সংশপ্তক: মানুষের
সমাজ ও সভ্যতায় ট্রেন ও বিদ্যুৎ শক্তির আবিষ্কারের মতোই এক যুগান্তকারী ঘটনা
ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিকাশ। যার হাত ধরে উত্থান সোশ্যাল মিডিয়ার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই নবতম উপহারের সাথে আপনার পরিচয়ের
সূত্রপাত সম্বন্ধে যদি একটু আলোকপাত করেন!
রীতা রায়
মিঠু: ২৮ বছর পূর্বের কথা, আমরা তখন ঢাকার বাইরে সাভার এলাকায় থাকি। আমার স্বামী একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরে জানালো, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জানিয়েছেন,
কয়েকজনকে কমপিউটার ট্রেনিং নিতেই হবে। সেই
কয়েকজনের মধ্যে আমার স্বামী অন্যতম। কমপিউটারের নাম শুনেছি, কিন্তু
কমপিউটার কি করে ব্যবহার করতে হয় তা তোঁ জানিওনা, বা জানার প্রয়োজনও পরেনি। দিন এনে দিন খাই আমরা , কমপিউটার শিখে কি করবো? আমার স্বামী
কিন্তু তখন আমেরিকা ফেরত, অথচ কমপিউটার ট্রেনিং নেয়ার প্রস্তাব শুনে একটু
অস্বস্তিতে পড়েছে। যাই হোক, প্রতিষ্ঠানের সাত/আট জন
কর্মকর্তা প্রতিদিন দুপুরে মাইক্রোবাস চড়ে ঢাকা শহরে যায়, কমপিউটারে কিছুক্ষণ
টেপাটিপি করে সাভার ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে এলে কৌতুহলী আমি স্বামীকে
জিজ্ঞেস করি, কি শিখলো? কমপিউটার কেমন দেখতে, ভয় লাগে নাকি, খুব কঠিন নাকি—এ
সমস্ত হাবিজাবি প্রশ্ন। অবশেষে তাহাদের কমপিউটার কোর্স
সমাপ্ত হলো, সার্টিফিকেট হাতে বাড়ি ফিরলো, কমপিউটার শেখার কর্ম ওখানেই শেষ হয়ে
গেলো, আমার মন থেকেও কমপিউটার হারিয়ে গেলো। তখন
অস্ট্রেলিয়া্র মেলবোর্নে থাকি, প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। দুই মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে আমার সময় কাটতে চায় না। ইংলিশ জানা আমি ইংলিশ লার্নিং স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম, সেখানে
কমপিউটার লার্নিং ক্লাস হয়। কমপিউটার দেখতে ১৭ ইঞ্চি টিভির মত,
সাথে টাইপ করার বোর্ড, তার সাথে তারে বাঁধা ‘মাউস’। আমার ভয় করে টেপাটেপি করতে, টিচারের নাম ছিল ব্রেন্ডা। বার বার ব্রেন্ডাকে ডাকি, বলি, দেখিয়ে দাও। ব্রেন্ডা কতজনকে দেখাবে, দৌড়ে আসে, নিজেই মাউস ঘুরিয়ে কোথাও নিয়ে
আমাকে বলে, ‘এন্টার’। আমি ‘এন্টার’ কি জিনিস তাই জানিনা,
এন্টারকে শুনি ‘ব্রেন্ডা’। টাইপ করতে শিখিনি, অথচ তখন শেখানী হচ্ছিল ‘এক্সেল’-এ কি করে কাজ করতে হয়, গ্রাফ করা----ঐ পর্যন্তই। ইন্টারনেট শব্দটির সাথে পরিচয় হলো অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সময়। ওদেশে বাচ্চাদের স্কুলে কমপিউটার ল্যাব ছিল, সেখানে ক্লাস ফাইভ
সিক্সের বাচ্চাদের ই-মেইল করার কায়দা শেখানো হতো। আমার বড় মেয়ে মৌটুসী তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, ওর বাবা মাস দুয়েকের
জন্য বাংলাদেশে যায়। টেলিফোনে প্রচুর খরচ হতো তখন, তাই
মৌটুসী স্কুলের ল্যাব থেকে বাবাকে ই-মেইল পাঠাতো, ওর বাবা সাথে সাথে রিপ্লাই দিত। মৌটুসী ই-মেইলের প্রিন্ট আউট এনে আমার হাতে দিত, মনে হতো দুই
লাইনের টাইপ করা কাগজ নয় এটি, তার চেয়েও অনেক বেশী কিছু। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ফিরে যাই, ১৯৯৯ সালে ১ লাখ টাকা দিয়ে আমাদের
