>

সুলগ্না দত্ত।

SongSoptok | 8/10/2014 |

                      ছেঁড়া ডানায় ওড়া





চপচপে ঘামে প্রায় বিছানা ভিজে জল ৷ অল্প অল্প হাঁপ ধরাও শুরু হয়েছে ৷ বাইরে আলো ফিকে হয়ে এসেছে বোধহয় ৷ মেঘ করেছে, তিনটে সাড়ে তিনটে হবে ৷ আলো আঁধারিতে শয্যাশায়ি অবস্থায় সত্যবাবু হাঁতড়াচ্ছেন ৷ চায়ের ফ্লাক্স ৷ কোনক্রমে সেই অবধি পৌঁছে ফ্লাক্সের ঢাকনা খুলতে দেখেন চা শেষ ৷ নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর, অজানা ভয় যেন এবার আরো দুর্বল করে দিচ্ছে ৷ সেই অলৌকিক তেজস্মী লোকটাকে, যার ভয়ে দূরারোগ্য ব্যাধিও পালায় এক ওষুধে ৷ আরো একটু হাতড়ে জলের বোতলটা কোনক্রমে পান ৷ ছিপি খুলে জলটা খেতে গিয়ে অনেকটা জল পড়ে যায় ৷ বিষম লাগে সত্যবাবুর ৷ অনেক শক্তি সঞ্চয় করে হাঁক দিতে যান কাজের মেয়েটাকে

 __ 'বিনিতা ও বিনিতা' ৷ দোতলার চিলে কোঠার ঘর থেকে এই ক্ষীণস্বর শুনতে পাওয়ার কথা নয় ৷ নিজেই বিড়বিড় করে বলেন,ওহ্, বিনিতা তো ছুটিতে ৷ দুই-তিন সেকেন্ডের জন্য অন্ধকার হয়ে আসে চোখের সামনেটা - আবার সেই হাঁপ ধরা, ঘাম দেওয়া ৷ কোনরকমে বালিসের পাশে রাখা মোবাইলটা নিয়ে ফেবারিট কলারের বোতমটা টিপে দেন ৷

 ___ হ্যালো ৷ হ্যাঁ দুপুর তিনটের মিটিংটা ফিক্স করে ফেল ৷ পাঁচটার টা কালকের জন্য পোস্টপন্ড করে দাও, গম্ভীর নারী কন্ঠ দ্রুত টেলিফোন কেটে দেয় ৷
 ___ মা, ভাত বাড়ো, গাড়ি এসে যাবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ৷
 ___ দিচ্ছি
 ___ আর শোনো, ঝুমা বাজার থেকে ফিরলে, ইলেকট্রিকের বিল এসেছে লেটার বক্সে, বার করে নিয়ে আসতে বলো ৷
 ___ তুই খা- ওকে আমি সব বলে দেব ৷
 ___ উফ্, আজও চিচিঙ্গে?
 ___ আরে বাবু, গরমে কি রান্না করবে বল?
 ___ দুপুরে লাউঞ্জে খেয়ে নেব, এই সব অফিসার, জি.এম দের মাঝে খাওয়া যায়?  তুমিই বলো …? টিফিন দিও না কিন্তু ৷ ___ আচ্ছা এখনকার মতো খেয়ে নে, রাতে ভালো রান্না করতে বলবো ৷

একুশ শতকের দ্রুতগামী নারী নীলাঞ্জনা রিজার্ভ ব্যঙ্কের অফিসার ৷ প্রাণের চেয়েও প্রিয় সখ লেখা ৷ কৈশরে স্বপ্ন ছিল নামী লেখিকা হবে - আজও সেই স্বপ্ন ধেয়ে চলেছে ৷ বিকেল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ অবধি অফিস, তারপর বাড়ি ফিরে মুখ গুঁজে শুধুই লেখালিখি ৷ সরকারি চাকরির ফাঁক-ফোঁকড়ে বেড়িয়ে পড়ে ডালহাউসির হাই-ফাই রেঁসতোরায় বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মিটিং করতে ৷ সকাল সাড়ে আটটা-নটায় কালো হন্ডা সিটি গাড়িটা যখন সিঁথিমোড় পার করে চিড়িয়ামোড়ের অভিমুখে যাত্রা করে তখন কানু ডাবওয়ালা প্রায়ই হাত নেড়ে ম্যাডামের গাড়ি দাঁড় করিয়ে ম্যাডামকে শাঁসে-জলে ডাব খাওয়ায় ৷ আজও তাই হলো ৷
 ___ কানুদা, বেশি জলওয়ালা দাও, আগের দিন জলটা ঝাঁজ ছিল কিন্তু ৷
 ___ ম্যাডাম, আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো ডাব দিচ্ছি, পঁচিশ টাকার ৷ এর জল, শাঁস খেয়ে আর দুপুরে আপনাকে খেতেই হবে না, একেবারে পেট ভরা থাকবে, খুব ভালো বসিরহাটের ডাব ৷

