>

জযা চৌধুরী

SongSoptok | 9/15/2015 |




নামটা দেখলেই সেই প্রাতঃস্মরণীয় সাহিত্যিকের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ছে? খুব স্বাভাবিক । আমি তো তাঁর নামটি ই বেছে নিয়েছি। শত বছর আগে সেই লেখার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে নারীর প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তা পাঠক জানেন। অধম আজ সেই কথা পুনরাবৃত্ত করতে বসি নি। গতকাল কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া এবং সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা আমাকে বার বার ভাবাচ্ছে তাহলে একজন শরৎচন্দ্র, একজন নোবেল প্রাপক রবীন্দ্রনাথ, একজন মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতি, এবং ইত্যাদি বেশ কয়েকজন প্রণম্য সাহিত্যিক নারীর ভূলুন্ঠিত মর্যাদা আরও একবার প্রতিষ্ঠা করবার জন্য এত যে লেখালিখি করেছেন তা আসলে সব টাই বৃথা হল! মানুষ তাহলে রোজ কিসের স্বপ্ন দেখবে? কোন প্রেরণায় প্রাণিত হয়ে নতুন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হবে? একটি স্বপ্নের কলেজ প্রেসিডেন্সি যার এখন নাম বিশ্ববিদ্যালয় তার চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে কোন একটি কারণে এক ছাত্রকে দেখা গেল মহিলাদের অন্তর্বাস পরে বিক্ষোভ জানাচ্ছে। জিজ্ঞেস করতে সে বলে অম্লানবদনে সে না কি অন্যায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছে। এখন প্রতিবাদ সব সময়েই জ্বলন্ত গণতন্ত্রের লক্ষণ। সুতরাং তার এই প্রতিবাদ ঠিক ভুল ইত্যাদি সম্পর্কে আমি একবারও বলবো না। আমার বক্তব্য ছেলেটি র প্রতিবাদ এর ধরণ নিয়ে। এর আগেও দেখেছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়- এ ন্যাপকিন এর মধ্যে প্রতিবাদ লিখে আন্দোলন করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন হল আন্দোলন যদি লক্ষ্য হয় তাহলে মহিলা নিয়ে ছাড়া কি আন্দোলন হয় না? মেয়েদের দেখলে সকলেই একবারের জায়গায় পারলে দুবার তাকায়। মনে যদি কোন খারাপ ইচ্ছা না-ও থাকে তবুও নারী যেন কৌতূহল । নারী হলো সেই জিনিষ যার সম্পর্কে হয় লাল টপকাবে নয় নমো করব। প্রেসিডেন্সির ছাত্রটি র যদি সেই ইচ্ছে হয়েছিল যে সে অশ্লীলতার মাধ্যমে বিক্ষোভ জানাবে... সে নিজের অন্তর্বাস টি কেন মেলে ধরলো না শয় শয় টিভি ক্যামেরার সামনে। তার মানে সেও বিশ্বাস করে নারী হলো পণ্য। পুরুষ তত বিক্রয় যোগ্য নয়। তার ব্যক্তিগত কথা বিক্রি করতে নারীর অন্তর্বাসটিই ক্যাচি হবে, হু হু বাবা ব্যবসা অতি বুদ্ধির বিষয় পাঠক। বোকা থাকলে চলে না হে।  যে বিশ্বখ্যাত ক্যামেরাম্যানটি বয়স্ক নারীর কুঁচকানো থলথলে স্তনের গভীর মনোযোগে ছবি তুলে দেশ বিদেশে বিক্রি করেন এবং ফলস্বরূপ তাঁর ধন্য ধন্য প্রশংসা প্রাপ্তি ঘটে তিনিও তাহলে নারীকে শরীর হিসাবেই ব্যবহার করেন। মোটিভ তাহলে ব্যবসা করা।  মানে সমান্তরাল দুটি হিসেব পাশাপাশি চলবে। একদল নারীকে দলবে পিষবে ধর্ষণ করবে আর অন্যদল তাকে সহানুভূতির ছদ্ম আড়ালে শরীর নিয়ে বাণিজ্যই করবে। ছাত্রটির কত বয়স ছিল এক্ষেত্রে ২০ ২১- ২২? এই বয়সের একটু আগে থাকতেই না সুকান্ত স্বপ্ন রচনা করেছিলেন সেই কবে? আঠারো বছর দেখায় দুঃসাহস? তো প্রণম্য কবি নিশ্চয়ই অন্তর্বাসের দুঃসাহসের কথা ভাবেন নি। একদল মান্য ব্যক্তি এই প্রতিবাদকে নানা কথার আড়ালে সমর্থন করছেন। তাদের বক্তব্য প্রতিবাদের ধরণ নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে কিন্তু প্রতিবাদ সমর্থন যোগ্য। ধরণ নিয়ে বিতর্ক ঘটেই যদি তা ধরণের ন্যূনতম মান- এ এসে দাঁড়ায়। এটি কোন ধরণের সভ্যতার পরিচয়? আমরা কি সমাজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে থাকি না? সব প্রতিষ্ঠানের ই ভালো মন্দ দিক থাকে। খোলা হাওয়া মানেই যুক্তি পালটা যুক্তির প্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু তারও আগে থাকে নীতি ধর্ম পাপ পুণ্য ইত্যাদি সুস্থ মানব বোধ। ঠিক ঠাক মানুষ হতে গেলে কি কিছু ভালোমন্দ বোধ থাকতে হবে না? আমি প্রতিবাদ করব, ধাক্কা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করব কিন্তু সেইটে করবার সময় নারীনামক পণ্য টিকেই কাজে লাগাবো? একবার ভাবুন দেখি যে ছেলেটি ব্রা পড়ে প্রতিবাদ করলো তার গর্ভ ধারিণীর মনের কথা? তিনি নিশ্চিত ভাবেই লজ্জায় ধরণী দ্বিধা হও টাইপ লজ্জা পেয়েছেন সন্তানের এহেন আচরণে। ছেলেটি মা- বোন শিক্ষিকা- প্রেমিকা-আত্মীয়া...কেউ ই কি মনে মনে মেনে নিতে পেরেছেন এ হেন অসভ্যতা? অসম্ভব! আমি বিশ্বাস করি না সুস্থ মানুষ এ হেন প্রতিবাদের ধরণ কে পছন্দ করবেন। একজন খুব শ্রদ্ধেয় মানুষ আবার নেতাজীর ওটেন সাহেবকে চড় মারার দৃষ্টান্ত এনেছেন, কেউ বা নকশাল তৃনমূল সিপিএম কংগ্রেস বিজেপি ইত্যাদি স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। নেতাজীর চড় মারায় কোন রকম অভব্যতা ছিল না এই জন্যই যে তিনি নিজে পুরুষ হয়ে প্রতিবাদ করার উপায় হিসাবে নারী দেহ বা তার অন্তর্বাস ব্যবহার করেন নি। তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী রিঅ্যাক্ট করেছিলেন। তাহলে মণিপুরের যে মায়েরা বছরের পর অত্যাচারিত হতে হতে নগ্ন হয়ে রাস্তায় নিজেরা নেমেছিলেন সেই যন্ত্রণাময় প্রতিবাদ আর বাপের হোটেলে খেয়ে পড়ে বই নিয়ে কলেজ যাবার নামে ব্রা পড়ে প্রতিবাদ করা- এক সারিতে বসবে? যাদবপুরের যে মেয়েগুলি ন্যাপকিন এ প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের তখন কুর্ণিশ করেছিলাম কেননা তারা নিজেরা মেয়ে হয়ে মেয়ে হিসাবে তার মনের ক্ষোভ জানানোর কথা ভেবেছিলেন। যদিও যথারীতি পরে দেখা গেল সাময়িক সংবাদপত্রের শিরোণাম হওয়া ছাড়া তাদের আন্দোলনের গভীর কোন লক্ষ্য ছিল না। এবং সেই আন্দোলনের কোন ফলো আপ ও নেই। তাই সেই আন্দোলনটিকে এখন পিছু ফিরে দেখে লজ্জায় অধোবদন হই। আজকাল বড় দেখতে পাই প্রতিবাদের ধরণ কত ক্যাচি হবে কত টিআরপি নেবে সেটিই তরুণের লক্ষ্য। নীতি নয় আদর্শও নয়। কারণ আদর্শ এর কোন তাড়াহুড়ো থাকে না সেটি একমুখী এবং তপস্যাপ্রবণ... আমরা তো চিরকাল এমনই জেনে এসেছি।