ঘরে ব্যবহার করার জন্য কমপিউটার কেনা হয়, সাথে ইন্টারনেটের লিমিটেড সংযোগ। আমি কমপিউটার ব্যবহার করতামনা, আমার মেয়েরাও করতোনা, কারণ তখনও
ফেসবুক চালু হয়নি, ইউটিউবের সন্ধান জানতামনা। দেশে সময় কেটে যেতো ফুড়ুৎ করে, তাই কমপিউটারে নিয়ে খেলা করার
সুযোগ হতোনা। আমেরিকা চলে এলাম
২০০১ সালে, মেয়েরাও একটু বড়, কমপিউটার ছাড়া চলে কি করে? কমপিউটার এলো, তখন বাংলা
পত্রিকা পড়ার জন্য সে কী আকুলতা ছিল! কিন্তু ইন্টারনেটে গিয়ে পাওয়া যায় কলকাতার
আনন্দবাজার। কলকাতার সংবাদে আমার আগ্রহ ছিলনা,
আগ্রহ ছিল ঢাকার সংবাদে। ২০০৩ সালের দিকে এক/দুটো বাংলাদেশী
পত্রিকার সংবাদ অনলাইনে পাওয়া গেলো। তখনও ইউটিউব চিনিনা। ২০০৭ সালে মেজো মেয়ে সারাক্ষণ ইন্টারনেটে অরকূট নিয়ে থাকে, এরপর
এলো ফেসবুক। আমি কিছুই বুঝিনা সেসব, আমি শুধু
ইউটিউবে গান শুনি, আর বাংলাদেশের পত্রিকা পড়ি। ২০১০ সালের শেষের দিকে মেজো মেয়ে মিশা ফেসবুকে আমার জন্য একাউন্ট
খুলে দেয়। ফেসবুক বিষয়ে বুঝে উঠতে কয়েক মাস
লেগে যায়, স্ট্যাটাস লিখি, দুই একজনের সাথে বন্ধুত্ব করি। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় আমার একটি লেখা
ছাপা হয়, সেই থেকে শুরু, আজও লিখছি, এর মধ্যেই ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের বইমেলায় আমার
লেখা, হ্যাঁ, আমারই লেখা দু’খানা বই প্রকাশিত হয়। একটির নাম ‘ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে, অন্যটি ‘মুহূর্তে দেখা মানুষ’। বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তির এই নবতম আবিষ্কারের সূত্রেই নতুন আমি, লেখক আমি’র
জন্ম হয়েছে।
সংশপ্তক: মানুষের
সাথে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্যোশাল মিডিয়ার মতোন এমন শক্তিশালী মাধ্যম
আবিষ্কৃত হয় নি আগে। এই যে গোটা পৃথিবীটাই প্রায় আপনার
হাতের মুঠোয়; এই বিষয়টি আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
রীতা রায়
মিঠু: মিড এজ ক্রাইসিস বলে একটা
ব্যাপার আছে। বয়স পঁয়তাল্লিশের পর থেকে
পুরুষ-নারী সকলকেই এই ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কেউ একাকীত্বে ভোগে, কারো মেজাজ হয়ে ওঠে তিরিক্ষি, কেউ ভোগে
বিষণ্নতায়--- একেকজনের প্রতিক্রিয়া একেকরকম হয়। নারীর বেলায় মিড এজ ক্রাইসিসের প্রতিক্রিয়া একটু বেশীই হয় যেন। আমাদের দিদিমা, ঠাকুমা, মায়েদের জীবনেও তা ঘটেছে, আমরা বুঝতে
পারিনি। ভেবেছি, আমাদের মা তোঁ এমন ছিলনা
আগে, মা কত নরম মনের মানুষ ছিল, এখন কেন যে এমন খিটখিটে হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আজ সেসব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি জানতে
পেরেছি । ব্যাপারটি কিরকম বলি, ইন্টারনেট
প্রযুক্তির কারণে গুগল, ইয়াহু, ইউটিউব, অর্কুট, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটারের মত
ম্যাজিক কিংডমের দরজা খুলে গেছে। গুগল তোঁ গুগলই নয়, চোখের সামনে
বিশাল বড় একখানা বই। যা কিছু জানতে ইচ্ছে করে, দুই একটি
শব্দে টাইপ করে দিলেই হলো, বই খুলে যায়। ‘একাকীত্ব’ বা ‘লোনলিনেস’ টাইপ করলেই