 নীলাঞ্জনা চোখের সানগ্লাসটা খোলে না ৷ ডাবের জল স্ট্র দিয়ে খেয়ে এগিয়ে দেয় নারকেল কেটে দিতে ৷ মোবাইলে বিপ্-বিপ্ মেসেজ আসে ৷ তোমার বইটা দারুণ চলছে এই আগের মাসের পনেরো তারিখ থেকে ৷ আশা করি রয়ালটি আরো বেশি পাবে ৷ নীলাঞ্জনা মৃদ্যু হাসে ঠোঁটের এক কোণে থেকে ৷ সেই হাসিতে অহংকার - স্বস্তি - আর মগ্নতার ছাপ থাকে ৷ তবে আগে তো নীলাঞ্জনা এইরকম ছিল না ৷ অহংকার ছিল না ৷ প্রতিপত্তি ও প্রাচুর্য হামবড়া ভাব ছিল না ৷ জীবনে কিছু করে দেখাতে হবে - বড় হতে হবে এইটাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ৷ একদিন সে নাম করা লেখিকা হতে চায় ৷ এরজন্য সে প্রাণপণ যা করতে হয় করবে ৷ কেউ বলেছে মোটিভেশান, কেউ বলেছে লোভ ৷ যশের লোভ ৷ ইদানিং এই বদলের ভাবটা বেশ কিছুজনের চোখে পরেছে ৷ প্রায় মাস খানেক ৷ তবে কি ডাক্তারবাবু সঙ্গে কথা কাটাকাটিটা এতটাই ওকে বদলে দিল? মাত্র এই কদিনে?

 ___ অসৎভাবে, অসাধু কাজ করলে জানবে আমি মরে গেছি, কোনদিনও বড় হতে পারবে নানীলাঞ্জনার কথাগুলো খুব রূঢ় লেগেছিল ৷ সেও উত্তর দিতে ছাড়েনি ৷
 ___ খুব রেগে গিয়ে বলেছিল, তাই তো নিজে সারাজীবন কিছুই করতে পারলে না

 ___ ম্যাডাম, একটা কথা জিঞ্জেস করবো?
 ___ কি রনোজয়?
___ বলছি, আপনি ডাক্তারবাবুর বাড়ি যাননি প্রায় মাস খানেক হয়ে গেল ৷
 ___ নীলাঞ্জনা হু বলে এড়িয়ে যেতে চায় ৷
___ ম্যাডাম, কিছু অসুবিধা আছে কি? কৌতুহলী রনোজয় আবার জিঞ্জেস করে৷
 ___ রনোজয়, এটা তোমার কাজ নয়, আমি বলবো কখন, কোথায় যেতে হবে ৷

ড্রাইভার রনোজয় একটু অবাক হয় ম্যাডামের ব্যবহারে ৷ কিন্তু কিছুই বলে না আর ৷ গত শনিবারও সে জিঞ্জেস করেছিল ম্যাডামকে ডাক্তারবাবুর বাড়ি যাওয়ার কথা, ম্যাডাম এড়িয়ে গিয়েছিল ৷ তবে আজ রনোজয়ের বেশ অপমান বোধ হল ৷ এর আগে ম্যাডাম কোনদিন এইভাবে তার সাথে কথা বলেনি ৷ তবে ডাক্তারবাবুর সাথে কি ম্যাডামের কিছু হয়েছে? রনোজয় মনে মনে ঠিক করে পরের শুক্রবার ম্যাডামকে আবার জিঞ্জেস করবে ৷

___ দুপুরে হো চি মিং সরণীতে মিটিং, তারপর বেড়িয়ে যাবো, গাড়িতে তেল ভরিয়ে নিও ৷
___ আচ্ছা ম্যাডাম ৷

 প্রাণতোশ সিকদার, নীলাঞ্জনাকে খুব শ্রদ্ধা করে ৷ লেখক হিসাবে নীলাঞ্জনার মধ্যে সে অনেক বড় সম্ভবনা দেখতে পেয়েছে ৷ ডাঃ সত্যব্রত রায় নীলাঞ্জনাকে কোনদিনও এইভাবে তথাকথিত আপে চড়াননি ৷ সে সুন্দরী যুবতি ৷ সে অবিবাহিত, সে স্বনির্ভরশীল এবং সে সফল ৷ এ সবের জন্য সে সবার নজর কাড়ে ৷ প্রাণতোশবাবুর সঙ্গেই আজকের মিটিংটা বিকেল তিনটে ৷

 ___ হ্যালো, হ্যাঁ সিকদারবাবু, আসছি প্রায় পৌঁছে গেছি ৷
 ___ আমি যে সকাল থেকে তোমার অপেক্ষায় কোন কাজে মন দিতে পারছি না নীলা
 ___ আর পাঁচটা মিনিট, এক্ষুণি পৌঁছে যাবো ৷
 ___ এসো, তোমার অপেক্ষায়, যে কতকাল

নীলাঞ্জনার সময় জ্ঞান খুব ভালো, কিন্তু কোলকাতার রোদ, হাওয়া, জল, মানুষ আর ট্রাফিক জীবনে সময়ানুবর্তিতা ব্যাপারটা যেন কাল্পনিক করে দিয়েছে ৷ আজ নীলাঞ্জনার জীবনের সেই দিন যেদিনের জন্যে অপেক্ষায় সে সেই ছোটবেলা থেকে ৷ এতকার সে স্বপ্ন দেখেছে ৷ আজ সেটা সত্যি হবে ৷ সাতাশ বছরের যুবতী নমিনেটেড হয়েছে বুকার প্রাইজের জন্যে ৷ আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্না লেখিকা হবে আজ থেকে ৷ সে এক নতুন জীবনের শুরু ৷ প্রাণতোশবাবুই এই ব্যাপারটা দেখেন- আজ লেটারটা হাতে পাবে ৷ ঠিক করা আছে, লেটারটা পেলেই সেটা নিয়ে বেড়িয়ে যাবে রনোজয়ের ম্যাডাম ৷

