নবনীতাদি বলতে পারবেন
( ধারাবাহিক )
একটা মৃত্যুর পেছন পেছন হেঁটে এসেছি আমি। নাকি সাঁতরে এসেছি? নবনীতাদি একবার বলেছিলেন তার প্রথম বাচ্চা হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা। কয়েক কোটি বছরের ইভোলিউশন যেন দশ মাসের মধ্যে ঘটে গেল তার শরীরের মধ্যে। শুনে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল আমার। আমিও তো একসময় মায়ের পেটের অথৈ জলের মধ্যে একটা ছোট্ট অ্যামিবার মতোই ছিলাম। আর এখন আমার ছেষট্টি কেজি ওজন!
মা দু’বার প্রি-ইউনিভার্সিটি পরীক্ষায় বসবে বলে ফর্ম ফিল-আপ করেছিল। দু’বারই হল না দুই শত্তুরের জন্য। প্রথমবার দাদা। আর তার পরেরবার আমি। আমার দাদাটা বড্ড জ্বালিয়েছিল মা-কে জন্মানোর সময়। আরে একটু নাচানাচি না করলে, একটু নিখাদ ফুটবলারের মতো নিজের অস্তিত্বের জানান না দিলে লোকে বুঝবে কী করে তুই আছিস কি নেই? মা-ও বোঝেনি। ব্যথা ওঠেনি একফোঁটাও। দেখতে দেখতে ডেট পেরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে গোপালপুরের হেলথ্ সেন্টারে ভর্তি করতে হল মা-কে। মেয়েছেলের গায়ে হাত দিলে কে কী বলবে, এই অজুহাতে ডাক্তার সরে পড়লেন। এদিকে মায়ের নাভিশ্বাস উঠে যাবার জোগাড়। নার্স বলল কলকাতায় নিয়ে চলে যেতে। কিন্তু তখন আর সে উপায়ও নেই। মাথা দেখা যাচ্ছে বাচ্চার। অথচ ফরসেপ দিয়েও টেনে বের করা যাচ্ছে না। অক্সিজেন নেই। ডাক্তার হাওয়া। হেলথ্ সেন্টারে কাজ করত গোপালপুরের কেষ্ট বিশ্বাসের ছেলে গৌতম, তার সন্দেহ হল, কেউ তুকতাক করেনি তো? সে ছুটল তার জ্যেঠিমার বাড়ি। জ্যেঠিমা তুক জানত। এটা-ওটা চালাচালি করে জ্যেঠিমা বলল, গৌতমের মা, কেষ্ট বিশ্বসের বউ-ই তুক করেছে মা-কে, সাতমাসের সাধে সাতরকম ভাজাভুজির সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে। তুক কাটানোর পাল্টা তুক-ও বলে দিল সে। বুড়োশিবের থানে ধর্ণা দিয়ে পড়ল আমার দিদা। অবশেষে ১৯৭০ সালের ৯-ই জুলাই, পৃথিবীর মাটি পেল সে। কিন্তু কাঁদল না একফোঁটাও। এখনও সে কাঁদে না। খালি হাসে। বড় নরম, ঝিকমিকে সেই হাসি।
কচুপাতার মধ্যে আংটির পাথরের মতো গোল, নিটোল জলকণা যেমন আলো পড়লে একইসঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার আনন্দ আর ঝরে পড়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা নিয়ে হাসতে থাকে, এও যেন অনেকটা সেরকম। আমি রোজ সকালে তার হাসিকে আলো দিয়ে চান করাই আর এইভাবে প্রতিদিন, আমার বেড়ে ওঠার পাশাপাশি তারও বাড়বাড়ন্ত হয়, গাছের ডালপালার মতো ছড়িয়ে যায় তার হাত-পা-মাথা, বুদ্ধিবৃত্তি আর হৃদয়, যুক্তি আর আবেগ। সে যুক্তি দিয়ে আমাকে ভালবাসে। আবেগ দিয়ে মারে। বুদ্ধি দিয়ে তার পাতের বরাবরের