লোনলিনেস কি, কেমন, কত ধরণের, এর কারণ, বিস্তার সহ প্রতিটি তথ্য বেরিয়ে আসবে। ইন্টারনেট সার্চ করেই মিডল এজ ক্রাইসিসের বিষয়ে সম্যক ধারণা এবং এর
প্রতিকার সম্পর্কে পরামর্শ পেয়েছি। ফলে নিজে যখন মিড এজে পৌঁছেছি,
নিজের মন মেজাজ, আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিজস্ব কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছি। আমি আড্ডা প্রিয়
মানুষ, আমি সংস্কৃতিমনা মানুষ, তিন কন্যা আজ আমার কাছ থেকে অনেক দূরে, প্রবাসের
একাকী নিস্তরঙ্গ জীবনে ফেসবুক, ইউটিউব, উইকিপিডিয়া আমার নিত্যসঙ্গী। আমার দিদিমা, ঠাকুমা, মা’কে যে অসহ্য ক্রান্তিকাল পার হতে হয়েছে, তথ্য
প্রযুক্তির এই যুগে সোশ্যাল মিডিয়া আমাকে সেই ‘লোনলিনেস’ এর করালগ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সংশপ্তক: মানুষের
সৃষ্টিশীলতা সৃজনশীলতার বিকাশের ক্ষেত্রে এই সোশ্যাল মিডিয়া সম্পূ্র্ণ একটি নতুন
দিগন্ত খুলে দিয়েছে। যা এক কথায় অভুতপূর্ব! আগে
নির্দিষ্ট কিছু মাধ্যমের ছাড়পত্র না পেলে আপন প্রতিভা প্রকাশের কোন উপায় ছিল না
বললেই চলে। কিন্তু এখন যে কেউ তার সৃষ্টিশীল
সৃজনশীল শক্তিকে বিশ্বের দরবারে নিজেই হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টি আপনি ঠিক কি ভাবে দেখছেন?
রীতা রায়
মিঠু: সোশাল মিডিয়াতো সৃষ্টিশীল
মানুষের সৃজনশীলতার আধুনিকতম বিকাশের অন্যতম অধ্যায়। এর বিস্তৃতি এবং ব্যাপকতা সাধারণ মানুষের প্রতিভা বিকাশে কতখানি
সহায়তা করেছে তা আমার নিজের জীবন দিয়েই অনুভব করতে পারি। সোশাল মিডিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক সৃষ্টি হওয়ার আগে
পর্যন্ত আমি নিজেকে শুধুই একজন ‘আমি’ হিসেবে জানতাম। এই ‘আমি’ কারো সন্তান, কারো বোন,
কারও স্ত্রী, কারো মা। এর বাইরের আমিকে আমি জানতাম না। ফেসবুকে চার বছর বিচরণ করার পর আমি আমার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আরও
কিছু ‘আমি’কে আবিষ্কার করলাম। নতুন আমি পত্রিকায় কলাম লিখেছি অনেক, ফেসবুকে জীবনমুখী লেখা
লিখেছি অনেক, দু’খানা বই লিখেছি, গল্প লিখেছি অনেক, সৃজনশীলতা
প্রকাশে বন্ধুদের ভালোবাসা এবং অকুন্ঠ সমর্থন পেয়ে নিজের অন্য আরেক ‘আমি’কে আবিষ্কার করেছি। কবিতার প্রতি আগ্রহ ছিলনা, কবিতা আবৃত্তি করার কথা কখনও মনে আসেনি। ফেসবুকে কবি বন্ধুদের কবিতা প্রীতি দেখে নিজেও চেষ্টা করলাম, অবাক
হয়েই আবিষ্কার করলাম, আমি নিজেও দুই চার লাইন কবিতা লিখতে পারি, কবিতা আবৃত্তিও
করতে পারি, অঙ্কুরিত হলো আমার সুপ্ত প্রতিভার বীজ, নতুন চারা মাথা বের করে উঁকি
দিলো, সকল কৃতজ্ঞতা আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়া এবং মিডিয়া জগতে বিচরণকারী বন্ধুদের
প্রতি।
সংশপ্তক: এই
প্রসঙ্গেই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের বিচলিত করে। আগে প্রতিভা বিকাশের কোন না কোন একটি মাপকাঠি ছিল। কিন্তু আজকে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে কেউ নিজেকে কবি সাহিত্যিক
সংগীতশিল্পী বলে প্রচার করতেই পারেন। এবং বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের
প্রশংসায় এই ভাবে মধ্যমেধার বাড়বারন্ত শিল্পসংস্কৃতির পক্ষে কতটা স্বাস্থ্যপ্রদ
বলে আপনার মনে হয়?
