সংশপ্তক: মানুষের সমাজ ও সভ্যতায় ট্রেন ও বিদ্যুৎ
শক্তির আবিষ্কারের মতোই এক যুগান্তকারী ঘটনা ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিকাশ। যার হাত
ধরে উত্থান সোশ্যাল মিডিয়ার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই নবতম উপহারের সাথে আপনার
পরিচয়ের সূত্রপাত সম্বন্ধে যদি একটু আলোকপাত করেন!
জয়া: সোশ্যাল মিডিয়া শব্দটাই আমায় সোসাইটি নামক
অধুনা বিলুপ্ত পাড়া বা কমিউনিটি ফিলিং এর কথা মনে করিয়ে দিল। আসলে যোগাযোগ এর
মাধ্যম যে বৈদ্যুতিন হয় সেটা মানতেই চাই নি আমি জোর করে বেশ ক’বছর। তাই অরকুট
থেকেই নিজের ও বন্ধুদের সঙ্গে লড়ে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম। বেশ কয়েক বছর পরে ২০১৩
সালের একদম শেষে আমার আসন্ন প্রকাশিত বইগুলোর কথা ভেবে ফেসবুক পাড়ায় নিজেকে ঢোকাই।
সংশপ্তক: মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে
স্যোশাল মিডিয়ার মতোন এমন শক্তিশালী মাধ্যম আবিষ্কৃত হয় নি আগে। এই যে গোটা
পৃথিবীটাই প্রায় আপনার হাতের মুঠোয়; এই বিষয়টি আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
জয়া: প্রভাবিত করে খুব নয় তার কারণ হচ্ছে আমি মূলতঃ
কাগজ বই-এর ভক্ত। জ্ঞান বা অজ্ঞান আমি বই কাগজ পড়ে সংগ্রহ করতেই ভালোবাসি। তবে এটাও
ঠিক তথ্য জানতে হলে এই মাধ্যমটির উপকারিতা খুব। আর মানুষের সঙ্গে মানুষের চেনা
শুনার সুযোগ ও এটিতে ঢের বেশি। তবে ‘চেনাশুনা’...মানে ‘জানাশুনা’ নয়। তার জন্য
প্রত্যক্ষ মানুষ টিকে সাক্ষাৎ করা জরুরী। নইলে বিপদ।
সংশপ্তক: মানুষের সৃষ্টিশীলতা সৃজনশীলতার বিকাশের
ক্ষেত্রে এই সোশ্যাল মিডিয়া সম্পূ্র্ণ একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। যা এক কথায়
অভুতপূর্ব! আগে নির্দিষ্ট কিছু মাধ্যমের ছাড়পত্র না পেলে আপন প্রতিভা প্রকাশের কোন
উপায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন যে কেউ তার সৃষ্টিশীল সৃজনশীল শক্তিকে বিশ্বের
দরবারে নিজেই হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টি আপনি ঠিক কি ভাবে দেখছেন?
জয়া: খুব
সপ্রশংস ভাবে দেখি। এটা খুব জরুরী মাধ্যম শিল্পী হতে চাওয়া মানুষের কাছে। প্রতিটি
মানুষ যে দামী ...প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কোন না কোন ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে তা মনে
করিয়ে দেয় এই মিডিয়া। তবে এটা শুধু প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের টিকেট। একবার মানুষ
তোমার দিকে আগ্রহী হলে শুরু হবে আসল সাধনা। জনসংখ্যা এত বেশি। নিজেকে প্রকাশের
আকাঙ্খা এত বেশি যে তার চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে এই মাধ্যম টি তাদের উপকার ই
করছে ভীষণ ভাবে।
সংশপ্তক: এই প্রসঙ্গেই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
আমাদের বিচলিত করে। আগে প্রতিভা বিকাশের কোন না কোন একটি মাপকাঠি ছিল। কিন্তু আজকে
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে কেউ নিজেকে কবি সাহিত্যিক সংগীতশিল্পী বলে প্রচার করতেই
পারেন। এবং বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের প্রশংসায় এই ভাবে মধ্যমেধার বাড়বারন্ত
শিল্পসংস্কৃতির পক্ষে কতটা স্বাস্থ্যপ্রদ বলে আপনার মনে হয়?