মাছের মুড়ো থেকে একটু-আধটু ভাগ দেয় আমাকে। আর যে ছেলেরা আমার প্রেমে পড়ে অথবা আমি যে ছেলেদের প্রেমে পড়ব-পড়ব করি, তাদের সে হৃদয় দিয়ে পিটিয়ে আসে। অথচ সে দেখতে কিন্তু মোটেই ডব্লু ডব্লু এফ-এর বীরের বাচ্চাদের মতো নয়, বরং খানিকটা আমার মতোই। আমার মতোই গোলগাল, ফুল-বয়েলড ডিমের মতো মুখ, ড্যাবা-ড্যাবা চোখ, হারমোনিয়ামের পালিশের মতো গায়ের রঙ, নাকের নীচে কুটি কুচি ঘামের মতো আবছা গোঁফ। হাইট-ও কম। মোটে পাঁচ-তিন। কিন্তু এই নিয়েই তার কী গর্ব! মাটিতে যেন পা পড়ে না। মেয়েরা নাকি সর্ষের পোকার মতো ছোটে তার পেছন পেছন। আর তিনিও কম যান না। কত যে চিঠি-গোলাপফুল-ক্যাডবেরি আমি উদ্ধার করেছি ওর বেড়ে ওঠার ফাঁকফোকর থেকে, অথচ আমি যেই একঝলক তাকিয়েছি কোনও অচেনা সাইকেল-ছেলের দিকে, কী ওর বন্ধুদের সঙ্গে একটার বেশি দুটো কথা বলেছি, ব্যাস্! অমনি শুরু হয়ে গেল ওনার দাদাগিরি। হাসতে হাসতে মারে সে আমাকে, মারতে মারতে হাসে। তারপর হাতের সুখ মিটিয়ে চলে যায় যখন, অসহ্য আক্রোশে ফেটে পড়তে পড়তে আমি তাকে বলি, গেঁড়ে মদনা! চিবিয়ে চিবিয়ে বলি, ঢোলগোবিন্দ! আমার কথা তার কানেই পৌঁছোয় না। ‘গেঁড়ে মদনা’ আর ‘ঢোলগোবিন্দ’-র ল্যাজের রেশটুকু স্বরবর্ণ হয়ে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।
হাওয়া আমাদের কতদূর টেনে নেয় শেষপর্যন্ত? হাওয়ার হাতছানির পেছনে ছুটে ছুটেই কি এত বড় হয়ে গেলাম আমরা? কোথায় সে নিয়ে যেতে চায় আমাদের? কোন অদেখা, অজানা তেপান্তরের মাঠে নিয়ে গিয়ে সে প্রাণভরে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে চায় আমাদের সঙ্গে? আবার মাঝে মাঝে, রাত্তিরবেলায়, হাওয়া হঠাৎ একদম চলে যায় আমার বুক থেকে। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে, চাদর-বালিশ হয়ে, পড়ে থাকি বিছানায়। আমি ‘দাদা’ বলে ডেকে উঠতে যাই, আমার গলা দিয়ে আদিম আর কর্কশ একটা গোঙানি বেরিয়ে আসে। কী করে সে বুঝতে পারে কে জানে। ধড়মড় করে উঠে ঘরের বড় আলোটা জ্বেলে দেয় আর একটু একটু করে হাওয়া আবার ফিরে আসে আমার বুকে। তারপর সে আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় আর সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। একই ঘরে ঘুমোই আমরা তিন ভাই-বোন, পরস্পরকে পাশেবালিশ করে। আমাদের যোনি নেই, লিঙ্গ নেই, সাপের শঙ্খ-লাগার রসায়ন জানি না আমরা। শুধু জানি সেইসময় সাপের গায়ে নতুন গামছা ছুঁড়ে দিতে হয়। সাপের মিলনে, নিঃশ্বাসে, রক্তে আর বিষে কালো হয়ে যাওয়া সেই গামছা নিয়ে আমরা নাইতে যাই পুণ্যিপুকুরে, পরস্পরের গায়ের জল মুছিয়ে দিই আর দিনকে দিন কালো হয়ে যায় আমাদের শরীর। ভিজে জামা-কাপড়ের আড়ালে সাপের বাচ্চার মতো বড় হতে থাকি। নিজেদের কাছে আর সহজ হতে পারি না সেরকম। রাতে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে থাকি পাশাপাশি। ঘুমের মধ্যে ইজের অথবা জাঙিয়ার ভেতরে হাত চলে যায় আপনাআপনি। ভালো লাগে। ভয় করে। কীসের ভালোলাগা, কীসের ভয়, বুঝতে পারি না। শিউরে শিউরে উঠি।
