিতান্তই লজ্জার, অনৈতিক এবং অপরাধযোগ্যও বটে...বিন্দিয়াদের মতো অল্প কিছু ঘর 'বেদিয়া' উপজাতির বাস এই গ্রামে। রাজস্থান তথা সমগ্র
দেশের বিভিন্ন অংশে এখনও যেখানে কন্যাভ্রূণ-হত্যা দহেজ বা পণপ্রথার কারণে আগুন জ্বলে
উঠছে,
সেখানে এই গ্রামে কোনো কন্যা সন্তানের জন্ম
খুশির বার্তা নিয়ে আসে...
খুশির কারণ কিন্তু বড় শোচনীয়,
অন্য কেউ নয়, তার নিজের বাবামা দাদা-ঠাকুমাই অসীম আগ্রহে অপেক্ষা করেন শিশুটির
মেয়ে থেকে নারী হয়ে ওঠার...দু'টো গ্রাম পেরিয়ে নতুন ইস্কুলে পড়তে যায়
বিন্দিয়া, খুব ছোটোবেলায় মাটিতে আঙুল বুলিয়ে আঁকি-বুঁকি কাটতো দেখে, বাবা সঙ্গে করে নিয়ে এসে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, আজ এই মুহূর্ত থেকে সব কিছু শেষ হয়ে গেল...
ঘুম ভাঙার সাথে-সাথে সুখের স্বপ্নটুকুও যেমন চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায়, ঠিক তেমনভাবেই বাস্তবের নির্মম মাটিতে পা রাখলো বিন্দিয়া.. আজ তার 'নথ্-উৎরাই', জীবনের প্রথম গ্রাহক, প্রথম পুরুষ...মায়ের কাছে শুনেছে- শুধু এই প্রথম রাতটুকুর জন্যে নাকি তার 'দর' উঠেছে পঞ্চাশহাজার, কারো-কারো সত্তরহাজারও ওঠে...
নিলামঘরে সাজিয়ে রাখা পুতুল-শৌখিনদ্রব্যের মতো তাদেরও দাম বাড়ে-কমে বৈকি, প্রতি রাতে নতুন মালিক, শাসন আর শোষণ.. তবে ভালোবেসে ঘর-বাঁধার স্বপ্ন সেখানে নিষিদ্ধ।এখন থেকে অনেক সাবধানে থাকতে
হবে বিন্দিয়াকে, নিয়ম করে জরিবুটি-ওষুধ খেতে হবে, অল্প-অল্প নাচ শিখতে হবে, এই তো সবে শুরু, কত মজলিশের পথ খোলা পড়ে আছে শুধু তারই
অপেক্ষায়...
সারাজীবনের পুঁজি সংগ্রহ করে নিতে হবে রূপ-যৌবনের এই কিছু বছরে.. তবে ভুল করেও নির্দিষ্ট সময়ের আগে মাতৃত্বের
ভুল হওয়া চলবে না, তাহলেই গ্রাহক-সংখ্যা কমবে, আর তখন এতগুলো মানুষের পেট চলবে কি করে? মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে বিন্দিয়া... বাবাকে সে বড় ভালোবাসে, মন বলে –ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে, হাত-জোড় করে নিজের ইজ্জৎটুকু ভিক্ষা চেয়ে নেয়, কিন্তু তা আর পারে না...
কারণ - সে জানে, বড়ি-দাদীর নির্দেশে এবার থেকে জিজার (হিন্দিতে জামাইবাবুকে 'জিজাজি' বললেও, রাজস্থান-মাড়োয়ারের স্থানীয় ভাষায় বড় দিদিকে 'জিজা' বলে) মতো তার জন্যেও বড়-বড় এক রাতের খরিদ্দারের খোঁজ করবে বাবা আর বদ্রীকাকো, কাকোর মেয়ে চাকোরিও তো বড় হচ্ছে...
বিকেল শেষে সন্ধে নেমে আসে, লন্ঠনের কাঁচ ধুয়ে-মুছে সাফ হয়...মা এসে 'পরব'-এ তুলে রাখা তার একমাত্র সুন্দর লেহেঙ্গা-চোলি বের করে রাখেন, বিন্দিয়াকে কাছে বসিয়ে চুল বেঁধে কাজল এঁকে
দেন। সযত্নে রূপোর পায়েল, মাথার শিষফুল ঠিক করে দিতে-দিতে বলেন -
"রোনা নেহি, মুসকুরাকে কাম করনা, গ্রাহক দিল সে খুশ হোনা চাহিয়ে.. আগর পহলিবার কোই গড়বড় হুই যায়ে, তো ফির কাম-ধান্দা ঢুন্ডনে মে তকলিফ হোগি..."কিছু বলে না বিন্দিয়া, চুপ করে সব শোনে। ইস্কুলের দিদিমণিদের
মুখগুলি মনে পড়ে বারবার, মনে পড়ে বন্ধুদের কথা, ভাগ্যিস তারা এ গ্রামের মেয়ে নয়.. পেটের দায়ে এ কেমন রীতি ঈশ্বর? নীরবে দু'ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে হাতের উপর, রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসে, বাইরে গাড়ি থামার শব্দ শোনা যায়...
####
[শুধু গ্রামের নামটি পরিবর্তন করেছি, বাকিটুকু অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে নির্মম সত্যি...]
[সহেলী
ভট্টাচার্য্য]