রীতা রায়
মিঠু: এই প্রসঙ্গে আমার একটিই কথা, করুকনা যে কেউ তার প্রতিভা বিকাশের
চেষ্টা, ঝরুকনা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের মুখ থেকে উচ্চ প্রশংসা! আমেরিকায়
বসবাস করে এই একটি সংস্কৃতি খুব ভাল বুঝেছি, কারো কাছ থেকে ভালো কিছু কাজ পেতে হলে
সবসময় তাকে উৎসাহ দিতে হবে। সকলেই ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে
জন্মায়না, কিন্তু পাথর ঘষেই আগুন জ্বালানো যায়। যারা প্রতিভা নিয়ে জন্মায়নি, তাদেরকে প্রতিভা মাপক তুল্যদন্ডে
রেখে প্রতিভা পরিমাপ করার দরকার কি? জন্মগত প্রতিভা নয়, প্রতিভা প্রকাশে তার
প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানানোইতো সমাজ-সংস্কৃতি বিকাশে অনেক বেশী স্বাস্থ্যপ্রদ মনে
হয়। বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের
বাড়াবাড়ি প্রশংসা অবশ্যই বিরক্তিকর, তবে সত্যিকারের প্রতিভাবানদের জন্য
হুমকীস্বরূপ নয়।
সংশপ্তক: আবিশ্ব
বিভিন্ন সংস্কৃতিকে পরস্পরের আরও কাছে নিয়ে আসতে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুমিকা কতটা
শক্তিশালী হতে পারে?
রীতা রায়
মিঠু: বাংলাদেশে এয়ারলাইনসের
একটি শ্লোগান খুব জনপ্রিয়, “ ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী”। শ্লোগানটি যখন বাজারে আসে, আমি কলেজে পড়ি। বিচার-বিশ্লেষণ করার মত বুদ্ধি তখন ছিলনা, আবেগে ভেসে যাওয়ার বয়স
কিনা! তখন এই শ্লোগানের মর্ম কথা বুঝতামনা। বুঝতেই
পারিনি দুই শতক আগে ইংল্যান্ডে যেতে ভারতবাসীকে ‘কালাপানি’ পাড়ি দিতে হতো, অর্থাৎ সমুদ্রপথে যেতে হতো। মাসখানেক তোঁ লেগেই যেত, আমেরিকা যাওয়ার কথা ভারতবাসী হয়তো
ভাবনাতেও আনতোনা। পৃথিবীর আয়তন পরিমাপ করা হতো
দিবা-রাত্রির ব্যবধান দিয়ে। সেই দিবা-রাত্রির ব্যবধান হিসেব
চুকে বুকে গেলো আকাশ যান আবিষ্কার হওয়ার পর।
মাসব্যাপী ক্লান্তিকর ভ্রমণ হয়ে গেলো মাত্র দশ বারো ঘন্টার ব্যাপার। তাহলে তো আয়তন কমে এতবড় পৃথিবীটাই ছোট হয়ে গেলো! হ্যাঁ, সেটিই
ঘটেছে, নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে পৃথিবীটা আমাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে অন্যদেশে না গিয়েও আমরা এখন সকল দেশের
নিজস্ব সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, বাণিজ্যনীতি সম্পর্কে জানতে পারছি, ঘরে বসেই
তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছি, স্কাইপিতে চেহারা দেখে কথা বলতে পারছি, এমনকি ইউরোপ,
আমেরিকায় বসেই কলকাতা বা ঢাকায় বাবা-মা, আত্মীয়-বন্ধুকে ফুলেল উপহার পর্যন্ত
পাঠাতে পারছি। এখন আমেরিকা আসার সময় আগের মতো
কেঁদে আকুল হইনা, মনে মনে জানি, একদিন পরেই স্কাইপিতে প্রিয়জনের মুখ দেখতে পাবো।
সংশপ্তক: এই যে
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকসংস্কৃতির সাথে সহজ আদান প্রদানের একটি শক্তিশালী
মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রটি: সেই সম্বন্ধে আমাদের
বাঙালিদের সচেতনতা কতখানি ঘটেছে বলে মনে হয় আপনার?