নীলাঞ্জনার মনে পড়ে যায় ডাক্তারবাবুর কথা, জীবনে অসৎ হয়ে ওপরে ওঠা গেলেও শান্তি পাওয়া যায় না ৷ তাই এইরকম ভুল করিস না কখনও, যেখানে তোর সন্মানে মানুষ হাত দিতে পারে ৷ নীলাঞ্জনা চায় না অসৎ হতে ৷ তার প্রতিভার জোর দুরন্ত - শুধু খ্যাতি আর লেখিকার মাঝখানের কয়েকটা কাঠের ধাপ আছে -- সেই ধাপ অতিক্রম করলেই সাফল্য ৷

___ রনোজয়, সারে তিনটের মধ্যে এসে পার্কিং লটে গাড়ি রাখবে ৷ পৌঁছেই কল করবে ৷
___ আচ্ছা ম্যাডাম ৷

নীলাঞ্জনার তিনটে পাঁচ হয়ে গেল প্রাণতোশবাবুর কেবিনে পৌঁছাতে ৷

 ___ ঠিক পাঁচ মিনিট লেট তুমি নীলাঞ্জনা সেন ৷
___ জানি পার্কিং পাচ্ছিল না ৷
___ কতক্ষণ অপেক্ষা করছি আমি ৷
___ দাদা, কোলকাতার রাস্তা - জানেনই তো ৷ যদি একটু লেটারটা দিয়ে দেন, আসলে একটু তাড়া আছে ৷
 ___ সেকি? এই পরমপ্রাপ্তির দিনেও তাড়া?
 ___ এক জায়গায় যেতে হবে আসলে, খুব দরকার ৷
 ___আরে এত আমতা আমতা করছো কেন? তুমি তো আজ থেকে বিরাট লেখিকা ৷ অরুণধুতি রায়, ঝুম্পা লাহিড়ী, নীলাঞ্জনা সেন - সব এক পক্তিতে ৷
 ___ এরকম করে বলবেন না প্লিজ
 ___ আরে আমি ভাবছিলাম তোমায় এখন থেকে তুমিও বলা যাবে না ৷ আপনি আজ্ঞে করতে হবে ৷ রিজার্ভ ব্যঙ্কের অফিসার - আবার বুকার প্রাইজ পেতে চলেছো ৷
___ দাদা কাজটা সেরে নি ৷ একটু তাড়া আছে সাড়ে তিনটেতে বেড়িয়ে যাবো ৷
___ দেখো, পাঁচ মিনিট লেটে এসেছো - তার জন্যনীলাঞ্জনার একটু অস্বস্তি বোধ হয় ৷ প্রাণতোশবাবু টেবিলের ওপাস থেকে ঝুঁকে পড়ে তার হাত ধরে বলে, congratulation ও বলতে সময় দেবে না? আকাশ পাতাল উত্তর খোঁজে নীলাঞ্জনা ৷ প্রাণতোশ এই মুহুর্তকে চিরে আবার বলে, প্রিয় লেখিকাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে কত সে আর তুমি কি বুঝবে ম্যাডাম !

তথাকথিত সৃষ্টিশীল নামজাদা লেখকদের কল্পনাগুলোকে না ছুঁয়ে দেখলে ভালো লাগে না ৷ এদের প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধা, ভক্তি সবই কিন্তু একটাই ভাবের সমন্নয় - তার বহিপ্রকাশও একটাই ৷ এটা আবার প্রমাণ হল ৷ প্রাণতোশ সিকদারের স্বভাব ভালো নয় ৷ এই মুহুর্তটা কি বদলানো যাবে না? লেখিকার প্রতিভা আর খ্যাতির মাঝখানে একটা খাম -- খামে ভরা ইনভিটেশন লেটার ৷ সেটার কাছে পৌঁছাতে এটাই কি তবে ওঠার সিঁড়ি? এটাকেই কি বলে স্ট্রাগেল?

___ দাদা  কাজের কথাটা সেরে নি? কাজের কথা সারতে সারতে নীলাঞ্জনাকে মেনে নিতে হয় - অনেক রকমের স্ট্রাগেল ৷ মহিলা হয়ে বোঝে এই ওপরে ওঠার বড় মারাত্মক পিচ্ছিল সিঁড়ি ৷ হঠাৎ চেনা রিংটোনটা বেজে ওঠে, ব্যস্ত হয়ে নীলাঞ্জনা ফোনটা ধরতে চায় ৷ ঠিক তখনই প্রাণতোশবাবু ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কেটে দেয় ৷
___ এই পঁচিশ মিনিট টুকু শুধু আমার ৷ প্রাণতোশের ডান হাতটা নীলাঞ্জনার কোমড় থেকে উঠে যায় বুকের কাছে ৷

 ___ হ্যাঁ, রনোজয় গেটে এসো ৷ আমি নামছি ৷
 ___ আচ্ছা ম্যাডাম ৷ রনোজয় ম্যাডামের কথা মতই হাজির হয়ে যায় ৷ নীলাঞ্জনার সময় আন্দাজটা বেশ ভালো, ঠিক সাড়ে তিনটে বাজে - এখন খামটা ওর হাতে ৷ পরম প্রাপ্তি ৷ মন দিয়ে পড়ে গাড়িতে বসেই বলে রনোজয়কে, চলো ৷ ___ ম্যাডাম, কোথায়? বাড়িতে?
___ না বারাসাতে যাবো ৷
___ ডাক্তারবাবুর ওখানে? আপ্লুত কন্ঠস্বর রনোজয়ের ৷
 ___ হ্যাঁ ৷