জয়া: প্রতিভা কে খুঁজে আনার দায়িত্ব সোশ্যাল
মিডিয়ার। সেটি সঠিক অর্থে প্রতিভা ই কী না
সেটা তার জন্য কাল অর্থাৎ সময় দেওয়া জরুরী। মধ্যমেধা আমাদের সমাজের ব্যাধি।
সোশ্যাল না আনসোশ্যাল বিষয়টা সেটা নয়। যা র মধ্যে প্রকৃত গুণ নেই সে ফেসবুক টুইটার
ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি যেখানে খুশি যত খুশি চিৎকার করে দাবী করুক সে প্রতিভাশালী
বলে... কার্যত টেঁকে না টেঁকে নি টিঁকবেও না কখনো।
সংশপ্তক: আবিশ্ব বিভিন্ন সংস্কৃতিকে পরস্পরের আরও
কাছে নিয়ে আসতে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুমিকা কতটা শক্তিশালী হতে পারে?
জয়া: এটি
সীমাবদ্ধ। কারণ মানুষ মানুষে বন্ধন হতে গেলে মুখো মুখি দেখবার কানে কানে শোনবার
খুব প্রয়োজন। নাগালের বাইরে ছবি দেখে সম্পর্ক সঠিক হতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়ার
ভূমিকা প্রথম থেকেই সীমাবদ্ধ। সংস্কৃতি প্রচার এর জন্য ভূমিকা খুব সদর্থক এই
মাধ্যমের একথা মানতেই হবে। এই সময় এইটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এমনটাও দাবী করা যেতে
পারে।
সংশপ্তক: এই যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের
লোকসংস্কৃতির সাথে সহজ আদান প্রদানের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল
মিডিয়াকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রটি: সেই সম্বন্ধে আমাদের বাঙালিদের সচেতনতা কতখানি
ঘটেছে বলে মনে হয় আপনার?
জয়া: বাঙালি কখনই সার্বিক নয় বরাবরই
ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাই সচেতনতা খুব আছে বলে মনে করি না। আসল সমস্যা হল গোড়ায়। এখন
মানুষ কিছুকেই বিশ্বাস করে না। লোকসংস্কৃতি র পোস্ট দেখে আকর্ষণ আসে অবশ্যই।
কিন্তু সেটিকে পৃষ্ঠপোসণা করতে সশরীরে সেই শিল্প কে দেখতে হয় শুনতে হয় জানতে হয়...
তবুও এর দৌলতেই যে লোকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আপ টু ডেট থাকছে একথা মানতেই হবে।
সংশপ্তক: সোশ্যাল মিডিয়া স্বভাবতঃই সমাজ দর্পনের
ভুমিকায় একটি কার্যকরী মাধ্যম। আমাদের বাঙালি সমাজের প্রেক্ষিতে এই দর্পনের
বর্তমান প্রতিচ্ছবিটি কতটা আশাব্যঞ্জক আপনার কাছে?
জয়া: আপনি যেভাবে দেখবেন। গেলাসের অর্ধেক ফাঁকা
দেখবেন না ভরাট দেখবেন সেটা আপনার মনের ওপর নির্ভর করবে। আমার ক্ষেত্রে বলব এখনো
অতটাও আশাপ্রদ নয়। তবে ভবিষ্যতে যদি হয়... দেখা যাক।
সংশপ্তক: একথা আমরা সকলেই জানি, ইংরেজী ও হিন্দীর
দূর্দমনীয় প্রভাবে আমাদের দৈন্দিন জীবনচর্চায় ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাসঙ্গিকতা দ্রুতহারে
ক্রমহ্রাসমান। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ার অভূত্থানে বাংলা ভাষার পুনরুজ্জীবনে কি
কোন আশার আলো চোখে পড়ছে আপনার?