রীতা রায়
মিঠু: আমার ব্যক্তিগত মতামত,
বাঙালির মানসিক গঠণে সীমাবদ্ধতা, স্বার্থপরতা, কার্পন্যতা এখনও বিদ্যমান। জানিনা, হয়তো আগামী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এইসকল কূপমন্ডুকতা থেকে
বেরিয়ে আসতে পারবে। ছোট্ট উদাহরণ দেইঃ বাঙ্গালির
পোশাকের কথাই ধরি, বাঙালি নারী শাড়িতে সুন্দর, শাড়ি বাঙালি নারীর অহঙ্কার। পাজামা-পাঞ্জাবি বাঙালি পুরুষের পোশাক। কিন্তু প্রবাসে বাঙালি উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়া এক শ্রেনীর বাঙালি
নারী-পুরুষের কেহই শাড়ি বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে না, এমনকি নিজ বাড়িতেও নয়। অফিসিয়াল কোন অনুষ্ঠানে যেতে হলে বাঙালি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিধান
করে, বাড়ির কাছে শপিং সেন্টার, ওখানে যেতে হলেও বাঙালি পোশাক পালটে তবেই শপিং
সেন্টারে যায়। আরেক শ্রেনীর বাঙালি আছে যারা
বাঙালি বা ওয়েস্টার্ন পোশাকের কোনটিই পরেনা, তারা সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের পোশাক
পরিধান করে। ফলে বিদেশীরা জানতেই পারেনা
বাঙ্গালির পোশাক পরিচ্ছদের বৈচিত্রতা সম্পর্কে। এতো গেলো বাস্তব জগতের কথা, মিডিয়াতে বাঙ্গালি ছেলেমেয়েরা বাংলা
সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতির সাথে বিনিময় যোগ্য মনে করে কিনা জানিনা। কারণ তারা অনলাইন মাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুক মাধ্যমে সাধারণতঃ
বাঙালি অনুষ্ঠানের ছবি, গান, নাচের পোস্ট দেয়না, পোস্ট দিলেও কাস্টমাইজ করে রাখে
যেন বিদেশী বন্ধুরা তা না দেখতে পারে।
প্রোফাইল ছবিতেও থাকেনা বাঙ্গালিয়ানার ছাপ।
ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে অনলাইন মাধ্যমে বিচরণ করেই এই ধারণাটুকু হয়েছে। তবে সকলেই তো একরকম হয়না, কিছু ক্ষ্যাপা বাঙালি সবকালেই থাকবে,
তারা নিজের সংস্কৃতির বিকাশ, বিনিময়ে নান্দনিক ও শোভন যা কিছু করা যায়, নিশ্চয়ই তা
করবে।
সংশপ্তক: সোশ্যাল
মিডিয়া স্বভাবতঃই সমাজ দর্পনের ভুমিকায় একটি কার্যকরী মাধ্যম। আমাদের বাঙালি সমাজের প্রেক্ষিতে এই দর্পনের বর্তমান প্রতিচ্ছবিটি
কতটা আশাব্যঞ্জক আপনার কাছে?
রীতা রায়
মিঠু: ভালোর পিঠে থাকে মন্দ, আধুনিকতার পিঠে পশ্চাদপদতা, সচেতনতার পিঠে
অসচেতনতা। শুধু সোশাল মিডিয়া কেন, যে কোন
মিডিয়াতেই শেখার মত এবং শেখানোর অনেক উপাদান থাকে। কে কতটুকু শিখতে চায় বা কোন বিষয়ে জানতে চায়, তা ব্যক্তির
ব্যক্তিত্ব, জানার আগ্রহ, রুচীর উপর নির্ভর করে। সোশ্যাল মিডিয়া অবশ্যই সমাজের দর্পন। দর্পনে চোখ রেখে সকলেই স্বচ্ছ ছবি দেখতে পায়না। চোখের দৃষ্টি যাদের ত্রুটিপূর্ণ, চোখে যাদের অসুখ, দর্পনে তারা
সমাজের অসম্পূর্ণ ছবি দেখতে পাবে। তাদের হয় চোখের চিকিৎসা করাতে হবে
নাহলে সোশ্যাল মিডিয়ার আওতা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এইসব দৃষ্টি অস্বচ্ছ মানুষগুলোতে অনলাইন
মাধ্যম ভরে উঠেছে। আশার কথা বলি,
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার অন্ধ, কানা, মানুষের ভীড়ে এক দুজন স্বচ্ছ দৃষ্টিধারীর
দেখা পাওয়া যায়, তাদের চোখ দিয়েই অন্যেরা সমাজটাকে দেখে, দেশ দেখে, বিশ্বকে দেখে।
সংশপ্তক: একথা
আমরা সকলেই জানি, ইংরেজী ও হিন্দীর দূর্দমনীয় প্রভাবে আমাদের দৈন্দিন জীবনচর্চায়
ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাসঙ্গিকতা দ্রুতহারে ক্রমহ্রাসমান। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ার অভূত্থানে বাংলা ভাষার পুনরুজ্জীবনে কি
কোন আশার আলো চোখে পড়ছে আপনার?