এক লাইনের চিঠি ৷ তবু বারবার করে পড়তে ইচ্ছে হয় ৷ নীলাঞ্জনা বেশ কয়েকবার এই একটা লাইন পড়ে আর বুকের মধ্যে একটা আনন্দের ঢেউ অনুভব করে ৷ কিন্তু শরীরের মধ্যে যেন কষ্ট দিতে থাকে প্রাণতোশের শক্ত হাত ৷ নীলাঞ্জনা চিঠিটা পরম যত্নে খামে ভরে আঠা লাগিয়ে মুখটা বন্ধ করে ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে ৷

 ম্যাডাম বারাসাতে যাবে শুনেই বিহ্বল রনোজয়ের মন খুশিতে ভরে ওঠে ৷ গাড়ির ঠান্ডা এসি আর অ্যাম্বিপিওরের স্নিগ্ধ বাতাসটা যেন একটা স্নেহময় ভালবাসা এনে দেয় ওর মনে ৷ রনোজয় ডাক্তারবাবুকে ভারি পছন্দ করে ৷ ডাক্তারবাবুর ছোট ছোট উপকারগুলো সে কোনদিনও ভুলবে না ৷ আর ভুলবে কি করে? ডাক্তারবাবু তার প্রথম সেপটিক হয়ে যাওয়া বুড়ো আঙুলটা কিভাবে ভালো করে দিয়েছিলেন ৷ মাত্র এক সপ্তাহের ওষুধে ৷

নীলাঞ্জনা মোবাইল ফোনে তোলা ছবিগুলো একের পর এক দেখতে থাকে ৷ কত পুরানো ছবি তার আর ডাক্তারবাবুর ৷ কত সব অঙ্গ-ভঙ্গি করা কত ছবি ৷ গত বছর পাঁচেকে তার প্রিয় ডাক্তারবাবুর সাথে কত ঘন্টা কথা বলেছে - প্রায় ১০ ঘন্টা সেটা আর কেউ জানুক না জানুক, এই মোবাইল ফোনটা খুব ভালো জানে ৷ কিভাবে তৈরী করেছে ডাক্তারবাবু তাকে ধাপে-ধাপে ৷ গাড়ির কাঁচ বেয়ে শহরে বৃষ্টি নামলো ঝমঝম করে ৷ আকাশও শোক পালন করছে, নীলাঞ্জনার অনুতাপে নাকি ভিজিয়ে দিতে এসেছে কত রাগ অভিমান? এক পশলা বৃষ্টিটা যেন গরম-এর সাথে সাথে ঠান্ডা করে দিল অনেক চাপা বেদনা ৷ FM রেডিওতে বাজছিল ৷ "মনে পড়লে অকারণ, কাউকে বলা বারুণ, রিম ঝিমঝিম বরষায়? তুই আজ ভেজার কারণ…" আরো কত এলোমেলো ছবি ৷ ডাক্তারবাবুর সাথে নীলাঞ্জনা একদিন ভিজেছিল ৷ নৌকা বানিয়ে জলে ছেড়ে ছিল ৷ ছপাত ছপাত জল কাদায় ডাক্তারবাবুর পাজামা গেছিল নোংরা হয়ে ৷ কিন্তু নীলাঞ্জনা কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না তার সেই দিনের কথাগুলোর জন্য ৷ তার চোখে জল আসে ৷ এই ভেবে যে ডাক্তারবাবু কত কষ্ট পেয়েছিলেন তার ওই ব্যবহারে ৷ হয়তো সেই রাতে আর খাবারও খাননি ৷ হয়তো মন খারাপ করে ঘর অন্ধকার করে সিগারেট খেয়েছিলেন দু-প্যাকেট ৷ আজ পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো, নীলাঞ্জনা মনে মনে বলে ৷ কিন্তু উনি হয়তো ওই রাগারাগির কথাই তুলবেনই না ৷

 ___ হ্যালো, বলো
 ___ কখন পৌঁছোচ্ছিস?
 ___ এই ঘন্টা খানেক লাগবে - রাস্তায় এখন ৷
 ___ বেশ আয়, তুই এলে ডিম পাস্তা করেছে, খাবো ৷ অপেক্ষা করছি ৷
___ খিদে পেয়ে যাবে তো খেয়ে নাও বাবা ৷ সুগার ফল্ট করবে ৷
___ দূর, আমার মিষ্টি মেয়েটাকে ফেলে খেতে পারি?  আয় তুই, তারপরেই খাবো ৷

গাড়ি প্রায় বারাসাতের চাঁপাডালির মোড়ে তখন, নীলাঞ্জনা গাড়ি থামিয়ে আঙুর কেনে- ডাক্তারবাবু খুব ভালোবাসেন ৷ প্রায় পনের মিনিটের মধ্যে গাড়ি পৌঁছে গেল বাড়িতে ৷