জয়া: হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। অবশ্যই। আমি কলকাতায় জন্মেছি
বড় হয়েছি। এখন কলকাতায় বাঙালি থাকে না বাংলায় কথাও বলে না। এই মাধ্যম আছে বলেই
বাংলাদেশী বাঙালিদের লেখা পড়বার সুযোগ পাই। আর কৃতার্থ হই একথা ভেবে যে শুদ্ধ
বাংলায় ভাবতে পারছি পড়তে পারছি এদের কলমের গুণেই। আমি এত এত এতই কম জানি আধুনিক
বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে... যে এই মাধ্যম না থাকলে আমেরিকাবাসী কচি রেজা –র কবিতা
জানতে পারতাম না... রায়গঞ্জবাসী শর্মিষ্ঠা ঘোষ এর কবিতা জানতে পারতাম না... বেলারি
বাসী রত্নদীপা দে ঘোষ এর কথা জানতে পারতাম না... এবং বৈজয়ন্ত রাহা দা, নন্দিতাদি,
সায়ন্তনী, অনুপম দাশ শর্মা , শীর্ষেন্দু, সৌমিত্র চক্রবর্তী, রিয়া চক্রবর্তী,
ফাল্গুনিদাদা, পৃথা, সোনালী পুপু,
ইন্দ্রনীল দা বারীনদা প্রদীপদা অরূপম দা শুভাশিস দা প্রত্যূষ অনুপম কৌশিক ভান্ডারি
প্রতাপ রায় আমি গড়্গড় করে বেশ কিছু নাম
বলতে পারি যাদের আমার পক্ষে চেনা সম্ভব ছিল না । আমি শুভ্র তোমার মত প্রাবন্ধিককে
জানতাম না নিউজিল্যান্ডের ঝিলিমিলিকে জানতাম না... আমার চিলির বন্ধু, আমার নিকারগুয়ান বান্ধবী আর্জেন্টিনার বেশ কজন বন্ধু
আমার মেক্সিকান কবি বন্ধু আমার বলিভিয়ান কবি বন্ধু আমার গুয়াতেমালান কবি বান্ধবী
আমার বিশ্বের নানা প্রান্তের বন্ধুদের জানা সম্ভব ছিল না আমার জীবন অপূর্ণ থাকত
তাহলে। আমার জানা আংশিক থাকত তাহলে।
সংশপ্তক: আমাদের এই দ্বিখন্ডিত বাংলায় কাঁটাতারের
দূরত্ব ঘুচিয়ে দুই পারের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও প্রীতির সম্পর্কের
উন্মেষ ঘটিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসার বিষয়ে সোশ্যাল
মিডিয়ার ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে আপনার মনে হয়।
জয়া: মন্তব্য করছি না।
সংশপ্তক: মানুষের ইতিহাস জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ,
সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দাঙ্গা, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘর্ষের ইতিহাস। সোশ্যাল
মিডিয়ার এই উত্থান কি সেই ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আবিশ্ব মানুষকে জাতি ধর্ম
সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে একটা মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয়
আপনার?
জয়া: এটা শুনতে তাই মনে হয় বটে। মিশর এর মত ঘটনা
দেখেছি বা শাহবাগ...আবার তার ব্যর্থতাও। আমি জানি না কতটা সম্ভব।
সংশপ্তক: আমাদের সমাজ ও সভ্যতায় দৈনন্দিন জীবনের
পরিসরে অন্যায় অত্যাচার, শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের হাতিয়ার
হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুমিকা কতটা কার্যকরী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
জয়া: শুরু
তো অবশ্যই করে । করেওছে নানা ক্ষেত্রে। তবে শেষ কথা বলে বাস্তবে মানুষ কতটা
উদ্যোগী। বিপ্লব আনে বদল। এবং মিডিয়ার ক্ষণস্থায়ী প্রভাব বিপ্লব আনতে পারবে বলে ও
ভাবি না। তবে সাময়িক একটা প্রভাব তো পড়েই। যদি মিডিয়ার তেমন ক্ষমতাই থাকত তাহলে
তসলিমা নাসরিন কে এভাবে দেশ ছাড়া সংস্কৃতি ছাড়া একা জীবন কাটাতে হত না। ওনার
সমর্থক তো মিডিয়াতে কম নেই। তা সত্ত্বেও আজ ও উনি পরিস্থিতির শিকার।
সংশপ্তক: সংশপ্তকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি আমাদের
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে এই সাক্ষাৎকার শেষ করবো একটি কথাই জানতে চেয়ে:
সোশ্যাল মিডিয়ার এই হঠাৎ উত্থান আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে,
তার প্রকৃতি ও বিকাশ সম্বন্ধে একটু যদি আলোকপাত করেন!
জয়া: এই
মিডিয়ায় আসার আগেই আমার চার খানি বই তৈরী হয়ে গিয়েছিল প্রকাশের জন্য। এসেছি বলেই বেশি
সঙ্খ্যক মানুষ জেনেছেন আমার নাম। যারা লেখা চান এখানেই আমায় চিনেছেন বেশির ভাগ।
কিছু অবশ্যই দেশ আনন্দবাজার টাইমস অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি পত্রিকা থেকে জেনে এসেছেন...
কেউ নাটকের সূত্রে জেনেছেন... কিন্তু মূলতঃ এই মাধ্যমই। আমি খুব ঋণী এই মাধ্যমের
কাছে। আমার ব্যক্তিগত অমূল্য কিছু মানুষ পাওয়া এর সূত্রেই। আমার অপূরণীয় কিছু
ক্ষতিও এই সূত্রেই। আসলে ব্যক্তিগত সময়
খুব কমে গেছে। এটা খুব লস আমার। তবে Then You cannot have both sides of the coin
at the same time. You have to sacrifice one…
জয়া চৌধুরী: কবি সাহিত্যিক অনুবাদিকা নাট্যব্যক্তিত্ব ও
ভাষাশিক্ষিকা