রীতা রায়
মিঠু: ভাষার ব্যাপারে আমার মনে
অতিরিক্ত শঙ্কা কাজ করেনা। যে যেমন ভাষায় কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্য
বোধ করে, সে সেই ভাষাতেই কথা বলুকনা, সমস্যা কি। ভাষা আবিষ্কার হয়েছে মনের ভাব প্রকাশের জন্য। ভাষা ব্যবহার করা হয় পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য। দুই জন বাংলাভাষী কথা বলার সময় খুব বেশীক্ষণ ইংরেজী বা হিন্দী
বলবেনা। মায়ের ভাষাতেই তাকে ফিরে আসতে হবে। প্রথম যখন ফেসবুকে প্রবেশ করি, ইংরেজী ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু ইংরেজীতে কতক্ষণ বলা যায়? ইংরেজী বললেই কয়জন তা বুঝতে
পারে? আমি বলবো কথা, অন্যজন যদি নাই বুঝলো, তাহলে বলা কেন, কার জন্য? তাই ইংরেজী
দিয়ে শুরু করলেও কিছুদিন পরেই তা বাংরেজী হয়ে গেলো। অর্থাৎ কিনা বাংলা কথাগুলোই ইংরেজী বর্ণমালা ব্যবহার করে লিখতাম। এভাবেই বা কতদিন? বাংলার মেধাবী সন্তানেরা তৈরী করে ফেললো, বাংলা
বর্ণমালার সফটওয়্যার, ‘অভ্র’। অভ্র জয় করে নিল বাংলাভাষীদের হৃদয় শীঘ্র। এখন অনলাইনে সর্বত্র বাংলার ব্যবহার। বাংলা ব্যবহার করছি বলে কি ইংরেজী ব্যবহার ভুলে গেছি? হিন্দী ভুলে
যাব? ইংরেজী, হিন্দী, আরবী, ফার্সি, স্প্যানিশ----বাংলার সাথে কোন বৈরীতা তো নেই। ভাষা জানা থাকলে জায়গামত ব্যবহার করা যায়, এটাই একাধিক ভাষা জানা
মানুষের প্লাস পয়েন্ট।
সংশপ্তক: আমাদের
এই দ্বিখন্ডিত বাংলায় কাঁটাতারের দূরত্ব ঘুচিয়ে দুই পারের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা
ভালোবাসা ও প্রীতির সম্পর্কের উন্মেষ ঘটিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে পরস্পরের
কাছাকাছি নিয়ে আসার বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে
আপনার মনে হয়।
রীতা রায়
মিঠু: কাঁটাতারের দূরত্ব ঘুচাতে
সোশ্যাল মিডিয়ার মানুষগুলোর অনেকেই খুব আন্তরিক, তবে মনের কথা তাদের মনেই থেকে
যায়, থেকে যায় চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দুতে, আর থাকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। দুই পারের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক হিসেব নিকেশ এবং সর্বোপরী দুই
পারের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান হিংসা, ক্রোধ, ঈর্ষা, ধর্মীয় বিরোধের কাছে
আন্তরিক মানুষগুলো নিশ্চুপ হয়ে যায়। কাঁটাতারের দূরত্ব কোন বাধা নয়, দূর
করতে হবে মনে জমে থাকা অবিশ্বাস, আক্রোশ, প্রতিশোধের স্পৃহা।
সংশপ্তক: মানুষের
ইতিহাস জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দাঙ্গা, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে
সংঘর্ষের ইতিহাস। সোশ্যাল মিডিয়ার এই উত্থান কি সেই
ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আবিশ্ব মানুষকে জাতি ধর্ম সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে একটা
মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয় আপনার?
রীতা রায়
মিঠু: সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে
অনেক ভালোর পাশাপাশি ভীষণ মন্দগুলোও সাধারণ মানুষকে আশাহত করে তুলছে। নেতিবাচক কথা বলতে ভালো লাগেনা। গত ছয় মাসে বাংলাদেশে পাঁচজন মেধাবী ব্লগার নির্মমভাবে খুন হয়েছে। ব্লগ কি? সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই মানুষ দ্রুত গতিতে মত আদান
প্রদানের সুযোগ পেয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই ব্লগের উৎপত্তি। ব্লগ হচ্ছে আমার ডায়েরী, কিন্তু পড়তে পারবে সকলে। আমার ডায়েরীতে আমার নিজের মনের কথাই লিখবো, এটাই স্বাভাবিক। তোমাকে পড়তে দিয়েছি বলেতো আমার ডায়েরীর মালিকানা দেইনি, আমার
ভাবনার মালিকানা দেইনি, আমার কর্মের দায়ও তোমাকে দেইনি, তুমি শুধু পড়বে, পছন্দ
নাহলে নিজের অপছন্দের কথা জানাবে। কিন্তু বাস্তবে
সেটি ঘটছেনা। সোশ্যাল মিডিয়াতে শুধু সাধুরাই
ঘোরেনা, শয়তানও ঘোরে। সাধুদের যেমন নিজেদের গোষ্ঠী আছে,
শয়তানদেরও তা আছে। শয়তানরাও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে
সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। শয়তানের কাজ সাধুকে দমন করা, সাধুর
কাজ শয়তানকে প্রতিহত করা। শয়তানের পেশীর
জোর থাকে অনেক বেশী, পেশীর জোর খাটিয়েই তারা তাদের চারপাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। পেশীশক্তিকে সকলেই ভয় পায়। তাই
ভীষণ ভীষণ অন্যায়গুলো খুব সহজে সংঘটিত হয়, চোখের সামনে রক্তাক্ত মানুষ দেখে অন্যরা
নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করে, তাই নীরব থাকে। তবুও কখনও কখনও প্রতিবাদ হয়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দূর্ণিবার ডাকে
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়, বিচারের রায় কার্যকর হয়, ব্লগার হত্যার আসামী ধরা পড়ে!