তরুণের বিদ্রোহ সভ্যতায় কতই না বাঁক এনেছে সব কালে সব দেশে। সে বাস্তিল দুর্গ পতন বলুন আর বলশেভিক বিপ্লবই বলুন কিংবা আমাদের অনুশীলন সমিতির বিদ্রোহ। কিন্তু কোন মহৎ প্রতিবাদই কি আদর্শ ছাড়া ঘটেছে? ঘটে নি কারণ বিদ্রোহের উদ্দেশ্য থাকে মহৎ কোন আদর্শ কে প্রয়োগ করার মরীয়া ইচ্ছা। মহৎ কোন কিছুর সঙ্গেই তাহলে মানবজাতির অর্ধেক অংশ নারীর দেহ নিয়ে, অন্তর্বাস নিয়ে, নারীকে পণ্য করে, নারী বিষয়ক বাজার তৈরী করা ইত্যাদি বিষয় থাকতে পারে না। আমি নারী আর তাই গর্বিত। কিন্তু আমার অস্তিত্ব পুরুষের মনোরঞ্জনেও নয়। পুরুষের বিদ্বেষেও নয়। একজন মানুষের যে কারণে পৃথিবীতে জন্মানোর, বেঁচে থাকার এবং মরে যাবার মূল্য থাকে নারীরও তাই। সেটি পুরুষ সাপেক্ষ নয়। নারী আসলে সর্ব প্রথম একজন মানুষ। তার কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য ইত্যাদি সবকটা রিপু থাকে। এমনকী সে ধর্মীয় ব্যাখ্যায় মারূপী কোন মানুষও নন। তাকে ভক্তি গদগদ হয়ে তাকে তুলে পুজো করারও দরকার নেই আবার প্রতিবাদের নামে তার অন্তর্বাস নিয়ে খেলা করারও দরকার নেই।  সে স্রেফ একজন মানুষ। এবং কখনো মেয়ে কখনো মা কখনো প্রেমিকা কখনো পিসি বা বৌ ইত্যাদি। সেও অমৃতেরই সন্তান। সমাজ আগে সেইটা মেনে সাবালক হোক তারপর বিবেকানন্দ  ঠিক না মার্কস ঠিক, আমেরিকা ভালো না চিন ভাল, সিপিএম ভালো না তৃণমূল ভালো তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। নারী আগে মানুষ স্বীকৃতি টুকু পাক।
অলমিতি।

[জয়া চৌধুরী]

Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.