এর মধ্যে তুতুলের জ্বর হল একদিন। মা-বাবা তুতুলকে নিয়ে শুলো ওপরের ঘরে। নীচের ঘরে আমি আর দাদা। মাঝখানে পাশবালিশ। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম, সাপের শঙ্খ-লাগার মতোই, ঘরের চাপ-বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে আমার শরীরের ওপর শুয়ে আছে আরও জমাট অন্ধকারময় একটি শরীর। থরথর করে কাঁপছে সে, পাগলের মতো মুখ ঘষছে আমার বুকে। আমি ‘দাদা’ বলে চিৎকার করে উঠতে গেলাম আবার, ছোটবেলার মতো, কিন্তু গলা দিয়ে সেই জান্তব গোঙানিটুকুও বেরলো না। তার হাত শক্ত হয়ে চেপে বসেছে আমার মুখে। হঠাৎ সে কীরকম ককিয়ে উঠল আর তারপরই শান্ত হয়ে গেল হঠাৎ। আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসল, বসেই থাকল বোবা পাথরের মতো চুপটি করে, তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল। দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগল সে, আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল, বোন আর কক্ষনো হবে না এরকম। আর আমি কাঁদতে কাঁদতে, কাঁপতে কাঁপতে, তার মুখে লাথি মেরে বললাম, মরে যাক। মরে যাক। মরে যাক। তারপর বাথরুমে, শরীর থেকে বিষ ধুয়ে ফেলতে ফেলতে আমি বললাম, ভগবান, ওকে নিয়ে নাও।
না, এরকম কোনও দিন দেখতে হয়নি আমাকে। এ হল সেই দুঃস্বপ্ন, যা আমি বারবার দেখে এসেছি আর কেঁদে উঠেছি ঘুমের মধ্যে। এ হল শিশুকাল থেকে আমার মধ্যে জন্ম নেওয়া সেই বিপন্নতা, এত বছর পরেও যা আমার পেছন ছাড়েনি। জন্মের পর, চোখ ফুটতে না ফুটতেই মরে গেছে আমার দাদা। পৃথিবীর মাটির মধ্যে মিশে গেছে তার ছোট্ট, সাড়ে তিন কেজির শরীর। আগুন-হাওয়া-জল – এরা নেয় না অতটুকু বাচ্চাকে। মাটি রাক্ষুসী। সে সব খায়। আবার লাল-নীল ডিম বমি করে যায় মাঠের মধ্যে, গরীব চাষীর ঘরে পৌঁছে দেবে বলে। কে জানে, এরকম কোনও ডিমের মধ্যে আমার দাদাও বেড়ে উঠছে কিনা। হয়তো এতদিনে কোনও চাষী-বউ বুক দিয়ে মানুষ করেছে তাকে। হয়তো সে ফিরে আসবে কোনওদিন, খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর পিঠে চড়ে। কলিংবেল বাজিয়ে বলবে, দিদি, ধূপকাঠি নেবেন? কারখানা অনেকদিন বন্ধ…
একটা মৃত্যুর পেছন পেছন হেঁটে এসেছি আমি। নাকি সাঁতরে এসেছি? কয়েক কোটি বছরের পথ কোন অলৌকিক সময়যানে দশমাসে পার হয়ে এসেছি? নবনীতাদি বলতে পারবেন।
ক্রমশঃ