কত দেশে কত সরকারের পতন হয়। হোক ধীর গতিতে, তবুও সোশ্যাল
মিডিয়ার কল্যাণেই তা হচ্ছে। নেতিবাচক দিয়ে
শুরু করেছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক প্রভাবের কথা বলি। নেপালে ভূমিকম্প হয়েছিল, ভূমিকম্পের ভয়াবহতার সংবাদ একেকটি
ভূকম্পনের চেয়েও দ্রুত শক্তিতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বিচারে নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ দাঁড়িয়েছে
নেপালের পাশে। সোশ্যাল মিডিয়ার কী অপূর্ব ক্ষমতা!
সংশপ্তক: আমাদের
সমাজ ও সভ্যতায় দৈনন্দিন জীবনের পরিসরে অন্যায় অত্যাচার, শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুমিকা কতটা কার্যকরী হতে
পারে বলে আপনি মনে করেন?
রীতা রায়
মিঠু: ছোট্ট একটি উদাহরণ,
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ‘রাজন’ নামের একটি কিশোরকে
একদল বিকৃত মানসিকতার মানুষ পিটিয়ে হত্যা করেছিল। কিশোরকে পিটানোর সময় উপস্থিত সকলেই খুব আমোদ পেয়েছিল, তা বুঝাতেই
বোধ হয় পেটানোর দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ধারণ করে এবং নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য
ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করে। ইউটিউবে ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার সাথে
সাথে সমগ্র অনলাইন জগতে হৈ চৈ পড়ে যায় এবং অপরাধী সকলকে আইনের হাতে তুলে দেয়া হয়। প্রায় পাঁচ বছর আগে ঢাকা শহরে বিশ্বজিত নামের এক সাধারণ খেটে খাওয়া
তরুণকে প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক খেয়োখেয়ি খেলায় হরতাল বিরোধীদের চাপাতির কোপ খেয়ে
মরে যেতে হয়। বিশ্বজিতকে এক কোপে মারা হয়নি,
বাঁচবার জন্য ছেলেটি এদিক সেদিক প্রাণপন ছুটছিল, হত্যাকারীরাও ওকে ধরার জন্য ধাওয়া
করছিল, অনেকটা সময় ইঁদুর বেড়াল খেলা হয়েছিল। অনেকেই
ইঁদুর বেড়াল খেলার ভিডিও চিত্র ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। হত্যাকারীরা ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ছিল, তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন বিক্ষোভের ঝড় উঠেছিল যে সরকার বাধ্য হয়
হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে। দুই দিন পর পর
আইসিস বাহিনীর নৃশংস কর্মকান্ডের ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ববাসীর
কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আইসিস বাহিনীর নাম শুনলেই সচেতন
মানুষ মাত্রেই আরও সচেতন হয়ে উঠছে, মানবতা এবং মানবতার অবক্ষয় মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আগে যুদ্ধ, দাঙ্গা, হত্যা, রাহাজানির সংবাদ পাওয়া যেত খবরের কাগজে,
ইতিহাস বইয়ে। ক’জনই বা বই পড়ে, ক’জনইবা খবরের কাগজ পড়ে।
মুঠোফোনে এক ক্লিকে বিশ্ব হাতের মুঠোয় চলে আসে, কমপিউটারের স্ক্রিনে বিশ্ব চলে
আসে, সংবাদ আদান-প্রদান হয় সেকেন্ডের গতিতে। ভাল
সংবাদের পাশাপাশি খারাপ সংবাদও মানুষ জেনে যায় দ্রুত। যার যেমন বিচারবোধ, সে তেমন করেই সংবাদগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে। সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, কোন সংবাদের প্রতিবাদ দরকার, কোন সংবাদে
প্রতিরোধ দরকার এবং কোন সংবাদে সমর্থণ দরকার। মাত্র দিন চারেক আগে সোশাল মিডিয়ায় তুরস্কের সমুদ্র উপকূলে বালির
মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা সিরিয়ান শিশু আইলানের মৃতদেহ সারা বিশ্বে যে আলোড়ন
তুলেছে, ইউরোপিয় দেশের সরকারগণ অসহায় সিরিয় শরণার্থীদের নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে
নিজেদের বিবেকের মহানুভবতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। উপরে তিনটি
হত্যাকান্ডের সংবাদ লিখলাম, যারা চলে গেছে তারা হতভাগ্য, কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে
তারা জাগিয়ে দিয়ে গেছে ঘুমন্ত বিবেক এবং ঘুমন্ত মানবতাকে, চিনিয়ে দিয়েছে আমাদের
চারপাশ ঘিরে থাকা নৃশংস, নির্বোধ, নিষ্ঠুর কিছু মানুষরূপী পশুকে।
সংশপ্তক:
সংশপ্তকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে এই
সাক্ষাৎকার শেষ করবো একটি কথাই জানতে চেয়ে: সোশ্যাল মিডিয়ার এই হঠাৎ উত্থান আপনার
ব্যক্তিগত জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, তার প্রকৃতি ও বিকাশ সম্বন্ধে একটু
যদি আলোকপাত করেন!