 ___ একি অবস্থা? তুমি এখনও শুয়ে? ওঠো -?
 ___ তুই তো বললি এক ঘন্টা
 ___ আমি তো তোমার দুষ্টুমি পাকড়াও করতে এসেছি ৷
 ___ আয় মা, পাশে বস একটু ৷ ইস্, ঘেমে গেছিস যে, টেবিল ফ্যানটা ঘুরিয়ে নে ৷
 ___ আরে ৷ দেখ ছেলে ব্যস্ত হয় ৷ আমি এই তো ঠিক আছি ৷
 ___ না, না বাবু তা কি হয়?
 ___ চুলগুলো দেখো? তোমার চিরুনি নেই?
 ___ একটু চুল আঁচড়ে দে না মা, দেখ কে দেখবে আমায় বল, তুই ছাড়া ৷

নীলাঞ্জনা সিঁথি কেটে চুল আঁচড়ে দেয় ডাক্তারবাবুর ৷ ডাক্তার সত্যব্রত রায় এই নামটা কোলকাতা শহরের বিশিষ্ট হাসপাতালগুলোতে খুব পরিচিত ৷ ডাক্তার পাঠ্য এবং গল্পের বই লেখেন - বেশ নাম ৷ ৬৪ বছরের এই বৃদ্ধ এক মন কারা ব্যক্তিত্ব এই সমাজের চোখে ৷ যাকে নিয়ে একদিন অনেক গবেষণা হবে ৷ Posthumous Award ও পাবেন ৷ আর সেই দিন নীলাঞ্জনা খুব গর্ব বোধ করবে ৷ হয়তো পরিচিতদের বলবে এনার জন্যই আজ আমি এখানে ৷ এখন ডাক্তারবাবু বিশাল মানুষ, সত্যিকারের অসাধারণ ৷ আর নীলাঞ্জনা তাঁর বিশেষ আবদারের চেলি ৷ গত পাঁচ বছর ধরে ডাক্তারবাবু ওকে তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন, আজ মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দিনটা যেদিন ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, যাহ্ - তোর দ্বারা কিছু হবে না, আমি আকাঙ্খায় পাগল ছেলেমেয়েকে কিছু শেখাই না ৷ ভালো লেখক হওয়ার আগে ভালো মানুষ হতে হয় ৷ নীলাঞ্জনা মনে মনে বলেছিল তাই তো নিজের কিছু হয়নি এত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেওে ৷

___ কৈ কী বলবি বললি? হঠাৎ সত্যব্রত রায়ের কথায় সম্বিত ফিরে পায় নীলাঞ্জনা ৷ নীলাঞ্জনা খামটা ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রাখে ৷ বলে, দেখো, তোমার জন্য সেই জার্মান মহিলা প্রেমপত্র পাঠিয়েছে ৷ ডাক্তারবাবু একটু বিচলিত না হয়ে বলে উঠলেন, তুই আর সেই জার্মান সব পাগল, ভাগ্যিস আমি পাগলের ডাক্তার নই; নয়তো সব এসে জুটে আমাকে পাগল করতো ৷
 ___ প্লিজ, এটা জরুরি, খুব জরুরি স্যাটস প্লিজ পড়ো, নীলাঞ্জনা আদর করে সত্যব্রতকে স্যাটস্ বলে ডাকে ৷
___ কি হাতে লুকিয়েছিস তুই? থামটা নিয়ে ডাক্তারবাবু একটু নেড়ে চেড়ে খুলতে গিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করেন নীলাঞ্জনাকে, হ্যাঁরে পাগলী সেদিন খুব রাগ করেছিলি না? আমি কিন্তু তোকে দুঃখ দিতে চাইনি ৷ দেখছিলাম, আমার পাগলীটার যদি কোথাও কষ্ট হয়, দুঃখ পায়, তাই-
___ একই ভাবে আমিও তো তোমার দুঃখ দিয়েছিলাম?
___ না, না, ও কিছু না ৷ আগে বল এইটা কি?
 ___ না বলবো না, তুমি খুলে পড়বে, তোমার জন্য, তোমার জন্য আবার ফেবিস্টিকি দিয়ে বন্ধ করে এনেছি ৷
___ বেশ বাবা, যা ও ঘর থেকে চশমাটা নিয়ে আয় _ এই ডাক্তারবাবুর কাছে নীলাঞ্জনার এখন গম্ভীর বানিজিক একুশ শতকের কর্মরতা নারী নয় ৷ সে খিলখিল করে হাসে চোখ পিটপিট করে ৷ সালোয়ারের পা উঁচু করে প্লাসটিকের চেয়ারে হাঁটু উঁচু করে বসে ৷ আহ্লাদে ডাক্তারবাবুর কাছে ছোট্ট বেড়াল ছানার মত বসে ৷ ডাক্তারবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে উপভোগ করে চোখ বুঁজে ৷ দস্যি মেয়ের মতো ওঘর থেকে চশমা আনতে যায় এক ছুট্টে ৷

___ স্যাটস্, পরো দেখি, এই নাও চশমা
___ দে দে দেখি কি আছে এই খামে ৷

খামের ভিতর চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা - প্রিয় লেখক নীলাঞ্জনা সেন৷ আপনার লেখা "25 spans of hallucination" বইটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ নভেল বলে বুকার্স প্রাইজ প্রদান করা হবে ৷ আপনার উপস্থিত কামনা করি ৷

___ কি বুঝলে স্যাটস্?

 ডাক্তারবাবু কথা বললেন না, এই প্রথম নীলাঞ্জনা ডাক্তারবাবুর চোখে জল দেখে ৷ কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলে স্যাটস্, তোমার মেন্টারিং সার্থক করতে পেরেছি তো? এতে নীলাঞ্জনার চোখেও জল আসে - খুশিতে, দুঃখে, আহ্লাদে ৷ ডাক্তারবাবুকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে, তুমি নির্ঘাত আগের জন্মে আমার বাবা ছিলে ৷ ডাক্তারবাবু তখনও মৌন ৷ ডিম পাস্তা, চৈত্রের এই অপরাহ্ন; এক তলার এই সাদা মাটা ঘর, ডাক্তারবাবুকে বিশ্বাস করতে দেয় না ৷ ভাবেন, পাগলীটা ঠিক করে দেখালো শেষ পর্যন্ত ৷ কত কেঁদেছে, কত বকাবকি করেছি, কত কষ্ট পেয়েছে ৷ আজ ও করে দেখালো ৷ ছলছল চোখ মৃদ্যু হেসে বলেন, কি নিবি আজ বল!

___ কিছু নাবলে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, মাথা ঠেকাতে যায় ডাক্তারবাবুর পায়৷
 ___ এমা কি করছিস পাগলী?
___ আজ একটা প্রণাম করি? স্যাটস্, তুমি না থাকলে আমি কিচ্ছু না ৷
___ দুর পাগলী, আমি তো রাস্তা দেখিয়েছি, তুই নিজেই তো হেঁটেছিস ৷
___ তুমি না থাকলে, আমি কিছু পারবো না, তুমি আমার পাশে থেকো ৷
___ ওরে আমার বোকা মেয়ে, আমি তো আছি ৷

'I তো has'. এটা ডাক্তারবাবুর পাগলীকে খুশি করার নিজস্ব ভাষা ৷ এই কথাটায় নীলাঞ্জনা খিলখিল করে হেসে উঠে ৷ ডাক্তারবাবু জানেন, ঠিক সময় কথাটা বলে নীলাঞ্জনার মুড বদলে দেন ৷ ডাক্তারবাবু জানেন, এই মেয়েটাকে উনি যেভাবে ভালোবাসেন সেভাবে কোন মানুষকে বাসেননি আগে ৷ মেয়েটা এলেই হাওয়ায় যেন একটা আগাম খুশির খবর দেয় ৷ বলতে চায়, আজ তোমার দোষ গুণ, সব মাপ - ছেলেমানুষের মত নীলাঞ্জনাকে আবদার করেন খাইয়ে দে, চুল আঁচড়ে দে, খুনশুটি করে বলেন তোর সাথে পাঁচু ভ্যানওয়ালার বিয়ে দেবো, তারপর রোজ বিকেলে ভ্যানে চেপে বেড়াতে বেরবো ৷ ডাক্তারবাবুর ভ্যান চড়তে ভারি ভালো লাগে ৷ কুল আর আঙুর খেতে খুব ভালো লাগে ৷ গঙ্গার হাওয়া খেতেও ইচ্ছে করে ৷ ডাক্তারবাবুর সব কথাই রাখে নীলাঞ্জনা - উনি যা বলেন সব অক্ষরে অক্ষরে পালনও করেন ৷ নিজের ছেলেমেয়েরাও এত বাধ্য হয় না ৷ বুড়ো বাবাকে ফেলে রেখে পালায় আমেরিকা ৷ কিন্তু এই পাগলীটাকে যতোই বকো তবুও কাছে আসে, পাশে বসে - নিজের মনে কত গল্প করে ৷ সেইসব গল্পে অর্ধেকও ডাক্তারবাবু শোনেন না ৷ তবুও মোহিত হয়ে যায় এই বাচ্চাটার কোমল নিস্পাপ মনটাকে দেখে৷

___ চল
___কোথায়?
___ আজ একটু বেড়াতে যাই ৷
___ বেড়াতে বের হলে ফেরবার নাম করবে না ৷
 ___ আচ্ছা আচ্ছা বেশ, তুই যা বলবি তাই হবে ৷
 ___ বিনিতাদি কতদিনের ছুটি নিয়েছে?
___ দুদিন
___ ঠিক আছে ৷ চলো তবে, এই দুদিন তুমি আমার বাড়িতে থাকবে - বল থাকবে ও স্যাটস্?
___ আচ্ছা নে, চল ৷
___ চলো, ভালো পায়জামা - পাঞ্জাবীটা বের করে দি? ডাক্তারবাবু নীলাঞ্জনার অম্লান মুখশ্রী দেখে অনুভব করেন একটা মেয়ে তার পাতানো বাবাকে কতটা ভালোবাসে ৷ তার কর্তৃত্ব, তার আবদার, তার তিলে তিলে বেড়ে ওঠা - জীবনে উত্থান-পতন ৷ নিজের মনেই হেসে ফেলেন ডাক্তারবাবু ৷
 ___ যা পাগলী, যেটা তোর পছন্দ সেটা এনে দে ৷
___ আচ্ছা
 ___ আর শোন, আলমারিটায় কাজের কিছু কাগজ আছে, ওইগুলো দেখে, চাবি নিয়ে নেমে আয় ৷
 ___ আচ্ছা, আচ্ছা ৷ ডাক্তারবাবুর মেয়েটার জন্য চিন্তা হয় ৷ এত ভালবাসা ওর লেখালিখির ওপর - নামী লেখিকা হবে একদিন ডাক্তারবাবু জানতেন ৷ তবে ওনার জীবদশায় হল এটা ভেবেই খুব ভালো লাগে ৷ কিছু ভুল না করে, পেরিয়ে চলেছে একা রাস্তা ধরে ৷ যে রাস্তাটা ভীষণ কঠিন ৷