রীতা রায়
মিঠু: ছিলাম সংসার গৃহের এ
কোণে, ও কোণে, মাঝখানে এবং সর্বত্র। গৃহেরই ছোট্ট আরেক কোণে বসানো
হয়েছিল টিভির মত দেখতে বিশ ইঞ্চি স্ক্রিনের কমপিউটার। অনুসন্ধিৎসু মন বিশ ইঞ্চি স্ক্রিনের কমপিউটারে খুঁজে পেলো গোটা
বিশ্ব। নিঃসঙ্গ প্রবাসী সংসার মনোযোগী
মানুষটি ধীরে ধীরে কমপিউটারের প্রতি মনোযোগী হলাম। কমপিউটারের এ বাটনে চাপ দেই, ও বাটনে চাপ দেই, চোখের সামনে খুলে
যেতে থাকে জানা অজানা কত রকমের জানালা। এভাবেই
খুলে গেলো ফেসবুক নামের বিশ্বসম্মিলনী পার্কের দরজা। খোলা দরজায় উঁকি দিয়ে সংসার মনোযোগী মানুষটি সংসারের কাজে ভুল
করতে শুরু করলো। সে রাঁধতে ভুলে যায়, কাঁদতে ভুলে
যায়, নাইতে ভুলে যায়, খাইতেও ভুলে যায়। মিডিয়ার
দূর্ণিবার আকর্ষণে মানুষটির বিচরণ ক্ষেত্র এ কোণ, ও কোণ থেকে সরে আসে, কেন্দ্রীভুত
হয় বিশ ইঞ্চি স্ক্রিনের কমপিউটার পর্দায়। এখানেই
সে অন্যের কথা শুনে, অন্যের কথা শুনে ধীরে ধীরে নিজের কথা লিখতে ইচ্ছে করে। এক দুটো শব্দ, এক দুটো বাক্য লিখা শুরু হয়, এবং এক সময় মানুষটি
নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে যুক্ত হয় হাজার মানুষের ভীড়ে। গৃহকর্ম, গৃহসুখকে অস্বীকার না করেই সে হারিয়ে যায় বিশ ইঞ্চি
স্ক্রিনের সোশাল নেটওয়ার্ক জগতে। এক দু লাইন বাক্য লিখতে লিখতেই সে
লিখে ফেললো দুটো বই। বই লিখতে লিখতেই খুঁজে পায় ‘সংশপ্তকের
স্বপ্নদ্রষ্টাকে। চোখের সামনে খুলে যায় সংশপ্তকের
দরজা, মানুষটি পায় সংশপ্তকে প্রবেশের আমন্ত্রণ। সংশপ্তকে প্রবেশ করে দেখা পায় কত গুণী লেখক, কবির। নিজেকে আর নিঃসঙ্গ মনে হয়না, মাতৃভূমি ছাড়া মনে হয়না। মাতৃভাষার এমন সাবলীল চর্চা এর আগে করার সুযোগ হয়েছিল কিনা তাইইতো
মনে করতে পারেনা মানুষটা। সংশপ্তকের স্বপ্নদ্রষ্টাকে এবং তাঁর
মাধ্যমে সংশপ্তক পরিবারের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা আমাকে কাব্যচর্চার এমন সুন্দর জগতে
প্রবেশাধিকার দেয়ার জন্য।
রীতা রায় মিঠু: কথাসাহিত্যিক