রনোজয় গাড়িতে বসায় ডাক্তারবাবুকে ৷ সন্ধ্যে তখন ছটা পাঁচ ৷
 ___ চল না আজ একটু গঙ্গার ধার থেকে ঘুরে আসি ৷
___ চলো ৷ রনোজয়, ঘাট হয়ে যাবো - দক্ষিণেশ্বর বা যে কোন ঘাট --- ৷
___ আচ্ছা ম্যাডাম, রনোজয় উত্তর দেয় ৷

বিকেলের এক পশলা বৃষ্টি কিন্তু বেশ স্যাঁত স্যাঁতে করে দিয়েছে চার পাশ ৷ রাস্তার ধারের চায়ের দোকার, মনে করিয়ে দেয় সেই র-চা খাওয়াটা, স্যাটস্ তখন চা-বুড়ো ছিল৷ সবই এখনও একই আছে, শুধু বদলে গেছে সময় ৷ ডাক্তারবাবুর হাত ধরে বসে নীলাঞ্জনা, ঠিক যেমন ছেলেবেলায় বাবাকে ধরে বসতো ৷ ট্রাফিক কম থাকায় তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল বাড়ি ৷ বাঁধানো পারে নীলাঞ্জনার হাত ধরে ডাক্তারবাবু একদৃষ্টে চেয়ে রইলেড় ওপরের টিপটিপ আলোগুলোর দিকে ৷

 ___ পাগলী ওপরের আলোগুলো দেখছিস?
___ হ্যাঁ, কি সুন্দর বিন্দু বিন্দু ৷ তাই না?
___ জানবি খ্যাতিও ঠিক এই আলোগুলোর মতো ৷
___ সেটা কি রকম?
___ যতক্ষণ আলো জ্বলছে, ততক্ষণই সুন্দর, নিভে গেলে অস্তিত্বই নেই ৷
 ___ আমায় খ্যাতি ধরে রাখার কথা বলছো তো?
___ তুই আরো নাম করবি দেখিসগঙ্গার হাওয়া, এই স্নিগ্ধ সন্ধ্যা নীলাঞ্জনার মনে পরে বাবার কথা - আমার মেয়েটা একদিন খুব নাম করবে ৷ আজ যদি বাবা থাকত ৷ বাবার এই না থাকাটাই বোধহয় ওকে ডাক্তারবাবুর এত কাছের মানুষ করে দিয়েছে৷
___তুই কোনদিন তোর স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় মিস বা স্যারকে বাড়ির জামাকাপড়ে দেখেছিলি?
___ না তো ৷
___ তোর মনে তাদের নাম বললে কি রকম ছবি মনে পড়ে?
___ ওই শাড়ি পরা মিস, সার্ট-প্যান্ট পড়া স্যার ৷
___ সন্মানটা কিন্তু এরকমই, যতদিন ঢাকা, অদুরের হয় ততদিনই সুন্দরএই জিনিসটা সাথে একেবারেই বনিবনা করবি না ৷
___জানি বাবা, চলতো ওই বেঞ্চিতে গিয়ে বসি
___ না শোন, জরুরি কথাটা ৷ আবরণে ঢেকে একটু দূরে দূরে থাকবি ৷ যেদিন নামের জন্য অন্যায়ের সিঁড়ির ধাপ পেরবি, সেদিন দেখিস আমি ঠিক মরে যাবো ৷
___ ধ্যুত তোমার শুধু বাজে বাজে কথা ৷ চলো তো ৷

 উত্তরের হাওয়াগুলো চুল ওড়ায়, জল পাড়ের সিঁড়িতে ছলাত ছলাত শব্দ করে ৷ ডাক্তারবাবু শক্ত করে ধরে নীলাঞ্জনার হাতটা - যেন বার্ধক্যের লাঠি ৷ ঘন্টা দেড়েক পর ঘাট থেকে ফেরে তিনজনেই - ডাক্তারবাবু, নীলাঞ্জনা আর ড্রাইভার রনোজয় ৷ সবারই চোখে ঝিমঝিম ঘুম আসে গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ায় ৷ এইবার বাড়ি ফেরার পালা ৷ পাঁচ বছরে প্রথম ডাক্তারবাবু না করেননি নীলাঞ্জনার পাঁচতলার ফ্ল্যাটে থাকতে ৷ একবার ও বলেননি, কি জানি অত্যে উঁচুতে উঠতে পারবো কিনা - দেখিস, আবার সোজা ওপরে না উঠে যাই ৷ গাড়ি এখন বিটি রোড ধরে চলল ৷ স্যাটস্-এর কাঁধে মাথা দিয়ে নীলাঞ্জনার ঝিমুনি আসছিল ৷ পি!পি!পি!পি!পি!

 ___ম্যাডাম উঠুন এসে গেছি ৷ কাতর আচ্ছন্নতা ৷ নীলাঞ্জনা এবার ধড়মড় করে উঠে বসে ৷ এপাস ওপাস তাকায় স্যাটস্ নেই তো ৷
 ___ ম্যাডাম ডাক্তারবাবুর বাড়ি পৌঁছে গেছি ৷ নামবেন না ৷
___ মানে? এখানে?
___ আমরা হো-চি-মিং সরণীতে গেছিলাম ৷ সেখান থেকে সোজা এখানে এলাম, ভুলে গেলেন নাকি?

নীলাঞ্জনা সম্বিত ফেরে - তবে কি সে স্বপ্ন দেখছিল?সেই চেনা গাড়ি, ড্রাইভার রনোজয়, হাতের খাম, বাইরে বৃষ্টির এক পশলা - শুধু স্যাটস্ নেই ৷ নীলাঞ্জনা নেমে পড়ে গাড়ি থেকে ৷ টাকি রোডের এই দিকটায় গাড়ি ঘোরানো যায় না, রনোজয় গাড়ি ঘুরিয়ে আনবে এক-দুই মিনিটে ৷ ভিতরে ঢুকতেই এক বিশাল জমায়েত ৷ বেশ ভীড় হৈ-চৈ হচ্ছে - দুজন বলা বলি করছে কেউ না থাকলে এইভাবেই শেষ হয় ৷ ভীড় চিঁরে নীলাঞ্জনা হাতে খামটা নিয়ে যতই এগোয় ডাক্তারবাবুর বাড়ির দিকে ততই ভীড় বাড়ে ৷ মনে মনে ভাবে, এই রকম ভীড় কেন? চুরি ডাকাতি হল নাকি? গেটের ভিতরেও ভীড় মানুষের দল - তবে কি?

___ কি হয়েছে দিদি? জিঞ্জেস করে নীলাঞ্জনা এক মহিলাকে ৷
 ___ ডাক্তার রায়বলেই কান্নায় ভেঙে পরে, আমার ছেলেটাকে কিভাবে বাঁচিয়ে ছিলেন, আজআবার কান্না ৷ ভয়ে নীলাঞ্জনার বুক ধরাস করে ওঠে - তাড়াতাড়ি করে ঘরে ঢোকে ৷ ডাক্তারবাবু বিছানায় শুয়ে! ঘুমাচ্ছেন! স্টেথো গলায় আর এক ডাক্তারবাবু যেন কি সব ঘসঘস করে লিখে চলেছে ৷ নীলাঞ্জনা বলে, কি ওষুধ আনতে হবে? বলুন, আমি এনে দিচ্ছি ৷ লেখালিখিতে ব্যস্ত ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করেন, কি বাড়ির লোক?
 ___ আঞ্জে হ্যাঁ ৷
___ আর ওষুধ আনতে হবে না, উনি আর নেই ৷

 নীলাঞ্জনা বিষফারিত নেত্রে ধপ্ করে পরে মাটিতে ৷ হাতের খামটাও পড়ে যায় ৷ কান্না বানের জলের মতো বেড়িয়ে আসতে চায় - কিন্তু বেরোয় না - বোধির মৌন মুহুর্ত ৷ এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু ৷ মনে পড়ে যায় যে আজ আর কেউ নেই নীলাঞ্জনার একমাত্র মা ছাড়া ৷ আজ থেকে ওকে আর কেউ বলবে না চুল আঁচড়ে দিতে, তেল মাখিয়ে দিতে ৷ উবু হয়ে বসে, হাত বাড়িয়ে দিলে বলবে না কেউ টান তো আমায়৷ সিগারেট খেতে খেতে কেউ বলবে না, ইস্ সরি, ধোঁয়া লাগবে তোর, ওঘরে যা ৷ কেউ বলবে না দাঁড়ি কামিয়ে দেকেউ বলবে না এইবারে চড় মারবকান্না আর চাপতে না পেরে ছুটে পালিয়ে যায় নীলাঞ্জনা ওঘরে ৷ আজ হাউ হাউ করে কাঁদলেও এই বাড়িটা আর তার প্রাণ ফিরে পাবে না ৷ সকাল থেকে রাত অবধি এখানে ঠায় বসে থাকতে ইচ্ছে করবে না ৷ নীলাঞ্জনার মনে পরে সেই সন্ধ্যেগুলো, যখন দেরি হচ্ছে বলে বকুনি খেতে হত তাকে ৷ প্রায় তাড়িয়ে না দিলে ওর ইচ্ছে করতো না বুড়োটাকে ছেড়ে যেতে ৷

___ ম্যাডাম বাইরে ডাকছে ৷ নীলাঞ্জনা বাইরে বেড়িয়ে আসে ৷
 ___ দেখুন, উনি মারা গেছেন 3:15 to 3:20 নাগাদ ৷ দাহ করতে বেশি দেরি করবেন না ৷ অতর্কিতে ধকাস করে ওঠে নীলাঞ্জনার বুকটা ৷ 3:15 to 3:20 নাগাদ তো নীলাঞ্জনা প্রাণতোশবাবুর কেবিনে ছিল - তখনই তো একটা ফোন আসেব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে তাড়াতাড়ি, কল লিস্ট চেক করতে চোখে পড়ে, স্যাটস্ই ফোন করেছিল ৷

 ___ 3:15 থেকে 3:20 নাগাদ সময়টা

___ বুকার্স-প্রাণতোশের লোমশ কালো হাত - আধখোলা ব্রা - 3:15 থেকে 3:20 মৃত্যু না খুন নীলাঞ্জনা?


https://ssl.gstatic.com/ui/v1/icons/mail/images/cleardot.gif








Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.